সপ্তাহ খানেক পরেই খুব সাদামাটা ধাচে সারল্য ও জাহ্নবী'র বিয়েটা হয়ে গেল। ঘরোয়াভাবে আয়োজন করা হলো বিয়ের। কেবল দুই পরিবারের উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো হয়েছে। আত্মীয় স্বজন তেমন কাউকে ডাকা হয়নি। তবে এরমধ্যেই অনেক কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে কাছের ও দূরের আত্মীয়দের কাছ থেকে। কেউবা বলছে, জাহ্নবী এক বাচ্চার বাপকে বিয়ে করেছে তাই কাউকে বিয়েতে দাওয়াত করেনি। আবার কেউ বলছে, এই বুড়ি বয়সে বিয়ে করেছে এইতো অনেক, দাওয়াত দিবে কিসের দুঃখে? এমন নানান কথা কানে আসছে পারভীনের। তিনি কষ্ট পেয়েছেন কারণ তার বাবার বাড়ির কাউকে অন্তত দাওয়াত করা উচিৎ ছিল। মেয়েরা তার বাবার সঙ্গে বুদ্ধি করে কাউকে দাওয়াত দেয়নি। অবশ্য পরিস্থিতি শুরুতে এমন ছিল না। ওনার ভাইকে ফোন করে বলা হয়েছিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোড়ন কেটে বলেছেন, এত্ত ভালো ভালো বিবাহের সম্বন্ধ নিয়ে গেছিলাম। মাইয়ার দেমাগ, রাজি হইল না। শেষ পর্যন্ত এই বয়স্ক পোলা, তাও বিয়াইত্তা? - এমন কথা শুনেই জাভেদ আলী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কাউকেই দাওয়াত করবেন না। পাছে বিয়েটা অশান্তিতে পরিণত হয়, সেই ভয় পাচ্ছিলেন তিনি।
বিয়ের পরই জাহ্নবীকে নিয়ে এলো সারল্য'র পরিবার। খয়েরী কাতান শাড়িটাতে খুব মিষ্টি লাগছে তাকে। হাতভর্তি কাঁচের লাল চুড়ি, অন্য হাতে স্বর্ণের বালা। জাহ্নবীর শাশুড়ী এই চুড়ি দুটো দিয়েছেন তাকে। গলায় জ্বলজ্বল করছে সাদামাটা ডিজাইনের একটা নেকলেস।
সারল্য'র ঘরটা আগের মতোই আছে, বিয়ে উপলক্ষে বিশেষ কোনো সাজসজ্জা নেই। তবে অনাড়ম্বর ঘরটাও আলোকিত হয়ে উঠল জাহ্নবীর উপস্থিতিতে।
ঘরে ঢুকে নিঃশব্দে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল সে। সারল্য তার পাশে এসে দাঁড়াল। মুচকি হেসে বলল, 'ভেবেছিলাম তুমি বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকবে।'
জাহ্নবী কম্পনরত বুকে সারল্য'র দিকে তাকালো। বিশ্বাসই হচ্ছে না এই মানুষটা তার স্বামী। তার এত বছরের একাকীত্ব ঘুচল অবশেষে। একটা নিজের মানুষ হলো তার। এমন একটা নিজের মানুষের অভাব সর্বক্ষণ তাকে তাড়া করে বেড়াতো।
সারল্য জানতে চাইলো, 'কী দেখছো?'
একটা ছোট্ট নিশ্বাস আড়াল করল জাহ্নবী। সে দেখছে তার হাজার জনমের প্রতীক্ষিত পুরুষটাকে। বলতে ইচ্ছে করছে, আমি তোমার অপেক্ষায় কত শত রাত নিদ্রাহীন কাটিয়েছি, তুমি যদি তা জানতে! আফসোস, কখনোই তুমি তা জানবে না। জাহ্নবী কাউকে নিজের আবেগ বুঝতে দেয় না।
লাজুক হেসে মুখ নামিয়ে নিলো জাহ্নবী। তার মাথায় এখন ঘোমটা নেই। শাড়ির লম্বা আঁচল পিঠের ওপর বিস্তৃত। খোপায় মিইয়ে যাওয়া ফুল। ঠোঁটে রঙ ক্ষয়ে যাওয়া লিপস্টিক। মায়াবতী লাগছে মেয়েটাকে।
সারল্য বলল, 'এই বারান্দাটা তোমার খুব পছন্দের তাই না?'
'পছন্দ নয়, প্রিয়। আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা।'
'আচ্ছা। তুমি শাড়িটা বদলে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমরা সারা রাত এখানে বসে গল্প করবো।'
জাহ্নবীর আনন্দ হতে লাগলো। এমন মধুর রাত তার জীবনে কক্ষনও আসেনি। এক সেকেণ্ড সময়ও সে অযথা নষ্ট করতে চায় না।
তারাহুরো করে গোসল সেরে সে একটা পুরনো সুতি শাড়ি পরলো। নতুন শাড়িতে অস্বস্তি লাগে, আরাম করে বসে থাকা যায় না। গোসলের পর সব প্রসাধনী ধুয়ে যাওয়ায় অনেক সতেজ বোধ করছে সে।
সারল্য নিজেও পাঞ্জাবি ছেড়ে একটা টি শার্ট গায়ে জড়িয়েছে। বারান্দায় শীতল পাটি আর বালিশ নিয়ে অপেক্ষা করছে সে। জাহ্নবীর লজ্জা লাগছে। হাত পা আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার। দরজায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সে সারল্যকে দেখছে। দুই পা এগিয়ে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না।
সারল্য জিজ্ঞেস করল, 'কই? আসো এদিকে?'
জাহ্নবী দুরুদুরু বুকে এগিয়ে এসে পাটির ওপর বসলো। সারল্য জানতে চাইলো, 'নার্ভাস লাগছে?'
'হুম।'
'দাঁড়াও তোমার নার্ভাসনেস কাটিয়ে দিচ্ছি।'
সারল্য দুম করে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। মুহুর্তের জন্য জাহ্নবীর হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। সে মৃদুস্বরে বলল, 'কাটিয়ে দিতে পারলেন কই? আরও বেড়ে গেল যে।'
সারল্য জাহ্নবীর হাতটাতে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুপ করে রইল। জাহ্নবীর শাড়িতে মুখ গুঁজে দিয়ে শান্ত হয়ে গেল সে। মনে হচ্ছে যেন ছোট্ট শিশু। বহুদিন পর মাতৃস্নেহ পেলে শিশুরা যেমন চুপটি করে জড়িয়ে রাখে, সেভাবেই চুপটি করে রয়েছে সারল্য। জাহ্নবীর নাকে মিষ্টি সুঘ্রাণ ভেসে আসে। সে জানে এই সুঘ্রাণ সারল্য'র।
জীবনের একাকীত্ব, হাহাকার সবকিছুকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে যেই মানুষটা তার বুকে নির্ভরতা খুঁজছে, তাকে কখনোই বিন্দুমাত্র আঘাত করবে না জাহ্নবী।
মিনিট দশেক নিস্তব্ধতায় কেটে গেল। স্বাভাবিক হয়েছে জাহ্নবী। স্বপ্ন স্বপ্ন ভাবটা কেটে গেছে। সারল্যকে ভীষণ আপন মনে হচ্ছে তার। অনেক্ষণ হাত ধরে রাখলে হয়তো এমন নির্ভার লাগে।
সারল্য বলল, 'আমার নিজের জন্য তোমার কাছে কিছুই চাইবার নেই। প্রত্যাশা করা ছেড়ে দিয়েছি বহু আগেই। তুমি আমার মাকে যত্ন কোরো জাহ্নবী।'
'মা আমাকে অনেক স্নেহ করেন। এটার মর্যাদা আমি রাখবো। ভাব্বেন না আপনি।'
'জাহ্নবী, আমি আমার অতীতকে ছেড়ে দিয়েছি। সেইসব স্মৃতি আর কখনো মনে করতে চাই না। তুমি কখনো মনে করতে দিও না।'
'ওই প্রসঙ্গে আমার আগ্রহ নেই। আমিও চাই আপনি এখন আমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকুন।'
'চাও?'
'চাইবো না?'
'অবশ্যই চাইবে। আমি যদি ভালবাসতে ভুলে গিয়ে থাকি, যদি তোমার কোথাও কমতি মনে হয় তাহলে আমাকে ভুল বুঝবে না। আমি মনের ওপর জোর খাটিয়ে কিছু করতে পারিনা। তবে আমার কাছ থেকে তুমি যেটুকু পাবে, জেনে রেখো তাতে কোনো ভেজাল নেই। পুরোটাই খাঁটি।'
জাহ্নবী সারল্য'র হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, 'আজ রাতে এটাই আমার শোনা সবচেয়ে সুন্দর কথা।'
'আরও অনেক সুন্দর কথা বলবো। আচ্ছা, বলোতো এইযে আমি তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি, এটাকে কিসের মতো মনে হচ্ছে?'
জাহ্নবী কিঞ্চিৎ ভেবে বলল, 'জানিনা তো। কীসের মতো?'
'একবার তোমাকে এক ডালি ফুল দিয়েছিলাম। তুমি ডালিভর্তি ফুল নিয়ে রিকশায় বসে ছিলে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল জগতের সবচাইতে সুখী মেয়ে, আনন্দময়ী।বএখন আমাকে কি তোমার সেই ফুলের মতো লাগছে না?'
জাহ্নবী মিষ্টি করে হাসলো। সারল্য অবশ্যই একটা ফুল। তার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর ফুল। নিষ্পাপ, বিশুদ্ধ ও সুন্দর!
বিয়েবাড়ির আমেজ এখনও ফুরায়নি। বাড়িটা মেহমানভর্তি না হলেও কিছুক্ষণ আগেই এ বাড়িটা একটা বিয়ের আসর ছিল, সেটা স্পষ্টতই মনে প্রলেপ ঢেলে রেখেছে। তথাপি কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে সামারের। দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে সে। কাঁদছে কারণ তার জীবনটা আর আগের মতো নেই। সে হারিয়ে ফেলেছে সবকিছু। হারিয়ে ফেলেছে নিজেকেও। সে ছিল একটা হাসিখুশি, প্রাণবন্ত মেয়ে। জীবন নিয়ে যার কোনো আক্ষেপ ছিল না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ঘোরাঘুরি আর আনন্দেই কেটে যেতো তার সময়। অথচ আজকের সামারের জীবনে বন্ধুরা সবাই ব্যস্ত। আগের মতো কাউকে পাওয়া যায় না। পেলেও আর আড্ডা'টা জমে না। সবাই কেমন যেন দূরে সরে গেছে। সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এসেছে গতকাল। আরজু পরোক্ষভাবে জানিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, তার সঙ্গে সামারের জুটিটা ঠিকঠাক নয়। তারা দুজন দুজনের জন্য নয়। তারমানেই তো ছেড়ে চলে যাওয়া। সামার মেনে নিতে পারছে না এই বিচ্ছেদ। দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে সে। নিজেকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলার দুঃখে বুক ভার হয়ে আছে। অন্ধকার ঘরে শুয়ে সে কেন কাঁদছে জানেনা নিজেই।
বিয়েতে অর্ণব এসেছিল। অর্ণব ভালবাসে তাকে। সামার দূরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল অর্ণবের দিকে। একতরফা ভালবাসলেই কী হয়? অর্ণবকে সে ভালবাসতে পারবে না। অর্ণব তার জন্য নয়। আরজুও তার জন্য নয়। সে কী নিজেই তার জন্য? এমন কেন সে? পরিণত বয়সেও বড্ড অপরিণত। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে সামারের কান্না পায়। নিজেকে বদলে ফেলতে ইচ্ছে করে খুব করে৷ খুব হাসিখুশি চঞ্চল মেয়েগুলো বোধহয় সময়ের স্রোতে হঠাৎ করেই শান্ত সমুদ্রের মতো চুপ হয়ে যায়!
কালবৈশাখীর দিন ফুরিয়ে বর্ষা এলো। ভায়োলেটের বিজনেসটা বেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এর পুরো কৃতিত্বটাই সারল্য ও জাহ্নবীর। ওরা দুজন মিলে যেভাবে দিনরাত পরিশ্রম করছে, আর সঙ্গে আছে দুজনের অনবদ্য মেধা।
এমনই এক বর্ষার দিনে সারল্য ছুটে এসে জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'একটা ভালো খবর আছে। শুনলে তুমি পাগল হয়ে যাবে।'
জাহ্নবী বেশ অবাক হয়। সারল্যকে বেলীফুলের মতো ফুরফুরে লাগে তার। কী এমন ভালো খবর! ভ্রু কুঁচকে জানতে চায় সে।
সারল্য ল্যাপটপ খুলে তার সামনে মেলে ধরে। জাহ্নবী চোখ বড়বড় করে দেখে জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর খবরটা। অনেক বড় একটা প্রযুক্তিগত ব্রাণ্ড তাদের ব্যবসায়ে ইনভেস্ট করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যেটা এইমুহুর্তে স্বপ্নের মতো বিশাল। জাহ্নবী খুশিতে একটা চিৎকার দিয়ে উঠল। সারল্যকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় সে বলল, 'তোমার জন্য সম্ভব হয়েছে এটা।'
সারল্য জাহ্নবী'র নাক টেনে দিয়ে বলল, 'কখনোই না। তুমি জিনিয়াস জাহ্নবী। তোমার ট্যালেন্ট, ইনোভেটিভ আইডিয়া, কাজের দক্ষতা সবকিছুর জন্য এটা তোমার প্রাপ্য।'
'তাই বলে এত অল্প সময়ের মধ্যে আমরা ইনভেস্টমেন্ট পেয়ে যাবো ভাবতেই পারছি না।'
জাহ্নবী মুহুর্তেই ফোন করল ভায়োলেটকে। খবরটা জানাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল ভায়োলেট। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া নেই। গলা ধরে আসছে তার। দুচোখ ছলছল করছে।
জাহ্নবী বলল, 'বাবার কাছ থেকে নেয়া টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দেবো ভায়োলেট।'
'হুম।'
'তুই খুশি হোস নি?'
ভায়োলেট উত্তর দিলো না। ফোন কেটে দিলো। আকাশ অন্ধকার করে এসেছে। এখনই নামবে বৃষ্টি। সে বৃষ্টিতে ভিজবে। তার চোখের জল বৃষ্টির জলে মিশে যাক। কেউ তা দেখবে না। জগতের কেউ জানবে না কেন এই মেয়েটা আজ কাঁদছে!
বৃষ্টি নামলো। শহুরে রাস্তায়, মাঠের ঘাসে, খোলা বারান্দায়। বারান্দায় বাতাসে দুলে দুলে উঠছে বাগানবিলাসের লতাটা। সব জানলা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা আসছে। জাহ্নবী জানলা বন্ধ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। বারান্দায় ভিজছে কে!
সে দৌড়ে এসে বারান্দায় দৃষ্টি মেললো৷ কয়েকদিন আগেই একটা আরাম কেদারা নিয়ে এসেছে সে। সারল্য রোজ সকালে সেখানে বসে পত্রিকা পড়ে। চেয়ারের হাতলে রাখা পত্রিকা আর চায়ের জলভর্তি৷ কাপে টুপটুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। জাহ্নবী ক্ষণিকের জন্য নড়াচড়া করতে ভুলে যায়। অঝোর ধারায় নেমেছে শ্রাবণ। মন চায় আজ উদাসী হতে! এমনই উদাসী সে হয়েছিল বহুবার, বহুকাল আগে। কই, তখন তো ছিল না এমন কেউ! কেবল একটা শূন্য বারান্দা পড়ে ছিল কল্পনায়..
.
.
.
চলবে........................................................................