!!১০৫!!
অনেকদিন বাদে গুলশানের ফ্ল্যাটে মাহার দম বন্ধ লাগছে। সে ছিলো সাথে। এই তো পেটের ভিতরে। নিজের জানান দিতো। নিজের অস্তিত্বের জানান দিতো। সে নাই। মাহার বুকটাকে খালি করে পাড়ি জমিয়েছে অজানায়। আজ সকালেই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে মাহা আর সার্থক। নিভা নেই বাসায়। মাহার ভিষণ ইচ্ছে ছিলো একবার জিজ্ঞেস করবে কেন এমন করা হলো তার সাথে! এমিলিনও বাসায় নেই। সার্থক কে জিজ্ঞেস করতে সে বললো তারা নাকি কানাডা চলে গিয়েছে। সার্থক কি করে তাদের যেতে দিলো! একটা হত্যা করেও নিভা পার পেয়ে যাবে? সার্থক কি নিজের বোন কে কিছুই বলবেনা? এই নতুন সার্থক কে তো মাহা চিনেনা। মাহা রাগ করে সার্থকের সাথে আর কথা বলেনি। বাড়িতে পুরাতন কর্মচারী কেউই নেই। মুইংচিন, মেরি আরো কয়েকটা পুরুষ পরিচারক। কেউই নেই। একটা নতুন মেয়ে আছে কেবল। নাহার নামে। যদিও মাহা তাকে পূর্বে দেখেছিলো। বছর চারেক আগে। মাহা যখন প্রথম এই বাড়িতে আসে তখন। এরপরে কোথায় যেন হারিয়ে যায় নাহার। বিগত বছরগুলোতে মাহা কখনো নাহার কে দেখেনি। রাজকীয় খাটে হেলান দিয়ে নানাবিধ কথা ভেবে চলেছে মাহা। শরীরটা প্রচন্ড দুর্বল। ডক্টর বেড রেস্টের নির্দেশ দিয়েছেন। সার্থকের সাথে রাগ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলো মাহা। এখন মাত্র উঠে বসলো। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো চিন্তাভাবনা।
"মাহা"
ক্লান্ত সার্থকের সুর। হাসপাতাল থেকে ফিরেছে মাত্র। হাতে সাদা এপ্রোন। বাসন্তী রঙের শার্ট আর জিন্স প্যান্ট পরনে লোকটাকে প্রানবন্ত লাগছে অনেক। ঝাঁকড়া চুলের মানবটা যেন পুরোদমে স্বাভাবিক। মাহা জবাব দিলোনা। মুখ ঘুরিয়ে ফেললো অপরদিকে। সার্থক বার কয়েক ডাকলো। মাহা সাড়া দেয়নি। সার্থকেও আর ডাকেনি। আলমারি থেকে কাপড় বের করে ফ্রেশ হতে চলে গিয়েছে। মাহার মনঃক্ষুণ্ন হলো এবার। অভিমান হলো খুব। চুপচাপ মাথাটা হেলিয়ে দেয় বালিশে। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নিশ্চুপ নোনাজল। কিছুক্ষণ বাদেই সার্থক খালি গাঁয়ে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরনে হাজির হয় মাহার সামনে। মাহা ডান হাত কপালের উপর রেখে শুয়ে আছে। সার্থক খাটের পাশে বসে। মাহা টের পেলেও কোনো সাড়া দেয়নি।
"আমি কি করেছি, মাহা? এমন করছো কেন?"
মাহা নিশ্চুপ।
"তুমি আমার সাথে কথা বলছো না কেন?"
আর চুপ থাকতে পারলোনা মাহা। মুখ খুললো এবার। শান্ত, কান্না মিশ্রিত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললো,
"আপনি জানেন না? আমি আমার বাচ্চা হারিয়েছি সার্থক। আপনি আপনার বোনকে কেন কিছু বলেন নি?"
সার্থক চুপ করে আছে। 'মাহা যদি তুমি জানতে! সন্তান হারানোর প্রতিশোধ এই সার্থক নেয় কি নেয়নি!' মনে মনে আওড়ায় সার্থক।
"কি হলো কথা বলছেন না কেন আপনি? জবাব দিন সার্থক। আমার উত্তর চাই।"
চিৎকার করে উঠে মাহা। সার্থক শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাহাকে। পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,
"শান্ত হও, মাহা। প্লিজ এমন পাগলামি করো না।"
মাহা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
"আমার উত্তর চাই সার্থক!"
"আমি তোমাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাওয়ার পরই নাকি নিভা, এমিলিন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমি বাড়ি ফিরে নিভাকে পাইনি। বিশ্বাস করো মাহা। নিভাকে হাতের কাছে পেলে আমি খু'ন করতাম। আমিও তো সন্তান হারিয়েছি।"
মাহা কতক্ষণ সার্থকের বুকে মাথা রেখে কাঁদলো। মানুষটাকে ভুল বুঝেছিলো সে।
"কান্না অফ করো প্লিজ। তোমার ক্রন্দন মুখ আমি সহ্য করতে পারিনা মাহা।"
বলেই মাহার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো সার্থক। মাহা এতক্ষণে শান্ত হয়েছে কিছুটা। বুকের ভার কমেছে।
"বারান্দায় যাবে?"
"ইচ্ছে করছেনা।"
"তোমার জন্য একটা উপহার এনেছিলাম।"
"কি উপহার?"
"চলো, দেখাচ্ছি।"
বলেই মাহাকে কোলে তুলে নিলো সার্থক। খোলামেলা বৃহৎ বারান্দা। হরেকরকম তরুর মেলা। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে। বারান্দার মাটিতে পেতে রাখা বিছানায় মাহাকে আলতো করে নামিয়ে দিলো সার্থক। মাহা চোখ বুজে আছে। এত উৎকন্ঠা, চিন্তা সবকিছু ছাপিয়ে আজো সার্থকের কাছাকাছি আসলে মাহা লজ্জা পায়।
"মাহা, চোখ খুলো।"
চোখ খুলেই চোখের সামনে জিনিসটা দেখে ছলকে উঠে হৃদপিণ্ড। একটা বীণা। কতদিন বীণা বাজানো হয়না। গান গাওয়া হয়না। মাহার গানের গলা এতটাই শ্রুতিমধুর যে তার বান্ধবী রুমানা তাকে কোকিল বলে ডাকতো। জীবন ছন্দের আড়ালে আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেলো সেই সুর। সেই গান। মাহার কোলে আলতো করে মাথা রাখে সার্থক। "বাজাবেনা বীণা? তোমার বান্ধবী রুমানার কাছে শুনলাম তুমি নাকি বীণা বাজাতে পারো? আমাকে তো কখনো বলোনি।"
"সময় হয়ে উঠেনি।"
"আজ বাজাবে একটু? একটা গান শুনাবে?"
"এতোদিন পরে। সব ভুলে গিয়েছি। তাছাড়া গলাও তো ভালোনা।"
"উফ্ মেয়ে! আমিই তো।"
সার্থক উঠে মাহার কাছে এগিয়ে দেয় বীণা। মাহা হাত বুলায় বীণাতে। পুরনো স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। মা খুব ভালো বীণা বাজাতেন। ছোটবেলায় মাহা ছাদে মায়ের বীণা বাজানো শুনতো। স্মৃতিগুলো আজ আবছা আবছা।
!!১০৬!!
মন খারাপ। প্রিয় জিনিসটা সামনে পেয়েও সুর তুলতে ইচ্ছে করছেনা।
"মাহা, আমাকে বাজিয়ে শোনাবেনা?"
সার্থকের আকুতি। মাহা ভগ্ন হৃদয়ে আবারও হাতে তুলে নেয় বহুদিনের পুরানো বন্ধুকে। কান্নার ফলে গলা ভেঙে আছে। মাহা চোখ বন্ধ করলো। বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ চিড়ে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। ঝিঁঝির ডাক নেই। নিস্তব্ধতা। মন দুলানো স্নিগ্ধ পবন। বীণার তারে তারে সুর তুলছে মাহা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের,
আমিও পথের মত হারিয়ে যাব
আমিও নদীর মত আসবোনা ফিরে আর
আসবোনা ফিরে কোনদিন
আমিও দিনের মত ফুরিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর আসবোনা ফিরে কোনদিন
মন আমার বাঁধলো বাসা ব্যাথার আকাশে
পাতা ঝড়া দিনের মাঝে মেঘলা বাতাসে।
আমিও ছায়ার মত মিলিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর আসবোনা ফিরে কোনদিন
যাবার পথে পথিক যখন পিছন ফিরে চায়
ফেলে আসা দিনকে দেখে মন যে ভেঙ্গে যায়।
চোখের আলো নিভলো যখন মনের আলো জ্বেলে
একলা এসেছি আমি একলা যাব চলে।
আমিও সুখের মত ফুরিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর.....
শেষের চরণটুকু আর গাইতে পারলোনা মাহা। সে হারিয়ে গিয়েছে। পথের মতো। আর কখনো ফিরে আসবেনা বাবা-মায়ের কোলে। আজ নিজের বাবা-মা, চৈতিকেও খুব মনে পড়ছে মাহার। সার্থক মাহাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো কপালে। চোখের পানি শুষে নিতে নিতে বললো,
"আমি আছি। থাকবো। নিজের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার থাকবো। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া পৃথিবীর কোনো শক্তি তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবেনা, অলকানন্দা।"
ফিসফিসিয়ে বলা কথা। হয়তো মাহা শুনেছে কিংবা শুনেনি।
"ওকে কোথায় কবর দিয়েছেন সার্থক? আমাকে একবার নিয়ে যাবেন? আমার বুকটা ভিষণ ফাঁকা লাগছে সার্থক।"
_________________
বিছানার সামনেই বড় জানালা। বিছানায় শুয়ে পা দুটো জানালার গ্রিলে তুলে বাইরের বৃষ্টি দেখতে মগ্ন এশা। সেদিন এতো রিয়েক্ট করা বোধহয় ঠিক হয়নি। পুলিশটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনে গিয়েছে কেবল। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ভাবা যায় এএসপি রেজওয়ান এশার কাছে ক্ষমা চেয়েছে! ইহা ভারি আশ্চর্য ঘটনা! লজ্জায় লাল হয় শ্যাম দুটো কপোল। এই তো সেদিন....
.
.
.
চলবে.......................