প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল - পর্ব ৩৮ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে আছে হয়তো। দ্রিমদ্রিম শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে। আকাশ ফেটে বৃষ্টি নামেছে। রাস্তাঘাট ভিজিয়ে দিয়েছে৷ প্রকৃতি উচ্ছ্বসিত! জানালার কাঁচে বৃষ্টির রেখা। অরু ধ্যান মেরে তাকিয়ে থাকতে চাইল। বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরছে। সে আর তন্ময় একই গাড়িতে। আনোয়ার সাহেব তাদের আলাদা যেতে দিয়েছেন মুলত। অবশ্য মোস্তফা সাহেব অমত করেছেন। তবে কে শোনে কার কথা! অরু আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক আবারো তাকাল। গতকাল রাত থেকে তন্ময়ের বলা কিছু শব্দ তার হৃদয়ে তীরের ন্যায় চুবেছে। এইযে 
 রাতে তাকে গভীর গম্ভীর স্বরে 'জান' বলে ডাকল। তখন সে দুনিয়া ভুলে গেল। ভুলে গেল চারপাশ। এতটুকু জীবনে কখনো এভাবে ডাকতে শোনেনি তন্ময়কে সে। কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করেনি তন্ময় এভাবে বলতে পারে! এইযে এখনো তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে সেই রাতের ঘটনা ভাবতেই। তারপর আজ যেভাবে মায়ের থেকে তাকে রক্ষ করলো। তারপর স্ত্রী বলে রুখে দাঁড়ালো। অরুর তখন মনে হলো, বাবার পড়ে তন্ময় তার দেয়াল। তাকে রক্ষা করার দেয়াল। তার ভালোমন্দ বুঝে নেবার মানুষ! স্বামী স্ত্রীর এই বন্ধন খুব ভালোভাবে অরুকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হুট করে তন্ময়ের ফোন বেজে উঠল। তন্ময় কল রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিয়েছে। ওপাশ থেকে হাস্যজ্বল পুরুষালি কন্ঠের স্বর ভেসে এলো, 'দোস্ত! যা শুনলাম সত্যি নাকি!'
'কি শুনেছিস!'
'ভাব কম নে মাম্মা! অবশেষে আমাদের মতো মিঙ্গেল হয়েই গেলি। আচ্ছা হঠাৎ বিয়ের কারণ কী? কীরে ভুল হয়ে গেছে নাকি তোর দ্বারা? আমি নিশ্চিত বিজনেস ট্যুরে গিয়ে ফ্রুটস খেতে হাত বাড়িয়ে ছিলি। বেসামাল হয়ে গেছিলি। তোকে আমি হাড়েহাড়ে চিনি ব্যাটা! হে হে! দোস্ত... '
'অরু পাশে।লাউডস্পিকার দেওয়া। আম ড্রাইভিং।'

মাহিনের অনর্গল কথা বন্ধ হয়ে গেল। পরপর কল কেটে গেল। অরু লজ্জায় হতভম্ব। সে দু'হাতে মুখ ঢেকে অন্যপাশে ফিরে গেল। ছি! 
_____________
অরু ঠিক জানে, তাদের এই বিয়ে এতো সহজে মেনে নেওয়া হবেনা। তখন রাগের বসে হয়তো মেনে নিয়েছে। নিশ্চিত বড়সড় ঝড় অপেক্ষা করছে বাড়িতে। বাড়িতে পা রাখতেই, আসল রূপ বেরোবে সকলের। হয়তো মা আরেকটি চড় বসাবেন গালে। চাচ্চু গম্ভীরমুখে অরুকে ডাকবেন সামনে। বকাঝকা করে অরুকে বান্দরবন পাঠিয়ে দিবেন। নয়তো বা বড়ো মা অভিমানী স্বরে কথা শোনাবেন। চাচী খুব করে রেগে হয়তো বলবেন, 'এই কাজ কীভাবে করলি বলত অরু? আমাদের কথা একবার ভাবলি না। তোকে দিয়ে এটা একদম আশা করিনি।' তখন অরু জবাব দিতে পারবেনা। কেঁদে ভাসিয়ে দিবে শাহজাহান বাড়ি। অবশ্য এখনই তার হাতপা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এই ভয় নিয়ে তো থাকতে পারছেনা। ভয়ে সাড়া শরীর কেঁপে উঠছে খানিক্ষন পরপর। এই পরিস্থিতি হাওয়া হয়ে গেলে কেমন হয়? ভ্যানিস হয়ে যাক! অরু এই থমথমে সিচুয়েশন আর নিতে পারছেনা। সকলের গম্ভীরমুখ সহ্য করতে পারছেনা। সবাই কেমন করে তাকে শুধু দেখেছে। কথা বলছে না, আদর করে ডাকছে না। কেন! অরু কি এমন করে ফেললো! 

পাঁচ ঘন্টার জার্নি করে রাত চারটায় গাড়ি বাড়ির সামনে পৌঁছেছে। অরু আসামির ন্যায়ে মাথা নত করে বেরিয়ে এলো। বাড়িতে প্রবেশ করে এক কোণে দাঁড়িয়ে পড়লো। আঁড়চোখে তন্ময়কেও দেখে নিল। তন্ময় সোফায় বসেছে। তার ভেতর কোনো আতঙ্ক, ভয় কিংবা জড়তার চিহ্ন নেই। অথচ অরু ভয়ে শ্বাস ফেলতে পারছে না। মাথা উঁচু করে বাবামায়ের মুখের দিক তাকাতে পারছেনা। বিশেষ করে বড়ো চাচ্চু আর বড়ো মায়ের পানে। 

একটি বিয়ে পুরো পরিবারকে অপ্রস্তুত সিচুয়েশনে ফেলে দিল। সম্পর্কের দ্বিতীয় প্যাঁচ বেরোলো। এতো বছরের সাধারণ মধুর সম্পর্কের মধ্যে, ভিন্ন স্বাদের সম্পর্ক জুড়ে গেল। যার স্বীকারোক্তি দেওয়াটা দুশ্চিন্তা এবং দ্বিধা জড়িত বিষয়।

আশ্চর্য! চোখের পলকে আনোয়ার সাহেব নিজের ভাইপোর শ্বশুর হয়ে গেলেন। সুমিতা বেগম শ্বাশুড়ি বনে গেলেন। আহাম্মক মোস্তফা সাহেব ভাতিজির শ্বশুর হয়ে গেলেন। জয়া বেগম শ্বাশুড়ি! সাধারণ সম্পর্ক গুলো মুহুর্তে অসাধারণ রূপ নিয়ে ফেলেছে। এই অসাধারণ সম্পর্কের রূপ বুঝে শাহজাহান বাড়ি গুরুজনেরা বড়োই সমস্যায় পড়ে গেলেন। এইযে, 
মোস্তফা সাহেব অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কেশে উঠেছেন। ভাইয়ের সঙ্গে আনোয়ার সাহেবও কেশে উঠলেন। ওহী সাহেব গলা খাকড়ি দিয়ে, অন্যপাশে তাকালেন। জয়া বেগম এবং সুমিতা বেগম নিঃশব্দে চাওয়াচাওয়ি করে নিলেন। পরিবেশ ভীষণ থমথমে এবং অপ্রস্তুত। মনে সকলের হাজারো কথা। কেউই আগ বাড়িয়ে কথাবার্তার শুরুটা করতে পারছেন না। দ্বিধাবোধ করছেন! অবশেষে মোস্তফা সাহেব ছেলের দিক চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। তন্ময়ের মুখ ভোঁতা হয়ে আছে। বাবার চোখ রাঙানো অগ্রাহ্য করে বলল,'এভাবে বসে থাকব? কিছু বললে বলো! আমি রুমে যাবো।'

ছেলের কথায় মোস্তফা সাহেবের দ্বিধাবোধ পুরোদমে কেঁটে গেল। গর্জিয়ে উঠলেন রাগী স্বরে, 'এতবড় তান্ডব করে আবার গলা বাড়িয়ে কথা বলছ! লজ্জা করছে না তোমার! এই মুখ আমার সামনে এনেছ কীভাবে? ওয়াদা ভঙ্গ করেছ তুমি ! ছিঃ! তুমি আমার ছেলে তা তো আমি ভাবতেই পারছিনা। আমি যে কিনা কখনো কথার খেলাপ করিনি জীবনে, সেই আমার ছেলে তুমি হলে কী করে!'
'এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।'

ওহী সাহেব এক গ্লাস পানি খেতে নিয়ে বিষম খেলেন। গলায় পানি আটকে লাগাতার কেশে দম আটকে ফেললেন। বুকে এলোপাতাড়ি থাপড়ালেন। মোস্তফা সাহেব স্টোক করে বসবেন! তিনি ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছেন না। বুকে হাত চেপে কম্পিত আঙুল ছেলের পানে তুললেন। ভেঙে ভেঙে কিছু বলতে গিয়েও পারলেন না। অন্যথায়, তন্ময় আসলে কথাটি বলতে চায়নি। মুখে চলে এসেছে হুট করে। বলে অবশ্য বেশ হালকা অনুভব করছে। বাবার অবস্থা দেখে তার রাজ্যের ঘুম ভ্যানিস হয়ে গেল। খুব আরাম করে সোফায় কাতচিৎ হয়ে বসলো। যার যা অভিযোগ শুনবে যেমন। 

ওহী সাহেব শান্ত হয়েছেন। খুব মোলায়েম সুরে কথা শুরু করলেন, 'কিছু হয়েছিল? এভাবে হুট করে...কী কারণ?'

তন্ময় দূরে কাঠকাঠ হয়ে দাঁড়ানো অরুকে দেখে নিল। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলল, 'কি হবে! কিছু হয়নি। কোনো কারণ নেই! বিয়ে করতে ইচ্ছে হলো করে নিলাম।'

ওহী সাহেব কথা এগোনোর ভাষা হারিয়ে ফেললেন। অন্য বাড়ির মেয়ে বিয়ে করলে নাহয় মানা যেতো। নিজের বাড়ির ছেলে নিজের বাড়ির মেয়ে বিষয় করেছে! এখানে কি বলবেন বা করবেন বুঝতেই পারছেন না। মোস্তফা সাহেব কিছুটা শান্ত হয়েছেন। তিনি আঙুল তুলে বললেন, 'তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। এই বাড়িতে তোমার কোনো স্থান নেই।'
'ঠিকাছে।'

তন্ময় উঠে দাঁড়ালো। উচ্চস্বরে বলল,'এই অরু ব্যাগ গুঁছিয়ে নে৷'

মোস্তফা সাহেব চোখ বড়সড় করে দাঁড়িয়ে গেলেন। চেঁচিয়ে বললেন, 'ও ব্যাগ গোছাবে কেন!'
'আমার বউ আমার সাথে যাবেনা?'

মোস্তফা সাহেব বুকে হাত চেপে সোফায় বসে পড়লেন। চোখ বন্ধ করে ওহী সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,'আল্লাহ গো! এই অসভ্য ছেলেকে আমার সামনে থেকে যেতে বলো। এক্ষুনি!'

তন্ময় চলে যেতে পা বাড়ালো। মোস্তফা সাহেব দম নেবার অবস্থায় নেই। তবুও ছেলেকে শুনিয়ে আবারো বললেন, 'এটা কোনো বিয়ে হলো! এই বিয়ে মানা যায়না! অরুর রুমের ট্রান্সফার করা হোক। আজ থেকে অরু নিচের রুমে থাকবে। জয়া ব্যবস্থা করো! আর তুমি..অসভ্য ছেলে! একশো হাত দূরে থাকবে ওর থেকে।'

বাবা ছেলের মধ্যে এই কীসের যুদ্ধ চলছে, কেউই বুঝে পেল না। উপস্থিত সবাই অসহায় চোখে দেখে গেল। তন্ময় তোয়াক্কা করলো না বাবার কথার। সে উপরে চলে গেল। অরুকে এসে শাবিহা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দীপ্ত চুপচাপ পিছু পিছু গেল তাদের। বুকের ভেতর গুরুমগুরুম করছে। আনন্দে চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। চেঁচিয়ে বাড়িঘর মাতিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না ভয়ে। সবাই গম্ভীরমুখে আছে। নিশ্চয়ই দীপ্তর ব্যাক পিঠের মধ্যস্থান থাপড়ে লাল করে দিবে। ভীতু দীপ্ত বাপ-চাচাদের আড়ালে এসে নেচে উঠলো। তার দীর্ঘ লাফানো'তে ঝাকড়া চুলগুলো দুলছে। যেন তারাও খুশিতে নাচছে। 

'বিয়েটা হয়ে গেল?'
'হু।'
'সত্যি? আমার কথা শোনার মতো মানুষ তো ভাই নয়। ও বিয়েটা সত্যি করে নিলো! হুয়াই? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিছু কী হয়েছে?'

শাবিহার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে অরু থমকে গেল। থমথমে গলায় বলল,'কি হবে!'
'কিছু একটা কারণ আছে! নাহলে আমার ভাই কথা নড়চড় করার মানুষ নয়। বাবাকে কথা দিয়ে সে নিজেই ভাঙবে এমনটা হতেই পারেনা। কুছ তো গারবার হে দীপ্ত, কুছ ত!'

দীপ্তর চোখমুখে রাজ্যের ঘুম। সে হৈ-হুল্লোড় করে শাবিহার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে। শাবিহাও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে শুয়ে পড়লো। অরু শুধু বসে রইলো। ফজরের আজান দিচ্ছে। তার ঘুম আসছে না। আনমনে তাকিয়ে ভাবতে বসলো। হঠাৎ করে জীবনের মোড় ঘুরে গেল অদ্ভুত ভাবে। ভাবতেই বড্ড অবাক লাগে সে এখন বিবাহিত। তার পছন্দের মানুষ, তার কাছের মানুষ, যাকে একসময় ভাইয়া বলে পিছু ঘুরে বেড়াতো, সে তার স্বামী। ওই অসাধারণ মানুষটা অরুর! ভাবনায় আসতেই খুব ভালো লাগছে। বুকে একরাশ অনুভূতি ঘুরঘুর করছে। পেট মুচড়ে উঠছে ভেতর থেকে। তবে যতই ভালো লাগা কাজ করুক না কেন! অরু একটু ক্ষিপ্ত তন্ময়ের উপর!
___________
সুমিতা বেগম হাঁসফাঁস করছেন। আনোয়ার সাহেব শুধালেন, 'কি হয়েছে?'
'এই বিয়েটা..মানে ভাইয়া খুব করে বলেছিল! এটা কি হয়ে গেল!'

আনোয়ার সাহেব স্মিথ হাসলেন। স্ত্রীকে ইশারা করলেন পাশে আসতে। সুমিতা বেগম আসলেন। আনোয়ার সাহেবের পাশে বসলেন। আনোয়ার সাহেব মোলায়েম সুরে বললেন,'আমাদের একটি মাত্র সন্তান। ধরো, মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দিলাম। চলে গেল শ্বশুরবাড়ি। চোখের সামনে থেকে বহুদূর। মাসে একবার হয়তো বছরে একবার দেখতে পাব। আমাদেরই বা কে দেখবে তখন? এইযে রাতে হুট করে মেয়েটা চলে আসে! কীভাবে যেন বুঝতে পারে আমার মাথা ব্যথা! বলবে, বাবা মাথাটা একটু মালিশ করে দেই? বাবা তোমার বুকে কী আবারো যন্ত্রণা করছে! সেবার তোমার ভীষণ জ্বর হলো! আমি সহ ভাইয়া তুফানের কারণে আটকে। বাড়িতে কেউ নেই! সবাই ফিল্ম দেখতে বেরিয়েছে। মেয়েটা একাই তোমাকে দেখবার জন্য বাড়িতে থেকে গেল। সেবাযত্ন করলো। হঠাৎ করে তোমার অবস্থা খারাপ। দিশেহারা মেয়েটা আমার সেই তুফানের মধ্যে ছুটে বেরিয়েছে পাশের ক্লিনিকের ডাক্তার ডাকতে! কী সাংঘাতিক তোমার অবস্থা হয়ে ছিলো। চিন্তায় মেয়েটা দুদিন তোমার সাথেই ছিল। সেবাযত্ন করলো। একপা নড়ল না তোমার চারিপাশ থেকে। সেই আমাদের আদুরে মেয়েটা চলে যাবার পর আমাদের কী হতো? এভাবে কেই বা দৌড়ে আসত। মাথা ব্যথায় পড়ে থাকলেও কেউ মালিশ করে দিবে বলে দৌড়ে আসত না! কিন্তু দেখ, আল্লাহতালার কী অশেষ রহমত৷ পরের বাড়িতে যাবার জন্য জন্ম নেওয়া মেয়েটা সারাজীবন বাবার বাড়িতেই থাকবে। পাশে। কাছে। দৈনন্দিনের মতো একসাথেই থাকব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেয়েটা চোখের সামনে থাকবে। এটা কী আনন্দের বিষয় নয় সুমিতা? আবার দেখ, তন্ময়কে ছেলের চোখে দেখে আসলাম। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ছেলে। কোনো কমতি বা খারাপ দিক নেই তার মাঝে। সেই ছেলে আমার একমাত্র মেয়ের জামাই হয়ে গেল৷ আমাদের মেয়ে জামাই। সম্পর্ক দুটো। হয়তো এই সম্পর্ক শক্ত করে রাখতে পরিশ্রম করতে হবে৷ আগের থেকে এখন আরও বেশি কেয়ারফুল হতে হবে। তবে দিনশেষে আপন সম্পর্ক গুলো চারিপাশে রয়ে গেল না?'

সুমিতা বেগম কেঁদে উঠলেন। ভেঙে পড়লেন স্বামীর বুকে। খুব করে কাঁদলেন। কাঁদতে দিলেন তাকে আনোয়ার সাহেব। একসময় শান্ত হলেন সুমিতা বেগম। খুব ধীর স্বরে বললেন, 'আমাকে একদিন বলেছিলেন, আপনি সেই দিনের অপেক্ষায় যেদিন আমি নিজেকে আপনাকে সবকিছু খুলে বলব। আমি আজ বলতে চাই৷ আপনি শুনবেন?'

 আনোয়ার সাহেব স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, 'শুনব।'
'ছোট থেকেই অবহেলিত ছিলাম। বাবামা সবসময় ভাইয়াদের এগিয়ে রাখতেন। ভাইয়ারা সর্বদাই আমাকে অপছন্দ করতেন। আমি সবসময় তাদের ভালোবাসা পাবার জন্য কাতর হয়ে থাকতাম। তারা আমাকে ভালোভাবে দেখতেনই না। আমার বন্ধুবান্ধবদের ভাইয়া গুলোকে দেখতাম। কতো সুন্দর ব্যবহার তাদের। খুনসুটি, আদর তাদের চারিপাশে লেপ্টে। সেগুলো দেখে কেঁদে ভাসাতাম। স্বপ্ন দেখতাম আমার ভাইয়া, আমার বাবাও এভাবে আমার মাথায় আদূরে ভাবে হাত রাখবে। মন খুলে কথা বলবে। আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে! কিন্তু স্বপ্নগুলো স্বপ্ন রয়ে গেল। আপনার সাথে বিয়ে হলো। এই পরিবার, পরিবারের মানুষ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। যেখানে আমি বড়ো হয়েছি সেখান থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন পরিবেশ ভিন্ন ব্যবহার পেলাম। প্রথম এসে ভেবেছিলাম এখানে হয়তো নাটক চলছে। তাই সবাই এমন ভালো ব্যবহার করছে। দিন যেতে থাকলো আমার ভুল ধারণা ভাঙলো। এই পরিবারের মানুষ গুলো আসলেই সত্যিকারের। খেয়াল করলাম বিয়ের পর ভাইয়াদের ব্যবহারের পরিবর্তন এলো। আমাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করলো। আমার যে কি আনন্দ হলো, আপনাকে বোঝাতে পারবো না। অনাকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন গুলো চোখের সামনে পূরণ হতে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়লাম। ভাইয়েরা যা বলত করার চেষ্টা করলাম। টাকা দিতে বলত, দিতাম। অফিসের সম্পর্কে জানতে চাইত জানাতাম। সত্যিটা চোখের সামনে থাকতেও তা অগ্রাহ্য করলাম। তাদের ভালোবাসা পাবার জন্য অন্ধ হয়ে গেলাম। মেয়েটাকেও তাদের বাড়িতে পাঠানোর জন্য একপায়ে রাজি ছিলাম। আমি ভালো মা নই। ভালো স্ত্রী নই। আমি.. '

অঝোরে কাঁদতে থাকা সুমিতা বেগমকে জড়িয়ে বুকে নিলেন আনোয়ার সাহেব। স্বান্তনা সরূপ কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। তিনি হেসে বললেন, 'আমার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে।'
'মাফ করবেন আমাকে?'
'তুমি অন্যায় করোনি সুমিতা। আমি তোমাকে অন্যায় করতে দেইনি। ঠিক এভাবে আগলে রেখেছি। মরার আগ পর্যন্ত আগলে রাখবো। তুমি শুধু পাশে থেক।'
__________
বিয়ের বিষয়টি যেমন ঘটেই নেই। সকলেই নর্মাল। কোনো রিয়েকশন নেই। সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে সবাইকে আগের মতো পেলো অরু। ব্রেকফাস্টে খেতে বসে সে ভয়েভয়ে মায়ের দিক তাকাল। সুমিতা বেগম গম্ভীরমুখে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিলেন নিত্যদিনের মতো। অরু একটানে খেয়ে নিল সেটা। ভয়ে নাকমুখ ও কুঁচকায়নি আজ। পরপর তন্ময় এসে পাশে চেয়ার টেনে বসলো। তৈরি হয়ে এসেছে জনাব। খেয়ে অফিস যাবে বোধহয়। অরু চোরাচোখে তাকেও দেখে নিল। আশ্চর্য! সবাই নর্মাল শুধু অরু বাদে। কেন! সবাই কী ভুলে গেল তাদের বিয়ের কথা? কালই ত বিয়ে করলো তারা। অরু বিবাহিত! ব্যাচেলর নয় আর। এতবড় সত্য কেউই গ্রাহ্য করছে না আর! সবাই কী এই বিয়েটা ভুলে যেতে চাইছে? তন্ময় ও? ভয়ে অরুর বুক কেঁপে উঠলো! 
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন