অলকানন্দা - পর্ব ৩১ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!৮৯!!

কিছু বুঝে উঠার আগেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে পড়ে গেলো মাহা। লাল রঙা তরলে ছেয়ে যাচ্ছে সবুজ রঙের কৃত্রিম গালিচাটা। মাহার চোখ বুজে আসছে। কেবল দেখতে পাচ্ছে কেউ একজন খুব চিৎকার করে তার দিকে ছুটে আসছে। মাহা বিরবির করে,
"সার্থক"
অতঃপর চোখ দুখানা বুজে যায় তার। সার্থক সবে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। প্রিয়তমার এহেন রূপে সার্থক ভীত, হতভম্ব। দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে অলকানন্দার বুকে। হৃৎস্পন্দন কেমন পরীক্ষা চালায়। মাথা তুলে নিজের সাথে মিলিয়ে ধরে, চিৎকার করে উঠে,
"এই প্রাণপাখি। চোখ খুলো, সোনা। চোখ খুলো অলকানন্দা।"

এত বছরের অভিজ্ঞ একজন ডাক্তার হয়েও কি ছেলেমানুষী আবদার। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে সার্থক। মস্তিষ্ক বলছে,"বোকা মানব এই মুহূর্তে নারীদেহটি হাসপাতালে না নিলে ছেড়ে চলে যাবে এই জগৎসংসার।" সার্থক চিৎকার করে দুরুক্তি করে। "না, না আমার অলকানন্দা আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা। কোথাও না।" সার্থকের গগনবিদারী চিৎকারে নিভা, এমিলিন, মেরি, মুইংচিন, রবার্ট সহ অন্যান্য সব পরিচারক, পরিচারিকা দৌড়ে আসে বিশাল হল রুমটায়। চোখ কপালে উঠে সকলের। কৃত্রিম সবুজ গালিচায় র'ক্তের স্রোত বয়েই চলেছে। সার্থক পাগলের মতো প্রলাপ বকছে। হিতাহিতজ্ঞান সত্যিই লোপ পেয়েছে তার। নিভা চিন্তাগ্রস্থের ন্যায় দৌড়ে আসে সার্থকের পানে। 
"ভাইয়া, কি হয়েছে ওর?"

সার্থক রক্তলাল চোখে তাকায় নিভার দিকে। নিভা চুপসে যায়। সংকুচিত হয়। এই চোখের মানে অজানা নয় তার। বিধ্বংসী সে নজর। নিভা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। কেউ আগাবার সাহস পায়না। সার্থক কারো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার তোয়াক্কাও করেনা। কোলে উঠিয়ে প্রাণভোমরা কে নিয়ে চলে হাসপাতালে। ও নেগেটিভ র'ক্তধারী মাহার শরীর থেকে প্রচুর র'ক্তক্ষরণ হয়েছে। সার্থক দুদণ্ড বসে থাকেনি কোথাও। পাগলের মতো র'ক্তের সন্ধান করেছে। অবশেষে ডক্টর ওয়াসিফের ছেলের দুব্যাগ র'ক্তে মাহার বিপদ কেটেছে খানিকটা। সারারাত সার্থক মাহার পাশেই বসেছিলো। ভোরের আলো ফুটছে পূর্বদিগন্তে। নাম না জানা পাখির কলকাকলি কানে ভাসছে। ছিমছাম কেবিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সার্থক সাদা বেডে পড়ে থাকা মলিন ঘুমন্ত মুখটার পানে চেয়ে আছে নির্নিমেষ। এই মেয়েটাই যে তার সব। তার হৃদয়ের একচ্ছত্র রাণী। তার মনোরাজ্যের সিংহাসনের অধিকারিণী। সার্থকের অলকানন্দা।
সার্থক ভেবেছিলো মাহা প্রেগন্যান্ট। গত কয়েকদিনের গতিবিধি নতুন অতিথি আগমনের জানান দিচ্ছিলো যেন। ভেবেছিলো প্রেগ্ন্যাসি কিট দিয়ে পরীক্ষা করতে বলবে মাহাকে। আজ হাসপাতালে এসে সে ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মাহা প্রেগন্যান্ট নয়। শরীর দুর্বল, প্রেশার লো। ডাক্তার ওয়াসিফই গতকাল মাহার অপারেশন করেছেন। মাথায় গভীর আঘাত পেয়েছে মেয়েটা। যান্ত্রিক ফোনটা বেজে উঠছে একটানা। হাসপাতালের নিস্তব্ধতা ভেদ করে যা ভিষণভাবে কানে লাগছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিসিভ করলো সার্থক। 
"ডক্টর ফায়রাজ আপনি আমার কেবিনে আসুন।"
"জ্বি, ডক্টর।"
ঘুমন্ত মাহার কপালে একটা আর্দ্র চুমু খেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সার্থক। গন্তব্য ডক্টর ওয়াসিফের কেবিন।
"আসবো?"
মাহার সিটি স্কেনটাই মনোযোগের সাথে দেখছিলেন ডক্টর ওয়াসিফ। ডক্টর ওয়াসিফ নিউরোলজি, গাইনেকোলজি দুই বিভাগেই সমান পারদর্শী। সেইসাথে ডিএফএম ডিগ্রিধারী। অসাধারণ তার মেধাশক্তি। ডাক্তারি সেক্টরে আসার পর জীবনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত তিনি ডাক্তারি পড়ায় ব্যয় করেছেন। দিন, দুনিয়া সংসার ভুলে কেবল সময় দিয়েছেন এই ডাক্তারি জগতের পিছনে। সার্থকের ডাকে সেদিকপানে তাকিয়ে ভিতরে প্রবেশের নির্দেশ দেন। 

!!৯০!!

"বসুন ডক্টর ফায়রাজ।"
"মাহার ব্রেন কন্ডিশন কেমন ডক্টর?"
"এখন কিছুটা ঠিক আছে। তবে আমি এমন কেস এর আগে কখনো দেখিনি ডক্টর ফায়রাজ। ওর ব্রেনের কিছু নার্ভস অদ্ভুত ঠেকছে আমার কাছে। তারা নিশ্চল আবার সচলও। বিষয়টা খুবই জটিল। আমার ধারণা ওর শরীরে এমন কোনো তরল পদার্থ পুশ করা হচ্ছে যার ফলে ওর নার্ভস নিশ্চল হয়ে পুনরায় সচল হয়ে উঠছে। এটা খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা ডক্টর ফায়রাজ। আপনার স্ত্রী কি বিগত কয়েকমাসের ঘটনা মনে রাখতে পারছে?"

হঠাৎই একটা কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে সার্থকের। মাথার দুপাশে শিরাগুলো দপদপ করে ফুলে উঠে। হাত মুঠো করে নিজেকে শান্ত করে সার্থক। গম্ভীর অথচ শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
"পুশ করা হচ্ছে মানে?"
"আমার ধারণা তরলটা কিছুঘন্টা পূর্বেও আপনার স্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে।"

এবারে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে সার্থকের। আসছি বলে বেরিয়ে পরে ডক্টর ওয়াসিফের কেবিন থেকে। নার্স নাজমা ফোন করলেন ডক্টর জিনিয়া তাবাসসুমকে। জিনিয়া কিছুদিনের ছুটি নিয়েছে। হাসপাতালে তার আসা হয়না গত দুদিন যাবত।
"হ্যালো, ম্যাডাম।"
"জ্বি, নাজমা আপা বলুন।"
"ম্যাডাম স্যারের ওয়াইফের অপারেশন হয়েছে গতকাল রাতে। খুবই ক্রিটিকাল সিচুয়েশন ছিল। এখনও আই.সি.ইউ তে ভর্তি।"
"কোন স্যার?"
"সার্থক স্যার"
"হোয়াট!"
বিস্মিত হলো জিনিয়া। 
"কি হয়েছে?"
"মাথা ফেটে গেছে।"
"এখন কেমন আছে?"
"কিছুটা ভালো।"
"আচ্ছা, ঠিক আছে। আজ রাখছি নাজমা আপা।"
"ওকে, ম্যাডাম।"

ফোনটা কেটে দেয় জিনিয়া। নাজমা ভেবেছিলেন হয়তো একটু বাহ্বা বা উপহার পাবেন খবর চালানের জন্য। তার কিছুই হলোনা। মনঃক্ষুণ্ন হলো নার্স নাজমার। ডক্টর জিনিয়া পরিবর্তন হয়ে গিয়েছেন। অনেকটা পরিবর্তন চোখে পড়ে। 

_____________

সারাদিনেও মাহার অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। সেই আই.সি.ইউ তে সাদা বেডটায় কতশত যন্ত্রপাতির ভিড়ে শুয়ে আছে মাহা। সার্থক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহার হলদে ফর্সা মুখমণ্ডলের দিকে। বুকটা খচখচ করছে বেদনায়। মাথায় রাগ চড়ে আছে। আজ তবে হোক একটা ধ্বংসলীলা। মাহার মুখে অজস্র চুমু খেয়ে একটা জরুরি কাজে বাইরে বেরিয়ে যায় সার্থক। 
অন্ধকার ঘর। চারদিকে কেবল দেয়াল। ছোট একটা দরজা। ঘরে ডুকতেই নাকে লাগে তীব্র গন্ধ। কি বিদঘুটে সে গন্ধ! এমন নিকষ কালো আঁধারে জ্বলে উঠে একটা টিমটিমে হলদে লাইট। নীল চোখের ফর্সা এক মানবকে বেঁধে রাখা হয়েছে। ব্যথায় আর্তনাদ করছে মানবটি। তার সামনে কাঠের চেয়ারে ঘাড় বাঁকিয়ে বসে আছে এক ছায়ামানব। গুরুগম্ভীর তার নিস্তব্ধতা, গাঁ ছমছমে তার বাঁকা হাসি। নীল চোখের মানব বারকয়েক শুকনো ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজানোর চেষ্টা চালায়। সে ব্যর্থ। জিহ্বাও যে শুকিয়ে আসছে। এই পৃথিবীর গুটিকয়েক মানুষ জানে সামনের মানুষটা ঠিক কতটা নির্মম! তার হৃদপিণ্ডখানা টেনে ছিঁড়ে বের করে নিলেও অবাক হবেনা সে। মাউথ অর্গান বাজাচ্ছে ছায়ামানব। তরতর করে ঘামছে নীল চোখের মানব। দেখা যাক কি বিধ্বংসী খেলা হয় আজ। 
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন