থাই গ্লাসের মধ্যে সরু লাইনে বৃষ্টির রেখা বইছে। সেখানে ছোপ ছোপ বৃষ্টির ছাপ স্পষ্ট। গভীর রাতে অস্পষ্ট বৃষ্টির মধুর শব্দ কানে ভেসে আসছে। বাতাস বইছে তুমুল। বাতাস উড়াতে ব্যস্ত পর্দা। সাদা পর্দাদের এলোমেলো খেলা চলছে যেনো। অরুর হাতের বাটি ফাঁকা। রসমালাই সে খেয়ে ফেলেছে আধঘন্টা হলো। আরও খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু নেই তো! তন্ময় হাতেগোনা কিছু বানিয়েছে। সবই একাই খেয়ে নিয়েছে। কিঞ্চিৎ লজ্জা নিয়ে পেছনে আঁড়চোখে তাকাল। তন্ময় এখনো তার পিঠ ছুইছুই হয়ে দাঁড়িয়ে। একমনে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। কী এমন ভাবছে মানুষটা! অরু খালি বাটি নাড়িয়ে বলল,'আপনাকে সাধতে ভুলে গেলাম তো। একাই খেয়ে নিয়েছি।'
তন্ময় একইভাবে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,'ভালো লেগেছে?'
'ভিষণ।'
'পেট ভরেছে?'
অরুর চোখমুখে না ফুটে উঠল। মুখ ফুটে সে বলতেই নিচ্ছিল না। পূর্বেই শব্দ করে ঢেকুর তুলে ফেললো। ঢেকুর তুলে হাসফাস করে সরে গেল। এদিকসেদিক লোকাতে চাইল। থমথমে নিঃশব্দ পরিবেশে শব্দময় হাসি শোনা গেল। গম্ভীর, গভীর হাসির স্বর। তন্ময়ের হাসির শব্দে অরু ভীষণ লজ্জায় পড়লো। হতভম্ব হয়ে গেল। ঢেকুর আসার সময় আর পেল না। একটু পড়ে আসত। তন্ময় গেলে নাহয় আসত! তখন হাজারবার আসলেও তো কোনো ক্ষতি ছিলো না। ভোঁতা মুখ নিয়ে অরু তন্ময়ের হাসি দেখার সাহস পেলো না। অন্যদিকে
খুব ব্যস্ত পায়ে তন্ময় দরজার দিক অগ্রসর হলো। অরু ভেবে নিল, তন্ময় এবার চলে যাবে। রাত কম তো হলোনা। ঘন্টাখানেক ধরে বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখেছে। অরুর এবার ঘুম ধরেছে। চোখজোড়া বুজে আসতে চাইছে। পা'জোড়া ও ব্যথায় ঝিম মেরে গেছে। আর এভাবেও বৃষ্টির দিনগুলো তার বড্ড প্রিয় কি-না! এদিনে ঘুমোতে আরাম লাগে। পেট ভর্তি থাকলে তো কথাই নেই। দরজা বন্ধ হবার শব্দে চমকে ঘুরে তাকাল। তন্ময় দরজা বন্ধ করেছে। অরু স্তব্ধ এবং বিমুঢ়! কপালের মধ্যস্থান কুঁচকে গেল রীতিমতো। ধীরগতি অনুসরণ করে তন্ময় ফিরে আসলো। বৃষ্টি তখনো প্রখর। তন্ময় হাতঘড়ি খুলছে। খুলে টেবিলের পাশে রাখল। ভাড় ছেড়ে দিয়ে বিছানায় বসল। অরু এতটাই তাজ্জব বনে গেল যে প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছে। তন্ময়কে দেখে মনে হচ্ছে সে এখানেই শোবার প্রিপারেশন করছে। অরু অবাকের চুড়ান্তে। মোস্তফা সাহেব বারংবার বলেছে সেপারেট থাকতে। পাশাপাশি রুমের বিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটিয়েছে। ভয়ে অরুর গলা শুকিয়ে গেল। তন্ময় যদি এই রুমে ঘুমোয় এবং সেটা মোস্তফা সাহেবের কানে যায়, তাহলে তোলপাড় হবে! আর সেইবা কীভাবে বেরোবে। দরজা তো বন্ধ! অরু ভয়ার্ত গলায় বলল, 'আমি কিন্তু শাবিহা আপুর রুমে যেতে পারব না। বড়ো চাচ্চু খুব রেগে যাবে।'
তন্ময় চুলগুলো কপাল থেকে উঠিয়ে বলল, 'এদিকে আয়।'
'হু?'
'কোথাও যাবিনা। এখানেই ঘুমোবি।'
'তাহলে আপনি?'
'আমিও।'
অরু আশ্চর্যের শেষ প্রান্তে। তন্ময় উঠে দাঁড়ালো। কয়েক পায়ের ধাপে এসে অরুর হাত চেপে ধরলো। টেনে বিছানায় বসিয়ে দিল। সে অন্যপাশে গিয়ে লাইটস ওফ করার সুইচ টিপে দিল। আঁধারে তলিয়ে গেল সব৷ ঘুটঘুটে অন্ধকার। তন্ময় বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। অরুকে যেভাবে বসিয়েছে সে সেভাবেই বসে। নড়চড় না দেখে পরপরই হালকা টেনে শুইয়ে দিল। অরু চাপাস্বরে চিৎকার করে উঠলো। ভয়ে সে গুটিয়ে গিয়েছে। বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়েছে। তন্ময় তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে নিয়েছে। মুখটা অরুর রেশমি চুলে গুঁজে দিয়ে দিব্বি শান্ত হয়ে গিয়েছে। কোনো নড়চড়, সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না তার থেকে৷ তবুও অরুর সর্বাঙ্গ জুড়ে শিহরণ বয়ে চলেছে। ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে হৃদয়। পেটে স্পষ্ট তন্ময়ের হাতের স্পর্শ অনুভব করছে। অনুভব করছে নিশ্বাসের মেলা। কম্পিত গলায় কিছু বলতে চাওয়া অরু বেশ কিছুক্ষন থমকে রইল। মস্তিষ্ক সম্পুর্ন ফাঁকা তার।ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছেনা! শুনতে পেল তন্ময়ের গলা, 'এভাবে শক্ত হয়ে আছিস কেন! শরীর ছাড়!'
'আ..আপনি নিজের রুমে যাচ্ছেন না কেন!'
'ঘুরে তাকা।'
'না একদম না। আপনি জবাব দেন। কেউ দেখলে কী ভাববে! বড়ো চাচ্চু তো খুব রাগবেন।'
'আমি দেখে নিব।'
অরু ভেঙাতে চাইল। তবে পেটে থাকা হাতের স্পর্শ গভীর হতেই, কথা গলায় আটকে গেল। থরথর করে কেঁপে, উঠতে চাইল বিছানা থেকে। সেসময় তন্ময় তাকে পাজাকোলে তুলে, ঘুরিয়ে নিয়েছে। মুখোমুখি ভাবে। অরু চোখজোড়া জাপ্টে বন্ধ করে রেখেছে। তন্ময় তার বন্ধ চোখের পাতায় চুমু খেয়ে বসলো। অরু মুচড়ে উঠলো সাপের মতো। তন্ময় ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, 'ঘুমাতে দে। নড়চড় করবি না।'
'নিজের রুমে যান তাহলে। আমি নড়চড় করবোই।'
'আমার যা করতে ইচ্ছে হচ্ছে, করে ফেলি?'
অরুর নড়ানড়ি থেমে গেল আচমকা। শান্ত হয়ে গেল তন্ময়ের বাহুতে থাকা মেয়েটা। তন্ময়ের ঠোঁটের কোণে স্মিথ হাসি। সে অরুর মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে চোখ বুজল। ভয়ে অরু জড়সড় ভাবে তন্ময়ের বাহুতে শুয়ে থাকলো। কোনোপ্রকার শব্দ বা নড়চড় করার বা মুচড়ে উঠার সাহস পেলো না। সময় অতিবাহিত হচ্ছে অথচ অরুর ঘুম আসছে না। অপরদিকে তন্ময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অরু একধ্যানে তাকিয়ে রয়েছে তন্ময়ের ঘুমন্ত মুখশ্রীর পানে। খুব আলগোছে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিল উঁচু নাকটা। পরপর গাল। আদুরে ভাবে তন্ময়ের চাপদাড়ি'তে আঙুল ঘোরালো। কপাল, চোখ ও ছুঁয়ে দিল। শুধু ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে পারলো না। তার বেশ লজ্জা লাগছে। নজর যেতেই লজ্জাবোধ চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে। ছুঁয়ে দেওয়া খুব দূরের বিষয়। একসময় অরু পরিবারের কথা ভুলে বসলো। আরামসে তন্ময়ের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল। ঘুমের ঘোরে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। অস্পষ্ট স্বরে গুঙিয়েছে কয়েকবার।
____________
লতা বেগম নিজের কথায় ঠায়। তিনি এই বিয়ে মানবেন না। অদ্ভুত! দু'একমাস বা বছর খানেকের ব্যবধান নয়, চারবছরের ব্যবধান। এতবড় মেয়ে তিনি কীভাবে নিজের ছেলের জন্য আনবেন। কেমন দেখাবে এটা! লতা বেগম চোখ মুখ বিকৃত করে বসলেন। অয়ন রাগারাগি করে রাতের আঁধারে বেরিয়ে গিয়েছে। কল করা হয়েছে তাকে কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে। লতা বেগম ছেলের জন্য চিন্তিত তবে তিনি এই বিয়েতে একদম মত দিবেন না।
সৈকত সাহেবকেও সমানে ঝেড়েছেন। ইচ্ছেমতো বকেছেন। হন্তদন্ত গলায় লতা বেগম বললেন,
'মানুষ কি বলবে! আমার ছেলে হাসাহাসির পাত্র হয়ে উঠবে। ছেলেটা নিজের ভালো বুঝে এখনো? কতো বা বয়স ওর! প্রাপ্তবয়স্ক হলে দেখবে, এই বিয়ের উপর চরম বিরক্ত হবে। তখন আমার ডিসিশনকেই সম্মতি জানাবে। এসব আবেগ! বছর খানেকের সংসার করেই, মন উঠিয়ে ফেলবে। না, না এটা হয়না।'
'সংসার তুমি করবে না। ছেলে করবে। এতো ভেবো না।'
'আশ্চর্য! ছেলে করবে দেখেই ভাবছি। আমার ছেলের ভালোমন্দ আমি দেখবো না।'
'তুমি শান্ত হও।'
সৈকত সাহেব হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বড়বড় পা ফেলে চলে গেলেন। তার নিজের ও মন শাঁয় দিচ্ছে না। মুলত ছেলের কারণে রাজি হয়েছেন। সংসার ছেলে করবে, অবশ্যই তার পছন্দ অনুসারে। তাই তিনি অমত করেননি। অপরদিকে শাবিহা তাদের চেনাজানা। গুণবতী মেয়ে! বয়সে একটু বড় হলেই বা কী! কিন্তু এতসব তার স্ত্রী বুঝবে না। তাকে এখন বোঝানো আর না বোঝানো এক! সৈকত সাহেব ভেবে রেখেছেন তিনি এই বিষয়ে পড়ে কথা বলবেন। স্ত্রীর মাথা ঠান্ডা হোক! পকেট হাতড়ে সেলফোন বের করলেন। ছেলেকে কল করলেন আবারো। সুইচডওফ বলছে পুনরায়। চিন্তিত হয়ে পড়লেন। গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। এতো রাতে ছেলেটা গেল কই, দেখতে হবে ত।
.
.
.
চলবে..............................