অলকানন্দা - পর্ব ৩৯ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!১০৭!!

"সেই কখন থেকে আপনি আমার পিছন পিছন আসছেন। আপনার সমস্যাটা কি?"
"কোনো সমস্যা নাই। তোমার ব্যাগটা আমার কাছে। এটা নাও।"

বলেই ব্যাগটা এগিয়ে দেয় রেজওয়ান। 'ওহ্, খালি ব্যাগ ফেরত দিতেই এসেছে আর আমি কত কি...'
মনে মনে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এশা। ব্যাগটা হাতে নেয় সে। দুজনেই দাঁড়িয়ে। কেটে গিয়েছে সহস্র সময়। কোনো কথা কারো মুখে নেই। একজনের মনে সুপ্ত অভিমান আরেকজনের অপরাধবোধ। কিছু বলতে গিয়েও আমতা আমতা করছে রেজওয়ান। 
"কিছু বলবেন?"
"না মানে হঠাৎ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলে কেন?"
"দেশে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, তাই।"
"এখন কোথায় মানে এখন কি কোথাও কর্মরত আছো?"
"হ্যাঁ, সিলেটে একটা কোম্পানিতে আছি।"
"ওহ্, তারমানে সিলেট থাকো এখন? ঢাকায় কতদিন আছো?"
"হুম। থাকবো আর কিছুদিন। আরো কিছু বলবেন?"
"তাড়া আছে?"
"ছিলো একটু।"
"একটা কথা বলতাম মানে আসলে... 
" এএসপি রেজওয়ান কে তোতলানো মানায় না। বলুন কি বলবেন। সরাসরি বলুন।"

মেয়েটা আগের চেয়ে অনেকটা বদলে গিয়েছে। কি তেজ কন্ঠে! থতমত খায় রেজওয়ান। দীঘল চুলের শ্যামবতী পরিপূর্ণ নারী। ধারালো যার কন্ঠস্বর। এলোমেলো বেণী করে রাখা হাঁটু সমান চুলগুলোতে। 
"তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছো, এশা?"
"আশ্চর্য! আমি আপনার উপর রেগে থাকবো কেন?"
"ঐদিনের ঐ আচরণের জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত এশা। কাজটা সঠিক হয়নি আমার। তখন এতটা স্ট্রেসের ভিতর ছিলাম।"
"সমস্যা নেই মিঃ রেজওয়ান। আপনি আমার এতোটা কাছের মানুষও নন যে এতটুকু কারণেই আপনার উপর রাগ করা লাগবে। আমার তো সেই ঘটনা মনেও নেই।"
এশার হেয়ালি করা কথাটা যেন তীরের মতো রেজওয়ানের বুকে আঘাত করলো। এই মেয়েটাকে রেজওয়ান ভালোবাসেনা। ভালোবাসা সব ঐ একজনকে ঘিরে। কিন্তু তবুও কেমন যেন একটা টান মেয়েটার প্রতি। রেজওয়ান দাঁড়িয়ে রইলো কিছু সময়। কথা হয়নি দুজনাতে। মৃদু হিমেল বাতাস বইছে। 
"আজ তাহলে আসি মিঃ রেজওয়ান। ভালো থাকবেন।"

রেজওয়ান কে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সম্মুখে অগ্রসর হয় এশা। মুখে বিশ্বজয়ী হাসি। এইতো চাচ্ছিলো সে। গত চারটা বছর অনলে পুড়েছে হৃদপিণ্ড। পছন্দের মানুষের কাছে অপমানিত হওয়ার দুঃখ যে ঠিক কতটা। কতটুকু গভীর, কতটুকু জ্বালাময়ী! আহ্! রেজওয়ান যদি তুমি এই অনল বুঝতে। একতরফা ভালোবাসা বুঝতে তাহলে হয়তো স্বয়ং লেখিকারও তোমাদের নিয়ে এত ভাবতে হতোনা। বর্তমানে ফিরে এশা। হঠাৎ করেই ভিষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। বিগত বছরগুলোতে সেই বিদেশি ভাটিতে কেমন করে পড়েছিলো এক এশা জানে আর তার সৃষ্টিকর্তাই জানে। ক্ষমা করবেনা এশা। এত সহজ সবকিছু? 

_____________

বাইরে ঘোর অন্ধকার। একটানা বৃষ্টি। কেমন যেন বৃষ্টির শব্দটা। একঘেয়ে। কানে তব্দা লাগানো। ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম। গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। মনে হয় দূরে কোনো অশরীরী ডাকছে। হাত বাড়িয়ে। গুলশানের বহুতল ভবনের ডুপ্লেক্স বাড়ির বারান্দায় পাগলামি করছে এক নারী। এই ঘোর অন্ধকার রাতে সে কবরে যেতে চাচ্ছে। সার্থক ঝাপটে ধরে আছে মাহাকে। মাহা কোনোমতেই মানতে চাচ্ছেনা। সে এখনই যাবে। 
"আপনি একটা পাষাণ। আপনি বাবা হয়ে এমন করছেন! আমি যাবো। এখনই নিয়ে চলুন আমায়।"
"মাহা, শান্ত হও। এতরাতে কবরস্থানে যাওয়া ঠিক হবেনা মাহা। তাও নাহয় যেতাম। বাইরে যে এত বৃষ্টি?"
"আপনি কেন এত বাহানা দিচ্ছেন সার্থক? আপনি, আপনি একটা নিষ্ঠুর।"
"আমি পাষাণ, আমি নিষ্ঠুর। সব মানলাম। একটু শান্ত হও মাহা।"
"শান্ত হতে বলছেন আমায়? আমি কি করে শান্ত হবো? আমার মেয়েটা হাত বাড়িয়ে ডাকছে। আমাকে যেতেই হবে।"
"না, তুমি যাবেনা।"
"আপনি আমায় ছাড়ুন। আমি যাবোই। নয়তো আমি আমার জীবন দিবো আজ।"
"মাহা!"

যা কোনোদিন হয়নি তাই হয়েছে আজ। সার্থক মাহার হলদেটে লালচে হয়ে আসা গালটা ছুঁয়ে বলে,
"আমি কি করলাম এটা মাহা। আমি এটা কি করলাম!"

মাহা নিজের গাল থেকে সার্থকের হাতটা সরিয়ে দেয়। লালচে হয়ে আসে তার চোখ। অভিমানে গাঢ় হয় মুখমন্ডল। তবুও পাগলামি করে মাহা। তাকে যে যেতেই হবে। সার্থক একা হাতে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মাহাকে। ওর অর্ধেক ওজনের মেয়েটার শরীরে আজ যেন কোনো পিশাচের শক্তি ভর করেছে। মাহাকে জোর করে ঘরে নিয়ে এসেছে সার্থক। মাহা পাগলামি করেই যাচ্ছে। তার যেতেই হবে আজ। হঠাৎ করেই বৃষ্টি থেমে গেলো।

!!১০৮!!

হুম, একেবারে হঠাৎ করে। নিস্তব্ধতা চারপাশে। ঘড়ির টিকটিক আওয়াজের মাঝেই ঢং ঢং শব্দ জানান দেয় রাত তিনটা বাজে। মাহার হাতদুটো ওড়না দ্বারা বেঁধে দেয় সার্থক। ছোট টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে তাড়াহুড়ো করে কিছু একটা খুঁজতে ব্যস্ত সে।
"বৃষ্টি তো থেমেছে। এবার নিয়ে চলুন আমাকে। ও ডাকছে। কষ্ট হচ্ছে ভিষণ। আপনি না ওর বাবা?"

সার্থক জবাব না দিয়ে একমনে খুঁজে যাচ্ছে ইনজেকশনটা। 
"কি হলো জবাব দিন? যাবেন না আপনি? আমি যাচ্ছি তবে। আমার হাত বেঁধে আপনি আমাকে আটকে রাখতে পারবেন না।"
বলেই উঠে দাঁড়ায় মাহা। ছুটে যায় দরজার কাছে। সার্থকও দৌড় দেয় মাহাকে ধরতে। পিছন থেকে ঝাপটে ধরে মাহাকে।
"ছাড়ুন আমায়। আমি যাবোই।"

চিৎকারে কানে তব্দা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। সার্থক সবক্ষেত্রে কঠিন হলেও মাহার বেলায় সে ধীরস্থির, নরম, কোমল, ধৈর্যশীল, শান্ত। 
"চুপ মাহা। আর একটা কথা বললে তুমি আমার মরামুখ দেখবে।"

অসহায় হয়ে আসে লালচে অভিমানী চোখজোড়া। এটা কি শুনালো সার্থক! এতক্ষণের পাগলাটে মাহা যেন একেবারেই শান্ত, নিরব, নিশ্চল। একটা মাংসপিণ্ডে বেস্টিত পাথরে মূর্তি। মাহাকে নিয়ে খাটে বসিয়ে তার হাতে আলতো করে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে সার্থক। নেতিয়ে আসে মাহার চোখজোড়া। কয়েকঘন্টার জন্য অন্ধকার জগতে পাড়ি জমায় সে। ঘুম নেই কেবল সার্থকের চোখে। ভালোবাসা! কি অদ্ভুত এই ভালোবাসা। নরপিশাচকেও মানুষে পরিণত করে দিতে পারে! যার অন্তরে বিন্দুমাত্র ভালোলাগা, ভালোবাসা ছিলোনা সেই বুকে ভালোবাসার উদ্রেক জাগিয়ে, সবকিছু নিঃশেষ করে কেন পাগলামি করছে জ্বালাময়ী নারী! এ কি তবে কৃতকর্মের ফল? এতটা যন্ত্রণাময়? 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। আলমারি থেকে নিজের এবং মাহার কিছু কাপড় গুছিয়ে লাগেজে তুলে নেয়। মাহাকে কোনোভাবেই কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। পাগলামি করবে। বাচ্চাকে দেখতে চাইবে। তারপর হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোক করতে পারে। সার্থক কোনোক্রমেই তা চায় না। তাই তো আজ রাতেই এই শহর ছেড়ে, কৃত্রিমতা ছেড়ে পারি জমাবে সিলেটে। যদিও পিছুটান থাকবে তবুও ভালো থাকবে মাহা। সার্থকের অলকানন্দা। এটা কি তবে গল্পের নতুন অধ্যায় নাকি সমাপ্তির ঘন্টা?
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন