সারল্য'র পরিবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে জাহ্নবীর বাসায় আসতে চায়। কথাটা ভায়োলেট নিজেই জানালো বাবা মাকে। শুরুতেই মুখ অন্ধকার করে ফেললেন পারভীন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, 'শেষ পর্যন্ত একটা ডিভোর্সি ছেলে? এত বছর ধরে আত্মীয় স্বজন সবার কথা শুনতে শুনতে আমার কান পঁচে গেছে। আমি কারও বাসায় যাইনা, কারও সাথে কথাও বলিনা। মেয়ে বিয়ে দেইনা কেন এই এক কথা সবার। এখন এই বয়সে এসে এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলো যার আগেও একবার বিয়ে হয়েছে, ছাড়াছাড়িও হয়েছে, বাচ্চাও আছে। আমি আর কারও সামনে মুখ দেখাতেও পারবো না। সেই অবস্থাও আর থাকবে না।'
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইলেন পারভীন। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ওনার। জাভেদ আলী শান্ত গলায় বললেন, 'এভাবে চিন্তা করো না তো। মেয়েটা বিয়ে করতে রাজি হয়েছে এটাই অনেক। সে যাকে নিয়ে সুখী হতে চায় হোক। তার জীবন, তার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে।'
'তোমার জন্যই নষ্ট হয়েছে ওরা। খালি স্কুল কলেজে ভালো রেজাল্ট করলেই হয়না। সমাজের নিয়ম কানুন মেনে চলা লাগে। মানুষের কাছে মান সম্মান কিচ্ছু নাই আমাদের।'
জাভেদ আলী উত্তেজিত হলেন না। বরং আগের মতোই শান্ত স্বরে বললেও বললেন, 'মান সম্মান নেই সেটা তোমার ভুল ধারণা। অনেকদিন পর দেখা হলে আত্মীয় স্বজন বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করবেই। জাহ্নবীর বিয়ে হয়েছে শুনলে সবাই খুশিই হবে। ছেলের ডিভোর্স হয়েছে না কী হয়েছে এসব নিয়ে কে মাথা ঘামাবে এখনকার দিনে?'
পারভীনের রাগ আরও খানিকটা বেড়ে গেল, 'তোমার এসব চিন্তা ভাবনার জন্যই মেয়েগুলোকে মানুষ করতে পারো নাই। একটাও হইছে মানুষের মতো মানুষ? বড় জনকে এত বছরেও বিয়ের জন্য রাজি করাইতে পারি নাই। এখন এসে তিনি জানালেন ডিভোর্সি একটা ছেলেকে বিয়ে করবেন। আরেকজনের কথা কি বলবো, ছেলের সঙ্গে এনগেজমেন্ট হইছে সেটা দুনিয়ার সবাইকে জানাইছি। তারপর তিনি বললেন ওই ছেলের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নাই তার। তাহলে এতদিন নাটক করার কী দরকার ছিল? বাপ মাকে বোকা বানিয়ে ওরা মজা নেয়। জীবনে শিক্ষা দিতে পারলাম না মেয়েগুলোকে।'
জাভেদ আলী নিজেকে শান্ত রাখলেন, 'দেখো পারভীন। আমার মেয়েদের কেউ খারাপ বলতে পারবে না। ওরা হয়তো শুধু বিয়ে নিয়েই আপত্তি করেছে, এটা দোষের কিছু না। সবার যে বিয়ে করে সংসারী হওয়ার মনোভাব থাকবে এটা ভুল ধারণা। আমরা নিজেরাই তো সারাজীবন বলে এসেছি বিয়ে করে ভুল করেছি। ওরা যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে চায় নেবে। এতে আমি আগেও কথা বলিনি, এখনও বলবো না।'
পারভীন উঠে পড়লেন। স্বামীর ওপরেই এখন ওনার সব রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই লোকটার সঙ্গে সংসার করা বৃথা। তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
