!!৯৬!!
মাহার দুইমাস চলছে। এক অদ্ভুত জগতে বিচরণ চলছে মাহার। দেহের ভিতর বেড়ে উঠছে ছোট আরেক দেহ। মানবদেহ! সার্থক একটা পাগল! এখন থেকেই কত যত্ন তার। মাহা আজ বহুদিন বাদে রেজওয়ান আর রেজওয়ানের মায়ের সাথে কথা বলেছে। এটা সত্যি সার্থকের পর যদি আপন কেউ হয় তবে তারাই। রেজওয়ান এখনো বিয়ে করেনি। সাবিনা কত করে বুঝান। বয়স তো নেহাৎই কম হয়নি। ত্রিশ পেরিয়েছে সেই কবে। সাবিনা বৃদ্ধ মানুষ কয়দিনই বা বাঁচবেন। ছেলেকে এত করে বুঝান তিনি। ছেলে নাছোড়বান্দা। তাই মাহার শরণাপন্ন হয়েছেন। এখন মাহা যদি একটু বুঝাতে পারে। রেজওয়ানের সাথে কথা বলা শেষে লাইব্রেরিতে বসে একটা বই পড়ছে মাহা। সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটা। এই নিয়ে কতবার পড়েছে মাহা জানেনা। প্রতিবারেই মাহা মুগ্ধ হয়ে বইটি পড়ে।
"দুধের গ্লাসটা যেমন রেখে এসেছিলাম ঠিক তেমনই আছে। খাওনি কেন তুমি?"
বলতে বলতেই মাহার মুখের সামনে দুধের গ্লাসখানা তুলে ধরে সার্থক। মাহা চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে মুহুর্তেই। এই খাদ্য না না খাদ্য না এই অখাদ্যটা মাহার কোনোকালেই পছন্দ নয়। সার্থক কে সে শত বুঝিয়েও পারেনা। জোর করে ফল আর দুধের অত্যাচার চলে তার উপর। গুণে গুণে সকাল, বিকেল, রাতে।
"এভাবে কপাল কুঁচকে থাকলে হবেনা। হা করো।"
"দুধ মজা না।"
"তা কি মজা? চকলেট আর ফুচকা?"
"দেখুন খবরদার আমার প্রিয় খাবার নিয়ে ঠাট্টা করবেন না।"
"হুম, বুঝলাম। এখন ভদ্র মানুষের মতো হা করো তো মাহা।"
অগত্যা দুধটুকু গিলতেই হলো মাহাকে। এই লোক তাকে না খাইয়ে এক চুলও নড়বেনা সে জানে। কে বলবে সে মাস্টার্স কমপ্লিট করা এক মেয়ে! একেবারে বাচ্চাদের মতো সার্থক মাহাকে আগলে রাখে। বাইরের মাহা খুব শক্ত হলেও এই মানুষটার সামনেই তার যত আবদার, দুষ্টুমি। মাঝেমাঝে নিজেকে ন্যাকা ন্যাকা মনে হয়। আয়নার ওপাশে প্রতিবিম্বটা চিৎকার করে বলে,
"ইস্! ন্যাকামি দেখো এর।"
মাহাও ভেঙচি কেটে বলে, "আমার ন্যাকামির লোক আছে দেখেই করি।" ভাবতে ভাবতেই নিজেকে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় পেলো মাহা। সার্থক কোলে উঠিয়ে নিয়েছে তাকে।
"উফ্! কি করছেন! বই পড়ছিলাম তো।"
"রাত অনেক হয়েছে, বউ। কালকে পড়ো আবার।"
"হুটহাট কোলে তুলে নেওয়াটা আপনার একটা বদভ্যাস বুঝলেন মিঃ।"
বলেই সার্থকের নাকে আলতো নিজের নাকটা ঘষে দিলো মাহা। সার্থক মাহার ঠোঁটে এক উত্তপ্ত চুমু খেয়ে বললো,
"যা চড়ার এখনই চড়ে নেও বউ। কয়েকমাস বাদে আর পারবেনা। আমার মা টা তখন আমার কোলে থাকবে। তখন তো মেয়েকে নামিয়ে নিজেই চড়ে বসে থাকতে চাইবে।"
সার্থকের উত্তপ্ত ভালোবাসা আর এহেনতর কথায় মাহা অবাক না হয়ে পারেনা। বেহায়া লোক! ঠোঁট টা তার ছিঁড়েই ফেলেছে বোধহয়। আহারে!
"রাখেন তো আপনার কথাবার্তা। আপনি জানলেন কি করে মেয়ে হবে? আমার তো ছেলে চাই।"
"উঁহু, মেয়ে চাই।"
মাহা মোচড়ামুচড়ি করছে। যার অর্থ সে আর থাকবেনা সার্থকের কোলে। সার্থক আত্মসমর্পণের সুরে বললো,
"ঠিক আছে, ঠিক আছে। সময় হলেই দেখা যাবে।"
"হুম, আল্লাহ যা দেন।"
!!৯৭!!
"এই মাহা, চলো বাড়ির সামনে সুইমিংপুলটার দিকে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি। তোমারও ভালোলাগবে।"
মাহার পায়ে পানি নেমেছে। হাঁটতে কষ্ট হয় ভিষণ। নিভার হাসি মাখা কন্ঠে বলা কথায় মাহা প্রতুত্তর করলো,
"আপু, হাঁটতে কষ্ট হয়। উনিও বাসার বাইরে বের হতে মানা করেছেন।"
"ভাইয়ার কথা ছাড়োতো তুমি। এই সময়ে একটু হাঁটাহাঁটি না করলে চলে? ভাইয়া তোমাকে সারাদিন ঘরে বন্দি করে রাখে।"
"এভাবে বলোনা আপু। উনি বেবিকে নিয়ে একটু বেশিই পজিসিব।"
"একটু হাঁটাহাঁটি তো করাই যায়।"
নিভার জোরাজোরিতে গুলশানের বহুতল ভবনের সামনে সদ্য নির্মিত সুবিশাল সুইমিং পুলটার সামনে হাঁটতে বের হয়েছে মাহা। শরৎকাল চলছে। বিকেলের আবহাওয়া বড়ই স্নিগ্ধ। আকাশে ভাসমান পেঁজা পেঁজা তুলোর ন্যায় মেঘ। মাহা কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেই একটা আমগাছের তলায় রাখা বেঞ্চে বসলো। মৃদু বাতাসে মাহার কোঁকড়া চুলগুলো দুলছে। মাথায় অবশ্য উড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া। পিঠে মেলে রেখেছে চুলগুলো। নিভা দাঁড়িয়ে আছে সুইমিংপুলের পাশে। হঠাৎ এমিলিন কোথা থেকে পাশে এসে দাঁড়ালো মাহার। পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এমিলিন আজো মাহার নিকট এক বৃহৎ রহস্য।
"এই মেয়ে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে?"
এত বছরে এই প্রথম এমিলিনের কন্ঠ শুনে অবাক মাহা। মায়াবী চোখদুটো বড় বড় করে মেলে দেয় এমিলিনের পানে। এমিলিন এসে বসে মাহার পাশে।
"আমাকে কিছু বলেছেন?"
"আশেপাশে আর কি কেউ আছে?"
"না, এত বছরে কখনো আপনি আমার সাথে কথা বলেন নি।"
"আজ বলবো। অনেক কথা বলার আছে তোমায়।"
মাহা চিন্তায় পড়লো খানিকটা। কি এমন বলবেন এমিলিন?
"আমি সার্থকের ছোট খালামনি। কানাডায় আমরা তিনবোন স্বামী, সংসার নিয়ে বেশ ভালোই ছিলাম। সার্থকের মা অর্থাৎ আমার বড়আপা সাজি খুবই ভালো একজন মানুষ ছিলেন। বড়পার বিয়ের কয়েকমাস বাদেই আমাদের বাবা-মা মারা যায়। বড়পা তখন ফারহান ভাইয়ার সাথে কানাডায়। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর মুহূর্তেই যেন এতিম হয়ে গেলাম আমরা তিনবোন। আমার বাবা-মা পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন। আত্মীয় বলতে আমাদের তেমন কেউই ছিলোনা। বড়পা আমাদের কানাডা নিয়ে গেলেন। আমাদের নিজের কাছে রেখে বিয়ে দিলেন ভালো জায়গায়। মায়ের আসনটা যেন বড়পাকে কবেই দিয়ে দিয়েছিলাম আমি। মেঝো বু এর মেয়ে নিভা। আমারও একটা ছেলে ছিলো। সার্থকের চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। ভালোই ছিলাম আমরা। হঠাৎ করেই সব এলোমেলো হয়ে গেলো। ঘুরতে যাওয়ার পথে প্লেন দুর্ঘটনায় হারিয়ে গেলেন বড়পা, ফারহান ভাই। দশবছরের সার্থকেরও কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। কানাডার জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিলো তারা। প্রায় একমাস বাদে উদ্ধার হলো সার্থক। তবে বড়পা আর ফারহান ভাইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমার স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেলেন হঠাৎ। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম মেঝো বুর বাসায় আমি, আমার ছেলে ইফতি, সার্থক সবাই মিলে থাকবো। ছোটবেলার হাসিখুশি সার্থক কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন একটা অন্ধকার ঘরে নিজেকে আটকে রাখে। রাত হলে চিৎকার করে। বহু ডাক্তার দেখিয়েও এর কোনো বিহিত করা যায়নি। পরে হঠাৎ করেই যেন সব স্বাভাবিক হয়ে গেলো। সার্থক একদম নিরব হয়ে গেলো। মাঝেমাঝে কোথায় যেন হারিয়ে যেতো সে। কানাডায় ডাক্তারি পড়া শুরু করলো একসময়। আমার মেঝ বুয়ের সাথে তার স্বামীর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো। এডওয়ার্ড ভাই ছিলেন খাঁটি কানাডিয়ান। একাধিক নারী সঙ্গ ছিলো তার। তাই মেঝ বু তাকে ডিভোর্স দেন। ডিভোর্সের পর আকস্মিক ভাবে এডওয়ার্ড কে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুবই জটিল আর অদ্ভুত পরিস্থিতি তে সময় কাটছিলো আমাদের। সার্থক উচ্চাকাঙ্খী হয়ে উঠে। পার্টি করা, ঘুরে বেড়ানো তার নিত্যদিনের কাজ। অনেক মানুষের আসা-যাওয়া হতো আমাদের বাসায়। যদিও ছোটবেলা থেকেই সার্থক তুখোড় মেধাবী। আমার কেন জানি মনে হতো অসৎসঙ্গে মজেছে সার্থক। আমি বাঁধা দিলাম তাকে। সে আমার কোনো কথাই মানলোনা। লুবান তার অনেক ভালো একজন বন্ধু হয়ে উঠলো। সাথে নিভা, নিভার বর রবার্ট, মুইংচিনও। কিছু একটা করতো তারা। রাতের পর রাত বাড়ি ফিরতো না। এরমাঝে সার্থক ডাক্তারি পাশ করে ইন্টার্নি করছে। আমার ছেলে ইফতিও একসময় তাদের সাথে মিশতে শুরু করলো। রাতের পর রাত বাড়ি ফেরার নাম নেই। মেঝো বু হঠাৎ মারা গেলেন। তিনি অবশ্য বিছানায় পড়েছিলেন বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে। হঠাৎ করেই সার্থক বিধ্বংসী হয়ে উঠলো। তাদের একটা কোড ওয়ার্ড হলো জুস। অনেকবারই তাদের মধ্যে এটা নিয়ে কথা হতো। আমার ছেলে ইফতি একদিন গায়েব হয়ে গেলো। আমি আজো জানিনা আমার মানিক কোথায়। আমার মানিক কে যারা গায়েব করেছে তাদের ধ্বংস আমি নিজ চোখে দেখে মরতে চাই। সার্থক.....
মাহা হতভম্বের ন্যায় শুনছিলো কথাগুলো। এটা ঠিক সার্থকের অতীত নিয়ে মাহা কিছু জানেনা। সার্থকও কিছু জানায়নি। মাহা তো সার্থক কে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। কি সুন্দর মনের মানুষটা! তাকে ঘিরে এসব কথা শুনতে মাহার ভালোলাগছেনা। তখনই সুইমিংপুলের পাশ থেকে নিভার চিৎকার ভেসে এলো। এমিলিন হয়তো আরো কিছু বলতেন। মাহা সেসব না শুনেই সুইমিংপুলের দিকে অনেকটা দ্রুত গতিতে ছুটে এলো। নিভা সুইমিংপুলের পানিতে পড়ে গিয়েছে।
"মাহা, মাহা আমি শ্বাস নিতে পারছিনা। আমাকে বাঁচাও মাহা।"
!!৯৮!!
মাহা কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। এমিলিন দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। শত্রুর ভালোবাসার মানুষের নির্মম পরিণতি তাকে আনন্দিত করছে মনে মনে। তিনি জানেন কি হতে যাচ্ছে। মানুষজন নেই বললেই চলে। এদিকে এবেলায় কেউ আসেনা। নিভা ডুবে যাওয়া অবস্থায় হাতটা বাড়িয়ে দিলো মাহার দিকে। চিৎকার করে বললো,
"আমার হাতটা ধরো মাহা। দয়া করে ধরো।"
মাহার বোধশক্তি লোপ পেয়েছে। এভাবে চোখের সামনে একটা মানুষ কে কিভাবে ডুবতে দিবে সে! নিজের চিন্তা না করেই হাতটা বাড়িয়ে দিলো নিভার পানে। নিভা হেঁচকা টানে মাহাকে পানিতে ফেলে দিলো। মাহা সাঁতার জানেনা। বারবার চিৎকার করে বলছে,
"আমাকে কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন, আপু। আমার বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছে।"
মাহা তখন সুইমিং পুলের মাঝে ডুবন্ত অবস্থায় নিজের জীবন বাঁচাতে চাইছে। আর নিভা বাঁকা হেসে সাঁতার কেটে সুইমিংপুলের পাশে বসে মজা নিচ্ছে। সার্থক নিজেকে কি মনে করে? এবারে একবারে সার্থকের কলিজায় হাত দিয়েছে নিভা। জানে মৃত্যু অবধারিত। তবুও শত্রুর সুখ যে তার সহ্য হচ্ছিলো না। হঠাৎ করেই হিংস্র বাঘের ন্যায় ভয়ানক লাল চোখ নিয়ে সাদা এপ্রোন পরনে দৌড়ে আসলো সার্থক। নিভা সার্থক কে সত্যি এখানে আশা করেনি। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো তার। যত যাই হোক জানের মায়া আছে তার। সার্থক ততক্ষণে ঝাঁপ দিয়েছে সুইমিংপুলের পানিতে। নিস্তব্ধ মাহা ততক্ষণে হয়তো বরণ করে নিয়েছে মৃত্যুকে।
.
.
.
চলবে............................