অলকানন্দা - পর্ব ৩২ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!৯১!!

ওয়েন্ডিগো হলো একটি পৌরাণিক প্রাণী বা অশুভ আত্মা যা কানাডার পূর্ব উপকূলীয় বন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট সমভূমি অঞ্চল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট লেক অঞ্চল এবং কানাডা, অ্যালগনকুইয়ান-পারিবারিক ভাষার বক্তা হিসাবে আধুনিক জাতিতত্ত্বে গোষ্ঠীভুক্ত এর আশেপাশে অবস্থিত ফার্স্ট নেশনসের লোককাহিনী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ওয়েন্ডিগোকে প্রায়শই একটি নরক আত্মা বলা হয়, কখনও কখনও মানুষের মতো বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রাণী হিসাবে চিত্রিত করা হয়, যা মানুষের উপর ভর করে। ওয়েন্ডিগো অতৃপ্ত লোভ/ক্ষুধার অনুভূতি, অন্য মানুষকে নরখাদক করার উপায়, সেইসাথে এর প্রভাবে যারা পড়ে তাদের হত্যা করার প্রবণতাও আছে। এই আত্মা এক অতৃপ্ত আত্মা। যা মানুষের ভিতরে বিদ্যমান নরপশুটাকে জাগিয়ে তুলে। তাকে বিধ্বংসী করে তুলে। ওয়েন্ডিগো হায়নার চেয়েও ধারালো। কখনো নিজের শিকারকে সে ছেড়ে দেয়না। ছায়ামানব। সে ওয়েন্ডিগোর মতো ধারালো কিংবা তার চেয়েও বেশি। মাউথ অর্গান বাজানো শেষে নীল চোখের ব্যাক্তিটার সামনে এসে দাঁড়ায় ছায়ামানব। ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি। বহুদিন শিকার হত্যা না করার তৃষ্ণা। নীল চোখের মানব কাঁপা কাঁপা সুরে ব্রিটিশ এক্সেন্টে বলে,
"এবারের মতো দয়া করো। শেষ একটা চান্স দাও। আমি কখনো ঐ ভুল করবোনা। কখনো না।"
হা হা করে হেসে উঠে ছায়ামানব। শত কাকুতি মিনতি তাকে কাবু করতে পারেনা। একজন নারী ছোট ঘরটার দরজায় বারেবারে নিজের সঙ্গীর প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছেন। আটকানো দরজাটা খোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে ছায়ামানবের যে মনে দয়া নেই, মায়া নেই। সে তো ধ্বংসের রাজা। ছুরি দিয়ে ক্ষিপ্রতার সাথে গলায় একটান দেয়। গলগল করে বেয়ে পড়ছে লাল তরল। ছটফট করতে থাকে নীল চোখের মানুষটা। একটা মুরগের গলা কাঁ'ট'লে যেমন ছটফট করে ঠিক তেমন। বাইরে নারীর চিৎকার বাড়ে দ্বিগুণ হারে। একসময় থেমে যায় ভিতরের আর্তনাদ। সে সাথে থেমে যায় বাইরের আর্তনাদ। বহুদিনের অভস্ত্য হাতে ধারালো ছু'রি চলে ব্রিটিশ মানবের দেহে। বহু আকাঙ্ক্ষিত কাজটা করতে পেরে সাময়িক স্বস্তি পায় ছায়ামানব। অতঃপর.... স্বাদ গ্রহণ করে ভিন্ন কিছুর। 

কেটে গিয়েছে একটা মাস। মাহা এখন অনেকটাই সুস্থ। গুলশানের ফ্ল্যাটে গড়েছে নিজ সংসার। ঘরের প্রতিটা কোণায় কোণায় তার বিচরণ। ল্যাব ঘরটা এখন আর নেই। সেখানে ঠাঁই পেয়েছে কতগুলো খাঁচা। খাঁচায় বন্দী হরেকরকম বিদেশি পাখি। লং টেল প্যারাডাইস, সালফার ক্রেস্টেড ককাটেল, মং প্যারাকিট,ওয়াক্সউইং, ইনকা টার্ন, ইডার, জাভা, চ্যাটারিং লরি, পার্লে কুনুর আরো কত পাখি! একজোড়া লাভ বার্ডও রয়েছে। কি যে সুন্দর দেখতে! নিভার আচরণে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। চুপচাপ থাকে। কালো রঙের জামা পরে সবসময়। মাহার সাথেও বেশি একটা কথা বলেনা। উদাস তার ভঙ্গি। মাহা হাসপাতাল থেকে ফিরে শুনেছে রবার্ট নাকি কিছুদিনের জন্য ইংল্যান্ডে গিয়েছে। হয়তো তাই নিভার মন খারাপ থাকে। মাহা প্রথম কয়েকদিন চেষ্টা করেছিলো নিভার সাথে হাসিখুশি কথা বলতে। তবে নিভা যেন কোনো পাথর। বাইরে ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছে। মাহা নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে। দৃষ্টি বাইরে বৃষ্টির দিকে। হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। মাহা চিনে এই স্পর্শ। তার একান্ত প্রিয় মানুষটার স্পর্শ। মাহার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে তাতে চুমুক দিলো সার্থক। 
"কি করছেন? আমার এঁটো তো।"
"হুম।"
"কি হুম? রাখেন এটা। আমি কফি করে এনে দিচ্ছি।"
"মিষ্টতা কোথায় পাবো আমি?"
"চিনি দিবো তো।"

সার্থক মুচকি হেসে মাহাকে নিজের দিকে ফিরালো। নাকটা আলতো করে টেনে দিয়ে বললো,
"তুমি বড্ড অবুঝ মাহা।"
মাহা জানেনা কেন! তবে এই লোকটাকে তার পৃথিবীর সবচেয়ে আপন একজন মনে হয়। একান্ত নিজের। মাহা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক কে। দুয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখ বেয়ে। সার্থক মাহার অগোছালো চুলে ভালোবাসার পরশ দিলো। 
"আমাকে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যাবেন?"
"প্রশ্ন নয় আদেশ করবে রাণী।"
মনের উদাসীনতার মাঝেও যেন হাসি পায় মাহার। লোকটা এমন কেন! 
"কালকে নিয়ে যাবেন?"
"দেখি হসপিটালে যোগাযোগ করে। ছুটি পেলে নিয়ে যাবো।"
"আচ্ছা।"
নিস্তব্ধতা। বাইরে এক পশলা বৃষ্টি। সার্থকের বুকে মাথা দিয়ে আছে মাহা। এত শান্তি কেন এই বুকটায়! 

!!৯২!!

চাকরি থেকে রেজওয়ানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আজ একটামাস যাবত রেজওয়ান ঘরে বসে। অন্ধকারে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। এত এত তিরস্কার সত্যিই আর নিতে পারছেনা রেজওয়ান। বেলা চারটা ত্রিশ। প্রতিদিনের মতো কলিং বেল বেজে উঠলো। সাবিনা বেগম দরজা খুলে দিলেন। তিনি জানেন কে আসবে। প্রতিদিনের মতো আজো এশা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। 
"আসো ভিতরে আসো।"
সোফায় এসে বসে দুজনে। হাতের ব্যাগটার দিকে নজর যায় সাবিনা বেগমের। গত পনেরোটা দিন যাবত এই মেয়েটা কিছু না কিছু রান্না করে নিয়ে আসছে রেজওয়ানের জন্য। প্রথম যেদিন খিচুড়ি আর কালা ভুনা করে নিয়ে এসেছিলো সাবিনা বেগম হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "কার জন্য?"। এশা মাথা নিচু করে আস্তে করে বলেছিলো,"আপনার ছেলের জন্য।" মেয়েটা কষ্ট পাবে বলে সাবিনা বেগম বলেন না। রেজওয়ান তো এসব খাবার মুখেও তুলেনা। এশা খাবার নিয়ে আসে এত আশা নিয়ে। সাবিনা বেগম যেন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারেন না। শ্যামবতী মেয়েটার মুখে ভিষণ মায়া। 
"আন্টি, আমি আজ আপনার জন্য আর আপনার ছেলের জন্য একটু হাঁসের মাংস, চালের রুটি করে নিয়ে এসেছি। খেয়ে বলুন না আন্টি কেমন হয়েছে।"
 বলতে বলতেই বাটিগুলো মেলে সাবিনার সামনে তুলে ধরলো এশা। খুব সুন্দর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। সাবিনা বেগম রুটি ছিঁড়ে হাঁসের মাংস তার ভিতরে পুরে মুখে দিলেন। এক কথায় অসাধারণ স্বাদ। ঝাল হাঁসের মাংস আর রুটি এত মজা! তিনি আগে কত খেয়েছেন এমন কখনো খান নি। পুরো তিনটে রুটি, অর্ধেক বাটি হাঁসের মাংস খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন সাবিনা। তিনি একটু ভোজনরসিক বটে। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,
 "তুমি তো চমৎকার রান্না করো মেয়ে।"

এশা একটু লজ্জা পেলো যেন। হবু শাশুড়ীর প্রশংসা প্রত্যেক হবুবউয়েরই ভালোলাগে। হায় হায়! কিসের হবুবউ আর কিসের শাশুড়ী! বোকা পুলিশ তো কিছুই বুঝেনা। আর এখন তো বিরহে দিন পাড় করছেন তিনি। 
"আপনার ছেলের ভালোলাগবে তো আন্টি?"
"তুমিই না হয় ওর ঘরে গিয়ে খাবারটা দিয়ে এসো।"
"আমি?"
"হুম, রেজওয়ানের খাবারটা দিয়ে আসো তো মা। আমি একটু পাশের বাসায় যাবো।"

সাবিনা চাচ্ছেন এশাকে সুযোগ দিতে। তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। এশা একটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে রেজওয়ানের দরজার সামনে দাঁড়ালো। নক করবে কি করবেনা! বুকটা ধুকপুক করছে তার। কতদিন বোকা পুলিশটাকে দেখা হয়না! দরজায় নক করেই ফেললো এশা। ভিতর থেকে গম্ভীর কন্ঠ,
"মা, বিরক্ত করো নাতো।"
প্রিয় কন্ঠ! কতদিন বাদে শুনলো এশা। বুকটা এখনো অশান্ত। 
"আমি, আমি এশা।"
"কি চাই?"
"আপনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলাম।"
"খাবোনা এখন। তুমি যাও।"
"প্লিজ, একটু খান। আমি অনেক কষ্ট করে আপনার জন্য হাঁসের মাংস আর চালের রুটি করে নিয়ে এসেছি। আপনার অনেক পছন্দের না?"
"বিরক্ত করো নাতো।"
"এমন করছেন কেন? একটু খেলে কি হয়?"
এশা নাছোড়বান্দা। আজ একনজর লোকটাকে দেখতে তার মনটা ছটফট করছে। কি করে বুঝাবে সে। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো রেজওয়ান। বিধ্বস্ত দশা। এলোমেলো চুল, পরনে একটা নীল টি-শার্ট আর শর্টস। এশা একধ্যানে তাকিয়ে আছে। তার মনে অবাধ্য সব ইচ্ছে জাগছে। রেজওয়ান ধমকে উঠলো, 
"এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার?"
"ইয়ে মানে"
"থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবো বেয়াদব মেয়ে। প্রতিদিন কি নাটক শুরু করেছো তুমি? আমার যা একটু সম্মান অবশিষ্ট আছে তাও ধূলোয় মিশিয়ে দিতে চাইছো?"
"না মানে..
"একদম চুপ। কি ভেবেছো আমি কিছু বুঝিনা? আর মা তোমাকে বাড়িতে জায়গা দেয় কেন! প্রতিদিন খাবার রান্না করে নিয়ে আসছো। আশেপাশের মানুষ দেখছেনা। আমার সম্মান শেষ করে কি মজা পাচ্ছো তুমি?"
"আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।"
"আমি ভুল বুঝছি। আমি? আর এসব কেন আনো আমার জন্য!"
কথাটা বলেই এশার হাতে থাকা খাবারের প্লেটটা নিচে ফেলে দিলো রেজওয়ান। 
"কাজটা আপনি ঠিক করেন নি মিঃ রেজওয়ান।"
ছলছল চোখে কথাটা বলে দৌড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো এশা। সাবিনা সিঁড়িতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, "এই মেয়ে কি হয়েছে তোমার?"
জবাব না দিয়েই দৌড়ে পালায় এশা। রেজওয়ান ঠাস করে নিজের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণ আগে প্রলয় চ্যাটার্জি ফোন করেছিলেন। কিছু কটু কথা শুনিয়েছিলেন। সেই রাগ এশার উপর দেখালো রেজওয়ান। 
!!৯৩!!

কতক্ষণ যাবত এক নাগাড়ে কলিং বেল বেজেই চলেছে। মেরি দরজা খুলে দিলো। সামনে একজন বিদেশি লোক দাঁড়িয়ে। মেরিকে দেখে কুশল বিনিময় করলো লোকটা। ব্রিটিশ এক্সেন্টে বললো,
"কেমন আছো মেরি?"
"ভালো, আলবার্ট। প্লিজ আপনি ভিতরে আসুন।"

আলবার্ট সোফায় এসে বসলো। মুইংচিনও এসে বসেছে পাশে। বহুদিনের পরিচয় তাদের। মুইংচিনের চেহারাটা মলিন। আলবার্ট সোফায় হেলান দিয়ে মেরিকে বললো,
"এক কাপ কফি পেলে মন্দ হয়না মেরি। সাথে বিশেষ... 
"ডক্টর স্যারের নিষেধ আছে।"
"ওকে, তাহলে কফিই নিয়ে আসো।"

কথাটা বলে মুইংচিনের দিকে তাকালো আলবার্ট। 
"কি মুইংচিন উদাস কেন?"
"কেন টুমি জানোনা?"
"উফ্, তোমার এই ভাঙা ভাঙা বাংলা বেশ শোনায় কিন্তু মুইংচিন।"
"মজা করোনা আলবার্ট।"
"সরি, সরি।"

দুহাত উপরে তুলে বললো আলবার্ট। নিভা কালো একপোশাক জড়িয়েছে সারা গাঁয়। ঘর থেকে বেশি একটা বাইরে বের হয়না সে। আলবার্টের কন্ঠস্বর শুনে হলরুমের সোফার কাছটায় এসে দাঁড়ালো নিভা।
"কেমন আছো নিভা?"
"খুব ভালো। পৃথিবীর সমস্ত সুখের ঊর্ধ্বে আছি আমি।"
"এই তুমি কি রাগ করলে?"
"না তো। তোমাদেরই তো সময়। আমরা তো জলে ভেসে আসছি।"
"আহা, রাগ করছো কেন? আমি কি তা বলেছি?"

মেরির মুখে আলবার্টের আসার খবর শুনে খানিকটা চিন্তিত হলো সার্থক। আচ্ছা, সে কি একটু শান্তি পাবেনা! দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত মাহার মুখপানে চাইলো সার্থক। কি নিষ্পাপ! কি পবিত্র! নিয়তি কেন এমন অদ্ভুত খেলায় নেমেছে? সার্থক তো বেশ ছিলো নিজের ছন্নছাড়া জীবনে। এখন যে সার্থকের বাঁচতে ইচ্ছে জাগে। একটু ভালো থাকার ইচ্ছে জাগে। সুন্দর একটা সংসার গঠনের ইচ্ছে জাগে। ফ্রেশ হয়ে এসে বেডরুমের দরজাটা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে নিচের দিকে পা বাড়ালো সার্থক।
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন