প্রাণদায়িনী - ফাবিয়াহ্ মমো - অনু গল্প

পড়ুন ফাবিয়াহ্ মমো'র লেখা একটি ভালোবাসার অনু গল্প প্রাণদায়িনী
প্রাণদায়িনী
প্রাণদায়িনী by ফাবিয়াহ্ মমো

সিগারেটে পরপর দুটো টান দিয়ে দাপটের স্টাইলে ধোয়া ছাড়ছে লোকটা। সিঙ্গেল সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে দাম্ভিকতার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। চোখদুটো সামনে থাকা মেয়েটার উপর স্থির রেখে মাথা-থেকে-পা পযর্ন্ত চোখ বুলাচ্ছে। মেয়েটার ঘার্মাক্ত দেহ, সুশ্রী মুখ, আতঙ্কে দিশেহারা চোখদুটো থেকে অশ্রু বর্ষণ হচ্ছে তখন। ঠোঁটের উপর বেঁধে দিয়েছে সাদা রঙের কাপড়। মুখবাঁধা মেয়েটার ডাগর-ডাগর চোখদুটো তিন ঘন্টার অশ্রান্ত অশ্রুপাতে ফুলে উঠেছে, রক্তিম হয়ে আছে পুরো মুখ। হাতদুটো নাইলনের রশি দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধেছে। হঠাৎ জাঁদরেল ধরনের এক ব্যক্তি সিগারেট টানা লোকটার কানের কাছে আসলো, গলার স্বর কিছুটা নিচু করে সর্তক কন্ঠে বললো,

- আপনার জন্য এটাকেই চুজ করেছি বস। ওরই নাম এশা। মেয়েটা প্রাইভেট পড়াতে যাচ্ছিলো, রাস্তা খালি ছিলো ওমনেই সুযোগ পেয়ে তুলেছি। ঠিক করেছি না?

'বস' সম্বোধন করা লোকটা এবার সিগারেটে জোরে একটান দিলো। ঠোঁটটা হালকা একটু ফাঁক করে ধোয়াযুক্ত নিশ্বাসগুলো ছাড়তে লাগলো। বাঁহাতটা কালো প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফোন বের করলো, ডানহাতটা ঠোঁটের কাছে এনে আঙ্গুলের ফাঁক থেকে সিগারেট গুঁজলো ঠোঁটে। জোরে টান দিয়ে ঠোঁটের কাছ থেকে ডানহাত সরাতেই পুনরায় ধোয়া ছাড়তে-ছাড়তে ফোনটা কানে ঠেকালো। কলের শব্দগুলো একবার-কি-দুবার বাজতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো, আর্দ্রমিশ্রিত কন্ঠটা কিছু বলবে তার আগেই মাঝপথে দাঁড়ি বসিয়ে দিলো। কান্নায় ঢলে পরা মেয়েটার দিকে স্থির দৃষ্টি তাক করে প্রশ্নসূচকে বললো,

- মেয়েটার নাম কি এশা? কি করে এই মেয়ে? আমিতো দেখছি কান্নায় ভালোই ঢপ দেখাতে পারে। এর ভাই যেই শক্ত মাল, সেই তুলনায় দেখি বোন পুরোই নড়বড়ে।

ওপাশ থেকে প্রচণ্ডরূপে বিষ্ময় নিয়ে 'কি বললি' সুরে চিল্লিয়ে উঠলো নারীকন্ঠটা। শব্দের তীব্রতায় বিষম খেলো শ্যূট-বুট পরা লোকটা। চাপা বিরক্তি নিয়ে কান থেকে ফোন আলগা করলো, ফোন খানিকটা দূরে নিবে তখনই অস্থির সুরে চেচিয়ে উঠলো কন্ঠটা,

- তুই কোথায় আছিস? তুই এখন কোথায় বল! তু-তুই-ই না, তুই না সমুদ্র দেখতে গেলি? তু-তু-তুই কার কথা বললি? কা-কা-কে তুলেছিস তায়েফ? ঠিক করে বল!

স্মিত হেসে ফোনটা আবার কানে ঠেকালো তায়েফ। শক্ত মুখটার উপর বাঁকা হাসির খেলা চলছে এখন। সহোদর বোনের আতঙ্কগ্রস্থ কন্ঠ শুনে প্রচুর হাসি পাচ্ছে তার, মেয়েটা সামনে না থাকলে ঠিকই হো-হো করে রুম কাঁপিয়ে হাসতো। ফোনের ওপাশ থেকে জমজ ভাইয়ের কার্যকলাপ শুনে স্তম্ভিত হয়ে আছে তায়েবা। মাথায় ঠাস করে হাত রেখে বিছানায় ধপ করে বসলো, নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় চোখদুটো বন্ধ করলো। তায়েফের মতো জঘন্য ছেলে আজ পযর্ন্ত দুটো দেখেনি! অতীতের পুরোনো ঘটনাগুলো মনে পরতেই তীব্র উৎকন্ঠায় জর্জরিত হয়ে চেঁচাতে লাগলো,

- তুই ওকে ছেড়ে দে তায়েফ। ওকে কিছু করিস না ভাই। মেয়েটা ছুটি কাটাতে বাড়ি এসেছে, কিছুদিন থেকেই চলে যাবে। ওর সাথে কিচ্ছু করার চিন্তা আনিস না লক্ষ্মী ভাই। ওকে আমার জন্য হলেও ছেড়ে দে। তুই কি আমার কথাও শুনবি না? তায়েফ রে, প্লিজ কথাটা---

টুট টুট টুট করে অনবরত শব্দ হতেই বুকটা কঠিনভাবে মোচড়ে এলো। চোখের কোটর ভীষণ বড় হয়ে চোয়াল হা হয়ে গেলো, কান থেকে ফোনটা ধপাস করে বিছানায় পরে গেলো তায়েবার। বীভৎস স্মৃতিগুলো তাজা হয়ে উঠলো ওর। দুই মিনিটের বড় ভাইটা চরিত্রের দিক থেকে জঘন্য। লেখাপড়ার সবটুকুই বিদেশের মতো পাশ্চাত্য দেশ থেকে সেরে এসেছে, সেখানকার ট্রেডিশান অনুযায়ী চলতে গিয়ে লম্পট, বেহায়া, উশৃঙ্খল, বদমেজাজী হয়েছে আরেফিন তায়েফ। দেশের মাটিতে এসেও সুস্থির থাকেনি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে-ঘুরে করে ক্লাব চষে বেড়িয়েছে। মা-হীন সংসারে বাবার সাথেই লাস ভেগাসে পাড়ি জমিয়েছিলো, আজ সহোদর বোনের উছিলায় ফের দেশে আগমন হয়েছে ওর। ছ'মাসের ছুটিতে দেশে আসতেই চর্তুথ মাসে তায়েবার আপন ননদিনীকে তুলে এনেছে ওর সাঙ্গুরা। তায়েবা নিজেও জানেনা মেয়েটার উপর কি ধরনের নির্যাতন চালাতে পারে, সেটা কি শারীরিক না মানসিক তার নূন্যতম ধারণা নেই। লোকমুখে যতদূর শুনতে পেয়েছে তার ভাই প্রতিদিনই সাদা চামড়ার মেয়েদের প্রতি দূর্বল হতো। তার ভাই কি রকমের আচরণ দেখাতে পারে, এশার সাথে কি করবে, আদৌ মেয়েটাকে স্বাভাবিক রূপে ছাড়বে কিনা.... আর ভাবতে পারলো না তায়েবা। চোখদুটো বন্ধ করে দুহাতে মাথার চুলগুলো টেনে রইলো। অস্থিরতায় দম ফেটে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে শেষ। আবারও ফোন নিয়ে তায়েফের নাম্বারের কল করলো, কোনো লাভ হলো না। রাগে-ক্ষোভে আছাড় মারলো ফোনটা, ওমনেই ফ্লোরে বারি খেয়ে চুরমার হলো সেটা। পাগলপ্রায় তায়েবা রুমের মধ্যে পায়চারী করতে থাকলো, ঘুমন্ত দেড় বছরের মেয়েটার দিকে চোখ দিতেই কেদেঁ ফেললো। সময় গড়াতে-গড়াতে আকাশের রঙ পালটে গাঢ় কালো হলো, নির্জন হয়ে গেলো চারপাশ। ব্যস্ত সড়কের হর্ণগুলো কমতে-কমতে গাড়ির চলাও হ্রাস পেয়ে গেলো, তবুও তায়েফের ফোন খোলা পেলো না। দেড় বছরের মেয়ে ফাইজাকে কোলে নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে তায়েবা, আকাশের তারাগুলো মলিন মুখে যেনো তাকেই দেখছে। স্বামীকে খবর দিয়ে তার বোনের ব্যাপারে বলবে কিনা এখনো দ্বিধায় ভুগছে। একটু আগে আফিফ বাসার ফোনে দিয়ে জানিয়েছে, রাতে ফিরতে একটু দেরি হবে, হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা প্রচুর। তায়েবা যেনো জেগে না থেকে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পরে, অপেক্ষা যেনো না করে সে। এদিকে ভীষণ অপেক্ষায় ধৈর্য্য হারাতে বসেছে তায়েবা। রাত দশটার বেশি বাজে তবুও এশার খবর নেই। মেয়েটা কি ভালো নেই? না তায়েফের বণ্য হিংস্রতার শিকার হয়েছে? ধিক্কারে বুক ফুলে উঠলো তায়েবার! মনে-মনে অকথ্য-অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করলো নিজের মায়ের পেটের ভাইকে। নয় মাস একই মাতৃগর্ভে বেড়েছে দুজন, অথচ চরিত্রের দিক দিয়ে আকাশ-পাতাল ফারাক।

সেদিন রাতে কোনো দেখাই মেললো না এশার। প্রচণ্ড অস্থিরতায় জবুথবু হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা বাড়লো তায়েবার। দ্রুত এ্যানহেলার টেনে শ্বাসকার্য সচল রাখার চেষ্টা চালালো, তবুও অসহ্য যন্ত্রনায় সমস্যা হচ্ছিলো তার। পরদিন সকালের দিকে বাসায় ফিরলো স্বামী আফিফ। এসেই বোনের ব্যাপারে জেরা শুরু করলো, বোনকে আশেপাশে দেখতে পেয়ে ভাইয়ের স্নেহ মনটা নিশপিশ করছিলো। সংসার জীবনে এই প্রথম মিথ্যা কথা বললো তায়েবা, এশার ব্যাপারটা নিয়ে ধামাচাপা দিলো, সে বান্ধুবীর বাসায় স্লিভ-ওভারের পার্টি করতে গিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে আর কোনো বাক্য উচ্চারণ করলো না আফিফ, চুপচাপ খেয়েদেয়ে রেস্ট নিয়ে পুনরায় কাজে ফিরে গিয়েছে। এদিকে দুপুরের আযানও দিলো, আছরের আযানও একই মসজিদ থেকে মুখর হলো, তখনও বাড়ির কাছে ভিড়লো না গাড়ি। ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে উদভ্রান্তের মতো আবার কল করলো, এবার ফোনটা ঢুকলো ঠিকই কিন্তু বাজতে-বাজতে বন্ধ হয়ে গেলো। নিরাশ-হতাশ-বিমূঢ় তায়েবা যখন ধৈর্য্যের সবটুকু হাল ছেড়ে দিলো তখনই কান ফাটিয়ে বাসার নিচে গাড়ি থামলো দুটো। শব্দ শুনতে দেরি সবকিছু ছেড়েছুড়ে উন্মাদের মতো নিচে দৌড়ে নামলো, সদর দরজায় ' কে? ' বলে প্রশ্ন করলোও না, তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে হাপাতে লাগলো। চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখতে পেলো তাতে আশ্চর্য হয়ে মুখে ডানহাতের তালু চেপে থমকে গেলো তায়েবা। নিজের চোখকেই যেনো বিশ্বাস করাতে পারছেনা! ক্রিম কালারের হাঁটু সমান কূর্তি পরেছিলো এশা, সঙ্গে কালো রঙের জিন্স। মাথার সবগুলো চুল একত্র করে উঁচুতে একটা ঝুটি করেছিলো, হাতে ছিলো ফ্যাশনেব্যাল অনেকগুলো ব্রেসলেট। পায়ে কালো রঙের শর্ট বুট পরা ছিলো ওর। অথচ এখন সম্পূর্ণ ভিন্নবেশে দেখতে পেয়ে কলিজা শুকিয়ে গেছে তায়েবার। গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে এশা, ব্লাউজটা মিচমিচে কালো। হাতে কোনো ব্রেসলেট তো নেই, পা'দুটো একদম খালি। এশাকে শাড়ির বেশে দেখে হতবাক তায়েবা অনেকক্ষণ পর পেছনে তাকালো, পকেটে হাত গুঁজে সৌষ্ঠব্য দেহের পুরষটাকে দেখে চিনতে ভুল করলো না। তায়েফের মুখটা শক্ত হয়ে আছে, কোনোপ্রকার হাসি নেই। এশাকে চৌকাঠায় নামিয়ে দিয়ে থেমে থাকা গাড়িটায় চড়ে বসলো তায়েফ। ততক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে রণমূর্তি দৃষ্টিতে তাকালো তায়েবা, এশার হাতটা ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। ধাম করে গাড়ির দরজা লাগাতেই একটু-একটু করে মাথা ঘুরিয়ে পিছু তাকালো একজোড়া সরল দৃষ্টি, গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই আচমকা হাতে টান খেয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে লাগলো সে। পা চালিয়ে ভেতরে যাচ্ছিলো ঠিকই, দৃষ্টি পরে রইলো গাড়িটার ভেতরে। হাতমুখ ধুইয়ে শাড়ি পালটে এশাকে নিয়ে শান্ত চিত্তে বসলো তায়েবা। খুঁটে-খুঁটে সব প্রশ্ন করতেই প্রথম প্রশ্ন দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে ধরলো,

- ওই শয়তান তোকে কিছু করেছে? তোর গায়ে হাত-টাত দিয়েছে? কোনো উঁচু-নিচু কাজ----

কথার মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে এশা বিব্রত সুরে ভাবীর হাত ধরে বললো,

- না ভাবী, আমাকে কিচ্ছু করেনি। বিশ্বাস করো, আমি ঠিক আছি।

তায়েবা তবুও স্বস্তি পেলো না। নিজের ভাই বলেই খুব তীক্ষ্ম ভাবে চেনে ওকে। এশার হাতটা ছেড়ে দিয়ে নিজেই ওর হাতদুটো মুঠোয় আগলে ধরলো, লাল হওয়া ঠোঁটটার দিকে দৃষ্টি যেতেই আচমকা গলার স্বরটা কাঠিন্য করে চিল্লালো তায়েবা,

- ওই জানোয়ারটা তোকে কি করেছে সত্যি বল!

ঠোঁটে কাপড় বেঁধে দিলে ওমন লাল হয়? লাল কেনো হয় আমি কি জানিনা? তুই আমার কাছে ওই জানোয়ারের কথা লুকাচ্ছিস?

- ওই জানোয়ারটা তোকে কি করেছে সত্যি বল! ঠোঁটে কাপড় বেঁধে দিলে ওমন লাল হয়? লাল কেনো হয় আমি কি জানিনা? তুই আমার কাছে ওই জানোয়ারের কথা লুকাচ্ছিস?

তেজালো সুরে চিল্লিয়ে উঠলো তায়েবা, দারুণ রাগ দেখিয়ে এশার হাতদুটো সজোড়ে ঝটকা মেরে ছেড়ে দিলো। এশা যে কঠিন কিছু লুকিয়ে বেড়াচ্ছে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই। মাথাটা ঠান্ডা করার চেষ্টা চালালো তায়েবা, এশার প্রতি সকল রাগ চেপে রেখে সেখান থেকে হনহন করে চলে গেলো। রুমে এসে ঘুমন্ত মেয়ের দিকে একপলক তাকালো তায়েবা, রাগে-জিদে হাতদুটো মুষ্ঠিবদ্ধ করে দম নিতে লাগলো। ফাইজার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তৎক্ষণাৎ বিছানার উপর থেকে ফোন তুলে নিলো, ফোনের স্ক্রিনে ডায়াল করতে-করতে রুমের দরজাটা চাপিয়ে দিলো, কাঙ্ক্ষিত জায়গায় কল বসিয়ে ফোনটা কান ঠেকালো তায়েবা, রাগে দাঁত কটমট করে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই কলটা রিসিভ হয়ে গেলো। তায়েবা ঠোঁট শক্ত করে সাথে-সাথে গলা চড়িয়ে বললো,

- কুলা'ঙ্গার কোথাকার! তুই দেশে এসেও আমাকে শান্তি দিলি না! তোর মতো বে'জন্মার কাছ থেকে আমি রেহাই পেলাম না! আমার ভাবতেও ঘে'ন্না লাগে তুই আমার ভাই! তুই জন্মের সময় ম'রে গেলি না ক্যান শয়'তান! তুই ম'রলি না ক্যান! বেঁচে থেকে আর কতো কষ্ট দিবি জানো'য়ার? তুই কি আমায় মে'রে ফেলতে এসেছিস না? আয় তাহলে, এক্ষুণি গাড়ি ঘুরিয়ে আসবি! এসে এক্ষুনি আমাকে মে'রে দিয়ে যাবি।

তায়েবার ক্রুদ্ধ স্বর শুনে ওপাশের ব্যক্তিটা নিরব হয়ে আছে। আদৌ কথাগুলো শুনেছে কিনা কে জানে। তায়েবা রাগ সামলাতে না পেরে বাঁহাতের মুঠোতে জানালার উড়ন্ত পর্দাটা মুচড়ে ধরলো,পাতলা পর্দাটা দলা পাকিয়ে মোচড়াতে থাকলে হঠাৎ ফোনের ওপাশ থেকে কন্ঠ ভেসে এলো,

- তোর ননদ দেখি হেব্বি একটা চিজ। তোকে কিছু বলেনি? তুই যে এতো বোকা হবি সেটাতো জানতাম না। ড্রেস চেন্ঞ্জ দেখেও বুঝতে পারলি না? থাক গে, বাদ দিলাম। তোর মতো গাধার কাছে বাক্য খরচ করার মানে হয় না।

তায়েবা সঙ্গে-সঙ্গে এমন ক্ষোভ দেখালো, কার্টেন হ্যাঙ্কারটা বিকট শব্দ করে ফ্লোরে পরে গেলো। চরম রাগে গজগজ করতে থাকলে ওপাশের ব্যক্তিকে ক্রুদ্ধ গলায় বললো,

- তোকে আমি ছাড়---

কথা শেষ করার আগেই শব্দ শুনে ঘুমন্ত ফাইজা হাউমাউ করে কেদেঁ উঠলো। তায়েবা তৎক্ষণাৎ মেয়ের দিকে তাকালে তাড়াতাড়ি ফাইজাকে থামানোর জন্য চলে গেলো। কানের ফোনটা কাধের সাথে চেপে ধরতেই ফাইজাকে কোলে তুললো। কল কিন্তু তখনও কাটেনি, সময়টা হুরহুর করে যাচ্ছিলো তখন। তায়েবা মেয়ের দিকে ব্যস্ত হলে কাধে চেপে ধরার ফোনটা আবারও শক্ত কন্ঠের জানান দিলো,

- তোর ননদকে বলবি আমার নাম্বারে কল দিতে। এক্যুরেট দশটায় কল দিতে বলবি। কোনো চালাকি যদি করিস, আমার ক্ষমতা কতদূর সেটা তোর ভালোই জানা আছে। এ দেশের পুলিশ কিন্তু মাল বুঝে, কাজ না। তুই আমার সাথে পাকনামো করতে যাবি না, তোর স্বামীর ঘিলু উড়াতে কিন্তু দু'সেকেন্ডও লাগবে না, এজন্য সাবধান!

ঝড়ের বেগে কথাগুলো শেষ করে কল কেটে দিলো তায়েফ। এর বিপরীতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো তায়েবা। মাথাটা প্রচণ্ড টেনশনে ভনভন করছে। ফোনটা বিছানায় ছেড়ে দিয়ে ফাইজাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো, চিন্তা করতে থাকলো কি করে এর থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। তায়েফের ঘনিষ্ঠ একটা বন্ধু আছে, যার আপন বাবাই রা'জনীতির লোক। এক্ষেত্রে বন্ধুকে বলে পুলিশবাহিনীকে টেক্কা দেওয়াটা মুশকিল কোনো ব্যাপার না, তাছাড়া তায়েফ কিষাদৌ এশাকে কিছু করেছে কিনা সেটাও অস্পষ্ট। চিন্তা করতে-করতে নির্বাক তায়েবা বিছানায় হেড সাইডে পিঠ ঠেকিয়ে ভাবতে লাগলো। ঘড়ির সময়টা বেদম স্পিডে যেতে-যেতে দশটার কাটায় থামলো। তায়েবা চোখ ঘুরিয়ে ঘড়ির সময়টা দেখলো ঠিকই, কিন্তু এশাকে কল করার কথা বললো না। রাতটুকু এশাকে বিশ্রামের জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজের রুমের আফিফের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো সে।

অপরদিকে রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়েছে এশা। কেবলই নিদ্রার জন্য রুমের লাইটটা অফ করলো। চোখদুটোতে ঘুমের আনাগোনা নেই, নির্ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে সিলিংয়ের সিটি ফ্যানটার দিকে। সাদা ফ্যানটা ঘুরতে-ঘুরতেই এশার মনে গতরাতের ঘটনাগুলো স্মরণ করাতে সাহায্য করছিলো। গতকাল বিকেলের দিকে বান্ধুবীর ছোট বোনকে পড়াতে বেরিয়েছিলো এশা, নিজের অবসর ছুটিগুলো কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যেই টিউশনি করা। বড় ভাই আফিফ এতে মতবিরোধী করলেও শেষে এশার মিনতিতে রাজি হয়। এশা জানতো না তখন, ঠিক দূরেই একটা গাড়ি তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। গাড়িটা সুযোগ বুঝেই তাকে হরণ করে ওমন আবাসিক ফ্ল্যাটে তুলে আনে। মিরপুরের সবচেয়ে আভিজাত্য ভবনের একটা ফ্ল্যাট ছিলো ওটা, দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো ফ্ল্যাটে কেউ দীর্ঘদিন যাবৎ বসবাস করছে। এশাকে যখন ড্রয়িংরুম থেকে অন্য একটা রুমে নিয়ে গেলো তখন বুঝতে পারলো ওটা বেডরুম। বুকটা তৎক্ষণাৎ মোচড়ে এলো এশার! না-জানি শয়তানের দলগুলো সম্মানে হাত দেওয়ার পায়তারা করছে! এশা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ছোটাছুটি শুরু করলে একপর্যায়ে কাঠের টেবিলে বসানো হয়। টেবিলটা সোফার কাছে রাখতেই রুমে প্রবেশ করে অজ্ঞাত পুরুষ। সেই পুরুষটার দিকে তাকিয়ে আচমকা কেদেঁ দিলো এশা, লোকটা কিন্তু একপলকের জন্যও এশার দিকে তাকালো না। সে কানে ফোন লাগিয়ে কথা বলতে-বলতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকলো, ফিটফাট করা সোফায় আরামসে বসতেই পায়ের-উপর-পা তুলে দিলো। একজন এসে তার হাতে বিদেশী ব্যান্ডের জলন্ত নিকোটিন ধরিয়ে দিলো, এশা সবই অশ্রুচোখে দেখছিলো, কিন্তু মুখে কাপড় বাধা থাকায় কিচ্ছু উচ্চারণ করতে পারছিলো না। ফোনে অনেকক্ষণ কথা বলে শেষমেশ এশার দিকে তাকাতে লাগলো লোকটা। লোকটার গভীর চাহনি এশাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত, চোখ ছোট-ছোট করে সিগারেটে টান দিচ্ছিলো। কানে দ্বিতীয় দফায় ফোন লাগিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে কথা বললো, এরপর সাঙ্গুর হাতে দিয়ে দিলো ফোনটা। তর্জনী তুলে সবাইকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বললো, এই দৃশ্য দেখে ছটফট করে উঠলো এশা। হাতের শক্ত বাধঁনটা খোলার জন্য প্রাণপনে চেষ্টা চালাতে থাকলো, এদিকে অর্ন্তদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা লোকটা একটা রকিং চেয়ার নিয়ে তার মুখোমুখি গিয়ে বসলো। ঘেমে-নেয়ে একাকার এশা টলমল চোখে চেয়ারে বসা লোকটার দিকে অসহায় চাহনিতে তাকিয়ে রইলো, কিছুক্ষণ পর নিরবতার চাঁদরে ছেদ করে লোকটা ধোয়া ছেড়ে বললো,

- তায়েবার জমজ ভাই আমি। জমজ হলেও চেহারায় তেমন মিল খুজেঁ পাবে না। জেনেটিক্যালি আমাদের চেহারা অমিল, বিশেষ মিল বলতে ওর আর আমার গায়ের রঙ সেম। নিশ্চয়ই আমাকে দেখে প্রচুর প্রশ্ন জাগছে, সব বলবো। বলার জন্যই এখানে তুলে আনা হয়েছে। সাথে কিছু করার চিন্তাও রেখেছি, সেটা না করে ছাড়বো না।

শেষ কথাটা শুনে বুকটা ধ্বক করে উঠলো এশার। মুখবাঁধা অবস্থায় টলমল চোখ থেকে ফোঁটায়-ফোঁটায় পানি পরতে লাগলো। হঠাৎ লোকটা ওর দিকে দু'হাত বাড়িয়ে দিলো, আতঙ্কে চোখ কুঁচকে ফেললো এশা। সারা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে হাতদুটো এশার দুগাল ছুঁয়ে কানের পাশ দিয়ে গেলো। এশা চমকে উঠে চোখদুটো আরো খিঁচুনি দিয়ে বুজে ফেললো, কিন্তু সেকেন্ডের মধ্যে টের পেলো লোকটা তার মুখের বাধঁন খুলে দিয়েছে। মুখে আর কোনো চাপাভাব টের পাচ্ছে না এশা। দীর্ঘ নিশ্বাসের প্রতিটি উষ্ণতা সাড়া মুখে পরছিলো, বুঝতে পারছিলো লোকটা নিজের মুখটা খুব কাছে এনে ফেলেছে। এশা চোখ খুলার সাহস পেলো না, কিন্তু নাকে কটু গন্ধ পাচ্ছে। এই গন্ধটা প্রায়ই কলেজ থাকতে পেতো, বড় ভাই যখন অবিবাহিত ছিলো, তখন তার রুমে প্রতি রাতেই গন্ধটা পেতো। এশা কি যেনো ভেবে আস্তে-আস্তে চোখ খুলে তাকালো, খুলতেই দেখতে পেলো লোকটা কাঁচের বোতলে মুখ লাগিয়ে চোখ কুঁচকে কিছু খাচ্ছে। তরল পানীয়টা যথেষ্ট বিস্বাদযুক্ত সেটা চোখেমুখে স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে। এশা আর কথা না বলে পারলো না, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করতে গিয়ে মাঝে-মাঝে তোতলা সুরে বলে উঠলো,

- আ-আআপনি আমায় কি-কিকি উদ্দেশ্যে আটকে রেখেছেন? আপনি কি মুক্তিপণ চাচ্ছেন?

মুখ থেকে মদের বোতলটা বিরক্তির সাথেই সরিয়ে ফেললো, চোখ খুলে এশার দিকে তাকাতেই বোতলটা টেবিলে রাখলো। নেশায় ঢুলুঢুলু চোখে গলায় ঢোক গিলে ক্ষুদ্ধ গলায় বললো,

- তোমার পকেটে কতো ভরবো সেটা বলো। আমার তো তোমাকে দিয়ে কাজ, টাকা দিয়ে কাজ নেই।

এশা চকিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

- আমাকে দিয়ে? আমাকে দিয়ে কি কাজ আপনার? আমিতো আপনাকে ঠিকমতো চিনোও না। আপনি কে সেটাও একটু আগে আপনার মুখ থেকে শুনেছি। আপনি কেনো আমায় তুলে এনেছেন? কেনো ক্ষতি করতে চাইছেন?

তায়েফ স্মিত হেসে উত্তর দিলো,

- তোমাকে ক্ষতি করতে পারলে---

এটুকু ভাবতেই হঠাৎ ভাবনার মধ্যে বাধা দিলো কলিংবেলের শব্দ। এশা বুঝতে পারলো তার বড় ভাই ফিরে এসেছে। রেডিয়াম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়ের হিসেবটা দেখতেই বুঝলো, রাত এখন পৌণে বারোটা। এশা আশ্চর্য হলো, সময় কিভাবে হুরহুর করে চলে যাচ্ছে? এবার কোলবালিশটা টেনে সেটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করলো এশা। আবারও গতরাতের স্মৃতিগুলো ভাসছে। লোকটার পুরো নাম ছিলো আরেফিন তায়েফ, পড়নের পোশাক এবং কথাবার্তার ধরণ যেনো জানান দিচ্ছে সে শৌখিন পরিবারের কেউ। স্মার্টলি কথা বলার স্টাইলটাও বেশ আর্কষর্ণীয় ছিলো, কোনোভাবেই বোঝা যাচ্ছিলো না তার মূখ্য উদ্দেশ্য কি। সিগারেট ধ্বংস করতে-করতে এক বোতল বিদেশী এ্যালকোহল শেষ করলো তায়েফ। সারা রুমে যখন নিকোটিনের ধোয়ায় বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, তখনই এশা সেটা সহ্য করতে না পেরে বমি করে ফেলে। গায়ের পোশাকটা নোংরা হয়ে গেলে তায়েফের নির্দেশে শাড়ি আসে। এশা সেই শাড়ি পরতে নারাজ, কোনোক্রমেই এই শাড়িতে হাত দিবেনা, সে বাড়ি যাবে! এদিকে তায়েফও নাছোড়বান্দা, ভয়ংকর এক হুঙ্কার দিয়ে এশাকে শাড়ি পরার জন্য অন্য রুমে সাঙ্গুদের সাথে পাঠিয়ে দেয়। ঘন্টাখানিক পরে রুমে ফিরে এশা, এসেই চোখের সামনে চেয়ারে মাথা ছেড়ে দেওয়া অবস্থায় তায়েফকে দেখতে পায়। খালি রুমে এশার ইচ্ছে করছিলো ওই ব্যাটার গালে ঠাটিয়ে চ'ড় মে'রে দিতে! কিন্তু পরে কি হয় সেটা চিন্তা করতেই এশা আর সেই চিন্তায় গেলো না। রুমের লাইট না জ্বললেও দূর-দূরান্তে নিয়নবাতির আলো সরাসরি এ ফ্ল্যাটে ঢুকেছে, জানালাগুলো বিশাল বড়-বড় এবং থাইগ্লাস সরিয়ে জানালায় বসার চওড়া জায়গা রয়েছে। এশা তায়েফের ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, বাঁহাতে থাইগ্লাসটা বামে টেনে খুলে ফেলে, বাতাসের ঠান্ডা পরশ এসে গায়ে লাগে এশার। বিগলিত মনে সহসা শান্তিতে চোখের পাতা বুজে আসে ওর, বুক ফুলিয়ে দম নিতেই সেটা ঠোঁট বেদ করে ছেড়ে দিতে থাকে। নির্জন রাতে নিরিবিলি শহরে ঠান্ডা হাওয়ার পসরা নেমেছে, প্রকৃতি যেনো বিলিয়ে বেড়াচ্ছে ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ। পেছনে কিছু টের পেতেই আকস্মিকভাবে চোখ খুলে তাকালো এশা, বুকটা হুট করেই ধড়ফড়-ধড়ফড় করে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে রুক্ষ হচ্ছে প্রচুর, ভয়ে জীর্ণ হয়ে আসছে শরীর। এশা একটু-একটু করে পেছনে ঘুরে তাকাতেই নিশ্বাস যেনো আঁটকে গেলো, বুকের উপর পাথর চাপার মতো নিশ্বাসটা সেখানেই থমকে গেলো! শাড়ির আচঁলটা ডানহাতে কায়দা করে পেঁচাতে ব্যস্ত তায়েফ, চোখের দৃষ্টি শান লাগালো ছুড়ির মতো ধারালো হয়ে আছে। আচঁলে টান খেতেই এক ঝটকায় সৌষ্ঠব্য বুকটার উপর হুমড়ি খেয়ে পরলো, টের পেলো তার বাহুদুটো কেউ পাঁচ আঙ্গুলে কঠিনভাবে ধরেছে।

শাড়ির আচঁলটা ডানহাতে কায়দা করে পেঁচাতে ব্যস্ত তায়েফ, চোখের দৃষ্টি শান লাগালো ছুড়ির মতো ধারালো হয়ে আছে। আচঁলে টান খেতেই এক ঝটকায় সৌষ্ঠব্য বুকটার উপর হুমড়ি খেয়ে পরলো, টের পেলো তার বাহুদুটো কেউ পাঁচ আঙ্গুলে কঠিনভাবে ধরেছে। এশা লোকটার বুকের উপর দুহাত রেখে জোরে একটা ধাক্কা মারলো, কোনো লাভ হলো না। উলটো হাতদুটো খামচে ধরে ব্যথা দিচ্ছে এখন। এশা অস্ফুট স্বরে চাপা আর্তনাদে গোঙিয়ে উঠলো, তবুও তায়েফ ছাড়লো না। এশার দু'বাহু ধরে আকস্মিকভাবে এমন ধাক্কা মারলো, এশা এবার সবচেয়ে ভয়ানক ব্যথাটা পেয়ে রুম কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো। পিঠে সূঁচালো কিছু খুব গভীরভাবে বিঁধে যাচ্ছে, তায়েফ সেই জায়গায় আরো জোরে ধাক্কা দিয়ে ঝাঁঝিলো সুরেই বললো,

- এখন যদি তোমার বারোটা বাজাই তাহলে কেমন----

হঠাৎ চিন্তার দরজায় কড়া বাজিয়ে রুমে ঢুকলো আফিফ। রুমের লাইট নেভানো বলে ছোট বোনকে জাগ্রত দেখেনি। এশা যেনো অন্ধকারের সুযোগ পেয়ে চোখ খোলা রেখেই দরজার কাছে দাঁড়ানো আফিফকে দেখতে থাকলো। আফিফ ভেতরে ঢুকলো না, দরজাটা ফের চাপিয়ে চলে গেলো। ব্যাপারটা দেখে আশ্চর্য হলো এশা! আজ যদিও এশার ঘুমাতে দেরি হচ্ছে, মানসিক ধকলে পরেছে বিধায় ঘুম নেই, কিন্তু আফিফ এখানে কি দেখে গেলো? এশার মনটা কৌতুহলের রেশে খচখচ করতে লাগলো। অন্যসময় এ টাইমে বেঘোরে ঘুমায় এশা, কিন্তু আজ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জেরে একটু উলোটপালোট হয়ে গেছে। এশা ডানকাত ফিরে চুপচাপ শুয়ে পরলো, চোখদুটো আবার বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ব্যর্থ হিসেবে যখন ঘুম এলোই না, তখনই বালিশের নিচ থেকে ভুম ভুম শব্দে ফোন কাঁপতে লাগলো।  এশা চোখ বন্ধ করেই বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিলো, কম্পমান ফোনটা বালিশের তলা থেকে বের করবে তখনই সেটা কেটে গেলো। এশা আর চোখ খুলে দেখলো না, ফোনটা ছেড়ে দিয়ে সদ্য নিদ্রায় তলাতে লাগলো। ঘুমের রেশটা কেবলই গাঢ়র দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, এর মধ্যে পরপর দুটো অদ্ভুত আওয়াজ পেলো এশা। আকস্মিক এই আওয়াজগুশো কখনোই এ বাড়িতে শোনেনি। এই কন্ঠ তার ভাবী তায়েবারও না। এশা চট করে চোখ খুলে শোয়া থেকে উঠে বসলো, বিছানা থেকে দ্রুতগতিতে নামলেও খুব আস্তে করে দরজা খুললো। এবার স্পষ্টভাবে শব্দটা শুনতে পাচ্ছে এশা, এটা কোনো মেয়ের কন্ঠ, একটা মেয়েলি সুর চিনতে সে কখনো ভুল করবে না। কিন্তু অপরিচিত এই কন্ঠ কোত্থেকে উদয় হলো? এসব নিয়ে চিন্তায় মগ্ন হলে হঠাৎ কেনো জানি একটু আগে আফিফের আচরণটার উপর সন্দেহ জাগলো। তার ভাই কি...

'অসম্ভব, অসম্ভব!' এশা তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধালো। অবচেতন মন যে কতো ভয়ানক চিন্তা ভাবনা করছে সেটা মুখে বলতেও বিবেকে বাঁধছে ওর। এশা তবুও নিজের মনকে আশ্বস্ত করার জন্য শব্দ উৎসের খোঁজ না লাগিয়ে ভাই-ভাবীর রুমের দিকে গেলো। পা টিপেটিপে আধ-ভেড়ানো দরজার সামনে যেতেই বুকভর্তি দম নিলো এশা, এরপর দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে আস্তে করে সেটা ধাক্কা দিয়ে দিলো। দরজাটা ধীরে-ধীরে রুমের ভেতরে ঢুকে যেতেই এশা সর্তকভাবে একপা এগুলো, নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে আবছা রুমের দিকে দৃষ্টি বুলালো। বিছানার দিকে চোখ পরতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো এশার, সমস্ত শরীর যেনো বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে এলো। তায়েবা, ফাইজা দুজনেই আছে কিন্তু আসল ব্যক্তিটাই নেই। এশা আর বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে পা চালিয়ে সেই শব্দ উৎসের খোঁজ লাগালো। অনেক চেষ্টা করার পর আবিষ্কার করলো, শব্দটা রান্নাঘরের পাশের ঘর থেকে আসছে। সেই ঘরটা কেবল কাজের মহিলাদের থাকার জন্য বরাদ্দ। দু'সপ্তাহ যাবৎ সাবু খালা নেই, তাই ওই রুমটা বন্ধ। তিনি গ্রামে গিয়েছেন বিধায় ওই রুমটায় তালা দেওয়া হয়েছিলো, অথচ সেই রুমটায় তালা নেই। উলটো দরজার নিচ দিয়ে সরু ফাঁক অংশ গলে এনার্জী লাইটের বাতি দেখা যাচ্ছে। এশা নিঃশব্দে সেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলো, দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো কিনা জানা নেই ওর। তাই দরজার উপর হাত রেখে আলতো একটা ধাক্কা দিয়ে পরোখ করে নিলো। ধাক্কা দিতেই দরজাটা ভেতরের দিকে যাচ্ছে, তার মানে দরজাটা খোলাই আছে। কিন্তু খোলা রেখেছে কি জন্যে? এশা শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে বড় একটা ঢোক গিলদো। নিজেকে একটু শান্ত-স্বাভাবিক করে আচমকা এক ধাক্কা মেরে বসলো, সরাৎ করে কাঠের দরজাটা খুলে যেতেই চোখের সামনে নোংরা দৃশ্য ভেসে উঠলো! তার ভাই যে এখন বিবাহিত, যেকিনা এক বাচ্চার বাবা, একজন পেশাদার ডাক্তার, যার নাম-ডাক বেশ ভালোই শোনা যায়, সেই ভাই অজ্ঞাত একটা মহিলা নিয়ে নিজ বাঢ়িতে নোংরামি করছে! অজ্ঞাত মহিলাটা তাড়াতাড়ি নিজের পোশাকহীন শরীরে কম্বল টেনে নিচ্ছে, আফিফ নিজের বোনকে এভাবে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দেখতে পেয়ে আমতা-আমতা করছে। এশা বাকরুদ্ধ অবস্থায় কোনো স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছিলো না, বিষ্ময়ে বড় বড় হওয়া চোখদুটো অশ্রুধারায় টলটল করছিলো তার। আফিফ দ্রুত একটু ভদ্রস্থ হওয়ার চেষ্টা করতেই এশা একদৌড়ে তায়েবার কাছৈ ছুটে গেলো। ঘুমন্ত তায়েবাকে ডেকে তুলেও লাভ হচ্ছিলো না, এদিকে যে ঘুমের ঔষুধ খাইয়ে তায়েবাকে থিতিয়ে রেখেছে সেটা পরে বুঝতে পারে এশা। নিরুপায় এশা ভাবীকে ওভাবেই ছেড়ে ফের ওই রুমের দিকে ছুটে পালায়, অচেনা মেয়েটা ততক্ষণ সাবলীল পোশাকে গা ঢাকা দিয়ে ফেলেছে। মেয়েটা যেই রুম থেকে বেরুতে নেবে তখনই এশার বাধা খেয়ে সটান করে দাঁড়িয়ে যায়, এশাও রাগে-ক্ষোভে-তিক্ততায় কষিয়ে মার মারে মেয়েটার গালে। মেয়েটা গাল বুলাতে-বুলাতে কটমট দৃষ্টিতে এশার দিকে তাকালো, এরপর অকথ্য ভাষায় বলে উঠলো,

- আমার গালে না মা'ইরা তোর ভাইয়ের গালে যাইয়া লাগা। আমারে কোন্ সাহসে মা'রতে যাস ? তোর ভাই রাতবিরাতে ঘরে বউ-বাইচ্চা থুইয়া মাতারি খুইজা বেড়াইবো, আর হাতে-নাতে ধরা পরছে দেইখা আমারে মা'রোস!

পরপর দুটো অ'শ্লীল ভাষায় গা'লি দিয়ে উক্ত মহিলাটা বেরিয়ে গেলো। রাগে শক্ত হয়ে থাকা এশা ভাইয়ের দিকে অশ্রুচোখে তাকালো, রাগে হাতের মুঠোগুলো মুষ্ঠি হয়ে গেছে। আফিফ নিজেকে গা ঢাকা দেওয়ার জন্য মিথ্যা পায়তারা সাজাতে থাকে,

- দ্যাখ এশা, তুই যা দেখলি এটা একদম ভুল। ওই মহিলা উলটো আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। বলেছে তার কথা যদি না মানি তাহলে আমার মেডিকেল প্রস্টিজ খুইয়ে দিবে। আমার কোনো দোষ নেই বোন, একটাবার আমার কথা শোন। এশা তুই তোর ভাবীকে---

আফিফ কথাগুলো শেষ করার পূর্বেই গলা চড়ালো এশা। ক্রোধে গা শুদ্ধো কাঁপছে ওর। ভাইয়ের দিকে জীবনে এই প্রথম তেজালো সুরে বললো,

- তুমি যে একটা জঘন্য লোক, জঘন্য মেন্টালিটি নিয়ে থাকো সেটা আজ চাক্ষুষ দেখলাম ভাইয়া। এসব দেখার পরও তুমি বানোয়াট কথা সাজাচ্ছো? তুমি কি আমাকে মূর্খ পেয়েছো? আমি কি তোমার কূকীর্তি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করবো না? তুমি খুবই জঘন্য! খুব জঘন্য! খুব বেশিই জঘন্য ভাইয়া! ওই তায়েফ তোমার ব্যাপার নিয়ে যখন বলেছিলো, আমিই এক গাধা তার কথা বিশ্বাস করিনি। উলটো তাকেই যা-তা ভাষায় বকাঝকা করে এসেছি, চড় মেরেছি। তোমাকে নিয়ে এসব ভাবতেও আমার তখন কষ্ট হচ্ছিলো ভাইয়া, কিন্তু আজ এসব সত্যি দেখে তার চেয়ে বহু মাত্রায় কষ্ট হচ্ছে। ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ!

শহরের বুকে যেনো সদ্য শীতের ছোঁয়া লেগেছে। পরিবেশটা কুয়াশায় ঢেকে না গেলেও ঠান্ডা বাতাসে পশম যেনো কাটা দিয়ে উঠে। পাখিরা ভোর সকালে হালকা মতোন কিচিরমিচির করে, কিন্তু সকাল হলেও শব্দ বন্ধ। সূর্য্যিমামাও যেনো শীতের আগমন দেখে দেরিতে তেজ ছড়ান, পৃথিবীর বুকে স্বল্প তাপমাত্রায় উষ্ণতা দেন। গ্রামের মানুষগুলো কনকনে শীতের মধ্যে ঘুম ত্যাগ করলেও শহরের একদল মানুষ দশটা অবধি ঘুমায়। যারা মূলত ব্যবসার হালটা নিজের মতো করে টানে তাদের জন্য শীতের সকালটা আরামদায়ক। যখন খুশী তখন তারা রেডি হয়ে নেয়, নাস্তা সারে, এরপর অফিসের পরিবেশটায় চোখ ঘুরাতে গাড়ি নিয়ে ছুটে। এমনই এক শীতের সকালে ন'টা অবধি ঘুমাচ্ছে তায়েফ। বিশাল বড় বিছানায় একাই দখল করে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমটা একটু পাতলা হলেও উঠতে ইচ্ছে করছেনা। হঠাৎ নিবরতার ঠান্ডা পরিবেশে মেজাজ চড়ানো কন্ঠ আসলো, দরজাটা নক করেই ভেতরে ঢুকে গলা উঁচিয়ে আজ্ঞা চাইলো,

- আসতে পারি বস?

তায়েফের মুডটা সেকেন্ডের ভেতর বিগড়ে গেলো। জুতাপেটা করে ব্যাটাকে কঠিন কিছু বলতে ইচ্ছে করছে, সকালটা যেনো খারাপ দিয়ে শুরু না হোক, তাই তায়েফ রাগ দমন করে বললো,

- কি চাই?

ঠোঁটে এক প্রস্থ হাসি ঝুলিয়ে বসের উদ্দেশ্যে বললো,

- বস, ওই শয়তানকে মুরদা বানিয়ে দিয়েছি। কেউ ওর খবর পাবেনা। ব্যাংকেও টাকা পাঠানো হয়ে গেছে। এরপর আর কি হুকুম আছে বস?

তায়েফ ঘুম ঘুম চোখে নিদ্রাজড়ানো কন্ঠে বললো,

- বউ দরকার। একটা বউ নিয়ে আসো। আরাম করে শীতটা একটু কাটাই। আহা, শীত! বউ ছাড়া শীত, আর বালিশ ছাড়া বিছানা দুটোই কষ্টদায়ক।

তায়েফের করা শুনে আহাম্মক হয়ে গেলো সাঙ্গুটা। কি উত্তর দিবে সেটা বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলো, তার বস মানুষটা কি বিয়েটিয়ে করতে চাচ্ছে নাকি? সাথে,সাথে সাঙ্গুটা মনে-মনে বলে উঠলো, 'আরে খোদা, কাম সারছে!'

ঘড়িতে বাজে সন্ধ্যা ছয়টা। ছয়টা পনেরোর দিকে নৌযানটা ছাড়ার কথা। তিনতলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল নৌযানে উঠেছে এশা। একটা বড় কেবিন বুক করেছে এশা। বিশাল বড় কেবিনটায় ডাবল একটা বিছানা। নরম বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরের অবস্থা দেখছে সে। নীল আকাশটা ভারী সুন্দর লাগছে। তিনতলার এই কেবিনটা মূলত একারনেই বেশি টাকায় নেওয়া, কারণ এখান থেকে আকাশ দেখতে মারাত্মক লাগে! এশা দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে জানালার দিকে মুখ করে আছে। ভেতরটা মনটা আজ ভালো নেই, ভাবী তাকে পড়াশোনা শেষ করার জন্য আবার গন্তব্যে পাঠিয়ে দিচ্ছে। শহরের বুকে ভাবী এবং ফাইজাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করছেনা, মনটা যেনো ভীষণভাবে নারাজ। কোলের উপর ফোনটাও এখন আর বাজেনা, সেই রাতের মতো একটু ভুম ভুম করে উঠেনা। ঝড়ের মতো লন্ডভন্ড করার জন্য এসেছিলো ওই ব্যক্তি, ঝড়ের মতোই তছনছ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সে। এশার পিঠে যে ছোট্ট একটা ক্ষত হয়েছে, সেটা ওই ব্যক্তির দেওয়া আঘাত। সেদিন এশার পিঠে ছোটখাট সরু ছিটকিনির মাথাটা বিদ্ধ হয়েছিলো, তারই বদৌলতে এখনো পিঠের ডানদিকটায় ব্যথা করে। আচ্ছা, ওই ব্যক্তিকে নিয়ে কেনো এশা ভাবছে? এশার সাথে তো তার যোগাযোগ নেই, তেমন সৌজন্যমূলক কথা হয়নি, কখনো দেখা হবে কিনা তাতেও সন্দেহ রয়েছে। হঠাৎ এশাকে চেতন করে রুমের দরজায় কেউ ঠকঠক করে উঠলো। এশা ভাবলো, হয়তো ম্যানেজার গোছের কেউ পরিদর্শনের কাজ সেরে নিচ্ছে। কেবিনে সব যাত্রী উঠেছে কিনা সেটাই হয়তো দেখতে এসেছে। এশা শান্তভঙ্গিতে বিছানা ছেড়ে নামলো, ক্রমাগত অস্থির ভঙ্গিতে ঠকঠক করা দরজার দিকে বিরক্তি নিয়ে এগুতে লাগলো। এশা টের পেলো নৌযান ছাড়ার সাইরেন বাজছে, বাজতে-বাজতেই দরজাটা খুলে দাঁড়ালো এশা। অপ্রত্যাশিত কিছু দেখতে পেয়ে আশ্চর্যে যেই চেঁচিয়ে উঠবে, তৎক্ষণাৎ মুখে হাত চাপা দিয়ে দরজাটা পায়ে ঠেলে বন্ধ করে দিলো। এশাকে ওই অবস্থায় পিছনে ঠেলতে-ঠেলতে একেবারে বিছানায় গিয়ে বসালো। এশা যেনো আঁটকে রাখা নিশ্বাস ছাড়তে পেরে হাঁফ বাচঁলো, চোখ বন্ধ করে জোরে-জোরে দম নিতে থাকলে হঠাৎ সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে শিউরে উঠলো এশা! ব্যস্ত ভঙ্গিতে চোখ খুলে তাকাতেই তায়েফের অবস্থা দেখতে পেলো। ফ্লোরে বসে এশার কোলে রেখে দিয়েছে তায়েফ। চোখদুটো পুরোপুরি বন্ধ করা অবস্থায় এশার হাতদুটো কাছে টেনে আনলো। একটা হাত টেনে নিয়ে নিজের গালে রাখলো, অন্যহাতটা টেনে নিয়ে মাথার চুলের উপর ছেড়ে দিলো। এশা নির্বাক হয়ে কপাল কুঁচকে দেখছে, তায়েফের মতিগতি ধরার চিন্তায় আছে সে। তায়েফ সন্তপর্ণে নিজের হাতদুটো বাড়িয়ে এশার কোমরটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো, কোল থেকে মুখটা তুলে এশার হতবাক দৃষ্টির দিকে তাকালো। কন্ঠস্বর যথাসম্ভব কোমল করে বললো,

- আমাকে কোনোভাবে কি বিশ্বাস করা যায় না?

এশা কোনোরূপ বাক্য উচ্চারণ করলো না, কঠিনভাবে চুপ রইলো। এমনভাবে সংযত রইলো যেনো তায়েফের উপস্থিতি তাকে বিচলিত করছেনা, অস্থির করছেনা, আনচান করছেনা, কোনোরূপ উৎকন্ঠার উদ্রেক ঘটাচ্ছে না। তায়েফ একদৃষ্টিতে এশার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, পরক্ষণে ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,

- আমিও যদি তোমার ভাইয়ের মতো জঘন্য কাজটা করি তাহলে কি বিশ্বাস করবে?

থরথর করে কেঁপে এশার ওষ্ঠযুগল। এ যেনো ঝড়ের আগে নিরবতার সংকেত। তায়েফ পরবর্তী কথা বলতে-না-বলতেই এশা হুঁ হুঁ করে কেঁ উঠলো। চলমান নৌযানটা আকাশের পেঁজো পেঁজো তুলোর মতো মেঘগুলো ছাড়িয়ে যাচ্ছে, শো-শো করে জানালা থেকে নদীপথের হাওয়া আসছে। শীতল হচ্ছে রুমের পরিবেশ। তায়েফ কোল থেকে সরে গেলো, এশার হাতদুটো গাল ও মাথা থেকে সরিয়ে নিলো। এশার আরো সন্নিকটে যেয়ে ফ্লোরে বসেই গলা জড়িয়ে ধরলো ওর। এশা অশ্রু ভেজা গলায় মুখ লুকালো তায়েফ, পিঠের দিকে ডানহাত বাড়িয়ে সেই ব্যথার জায়গাটা স্পর্শ করলো। গলার স্বরটা ঠান্ডা করে বলতে লাগলো,

- ব্যথাটা না দিলে তুমি যে কাগজে সই করতে না এশা। তোমার ভাইকে জব্দ করার জন্যই তোমাকে কষ্ট দিতে এনেছিলাম। কিন্তু তোমার আচঁড় দিতে গিয়ে আমার ব্যথা অনুভব করেছি এশা। মানুষ আমার চরিত্র নিয়ে যে পরিমাণে গুজব ছড়িয়েছে, আমার জমজ বোনই আমাকে আর বিশ্বাস করেনা। আমি ক্লাবে যাই, ফূর্তি করি, কিন্তু কোনোদিন কোনো মেয়েকে তোমার ভাইয়ের মতো দেখিনি। এই শীতগুলো খুব যন্ত্রণাদায়ক এশা, আমাকে দ্রুত বিয়েটা করে উদ্ধার করো। এখনো বালিশ আঁকড়ে ঘুমাতে হয়, এর চেয়ে জঘন্য ব্যাপার হয় বলো? দ্রুত আমাকে বিয়ে করো, আমার বুকটার মধ্যে চলে আসো।  তোমাকে ভয়ংকর ভাবে ভালোবেসে ফেলেছি এশা, এদেশ থেকে যদি চলে যাই, তোমাকে নিয়েই বিদায় হবো। তুমি রাজি আছোতো?

এশা এদফাতেও চুপ। হ্যাঁ, না কিছুই না বললো না। তায়েফ অনুভব করলো, এমন নিঃশব্দ পরিবেশে এশার রোদনধ্বনি আর শোনা যাচ্ছেনা। তার মাথা একটু-একটু করে ছুঁয়ে যাচ্ছে কোমল ওষ্ঠজোড়ার পরশ।

'প্রাণদায়িনী তুমি, প্রাণনাশিনী আমার।

তোমার জন্য ক্ষিপ্ত ছিলাম, তোমাতেই আসক্ত আজ।'



***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন