!!১১১!!
সিলেটে আজ বিশদিন পূর্ণ হলো। চারদিকের পরিবেশটা ভিষণ সুন্দর। মাহার অবচেতন মস্তিষ্ক খানিক ভুলে গিয়েছে 'তার' কথা। দূরে পাহাড়ে, নীলচে নদীর জলে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাচ্ছে মাহা। আজ সার্থক মাহাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছে বাগানে। মালনীছড়া চা-বাগান। কি ভিষণ সুন্দর! যতদূর চোখ যায় সবুজ সায়র। উঁচু-নিচু ঢিবিতে তাজা চায়ের গাছ। বেশি মানুষজন নেই। আকাশে বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস। থম মেরে আছে প্রকৃতি। চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে মাহা আর সার্থক। মাহার কেবল একটাই চিন্তা আসছে মাথায়। এমন কিছু কি তার সাথে আগেও ঘটেছিলো! সে কি কখনো মালনীছড়ায় এসেছিলো! এমন কোনো স্মৃতি তো মনে নেই। আনমনে হয়ে আছে মাহা। সার্থক ভিষণ মজা করে চা খাচ্ছে। চা আবার সার্থকের খুবই প্রিয়।
"আনমনে কেন? চা ভালোলাগছে না?"
ধ্যান ভাঙে মাহার। সচকিত হয়ে সার্থকের পানে তাকায় মাহা। মন উদাসীন লাগছে।
"আমার মনে হচ্ছে এর আগেও মালনীছড়ায় এসেছিলাম আমি।"
"হয়তো এসেছো ছোটবেলা কিংবা তোমার দেজা ভ্যুও হতে পারে।"
"এমনটা না। আমার...
"আসসালামু আলাইকুম, ভাইজান। ভালো আছেন?"
শক্তপোক্ত শরীর। ইয়া বড় গোফ। পরনে লুঙ্গি, শার্ট আর উপরে কালো চাদর। চৌকিদার খাজার মুখে হাসি। সার্থকও হেসে জবাব দেয়,
"ভালো আছি৷ তুমি ভালো তো খাজা?"
"আমিও খুব ভালো আছি ভাইজান।"
মাহা অবাক হয়ে খাজার পানে চেয়ে আছে। এই লোকটাকেও তো পূর্বে দেখেছে মাহা!
"তোমার ভাবি।"
মাহাকে দেখিয়ে বলে সার্থক। খাজা হাসে। হাসলে তাকে ভিষণ বিদঘুটে দেখায়।
"ভালো আছেন ভাবি?"
"হু...হুম। আচ্ছা, আমার মনে হচ্ছে আমি আপনাকে পূর্বে দেখেছি।"
"হতে পারে অন্য কাউকে দেখছেন। ভাইজান আমি যাই।" লোকটা দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে।
ঘুরাঘুরি শেষে বাড়িতে ফিরে আসে তারা। মাহার মাথায় কেবল ঘুরছে একটাই কথা। এসব তো পূর্বেও দেখেছিলো মাহা। কিন্তু স্পষ্ট কিছুই মনে পড়ছেনা কেন! মুইংচিন এখন বেশি একটা মাহার সামনে আসেনা। এ বাড়িতে মুইংচিন, মেরি, নাহার, মালী সজল, ড্রাইভার লতিফ, দারোয়ান দুলাল আর সার্থক, মাহা থাকে। মাঝেমধ্যে ডেভিড আসে। কৃষ্ণাঙ্গ এই পুরুষটাকে মাহার পছন্দ নয়। কেমন করে যেন চেয়ে থাকে। খুবই বাজে দৃষ্টি তার। বাড়ির একপাশে পাহাড় আর অপরপাশে অর্থাৎ দক্ষিণাংশে ঝোপঝাড় সাথে ছোট একটা গ্যারেজ। মেরি বলেছে এই গ্যারেজটা নাকি বহুদিন পুরানো। আজ আকাশে চাঁদ নেই। বারান্দায় পেতে রাখা বেতের চেয়ারে বসে দূরে পাহাড়ের দিকে চেয়ে আছে মাহা। শো শো কেমন একটা আওয়াজ ভেসে আসছে দূর পাহাড় হতে। সার্থক বাইরে বেরিয়েছে একটু। রুমানার কলে ধ্যান ভাঙে মাহার। আজকাল ভিষণ আনমনে হয়ে যাচ্ছে মাহা। বাচ্চাটা মারা যাওয়ার পর কোনো কিছুই ভালোলাগে না তার। ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকায় মাহা।
"কি রে কোকিল? তোরা সিলেটে শিফট করেছিস?"
"হুম"
"হারামী একবারও বললি না আমাকে। রেজওয়ান ভাইয়ার কাছে শুনলাম।"
"সরি, রুমানা। আমার আসলে কি যে হয়েছে। কিছুই ভালোলাগেনা। তুই কি আগামীকাল একটু আসতে পারবি আমার বাসায়? তোর বাবুটাকে নিয়ে আয়। দেখা হয়নি ওকে।"
"আচ্ছা, দেখি। শরীর কেমন এখন?"
"আছে, মোটামুটি। মনটা খালি উদাসীন লাগে।"
"চিন্তা করিস না। আমি আসবো আগামীকাল। আমাকে একটু তোর ঠিকানাটা মেসেজ করে দে।"
"আচ্ছা"
ঠিকানা মেসেজ করে মোবাইল রাখতেই সার্থকের ডাক।
"মাহা, তুমি কি বারান্দায়?"
"হুম"
"ঘরে এসো।"
ক্লান্ত দেখাচ্ছে সার্থক কে। সারাদিনে অনেক পরিশ্রম করে মানুষটা। মাহা এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। সার্থক এক লহমায় পান করে পুরো পানিটুকু। পিপাসা লেগেছিল খুব। মেয়েটাকে কিছু না বললেও অনেককিছু বুঝে যায়। মাহা সার্থকের পাশে খাটে বসতেই সার্থক মাহার কোলে মাথা রাখে। মাহাও আনমনে টেনে দিচ্ছে সার্থকের ঝাঁকড়া চুলগুলো। চোখ বুজে সার্থক।
"মাহা"
"হুম"
"আমি যদি কখনো না থাকি তুমি চলতে পারবেনা একা একা?"
হাত থেমে যায় মাহার।
"এসব কি বলছেন আপনি?"
"এমনি বাদ দাও। ঔষধ খাচ্ছো নিয়মিত?"
"কথা ঘুরাবেন না সার্থক। আপনি জানেন না এই পৃথিবীতে আপনাকে ছাড়া আমার আর কেউ নেই? কেন কষ্ট দেন আমাকে?"
"আহা রে। বোকা মেয়ে। আমি মজা করছিলাম রে বাবা।"
"এমন মজা কখনো করবেন না। আমার এমন মজা একটুও পছন্দ না।"
"ওকে, ওকে। এই যে কানে ধরলাম। আর কখনো বলবো না।"
ক্ষান্ত হয় মাহা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। জীবন নামক খেলায় এবার ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সার্থক। মাহাকে নিয়ে একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন কখনো পূরণ হবেনা সার্থকের। তাই যতদিন আছে মাহাকে নিয়েই থাকতে চায় সার্থক। আর কোনো পিছুটান নয়।
!!১১২!!
সূর্যোদয়টা কি যে মনোরম! ধূসর আকাশে লালচে সূর্যের উঁকি! ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে লালচে সূর্যটা। বাগানে হরেকরকম ফুলের ছড়াছড়ি। পরাগ, বেলী, কুঁড়ি, দোপাটি, জবা, চাঁপা, কামিনী, চামেলী, ডালিয়া,গুলবাহার, কাঠ গোলাপ, ড্যাফোডিল, মালতি, টগর, গন্ধরাজ, জুঁই কি নেই বাগানটায়। এক কোণায় সারিতে অলকানন্দা গাছের সমাহার। সবুজের মাঝে থোকায় থোকায় ছড়িয়ে হলদে ফুলগুলো। কাঁচা হলুদ। মাহার গাঁয়ের রঙটাও এমন। সজল পানি দিচ্ছেন বাগানে। বাড়ির সবাই ঘুমে।
"চাচা, ভালো আছেন?"
মাথা নাড়ায় সজল। মাহা মাথার উড়না টেনে সজলের সামনে দাঁড়িয়ে।
"আমাকে দিন আমি পানি দেই।"
না বোধক মাথা নাড়ায় সজল। বাড়িয়ে থাকা হাতটা গুটিয়ে নেয় মাহা।
"আপনি কথা বলতে পারেন না, চাচা?"
এবারও না বোধক মাথা নাড়ায় সজল। আহারে! মাহার বড্ড মায়া হলো সজলকে দেখে। আশেপাশে ঘুরে দেখছে মাহা। স্নিগ্ধ ভোরের দাপটে সবকিছুই যেন অভূতপূর্ব হয়ে উঠেছে। পাহাড়, নদী, বাগান। অপূর্ব! মাহা মুগ্ধ। সবই ভালো তবে কেমন জানি গা ছমছমে লাগে। বিশেষ করে বাড়ির দক্ষিণ দিকটা। হয়তো পুরানো গ্যারেজ আর ঝোপঝাড় আছে বলে। মাহা রান্না বসিয়েছে আজ। সার্থকের পছন্দের খিচুড়ি, মাংস ভুনা আর বিরিয়ানি রান্নায় ব্যস্ত গৃহিণী। সার্থক উঁকি দিয়ে গিয়েছে দুয়েকবার। মাহা বকে পাঠিয়েছে। মেরি, নাহার সাহায্য করতে চেয়েছিলো। তবে মাহা নাছোড়বান্দা। সব করবে নিজ হাতে। টেবিলে খাবার সাজানোর সময়ই দাড়োয়ান দুলাল এসে জিজ্ঞেস করেন,
"স্যার, রুমানা নামে এক মহিলা আসছেন। ম্যাডামের নাকি পরিচিত।"
"হ্যাঁ। ভিতরে নিয়ে আসো।"
রুমানা আর ওর তিন বছরের ছেলে এসেছে। বাড়িতে ঢুকেই দৌড়ে মাহাকে জড়িয়ে ধরে রুমানা।
"কেমন আছিস, কোকিল? ইস্ রে, একদম শুকিয়ে গেছিস।"
পাশে ছোট রাতুল দাঁড়িয়ে। মাহা খানিক হাসলো রুমানার কথায়। রাতুল কে কোলে নিয়ে বললো,
"তোমার মা সেই আগের মতোই আছে বাবা।"
সার্থকের সাথে কুশল বিনিময় হয় রুমানার। সোফায় বসে কথায় ব্যস্ত হয়ে গেলো দুই রমনী। সার্থক নিজেই খাবার নিয়ে খেয়ে নিয়েছে। অনেকদিন বাদে হাসোজ্জল দেখাচ্ছে মাহাকে। তাই ওকে আর বিরক্ত করতে চায়নি সার্থক। হাতে সাদা এপ্রন নিয়ে মাহার সামনে হাজির হয় সার্থক।
"মাহা, আমি আসি। আজ একটু ফিরতে দেরি হবে। রুমানা আজ থেকে যাবে কিন্তু!"
জিহবায় কামড় দেয় মাহা। 'ইস্! গল্প করতে করতে সার্থক কে খাবার দিতেই ভুলে গিয়েছে সে!' সার্থক খেয়াল করেছে সবটা। অতঃপর মুচকি হেসে বেড়িয়ে পড়ে সে।
"ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে। আজ আমি রান্না করেছি। রাতুল বাবা বিরিয়ানি খাবে তুমি?"
কি কিউট বাচ্চাটা! মাহার কথা শুনে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
"আন্টি কি বলছে? আন্টিকে বলো ইয়েস আন্টি। রাতুল খাবে।"
রাতুল চুপ। মাহা কোলে উঠিয়ে নেয় রাতুল কে। রাতুল প্রথমে চুপচাপ থাকলেও আস্তে আস্তে মাহার সাথে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে ওর। 'আন্তি এতা কি? আন্তি ওতা কি?' করে পাগল করে দিচ্ছে মাহাকে। মাহাও মনের আনন্দে জবাব দিচ্ছে। খাবার দাবার সেড়ে নাহারকে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালো রুমানাকে। এখন দুজনে মিলে চা নিয়ে সোফায় বসেছে গল্প করতে। বিকেল ছুঁইছুঁই। রক্তিম আকাশ। পাখিগুলো ফিরে যাচ্ছে আপন নীড়ে। রাতুল সারা হলরুম ঘুরে ঘুরে খেলছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রুমানা বলে,
"টুকিকে ভিষণ মনে পড়ছে রে কোকিল।"
কিছুক্ষণ শান্ত থাকে উভয়েই।
!!১১৩!!
"টুকির বাবা চলে গেলেন বছর দুয়েক আগে। মেয়ের বিচার দেখে যেতে পারলেন না। পুলিশও তো কেসের কোনো অগ্রগতিই করছেনা। রেজওয়ান ভাইয়া কেসটা ছেড়ে দিলো আর কোনো গতিই হলোনা কেসটার। কি সুন্দর মায়াবী ছিলো টুকি। আহারে! ভালো মানুষগুলোই বুঝি আগে চলে যায়।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমানা। মাহাও আনমনে হয়ে আছে।
"মাম্মা, মাম্মা....
হঠাৎ রাতুলের চিৎকারে সচকিত হয় দুজনে।
"কোকিল, রাতুল কই?"
"আব্বু, রাতুল আব্বু কই তুমি?"
দুজনেই পাগলের মতো খুঁজছে রাতুল কে। তবে রাতুল নেই! রুমানা কান্না করে দিলো এবারে। মাহা চিৎকার করে নাহার, মেরিকে ডাকলো। রাতুলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তবে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা। প্যাচাঁনো সিড়ির অগ্রমুখের ডানপাশে একটা গলি। এদিকটায় লাইটের আলো কম আসে বিধায় গলিটা সহজে চোখে পড়েনা। দুপাশে সাদা দেয়াল। সম্মুখেও সাদা দেয়াল। তবে ছোট একটা জানালা আছে। একপাশের দেয়ালে একটা ঘরের দরজা। রাতুল ছোট গলিটায় বসে কাঁদছে। মাহা, রুমানা অনেক খুঁজাখুঁজির পর রাতুল কে সেখান থেকে উদ্ধার করলো। ভয়ে কাঁপছে ছেলেটা। রুমানা ছেলেকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছে রাতুল।
"আব্বু, ভয় লাগছে?"
"হু"
"ভয় পেয়োনা। মাম্মা আছিনা।"
"মাম্মা, লক্ত। অনেক লক্ত।"
ভয় পেয়ে আবোল তাবোল বকছে রাতুল। তাই রুমানা আর সেসব কথায় পাত্তা দেয়নি। কোলে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ছেলেকে।
"আজ তবে আসি, কোকিল। ওর বাবা নিতে আসবে।"
"রাতুল কে আমার দেখে রাখা উচিত ছিলো। সরি রে রুমানা। আমার জন্য..
"তুই সব সময়ই বড্ড বেশি বকিস। তোর জন্য কিছুই হয়নি। ছেলেটা হয়েছে দুরন্ত। সব সময় খালি ছুটাছুটি।"
গেট থেকে রুমানাকে গাড়ি অবধি এগিয়ে দেয় মাহা। রুমানার স্বামী অনিক অপেক্ষা করছিলো গাড়ি নিয়ে। রুমানা গাড়ি থেকে বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ কৃষ্ণবর্ণের এক লোকের পাশে জিদানের মতো কাউকে দেখলো মনে হলো। তারা মাহাদের বাড়িতে ঢুকছে। জিদান, রুমানার চাচাতো ভাই। কিন্তু জিদান এখানে কি করে! আদোও জিদান তো? নাকি ভুল দেখেছে রুমানা। গাড়ি অনেকদূর চলে এসেছে। তাই সেই ছেলেটিকে আর দেখা হয়নি রুমানার।
____________
"বাচ্চাটাকে মেরে ফেললেই হতো।"
"বোকার মতো কথা বলোনা। প্রাণের ভয় নাই।"
"কতদিন খাওয়া হয়না কাঁচা মাংস। কচি বাচ্চাদের মাংস!"
বলেই আফসোসের সুর তুলে লোকটা। কি বিভৎস দেখাচ্ছে তাকে!
.
.
.
চলবে...............................