জাহ্নবী'র দিনগুলো মধুর ব্যস্ততায় কেটে যাচ্ছে। ভায়োলেটের ব্যবসার শুরুটা তার হাত ধরেই হলো। অন্যদিকে নাদিরের ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ও তার উপস্থিতি না থাকলে চলে না। নিজের অফিস শেষ করে এই দুই কাজে সময় দেয়ার পর নিশ্বাসটুকুও ফেলার সময় হচ্ছিল না জাহ্নবী'র। এরই মাঝে একদিন সারল্য'র সঙ্গে দেখা হলে সে বলল, 'নানুবাড়িতে যাবো। যাবেন?'
জাহ্নবী চমকে উঠলো তার কথায়, 'নানুবাড়ি!'
'হ্যাঁ। একদিন না বলছিলেন আপনার গ্রামে যেতে ইচ্ছে করে? গ্রাম দেখতে যাবো চলুন। নানু অনেকদিন ধরেই ডাকছে। ক'দিন ধরে আম্মুও বলছে এবার একবার নানুবাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে। অনেকদিন বাপের বাড়ি যাওয়া হয়না আম্মুর। তাই ভাবলাম আপনাকেও বলি। যাবেন?'
নিঃসন্দেহে চমৎকার দাওয়াত। কত বছর হল জাহ্নবী গ্রামে যায় না। শুধুই কি গ্রাম! তার মাথায় কোথাও বেড়াতে যাবার স্মৃতিই মনে পড়ে না। সারাক্ষণ বাড়ি, বাড়ি, বাড়ি আর৷ বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ঘরের দমবন্ধ পরিবেশ ছেড়ে নিজের মতো বাঁচতে একলা বাসায় ওঠা। এখন তো মনপ্রাণ খুলে বাঁচতে ইচ্ছে জাগবেই।
'অফিসের এত কাজ রেখে কীভাবে যাবো?' জানতে চাইলো জাহ্নবী।
সারল্য'র নিষ্পাপ উত্তর, 'অফিসে দুদিনের ছুটি নিলে খুব একটা অসুবিধা হবেনা।'
'নাদির স্যারকে কী বলবো?'
'জাহ্নবী, আপনি হাসালেন আমায়। আপনার কি মনে হচ্ছে নাদিরের কাজ আপনার জন্য আটকে থাকবে? ও নিজেই ওর কাজের জন্য এনাফ। তাছাড়া টিমের বাকিরা তো আছেই। আপনাকে কেউ মাথার দিব্যি দিয়ে রাখেনি।'
জাহ্নবী খানিক্ষন চুপ করে রইল। তার খুব গ্রামে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে সত্যি কিন্তু নিজের স্টার্টআপের কথাটা সারল্যকে এখনো জানায়নি সে। ভায়োলেট তার ওপর পরম নির্ভরতায় ব্যবসার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। অফিসের ইন্টেরিয়র ডিজাইন চলছে। কাজ শেষ হলেই নিজের চাকরি ছেড়ে জাহ্নবীকে ওর অফিসে বসতে হবে। এ সময় সে কীভাবে গ্রামে বেড়াতে যাবে? এ তো অসম্ভব ব্যাপার।
জাহ্নবী ম্লান হেসে বলল, 'আপনার নিমন্ত্রণ পেয়ে খুশি হয়েছি। কিন্তু বোধহয় যাওয়া হবে না।'
'ভেবে দেখুন। আম্মুকে বলেছি ব্যাগ গুছিয়ে ফেলতে। দু একের মধ্যেই যাবো।'
'যান, ঘুরে আসুন। ভালো লাগবে।'
সারল্য চোখ পাকিয়ে জাহ্নবী'র দিকে খানিক্ষন তাকিয়ে থাকতে থাকতে উত্তর দিলো, 'আমি জানি ভালো লাগবে আপনার।'
দুই রুমের একটা ছোট্ট অফিস নিয়েছে ভায়োলেট। নিজের মনমতো সেটা সাজানোর প্রয়াস চলছে। দেয়ালে জায়গা করে নিয়েছে অভিজাত পেইন্টিং। দুই রুমের হলেও তার কাজের প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে এখানে। জাভেদ আলী ব্যাংক থেকে টাকা ট্রান্সফার করে দিয়েছেন ভায়োলেটের একাউন্টে। একান্তই নিজের মতো করে সে সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছে।
অফিসের কাঁচের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জাহ্নবী আনমনে কী যেন ভাবছে। ভায়োলেট তার পাশে এসে দাঁড়াল। মৃদু গলায় বলল, 'কী দেখছো আপু?'
জাহ্নবী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, 'কিছু না।'
'ভাবছো তোমার কাঁধে অনেক বড় একটা দায়িত্ব দিয়ে ফেললাম?'
'এরকম একটা দায়িত্ব আমার খুব প্রয়োজন ছিল। নিজের মেধাকে কাজে লাগানোর কোনো সুযোগই তো পাচ্ছিলাম না।'
'এত ভালো একটা চাকরি পেয়েছো নিজের যোগ্যতায়, তাও এই কথা?'
'চাকরিতে তো অন্যের নির্দেশে কাজ করি ভায়োলেট। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কিছু একটা করার মতো কাজ দরকার ছিল। থ্যাংকস রে।'
'আর থ্যাংকস বলো না আপু। একদিন তুমিই বিরক্ত হয়ে বলবে আমার কাঁধ থেকে দায়িত্বের বোঝা নামিয়ে দে।'
'মাইর খাবি এবার।'
খানিক্ষন চুপ থেকে জাহ্নবী বলল, 'অফিস রেডি হওয়ার আগে আমার কোনো কাজ আছে? মানে দুদিনের ছুটি পাওয়া যাবে?'
ভায়োলেট ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে ফেলল, 'আমাকে বস ভেবো না। তুমিই এখানকার বস।'
'সেজন্যই বলছি। বস'রা কখনো ছুটি পায় না। তাদেরকে কে ছুটি দেবে?'
'এই কোম্পানিতে ওসব হবেনা বাবা। যখন মন চাইবে ছুটি নেবে। নিজের রিফ্রেশমেন্টের জন্য।'
জাহ্নবী ইতস্তত করতে করতে বলেই ফেলল, 'ঢাকার বাইরে আমার একটা দাওয়াত আছে। তোকে এক বন্ধুর কথা বলেছিলাম না? ওর ফ্যামিলি যাচ্ছে। আমাকে যেতে বলেছে। কী করবো বুঝতে পারছি না।'
ভায়োলেট হেসে বলল, 'অবশ্যই যাবে। এরপর তো কাজে মন দিতে হবে। অফিসের কাজ আমি গুছিয়ে নেবো। তোমার এখন কোনো চাপ নেই। নিশ্চিন্তে ঘুরে এসে সবকিছু বুঝিয়ে নিও। বুঝেছো?'
জাহ্নবী দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল, 'যাবো?'
'যাও। মনটা ফ্রেশ হবে।'
ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা বোধ করল জাহ্নবী। সে বহু বছর পর শহরের বাইরে যাবে। এই দম বন্ধ করা শহর ছেড়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে। ইশ, ভাবলেই মন ভালো হয়ে যায়।
শহরের বাতি জ্বেলে ল্যাম্পপোস্ট গুলো দাঁড়িয়ে আছে। জাহ্নবী ও ভায়োলেট একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কারও সঙ্গে কোনো কথা বলে না। দুজনের চোখে অপরিসীম স্বপ্ন এসে নাড়া দিয়ে যায়। রঙিন, লাল, নীল স্বপ্ন। স্বপ্ন ধরার জন্য ওরা ছুটতে রাজি। এখন ছুটতে হবে, বহুদূর!
সারল্য ও তার মা রওনা দিচ্ছে গ্রামের উদ্দেশ্যে। তাদের সঙ্গে যাচ্ছে জাহ্নবী। লাগেজ গুছিয়ে সে বাসার সামনে অপেক্ষা করছে। সারল্য'র গাড়ি এসে দাঁড়াল সামনে।
জাহ্নবী ওর মাকে সালাম জানিয়ে বলল, 'কেমন আছেন খালা?'
'ভালো আছি মা। আসো, উঠে পড়ো।'
মহিলার পাশের সিটেই বসলো জাহ্নবী। গন্তব্যস্থল তার অজানা। সারল্য'র সঙ্গে এরপর খুব একটা কথা না হওয়ায় সে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়নি ওর নানুবাড়িটা কোথায়? তবে উত্তেজনার অন্ত নেই তার। কোথায় যাচ্ছে সেটাও তার জন্য বিস্ময়কর হয়ে থাকুক।
গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার। তার পাশের সিটে বসেছে সারল্য। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। চোখে চশমা। জাহ্নবী চমকে উঠলো ওকে দেখে। যেন রূপকথার গল্প থেকে উঠে আসা বিশুদ্ধ মানব। সারল্য পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, 'সকালে নাস্তা করেছেন?'
জাহ্নবী ইতস্ততবোধ করছে। ঘুম থেকে উঠতে তার দেরি হয়ে গেছে। তাই সকালে নাস্তা বানানো হয়নি। সারা রাত উত্তেজনায় দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। ভোরবেলা ঘুমিয়ে সকাল নয়টায় রেডি হওয়াটা মোটামুটি কঠিন। তার ওপর সকালের নাস্তা? বায়ৃ রোজ নাস্তা বানানোর অভ্যাস থাকলেও এটা আজকে মিস হয়েছে তার। জাহ্নবী'র মুখ দেখে সারল্য কী ভেবে নিলো কে জানে। মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে।
কিছুদূর এগোতেই গাড়িতে উঠে পড়ল সারল্য'র বোন শার্লিন ও তার মেয়ে। জাহ্নবীকে দেখে আন্তরিকভাবে হাসলো সে। এতক্ষণে জাহ্নবী'র বিব্রতভাব কাটলো। শার্লিন সঙ্গে থাকলে সারল্য'র নানুবাড়িতে বেড়াতে যেতে তার জড়তাবোধ থাকবে না। নয়তো লজ্জায় একদিকে কুঁকড়ে যাচ্ছিল সে।
শহর পেরোতেই একটা রেস্তোরাঁয় গাড়ি দাঁড় করাতে বলে দিলো সারল্য। বলল, 'নাস্তাপানি খেয়ে নেই৷
শার্লিন মুখ বাঁকিয়ে বলল, 'এখনই দাঁড়াতে হবে কেন? এখনো অনেকটা পথ বাকি।'
'জাহ্নবী সকাল থেকে কিছু খায়নি।'
শার্লিন আর কোনো উত্তর দিলো না। বিব্রতবোধ করল জাহ্নবী। বলল, 'আমি কিছু খাবো না।'
সারল্য জোরগলায় বলল, 'আরে নামুন তো। মা তুমিও আসো।'
ভাগ্নীকে কোলে নিয়ে সারল্য রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করল। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল জাহ্নবী। শার্লিন ওর দিকে তাকিয়ে ভদ্রতাসূচক হেসে বলল, 'আসুন আপু।'
নাস্তার আইটেম বলতে পরোটা, ডাল, সবজি ও ডিম ভাজি। যাত্রাপথের নাস্তা হিসেবে এই ঢের। সারল্য ওর ছোট্ট ভাগ্নীকে খাবার তুলে খাওয়াচ্ছে। জাহ্নবীর মন কেমন করে। সারল্য'র মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। নিঃসন্দেহে সারল্য খুব ভালো একজন বাবা। কিন্তু বাবার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। মাঝেমাঝে ভাগ্য আমাদের সঙ্গে এমন করে কেন!
সিলেটের ছায়াঘেরা এক গ্রামে সারল্য'র নানুবাড়ি। চা বাগানের ভেতর দিয়ে পথ চলার সময় জাহ্নবী অবাক চোখে সবকিছু দেখছিল। এর আগে কখনো সে চা বাগান দেখেনি। চোখের পলকেই চা বাগান পেরিয়ে একটা অদ্ভুত সুন্দর বাড়ির সামনে এসে তাদের গাড়িটা দাঁড়াল। বেশ বড়সড় বাড়িটা। পুরনো বাড়ির কয়েকটা ঘর দক্ষিণদিকে। বাড়ির সামনের দিকে নতুন করে একটা বিল্ডিং বানানো হয়েছে, আধুনিক ডিজাইনে। পুরনো বাড়িটার দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে, লালচে রঙের ঘরের পেছনে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় গাছ। ভেতরের মানুষ গুলো অনেক আন্তরিকতার সাথে সবাইকে গ্রহণ করলো। জাহ্নবী একটা সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। অস্বস্তি হচ্ছে তার। বাড়িতে ঢুকেই ছোট ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেছে সারল্য। সে একা বসে আছে এক কোণে।
এমন সময় মধ্যবয়সী এক লোক এসে জাহ্নবীকে বলল, 'এখানে একা বসে আছেন যে? বারান্দায় আসুন।'
জাহ্নবী ভ্রু কুঁচকে ফ্যালফ্যাল করে লোকটার দিকে তাকালো। তিনি হেসে বললেন, 'আমি ইমতিয়াজ, শার্লিনের মামা। আপনি নিশ্চয়ই ওর বন্ধু?'
জাহ্নবী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, 'আমি সারল্য'র বন্ধু।' কিন্তু সেটা না বলে চুপ করে রইল সে।
ইমতিয়াজ মামা বললেন, 'বারান্দায় সবাই আছে। আসুন।'
নতুন ভবনের ভেতর দরজা দিয়ে বের হতেই পুরনো ভবনের বারান্দায় এসে পড়ল ওরা। সিমেন্টের ঢালাই দেয়া কালো রঙের শীতল মেঝের বারান্দা। একদিকে পাতা রয়েছে চৌকি, লম্বা লম্বা কয়েকটা পুরনো আমলের কাঠের চেয়ার ও একটা বেঞ্চি। সবাই সেখানে বসে গল্পগুজব করছেন। দীর্ঘদিন পর বাবার বাড়িতে এসে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছেন সারল্য'র মা।
তিনি জাহ্নবীকে আদর করে কাছে ডেকে বললেন, 'আয় মা, এদিকে আয়। এখানে এসে বোস।'
জাহ্নবী বিমোহিত হল। মহিলা পরম যত্নে তাকে 'তুই' সম্বোধন করছে। এ এক অনাবিল আনন্দ! সে খুশিমনে ওনার পাশে চৌকিতে গিয়ে বসলো। চৌকিতে বসে আছেন ওনার মা অর্থাৎ সারল্য'র নানী, নানীর জা, ও তাদের পুত্রবধূরা। তিনি সবার সঙ্গে জাহ্নবী'র পরিচয় করিয়ে দিলেন। মুগ্ধতার রেশ এতটাই আচ্ছন্ন করে রাখল যে, অনেক্ষণ শুধু অবাক চোখে জাহ্নবী সবাইকে দেখে গেল। মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছিল না তার।
এমন সময় সারল্য বাচ্চাকাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে হৈ হুল্লোড় করতে করতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
.
.
.
চলবে.......................................................................