সভ্য বুঝতে পারল না, সে কি ফিরে ইনারাকে জড়িয়ে ধরবে? নিজের দ্বিধাবোধের উপর জয় করে সে ইনারার পিঠে হাত রাখতে গেল। তখনই ইনারা উঠে দাঁড়ায়। আর সভ্য তার হাত সরিয়ে নেই। কিন্তু ইনারা সরে না। সে সভ্যের বুকে থুতনি রেখে উপরে তাকায়, "আপনি আমার প্রশংসা করেন নি কেন আজ? দেখেন আমি আজ কত সুন্দর করে সেজে এসেছি।"
"তুমি কি খেয়েছ ইনারা? আমি এলকাহোল এর গন্ধ পাচ্ছি।"
ইনারা সাথে সাথে দূরে সরে যায় সভ্যের। বাচ্চার মতো মাথা নাড়িয়ে বলে, "ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ ছিঃ! আমি মদ খাব। একদম না। আমি তো... কোক খেয়েছি। হ্যাঁ কোক। বাজে ছিলো কিন্তু আমার ভালো লেগেছে। এমন কোক আমাকে আগে দেয়নি কেন? আমি কোকাকোলা কোম্পানির উপর কেস করব। তারপর তারা আমাকে প্রতিদিন এ কোক দিয়ে যাবে। হি হি। আমার কত বুদ্ধি দেখেছেন?"
ইনারা এদিক থেকে ওদিক হয়ে দুলে দুলে কথাগুলো বলছিল। হঠাৎ করে সে পরে যেতে নিলেই সভ্য তাকে ধরে নেয়। চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে, "ঠিক আছো তুমি? আর তোমার কি জ্ঞান বুদ্ধি এতই কম যে কোক আর এলকাহোল এর পার্থক্য বুঝতে পারো না?"
ইনারা শব্দ করে হাসে। সে সভ্যের গলা জড়িয়ে বলে,
"আপনি জানেন আপনি এত্তগুলা খারাপ। বারবার আমাকে বকা দেন। বকা দেন কেন? দেখেন না আমি কত কিউট? আমাকে বকা দিতে বুক কাঁপে না আপনার। আমার মতো মিষ্টি মেয়েকে কেউ বকা দিতে পারে?"
"তাহলে তোমাকে কি করা উচিত?"
"আদর করবেন আমাকে।"
ইনারা সভ্যের হাত নিজের কোমরে রাখে। আবার বলে, "আমি আপনাকে কিসসি দিয়েছি না। এবার আপনি আমাকে কিসসি দেন দেখি।"
সভ্যে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো ইনারার দিকে, "কি!"
"কি কি কেন করছেন? আপনি না কোনো ঋণ রাখেন না। তাহলে আমি আপনাকে কিসসি দিলে আপনাকেও দিতে হবে। তাও আমার ঠোঁটে।"
সভ্য যেন আকাশ থেকে পড়ে। ইনারার কথা শুনে সে নিজেই লজ্জায় পড়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে, "ইনারা তুমি এখন হুঁশে নেই। তাই তুমি কি বলছ বুঝতে পারছ না। আসো, আমি তোমাকে তোমার বাসায় দিয়ে আসি।"
"না, আপনি আমাকে চুমু না দিলে আমি কোথাও যাব না।"
ইনারা উচ্চস্বরে বলতে শুরু করে, "আমি বাহিরে সবাইকে যেয়ে বলব আপনি কত খারাপ। আমার থেকে চুমু নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। অসভ্য!"
ইনারা আসলে যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে নিলো। চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, "ইনারা এমন করো না। আমার কথা শুনো..."
"না, ইনু কোনো কথা শুনবে না। আজ ইনু যা বলবে কেবল তাই হবে।"
বড্ড বিপদে পড়ে যায় সভ্য। বুঝতে পারে না কি করবে। এখন যদি ইনারা সকলের সামনে যে আসলেই এসব আজেবাজে কথা বলে তাহলে তো তার সাথে এই ইনারার সম্মানও যাবে। তারা তামাশার পাত্র হবে তা আলাদা কথা। না, ইনারাকে এখানে এই অবস্থায় রাখা যাবে না। সে ইনারাকে মিষ্টি গলায় বলল, "আচ্ছা চলো। প্রথমে বাসায় যাই তারপর তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।"
"সত্যি?"
"হ্যাঁ তবে পথে কোনো কথা বলতে পারবে না ওকে?"
ইনারা মাথা নাড়ায়। কিছু না বলে সভ্যের পিছিয়ে যেতে থাকে।
হলে সকল মানুষ উপস্থিত আছে বলে সভ্য ইনারাকে ব্যাকডোর দিয়ে নিয়ে যায় গ্যারেজে। সেখান থেকে গাড়িতে উঠে সভ্য বুঝতে পারে না কি করবে। এই অবস্থায় ইনারাকে তার বাসায় নিয়ে গেল সমস্যা হতে পারে। এর উপর সে ইনারার বাসার ঠিকানাটা ও জানে না। একারণে সভ্য তাকে নিজের এপার্টমেন্টে এ নিয়ে যেতে বলে ড্রাইভারকে। গ্যারেজে গাড়ি থামিয়ে ইনারাকে দরজা খুলে দিয়ে বলে, "এবার আসো।"
"না। আমি আসবো না।" মুখ ফুলিয়ে বলে ইনারা।
"কিন্তু কেন?"
ইনারা দুই হাত ধরে বলে, "আমাকে কোলে করে নিয়ে যান।"
সভ্য লজ্জিত ভাব নিয়ে ড্রাইভার এর দিকে তাকায়। সে মিটিমিটি হাসছে। সভ্য লজ্জিত হয়ে বলে, "ইনারা প্লিজ। বিল্ডিংয়ের মানুষ দেখলে কি ভাববে বলো?"
"আপনি আমার থেকে বেশি সবার কথা ভাবেন। যান আপনার সাথে কাট্টি। এই জীবনে আর কখনো আপনার সাথে কথা বলবো না।"
কথাটা মূল্যহীন। এই মুহূর্তে ইনারা তার হুঁশে নেই। কিন্তু এতটুকু কথা সভ্যের বুকে আঘাত দিলো। তার ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল ইনারা আর তার সাথে কথা বলবে না। সে এক দুই না ভেবে গাড়ির দিকে ঝুঁকে ইনারার সে নীল সায়রের মতো চোখদুটোয় চোখ মিলিয়ে বলল," এই কথাটা বলেছ ঠিকাছে কিন্তু এমন কথা আর কখনো মুখেও আনবে না।"
বলেই সে ইনারাকে কোলে তুলে নেয়। ইনারা মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। মৃদু হাসে। সভ্যের কাঁধে হাত আবদ্ধ করে মুখ রাখে তার বুকের উপর।
সভ্য ড্রাইভারকে আদেশের সুরে বলে, "গাড়ি লক করে চাবি আজকের মতোই নিজের কাছে রাখুন। কাল সকালে সময়ে আসবেন।"
এরপর লিফটে উঠে যায় সভ্য। সারারাস্তা ইনারা শান্ত থাকে। জলের মতো শান্ত। কোনো কথা বলে না। সভ্য তাকে বাসার সামনে এসে নামায়। দরজার লক খোলার জন্য। লক খুলতেই ইনারা ভেতরে ঢুকে তুফান বয়ে আনে। সে পায়ের জুতা পরেই সারাঘরে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। সভ্য অবাক হয়ে যায়। খানিকক্ষণ সময় পূর্বে যে মেয়েটা এত শান্ত ছিল তার হঠাৎ কী হলো? কিন্তু এখন ভাববার সময় নেই। ইনারার পিছনে ছুটে বেড়ায় সে। ইনারা যেন ভারী মজা পায় এসবে। সে লাফিয়ে লাফিয়ে সারা ঘর ঘুরে বেরায়। অবশেষে সে উঠে দাঁড়ায় সোফাতে। সভ্য বিরক্ত এবং হয়রান দুটোই হয়। সে বলে, "ইনারা দেখো ভালো মেয়ের মতো এসে রেস্ট নেও। আমি তোমার জন্য লেবুর শরবত বানিয়ে আনছি। একটু নেশা কাটবে তোমার। তারপর ঘুমিয়ে পরো।"
