অলকানন্দা - পর্ব ৩৬ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!১০১!!

বহুদিন বাদে চৈতির অবয়বের কাউকে দেখছে মাহা। সুবিস্তীর্ণ মাঠ। যেদিকে চোখ যায় কেবল সবুজ আর সবুজ। ধূসর শাড়ি পরনে দূর পাহাড়ের দিকে ছুটে চলেছে চৈতি। মাহা পিছন থেকে চৈতির নাম ধরে ডাকলো। চৈতি থমকে দাঁড়ালো। মাহা দৌড়ে চৈতির কাছে যেতে চাচ্ছে। চৈতি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে মাহা পারছেনা। মাহা চৈতিকে ধরতে পারছেনা। হঠাৎ... হঠাৎ সব অন্ধকার। তীব্র আলোয় চোখ মেললো মাহা। চৈতির হাতে লাল টকটকে গোল জামা পরনে একটা ফুটফুটে বাচ্চা। খুব কান্না করছে বাচ্চাটা। মাহা নিজের পেটে হাত বুলালো। পেট ফুলা না কেন! সার্থকের মতো মুখের আকৃতি আর মাহার গাঁয়ের রঙ বাচ্চাটার। মাহা চিৎকার করে উঠলো। মাতৃ মন বুঝে গেলো বাচ্চাটা তার। মাহা প্রাণপণে দৌড়ে বাচ্চাটাকে ছুঁয়ার চেষ্টা করলো। এগিয়ে চলেছে। এই তো আরেকটু। না, মাহা পারছেনা তো। কেন! কেন মাহা পারছেনা। মাহার মস্তিষ্ক অবশ হয়ে আসছে ক্রমশ। বাচ্চাটা হাত বাড়িয়ে মা, মা করে কাঁদছে। "চৈতি, চৈতিরে আমার বাচ্চা আমাকে দিয়ে দে। আল্লাহর দোহাই লাগে। আমার কলিজাটাকে ছিনিয়ে নিস না। দয়া কর। চৈতি রে।"
কাঁদছে আর ছুটছে মাহা। চৈতি এতো আকুতি মিনতি শুনেও সামনে ফিরে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। মাহা ছুটতে নিবে তাদের পিছু তখনই কেউ একজন আঁকড়ে ধরলো তাকে। মাহা ছটফট করছে। তাকে যে করেই হোক যেতে হবে। তার বাচ্চাটা কাঁদছে। হঠাৎ নাকে এসে ঠেকলো প্রিয় ঘ্রাণ। এটা তো প্রাণপ্রিয় পুরুষটার গাঁয়ের ঘ্রাণ। অবচেতন অবস্থায় মাহা আঁকড়ে ধরলো সার্থক কে। চোখ মেলে তীব্র আলোয় চিৎকার করে উঠলো সে। সার্থক শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাহাকে। মাহা ছটফট করছে। 
"সার্থক, সার্থক আমাদের বাচ্চা চৈতি নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছিনা সার্থক। আমার কষ্ট হচ্ছে। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। আপনি, আপনি তাদের ধরুন সার্থক।"
উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে মাহা। প্রেশার হাই হয়ে স্ট্রোক করার চান্স সর্বোচ্চ। সার্থক শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মাহাকে। চৈতির মৃ'ত্যুর খবর শোনার পর এমনি পাগলামি করতো মাহা। ম'র্গে ছুটে যেতে চাইতো। কত কত রাত নির্ঘুম কাটিয়ে মাহাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে সার্থক! তবে আজ? আজ তো সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে যাবে মাহা। সার্থক কি করে সামাল দিবে! মাহার ছটফটানি বাড়ছে। 
"আপনি কিছু করছেন না কেন? আমার বাচ্চা নিয়ে চলে যাচ্ছে। আর আপনি নিরব?"
মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সার্থক। 
"শান্ত হও মাহা।"
"আমাকে শান্ত হতে বলছেন আপনি! আমার বাচ্চা!"
"বাস্তবতা বুঝতে চেষ্টা করো মাহা। সে চলে গিয়েছে।"

'সে চলে গিয়েছে' কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো মাহা। ছটফটানি কমে গেলো তার। স্থির, নিশ্চল দেহখানা সার্থক কে সঁপে জ্যান্ত লা'শের মতো পড়ে রইলো সে। সার্থক মাহার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একখানা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো সাথে কপালে। 
"একটা গল্প শুনবে মাহা?"

মাহা নিরুত্তর। সার্থক উত্তরের আশা না করেই বললো,
"ছোটবেলা থেকে একাই বড় হয়েছি আমি। আমার কোনো ভাই-বোন ছিলোনা। কানাডার প্রতিদিনকার আর্কটিক বরফাচ্ছন্নের শৈত্যপ্রবাহে আমি আনন্দ খুঁজে পেতাম। প্রজাপতি থেকে শুরু করে চিল প্রতিটা প্রাণীকে জানার প্রবল আগ্রহ ছিলো আমার। ছয় বছর পর্যন্ত আমি ছিলাম একটা প্রফুল্ল মেজাজের বাচ্চা। যে সব কিছুতে আনন্দ খুঁজে পায়। সবার সাথে মিশে। হাসি-খুশি থাকে। কারণ তখনো পর্যন্ত আমি সুন্দর একটা পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠছিলাম। বাবা-মায়ের মাঝে কখনো আমি ঝগড়া দেখিনি। আমার বাবা ডক্টর ফারহান। তাকে খুব ভালোবাসতাম আমি। একসময় আমার মা প্রেগন্যান্ট হন। আমি শুনলাম আমার একটা বোন হবে। ছোট আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম সেদিন। বোন আসবে, বোন আসবে করে মাতিয়ে রাখতাম সারাবাড়ি। তবে ভালো সময়গুলো যে জলদি ফুরিয়ে যায়! বাবা-মায়ের মাঝে হঠাৎ প্রচুর ঝগড়া শুরু হয়। মা লুকিয়ে কাঁদতেন। আমি দরজার পিছনে লুকিয়ে থাকতাম যখন বাবা-মা ঝগড়া করতো। বাবা জিনিসপত্র ভাংচুর করতেন। উচ্চ গলায় মাকে বকতেন। বিশ্বাস করো মাহা আমার, আমার খুব কষ্ট হতো তখন। বাহিরের দুনিয়ার সামনে তারা আদর্শ স্বামী-স্ত্রী অথচ... দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। আবার বলে,
"আমার বাবার এক কানাডিয়ান নার্সের সাথে খারাপ সম্পর্ক ছিলো। মা সেটা মেনে নিতে পারেন নি। আমি আর মা বাইরে বেরিয়েছিলাম সেদিন। বাসায় ফিরে খুবই অন্তরঙ্গ অবস্থায় দুজন কে হাতেনাতে ধরেন মা। বাবা-মায়ের ঝগড়া শুরু হয়। চিৎকার, চেঁচামেচি, ভাংচুর। একসময় বাবা আমার মাকে ধাক্কা দেন। মা ছিটকে নিচে পড়ে চিৎকার করে উঠেন। র'ক্ত মাহা... পুরো ফ্লোর র'ক্তে ভরে গিয়েছিলো মাহা। আমার.. আমার মা যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছিলেন। আ...আমি

কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে সার্থকের। মাহাকে জড়িয়ে রাখা বাঁধন আলগা হতে থাকে। মাহা তা হতে দেয়নি। নিজেই সার্থক কে জড়িয়ে ধরলো সে। সার্থকও তো বাবা হতো। ওর মনেও তো অনেক কষ্ট হচ্ছে। মাহাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তো সার্থক আছে। সার্থক কে সান্ত্বনা কে দিবে! 

!!১০২!!

"আমি পর্দার আড়ালে কেবল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম সেই র'ক্তের পানে। আমার ছোট বোনটা র'ক্তের পিন্ড হয়ে বের হয়ে আসছে। বাবা ঘাবড়ে গেলেন। অনেকক্ষণ বাদে আমার মাকে হসপিটালে নেওয়া হলো। আমার মা সুস্থ হলেন। বাড়ি ফিরলেন। একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন তিনি। যেনো কোনো জীবন্ত লা'শ মাহা। আমার চোখের সামনে আমার পরিবার আস্তে আস্তে ধ্বংস হতে দেখেছি আমি। বাবা দিনের পর দিন বাড়ি ফিরতেন না। মা ঘরে দরজা দিয়ে বসে থাকতেন। একলা আমার সময় কাটতো আকাশ পানে তাকিয়ে। প্রাণবন্ত সার্থক যেন কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রাণহীন সার্থক হয়ে গেলো। আমার দুইখালা কে কানাডা নিয়ে আমার মা ই বিয়ে দিয়েছিলেন। তারা আসতো মাঝেমধ্যে। তখন বাবা-মা খুবই স্বাভাবিক আচরণই করতো। আমার বাবা আমার মাকে ভয় দেখিয়েছিলেন। কানাডিয়ান নার্স বিবাহিত ছিলেন। উনার হাসবেন্ড পুলিশে চাকরি করতেন। তাদের অনৈতিক সম্পর্ক জানাজানি হলে ঝামেলায় পড়তে হতো বাবাকে। সেকারণে আমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে আমার মাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। আমার জীবনটা খুবই অদ্ভুত কেটেছে মাহা। আমার ছেলেবেলা আমার কাছে এক বিভীষিকা। এই ফায়রাজ সার্থকের মনে একসময় অনেক ক্ষত ছিলো মাহা। তুমি আমার ক্ষতের ঔষধ। আমার অবাধ্য জীবনের বাধ্য সূচনা।"

মাহা অশ্রু মিশ্রিত গলায় শুধালো, 
"আমি আপনাকে ভালোবাসি সার্থক। অনেক ভালোবাসি।"
"যদি কখনো শুনো তোমার ভালোবাসার মানুষটা অপবিত্র?"
"ভালোবাসার মানুষেরা কখনো অপবিত্র হয়না সার্থক।"

সার্থক মলিন হাসে,
"এতো বিশ্বাস করো আমায়?"
"নিজের চাইতেও বেশি।"
"এতো ভালো কাউকে বেসোনা কন্যা। 
ভেঙে দিবে তোমার বিশ্বাসের বন্যা।"
"আমি কিচ্ছু জানিনা। বুঝিনা। শুধু জানি আমার ভালোবাসার মানুষটা কখনো কোনো খারাপ কাজ করতে পারেনা।"

বলেই সার্থকের বুকে অশ্রুসিক্ত নয়ন সমেত মুখ গুঁজে দেয় মাহা। সার্থক মাহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আনমনে সুরে শুধায়,
"সারা দুনিয়া করলো পর, তুই করলি আপন। 
ভয় পাই, আমি ভিষণ ভয় পাই তোর ভালোবাসার কাফন।"

সার্থক আনমনা হয়ে উঠে। বারান্দা দিয়ে দিগন্ত পানে আকাশ দেখে। সিক্ত হয়ে উঠে তার নয়ন। মাহা কি মেনে নিতে পারবে প্রিয় মানুষের অপ্রিয় রূপ? 
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন