!!৯৯!!
মাহাকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে। সুইমিংপুলে মাহার ছটফটানির দরুন পেটে চাপ পড়েছে অত্যাধিক। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। ভিতরে ডক্টর ওয়াসিফসহ আরো বিজ্ঞ কয়েকজন ডক্টর রয়েছেন। সার্থক একজন সার্জন হওয়ার পরেও ওটিতে যাওয়ার সাহস তার হলোনা। এই দুটো হাতে কত মানুষের বুক চিড়েছে সে। কত ওটি করেছে। কখনো হাত কাঁপেনি। কখনো কোনো দেহের কাঁ'টা ছিঁ'ড়ায় তার কিছুই যায় আসেনি। আজ কাঁপছে সারা শরীর, মন সব। ডক্টর জিনিয়া তাবাসসুম দেশ ছেড়েছে আজ প্রায় বছর দুয়েক হলো। সার্থকের মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে জিনিয়াকে তার বড্ড প্রয়োজন ছিলো। খুবই ভালো মানের একজন চিকিৎসক জিনিয়া। মাথায় অহেতুক চিন্তা ভাবনা ঘুরাঘুরি করছে। তীব্র অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে মস্তিষ্কে। পাগলের মতো পায়চারি করছে সার্থক। এমন সময় বেরিয়ে এলেন ডক্টর ওয়াসিফ।
"ডক্টর ফায়রাজ"
ওয়াসিফের ডাকে দ্রুত গতিতে তার সামনে এসে দাঁড়ায় সার্থক। বহু কষ্টে উচ্চারণ করে,
"আমা.. আমার স্ত্রী কেমন আছে ডক্টর?"
"আপনার স্ত্রী এখন আশঙ্কামুক্ত। তবে..
"তবে কি ডক্টর?"
"আপনার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারিনি। আপনার স্ত্রীর প্রেগ্ন্যাসিতে অনেক কমপ্লিকেশন ছিল। পেটের উপর প্রচন্ড চাপ পড়ায় ব্লিডিং হয়েছে। তাই...
সাতমাসের বাচ্চাটা এভাবে চলে যাবে ভাবতেই পারছেনা সার্থক। কত স্বপ্ন বুনেছিলো দুজনে। কত আশা ছিলো বাচ্চাটাকে নিয়ে আজ সব শেষ। সব।
"ছেলে নাকি মেয়ে হয়েছিলো?"
"মেয়ে"
দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে সার্থকের বুক চিড়ে। দ্বিতীয়বারের মতো মাকে হারালো তবে। বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যথা। কি ভেবেছে সবাই? সার্থকের কলিজায় আঘাত করে পাড় হয়ে যাবে সকলে? শরীর, মন জ্বলছে অনলে। বাঁকা হেসে ঘাড় কাত করে ওয়েন্ডিগো এলো বুঝি! একটা শক্ত কাগজের কার্টুনে ভরে বাচ্চাকে প্যাকেট করে সার্থকের হাতে দেওয়া হয়। বাক্স খুলে একনজর মা টাকে দেখার সাহস হয়নি সার্থকের। দহন, দহন হচ্ছে বুকের মধ্যখানে। সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে জাগছে। মাহাকে দুদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তাই আই.সি.ইউ তে রাখা হয়েছে। সার্থক বাইরে থেকে কাঁচের দেয়ালের এপাড় থেকে প্রিয়তমার ক্লান্ত মুখটা দেখলো কেবল একবার। দহনে একটু বৃষ্টি নামলো। অতঃপর বেরিয়ে এলো হাসপাতালের বাইরে। মায়ের দাফন কাজ সম্পন্ন বাকি!
_____________
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি বইছে বাইরে। গুলশানের বহুতল ভবনের অদূরে একটা কবরস্থান। একটু আগেই মাত্র একটা সাতমাস বয়সী বাচ্চার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়ছে। বাচ্চার বাবা কবরের পাশটায় মাটির রাস্তায় বসে একধ্যানে কবরের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে করছে বিগতদিনের স্মৃতি। এই তো কিছুদিন পূর্বে,
মাহার পেটের উপর থেকে ঢোলা গেঞ্জিটা সরিয়ে টুপটাপ করে দু'খানা চুমু পেটে এঁকে দেয় সার্থক। মাহা এতো লজ্জা পায় সার্থকের এমন বেহায়াপনায়!
"কি যে করেন না আপনি। মুখ সরান। আমার সুড়সুড়ি লাগছে।"
মাহার কথা আদোও সার্থকের কানে গিয়েছে কিনা কে জানে। এবারে হরেকরকম গল্প জুড়ে দিলো পেটে থাকা অবুঝ শিশুটার সাথে।
"মা, বুঝলি তোর আম্মু আস্ত একটা হিংসুটে। মেয়েকে আদর করলেও সহ্য হয়না।"
"আপনি এতো শিউর কি করে মেয়েই হবে? এই চলুন না আলট্রাসনোগ্রাফি করে দেখি কি হবে?"
"না, মাহা। বাচ্চা জন্মের পর একেবারে জানবো আমরা। আমি জানি আমার মা ই আসবে।"
"আপনি ভিষণ পাগলাটে সার্থক।"
সার্থক মাহাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে,
"তোমারই তো।"
"হুম, আমার। একান্ত আমার। আ.. আ..
মাহা পেটে হাত রেখে চিৎকার করে উঠলো। সার্থক ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"এই মাহা ঠিক আছো তুমি? মাহা?"
মাহা চোখ-মুখ খিঁচে সার্থকের ডানহাত টেনে নিয়ে পেটে ছুঁয়ালো। বাবু কিক মারছে পেটে। মাহা চোখ-মুখ খিঁচে বললো,
"বাবার মতোই দুষ্টু হবে। খুব মজা পাচ্ছে মাকে মেরে।"
বলতে বলতেই গলা ভেঙে যায় মাহার। কান্না-খুশির অনুভূতিতে বাকরুদ্ধ সে। সার্থক অবাক হয়ে পেটে হাত ছুঁইয়ে রাখে। বাবু থেমে থেমে কিক করছে। সার্থক মাহার কাঁধে মুখ গুঁজে। দু-তিন ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চোখ বেয়ে।
যেমনটা আজ পড়ছে। সার্থকের চোখের নোনতা অশ্রু আর বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে ধুঁয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় সার্থক। হিসাব -নিকাশ বাকি অনেক।
!!১০০!!
"এবারের মতো আমাদের ক্ষমা করা যায় না?"
ক্রন্দনরত দুই মানবীর একজন বলে উঠে। সামনে চেয়ারে বসে বাঁকা হাসে ছায়ামানব। ক্ষমা শব্দটাই তো তার অপছন্দ। ভিষণ ভিষণ অপছন্দ।
"আজ একটা পরের জন্য নিজের আপনদের শেষ করে দিচ্ছো! সেই তোমার ধ্বংস ডেকে আনবে..
"শিস্, চুপ!"
মুখে আঙুল দিয়ে ধমকে উঠে ছায়ামানব। ধমকে কেঁপে উঠে সুউচ্চ বিল্ডিং। একজন মানবী জীবন ভিক্ষা চাইলেও আরেকজন নিশ্চুপ। তিনি যেন জানতেন এমন কিছুই হবে। আর কোনো কথা বলার সুযোগ কেউই পায়নি। বাইরে বৃষ্টির তালে তালে খ'ন্ড হতে থাকে আস্ত দুই মানবী। তাদের র'ক্তের একেকটা ছি'টে আনন্দে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে ছায়ামানবের। তান্ডব করতে ইচ্ছে করছে। খুশির তান্ডব।
_________________
মেরির কাছ থেকে মাহার অসুস্থতার কথা শুনে হাসপাতালে ছুটে এসেছে রুমানা, এশা। রুমানার অফিসের কলিগ এশা। বিদেশ থেকে ফিরে পুরানো সকল কিছু ভুলেই সিলেটে একটা কোম্পানিতে চাকুরি করছে এশা। রুমানা এশাকে চিনতো না। পরে কথায় কথায় একদিন পরিচয় হয়। সেই থেকে কোকিল অর্থাৎ মাহার আত্মীয় বিধায় এশাকে যথেষ্ট স্নেহ করে রুমানা। এক দরকারি কাজে আজ ঢাকা এসেছিলো দুজনে। মাহার সাথে দেখা করতে এসেই মাহার হাসপাতালে থাকার খবর পায় তারা। অদ্ভুতভাবে রেজওয়ান একটা কেসের তদন্তে আজ হাসপাতালে এসেছিলো। রুমানাকে হাসপাতালে দেখে অবাক হয় রেজওয়ান। চৈতি কেসের তদন্তে রুমানার সাথে অনেক কথাই হয়েছিলো রেজওয়ানের। রিসিপশনে কথা বলছে রুমানা। তার পাশে নীল থ্রি-পিস পরনে শ্যামবতী একজন কে দেখে থমকে যায় রেজওয়ান। এই কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখার জন্য মন বড়ই ছটফট করতো তার। চোখের পলকে হারিয়ে গেলো দুজনে। রেজওয়ান দৌড়ে রিসিপশনের কাছটায় এসে চারপাশে তাকাতেই দেখে বামদিকের সিঁড়ি বেয়ে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে উপরে উঠছে রুমানা আর এশা। রেজওয়ানও তাদের পিছুপিছু ছুটে আসে। উচ্চস্বরে ডাক দেয়,
"রুমানা। এই রুমানা।"
তাড়াহুড়ো করে পিছু ফিরে রুমানা। সাথে এশাও। প্রিয় মানুষটাকে এতো বছর পর সামনে দেখে থমকে যায় এশার পৃথিবী। হৃদপিণ্ডের ধুকপুক ধুকপুক শব্দটা বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নিজেকে সামলে নেয় এশা। রেজওয়ান রুমানার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
"এত হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটছো?"
"আপনি খবর পাননি রেজওয়ান ভাই?"
"কিসের খবর?"
"মাহার এ'ক্সি'ডে'ন্ট হয়েছে। বাচ্চাটাও বোধহয় আর বেঁচে নেই।"
"কি!"
বুকটা কেঁপে উঠে রেজওয়ানের। মাহাকে রেজওয়ান ভালোবাসে। এখনো মনের কোণে লুকিয়ে রেখেছে সে ভালোবাসা সযত্নে।
"কোথায় মাহা এখন?"
"২০২ এ"
তিনজনে মিলে ২০২ নং কক্ষে হাজির হয়। মাহাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে। হাতে স্যালাইন। আপাতত চার-পাঁচদিন মাহার বিশ্রাম প্রয়োজন। জেগে উঠলেই পাগলামি করবে মাহা। তখন শরীরে চাপ পড়বে তার। যা সার্থক চাচ্ছেনা। মাহার পাশে বসে আছে সার্থক। চোখদুটো লাল। বিগত তিন-চারদিন চোখের পাতা এক করেনি সার্থক। কেবল চেয়ে দেখেছে। নিশ্চুপ হয়ে নিজের অলকানন্দার হলদেটে ফর্সা মুখটা দেখেছে, ভালোবাসার পরশ বুলিয়েছে। মাথায় হাত বুলিয়েছে। মাহা একবারও তাকে বেহায়া পুরুষ বলেনি। একবারও না। কেন বলেনি! কেন? সার্থকের যে কষ্ট হচ্ছে। ভিষণ ভিষণ কষ্ট।
"ভাইয়া?"
রুমানার ডাকে লাল হওয়া নির্ঘুম চোখে পিছনে ফিরে সার্থক। বড্ড ক্লান্ত সে। জীবনযুদ্ধে সে ক্লান্ত। রুমানা, রেজওয়ান আর এশাকে দেখে উঠে দাঁড়ায় সার্থক। আলতো হাসার চেষ্টা করে তবে তা হয়না। রেজওয়ানের বুকটায় চিনচিনে অসহনীয় ব্যথা শুরু হয়েছে নিস্তব্ধ মাহার মলিন মুখটার পানে তাকিয়ে। এই মেয়ের জন্যই তো নিজের সব সুখ বিসর্জন দিলো সে। তবে আজ কেন মেয়েটার এই দশা!
"ভাইয়া, কোকিল কেমন আছে এখন?"
"কিছুটা সুস্থ।"
ভাঙা গলায় উত্তর দেয় সার্থক। মাহা গভীর ঘুমে। আগামী দু-তিন ঘন্টার পূর্বে ঘুম ভাঙবেনা তার। রুমানা, এশা কতক্ষণ যাবত বসে রইলো মাহার পাশে। রেজওয়ান টুকটাক কথা বললো। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাচ্ছে সে। এতোদিন পর হঠাৎ এশার সাথে দেখা আবার মাহার এমন অবস্থা। অথৈ সাগরে পড়েছে রেজওয়ান। অফিস থেকে জরুরি কল এসেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেজওয়ানের এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে।
"রুমানা কোথায় যাবে?"
"আমরা একটু মালিবাগের দিকে যাবো।"
রেজওয়ানের প্রশ্নে উত্তর দেয় রুমানা। তারও মনটা ভিষণ খারাপ।
"আমার সাথে চাইলে আসতে পারো। আমিও মালিবাগের দিকেই যাবো।"
মাহার ঘুমন্ত মুখপানে তাকিয়ে, সার্থকের উদাস চেহারার দিকে তাকালো রুমানা। একটা মানুষ অপর একটা মানুষকে ঠিক কতটা ভালোবাসলে এমন উদাসীন হতে পারে; সেই ব্যাখা রুমানার কাছে নেই। এশা এ সব কিছুর মাঝেই নিরব দর্শক। নিজের অনুভূতি লুকাতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে মেয়েটা।
"আমরা তাহলে আজ উঠি সার্থক ভাইয়া?"
"হুম"
কোনোমতে ঘাড় ফিরিয়ে কথাটুকু বলে আবার মাহার পানে তাকালো সার্থক। বিগত একঘন্টা কেবল রেজওয়ানের দুয়েকটা কথায় হু হা জবাব দিয়েছে সার্থক। বাকি পুরোটা সময় একধ্যানে তাকিয়ে ছিলো নিজের ঘুমন্ত অলকানন্দার পানে। যেন ঘরে অবস্থিত তিন প্রাণীর প্রতি কোনো আগ্রহই নেই তার। এশা, রুমানা, রেজওয়ান বেরিয়ে পড়লো কেবিন ছেড়ে। এশা, রুমানারও অফিসিয়াল জরুরি কাজ রয়েছে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছুটে যেতে হবে কর্মক্ষেত্রে। রেজওয়ান আলতো করে তাকালো এশার পানে। শ্যামবতী কিশোরী মেয়েটা এখন পরিপূর্ণ রমণী। বিয়ে হয়ে গিয়েছে বোধহয়। চুলগুলো আগের মতোই আছে হাঁটু সমান। গাড়িতে উঠে বসলো তারা। রেজওয়ান নিজেই ড্রাইভ করছে। পিছনে বসেছে রুমানা, এশা। রেজওয়ান কথা বলতে চাচ্ছিলো এশার সাথে। মূলত ক্ষমা চাইতে চাচ্ছিলো এশার কাছে। সুযোগ হয়ে উঠেনি। মালিবাগ আসতেই তড়িঘড়ি করে দুজনে নেমে চলে যায়। রেজওয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের পানে। মাহার জায়গা সারা হৃদয়জুড়ে তবে একটু ফাঁকা জায়গায় বোধহয় নতুন একজন নাম লিখিয়েছে। কিংবা লিখিয়েছিলো অনেক আগেই রেজওয়ান বুঝেনি। সেই নতুনজন কি তবে এশা?
.
.
.
চলবে..........................