"না, আমি এখন দৌড়াব, লাফাব, খেলবো আপনার সাথে।"
"ইনারা ভালো হচ্ছে না কিন্তু। আমাকে জোর করতে বাধ্য করো না।"
"আমি শুনবো না আপনার কথা। এখন আমি খেলব।"
ইনারা ভেঙিয়ে যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে নেয়। বলে, "তুমি এভাবে মানবে না।"
আর কোলে উঠিয়ে নেয় ইনারাকে। বেডরুমে নিয়ে যেয়ে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কঠিন গলায় আদেশ করে, "আমি যা বলছি তা শুনো, ভুলেও এখান থেকে নড়বে না। আমি আসছি।"
সভ্য উঠে উঠতে নিলেই ইনারা তার শার্টের কলার ধরে তাকে নিজের দিকে টান দেয়।
সভ্য হতভম্ব, "কী করছ?"
"কি কথা ছিলো? আপনি না আমাকে আমার দেওয়া চুমু ফেরত দিবেন? জলদি দিন।আমার প্রথম চুমু আপনার কাছে রাখতে দিব না।"
সভ্যের চোখ যেয়ে আটকায় ইনারার চোখে। তার নীল আভা মাখানো চোখটা এমনিতেই কোনো গভীর মায়ার সমুদ্রের মতো দেখায়। এর উপর আজ সে আরও নীল কাজল মেখে এসেছে তার মায়ার সমুদ্রে। এই সমুদ্র না ডুবে পারে সে? সভ্য সে চোখে ডুবে এমনিতেই নিজেকে হারায়। এর উপর ইনারার কথায় তার চোখ যেয়ে আটকায় তার ঠোঁটের উপর। তার নিখুঁত ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি রঙের লিপ্সটিক মাখা। তার ঠোঁটজোড়া দেখে অন্য একরকম আকর্ষণ কাজ করে সভ্যের। সে এক ঢোক গিলে। তার চোখ আটকে থাকে সেখানেই। নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারায় সে। সে এগোয় ইনারার দিকে। তার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে তার মাঝে হারানোর পূর্বেই তার মনে পড়ে ইনারা এখন নেশায় আছে। সে নিজের হুঁশে থেকে এসব বলছে না। তাই এই কাজটা করা অন্যায় হবে। ইনারা সত্যি এমনটা চায় না, সে কেবল নেশায় এমনটা করছে।
এতটুকু কথা মাথায় আসতে উঠে দাঁড়ায় সভ্য। সে ইনারার দিকে পিঠ করে দাঁড়ায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে গভীর নিশ্বাস ফেলে সভ্য। আর বলে, "বিরক্ত করো না তো ইনারা। জেদ বন্ধ করো। তুমি রেস্ট নেও, আমি শরবত বানিয়ে আনছি।"
সে যেতে নিবে তখনই ইনারা আলতো করে তার হাত নিজের দু'হাত দিয়ে ধরে নেয়। সভ্য পিছু ফিরে। দেখে ইনারা ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কাঁদোকাঁদো গলায় বাচ্চামো সুরে বলল, "আমি সবাইকে বিরক্ত করি বলে সবাই আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়। আপনিও আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন তাই না?"
উঠে দাঁড়ায় ইনারা। আবার বলে, "আমি জেদ করে স্কুলে পিকনিক এ গিয়েছি বলে মা আমাকে সবসময়ের জন্য ছেড়ে চলে গেছে। বাবাও আমার দূরে রাখে। এই'যে... এই'যে আজ জেদ করেছি বলে আমাকে আঘাত দিয়েছে।" ইনারা তার হাত দেখিয়ে বলল।
সভ্য অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল ইনারার হাতের দিকে। তার বাবা! তার বাবা এমনটা করেছে? ইনারাকে আঘাত দিয়ে এভাবে তাকে ফেলে চলে গেছে?
ইনারা সভ্যের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে শক্ত করে ধরে বলে, "আপনি আমাকে ছেড়ে যেয়েন না। আই প্রমিজ, আমি আর জেদ করব না। আজ বাবা...বাবা বলেছে আমি অনেক খারাপ তাই সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি খুব জেদি। সবাইকে বিরক্ত করি। কিন্তু কি করব বলেন আমার ভালোবাসা পেতে ইচ্ছা করে। খালাজান, ফুফা, আইজা আপু, আনিফা আমাকে অনেক ভালোবাসে। সুরভি আর প্রিয়ও। কিন্তু কেউ তার মতো ভালোবাসা দেয় না। কেউ আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমায় না, খাইয়ে দেয় না, সারারাত জেগে আমার অহেতুক কথা শুনে না। আমার অনেক ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে। মা যাবার পর বাবা আমাকে আর ভালোবাসে না। ঘৃণা করে। অনেক ঘৃণা। আপনি ঠিক বলেছেন সে আমাকে ব্যাথা দিয়েছে, হয়তো আমাকে আর ভালোবাসেও না। আমি তা জানি। কিন্তু মানতে ইচ্ছা করে না। একথাটা ভাবলে না আমার বুকে অনেক ব্যাথা হয়। ভালো লাগে না। আমি আপনাকে এত বিরক্ত করি, আপনিও কি আমাকে ছেড়ে দূরে চলে যাবেন?"
সভ্যের বুকে কেমন ব্যাথা হলো। বুকের ভেতর যেন মুচড়ে উঠলো ইনারার হৃদয়ে এত কষ্ট জমে আছে তা কেউ তার ঠোঁটের হাসি দেখে বুঝতেই পারবে না। তার বুক কেঁপে উঠে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে ইনারার পিঠে হাত রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। ইনারার কষ্টের কিছুমাত্র অনুভব করার মতোও সাধ্য তার নেই। কিন্তু নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসার সাধ্য তার আছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
"কোথায় হারাব আমি তুমিবিহীন?
আমার সর্বাঙ্গে তোমার বসবাস।
তুমিতে আমার জীবন
তুমিতে আমার নির্বাসন
তুমি-ই শেষ ঠিকানা
তোমার প্রণয়ে আমি হলাম সর্বহারা
জানো কী, ও আমার প্রণয়ী..."
ইনারা নম্র দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্য মৃদু হাসে। সত্যিই তো এত মায়াভরা মুখ দেখে কে রাগ থাকতে পারে? কীভাবে ছেড়ে যেতে পারে সে এই মেয়েটাকে? যার প্রণয়ের মোহে বেঁধে গেছে সে। এই মোহে সারাজীবনের জন্য হারাতেও সে দ্বিধাবোধ করবে না। এই মোহে নিজেকে শেষ করতেও দ্বিধাবোধ করবে না সে।
সভ্য মৃদুস্বরে বলল, "তোমার প্রথম চুমুটা ফেরত দিচ্ছি। তবে ঠোঁটে নয়..." সভ্য ঝুঁকে ইনারার কপালে আলতো করে চুমু খেল। সভ্যের ঠোঁটের স্পর্শ পাবার সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো ইনারা। সভ্যের শার্ট শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। সভ্য তার কথাটা সম্পূর্ণ করল, "তোমায় সারাজীবন পাশে থাকার আশ্বাস দিলাম, আমার প্রিয় প্রণয়ী।"
.
.
.
চলবে................................