ভায়োলেট বিব্রতবোধ করছে। জাভেদ আলী ভায়োলেটকে শান্ত গলায় বললেন, 'তুই চিন্তা করিস না। এই সপ্তাহেই একদিন ওদেরকে আসতে বল। আমরা কথাবার্তা বলি, পরিচিত হই।'
'বাবা, মা যদি জানতে পারে আমি তোমার কাছে বিশ লাখ টাকা নিয়েছি তাহলে তো হার্টফেল করে মরবে।'
জাভেদ আলী হেসে বললেন, 'ও চিরকালই ওরকম। ওর কথা বাদ দে। জাহ্নবীর সঙ্গে আমি কথা বলবো। সময় করে ওরা আসুক। তোর মাকে আমি দেখছি।'
'মা খুব রেগে গেছে। বিয়েটা হলেও মা'র ইচ্ছের বিরুদ্ধে হবে।'
'তাতে কীইবা আসবে যাবে? জাহ্নবী আমার খুব শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে। জীবন নিয়ে ওর কোনো চাহিদা নাই। ছোট থেকে সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখত। কখনো কিছু চাইতো না, কোনো খরচ করতো না, মন দিয়ে পড়াশোনা করতো। নিজেকে কখনো বুঝতে দেয়নি কাউকে। আমার মেয়েটা যখন নিজে থেকে কাউকে বিয়ে করতে চাইছে, আমার পুরো সাপোর্ট পাবে। এখানে আত্মীয় স্বজন কে কী বলল আমার দেখার বিষয় না। এখন যদি সিনেমার নায়কের সঙ্গেও বিয়ে দেই, তারা নায়ক দেখে খুশি হবেনা। উলটো বলবে ছেলেটা ছবিতে রোল করে, এদের চরিত্র ভালো হয় না। মানুষের কথায় এজন্যই আমি কান দেই না।'
ভায়োলেটের ইচ্ছে করল বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু ধরলো না। মুগ্ধ হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল সে। জাভেদ আলী খুশি হয়েছেন। প্রতিটা বাবাই চান মেয়েকে সুখী দেখতে। তিনি হয়তো কল্পনায় মেয়ের সুখী সুখী একটা সংসার দেখতে পাচ্ছেন।
পারভীন আরও কয়েকদিন রাগ করে রইলেন। কারও সাথে তেমন কথা বললেন না। জাভেদ আলী বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলেন বিয়ের ব্যাপারে। প্রত্যেকবারই বিষয়টাতে বিরক্তি প্রকাশ করলেন তিনি। সবসময় একটাই উত্তর দিলেন, 'যার যা ভাল্লাগে করো। আমার কী?'
জাভেদ আলী বুঝলেন পারভীনকে আর বুঝিয়ে লাভ নেই। বিয়েটা হয়ে গেলে যখন মেয়ের আনন্দোচ্ছ্বাস দেখবে, নিজেই আশির্বাদ করবে মেয়েকে। তিনি একটা দিন ঠিক করে ছেলেপক্ষকে আসতে বললেন।
জাহ্নবী আগের দিন সন্ধ্যাতেই বাড়ি চলে এসেছে। পারভীনের খুব একটা মত নেই সেটা ভায়োলেট আগেই বলেছে তাকে। জাহ্নবী অবাক হয়নি। সে জানতো মা রাজি হবেন না। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে রাজপুত্র এলেও মা এমন গোমড়া মুখে করে থাকতেন। ওনার অদ্ভুত চরিত্র সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা আছে।
সকাল থেকে মেহমানদের জন্য খাবারের আয়োজন শুরু হল। পারভীনের মুখ অন্ধকার। তাকে জোর পূর্বক রান্নাঘরে নিয়ে আসার ইচ্ছেও নেই জাহ্নবীর। তাই সে নিজেই গতকাল জাভেদ আলীকে বাজারের লিস্ট করে দিয়েছে। সকাল হতেই রান্নার আয়োজন শুরু করেছে সে। উত্তেজনায় সারা রাত ঘুম হয়নি। ক্রমশ হাত পা কাঁপছে। অস্থিরতায় এঘর ওঘর করছিল কেবল। এভাবেই রান্নার প্রস্ততি নিচ্ছে সে।
সকালে উঠেই পারভীনকে জিজ্ঞেস করেছিল, 'মা, কী কী রান্না করবে?'
পারভীন উত্তর দেননি। উত্তরের আশাও করেনি জাহ্নবী। সে জাভেদ আলী, সামার ও ভায়োলেটকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, 'সবাই মতামত দাও কী কী রান্না করবো?'
প্রত্যেকেই যে যার মতো দু একটা খাবারের আইটেম বলে দিলো। সকাল সকাল দুটো ডেজার্ট রেডি করে ফ্রিজে রেখে দিলো জাহ্নবী। এরপর গরুর মাংস মেরিনেট করে রাখল। ভায়োলেট মশলা বাটতে তাকে সহায়তা করছে। রান্নাবান্নার কাজে একদমই নেই সামার। সে ঘুরে ঘুরে বাদাম, কিশমিশ খাচ্ছে আর কখনোবা টিভির সামনে সোফায় পা দুলিয়ে বসে মোবাইলে চোখ রাখছে। এসব নিয়ে আক্ষেপ নেই জাহ্নবী'র। সে আপন মনের আনন্দ নিয়েই রান্না করছে। ভায়োলেট কিছু মিষ্টি খাবারের রেসিপি খুঁজছে ইউটিউবে। দুই বার্নারের চুলায় একদিকে রান্না বসিয়েছে জাহ্নবী। অন্য চুলায় ভায়োলেট রেসিপি দেখে চেষ্টা করছে বানানোর।
রান্নার ফাঁকে দৌড়ে দৌড়ে জাহ্নবী ঘরের আসবাবপত্র মোছামুছি করছে। গুছিয়ে রাখছে পুরো ঘর। জাভেদ আলী অস্থির চিত্তে পায়চারি করছেন। সামারকে দেখতে অর্ণবের পরিবার এ বাড়িতে এলেও তখন এমন অনুভূতি হয়নি ওনার। আগেও বহুবার পাত্রপক্ষ এসেছে এ বাড়িতে। জাহ্নবীকে দেখতে বহু সম্বন্ধই এসেছে। কিন্তু কই, আগে তো এমন লাগেনি। এবার সত্যি সত্যি বিয়ের আমেজ টের পাচ্ছেন তিনি।
দুপুরের পরপরই পারভীন আর নিজের ঘরে থাকতে পারলেন না। রান্নাঘরে এসে ঢুকলেন। কোনোকিছুতে হাত দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিঃসংকোচে জাহ্নবী এক চামচ তরকারি তুলে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'মা দেখো তো লবণ ঝাল ঠিক আছে?'
পারভীন অবাক হলেন। জাহ্নবীর আচরণে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। তিনি তরকারি চেখে দেখলেন। লবণ একটু কম হয়েছে। তবে সেটা মুখে না বলে নিজেই লবণের বয়াম থেকে খানিকটা লবণ মিশিয়ে দিলেন তরকারিতে।
জাহ্নবী বলল, 'তোমাকে একটু ভাত দেই মা? ভাত হয়নি এখনো। পোলাও হয়েছে। একটু পোলাও খাও?'
পারভীন একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, 'তোরা খাইছিস?'
'না।'
'তরকারি তো হয়েছে। রেজালা আমি বানাই। তোরা দুইবোন অল্প করে খেয়ে নে। তোর বাবাকেও দে।'
জাহ্নবী মনেমনে অবাক হল, আবেগে চোখ ভিজে আসতে চাইলো। কিন্তু সেটা কাউকেই বুঝতে দিলো না। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, 'তুমিও আমাদের সঙ্গে খাও। টেবিলে খাবার দেই। খেয়েদেয়ে রান্না কোরো।'
জাহ্নবী পারভীনের উত্তরের আশায় না থেকে পোলাওয়ের পাতিল নিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর রাখল। সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খেলে মায়ের রাগটা পড়ে যাবে।
কিন্তু টেবিলে আসলেন না পারভীন। তিনি ব্যস্ত হয়ে রান্নার জোগাড় করতে লাগলেন। ভায়োলেট ওনাকে ডাকতে গেলে তিনি বললেন, 'পোলাও সব আমরা খেয়ে ফেললে মেহমান খাবে কী?'
জাহ্নবী বলল, 'আবার রান্না করবো। তুমি আসো তো।'
দুইবোন পারভীনকে ধরে নিয়ে এসে টেবিলে বসালো। খাবার খেতে খেতে জাভেদ আলী বললেন, 'ফলমূল আর কিছু আনবো?'
ভায়োলেট বলল, 'বাবা, ড্রাগন ফ্রুটস নিয়ে এসো আর স্ট্রবেরি।'
'ওদেরকে ফোন করেছিলি? কখন আসবে জানায়নি কিছু?'
জাহ্নবী লাজুক স্বরে উত্তর দিলো, 'গতকাল তো বলেছিল সন্ধ্যার দিকে আসবে।'
'আজকে আর কথা বলোনি? এক্ষুনি ফোন দাও। সুন্দর করে জিজ্ঞেস করো কখন আসবে। মেহমান আসবে বাসায়, আগ্রহ না দেখালে কী ভাব্বে? একবার ফোন করো।'
'আচ্ছা বাবা।' মৃদু স্বরে বলল জাহ্নবী।
'আর তুমি ভাত খেয়ে উঠে কিছুক্ষণ রেস্ট নাও। ক্লান্ত হয়ে গেছো। পারলে ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নাও। তারপর গোসল করে পরিপাটি হয়ে থাকো। বাকি রান্নাবান্না তোমার মা করবে।'
জাহ্নবী মাথা নিচু করে রইল। আর কেউ কোনো কথা বললো না। বাকি খাবারটা শেষ হল নিরবে।
জাহ্নবী যখন আবারও এসে রান্নাঘরে ঢুকল, তখন পারভীন বললেন, 'তোর আব্বা কী বলছে শুনিস নাই?'
মায়ের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে জাহ্নবী নিজের ঘরে চলে এলো। কিন্তু ঘুম এলো না তার। ক্লান্ত হলেও সেটা নিজেই বুঝার উপায় নেই। অস্থির অস্থির লাগছে। গত কয়েকদিনে সারল্য'র সঙ্গে তার সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। খুব আপন আপন লাগে মানুষটাকে। আজ সে আসবে বিয়ের কথা বলতে। এইমুহুর্তে কী করে ঘুমাতে পারবে সে!
সারল্য ও তার পরিবার এলো সন্ধ্যা নামার খানিক আগেই। মা, বোন, নাদির ও তার পরিবার আর শার্লিনের শ্বশুরমশাই। জাহ্নবী শাড়ি পরেছে। তাকে জোর করে সাজগোজ করিয়ে দিয়েছে সামার ও ভায়োলেট। সে তো কিছুতেই সাজবে না। এতদিনের পরিচিত মানুষদের সামনে সেজেগুজে যেতে লজ্জা লাগছিল তার।
সারল্য'র মা কোনো আনুষ্ঠানিক কথাবার্তার ধারেকাছেও গেলেন না। এমনভাবে সবার সঙ্গে মিশতে লাগলেন যেন তিনি সত্যিই জাহ্নবীর খালা। নাস্তা খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই তিনি সারল্যকে বললেন, 'নে, এটা পরিয়ে দে ওকে।'
সারল্য অবাক হয়ে দেখল মায়ের হাতে লাল ভেলভেট বাক্সে জ্বলজ্বল করছে একটা হিরের আংটি। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে সে একবার শার্লিনের দিকে তাকাল। এটার কথা সে জানতো না।
মা বললেন, 'ওর দিকে কী দেখছিস? আমি কিনেছি এটা। ছেলের বিয়ে পাকা করতে আসবো আর আংটি আনবো না? আমার পরিবারের একটা ঐতিহ্য আছে।'
সারল্য লাজুক হেসে মাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর ধীরেধীরে হাত বাড়িয়ে জাহ্নবী'র হাতটা ধরলো সে। লজ্জার রঙিন আস্বাদনে রাঙা হয়ে উঠল জাহ্নবী। সারল্য আলতো করে তার আঙুলে আংটি পরিয়ে দিলো। জাহ্নবী হাতের দিকে তাকালো। স্থিরচোখে আঙুল টাকে দেখতে লাগল সে। আগে কখনোই সে আংটি পরেনি। মুগ্ধ হয়ে দেখল তার সরু আঙুলে উজ্জ্বল হয়ে আছে একটা আকর্ষণীয় ডায়মন্ড রিং!
.
.
.
চলবে..........................................................................