দৌড়াতে-দৌড়াতে রুমে এলো সুরাইয়া। বুকের হৃৎপিন্ড যেনো ধ্বক-ধ্বক করে কাঁপছে। মুখ হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে। হাঁপাতে-হাঁপাতে দরজার কাছে থামতেই উৎকন্ঠার সাথে ডাকলো,
- সাবা বুবু? ও বুবু, জলদি উঠো! তাড়াতাড়ি উঠো!
কন্ঠের ব্যগ্রতা শুনে চোখ খুললো সাবা। মাত্র শুয়েছিলো সে, দরজার দিকে তাকাতেই ধড়ফড় করে উঠে বসলো। সুরাইয়া চটপট হাতে দরজা লাগিয়ে বিছানার দিকে ছুটে আসলো। নিশ্বাস নিতে-নিতে কপালের ঘাম মুছে চন্ঞ্চল গলায় বললো,
- জানো কি হয়েছে? বড়মাকে ফোন দিয়েছে। বড়মার সাথে কথা বলছে। আমি হারিকেন দিতে গিয়ে সব শুনে ফেলেছি।
সুরাইয়ার ফড়ফড়ানি অবস্থা দেখে প্রচুর কৌতুহল হচ্ছে সাবা। আসল কথাটা শোনার জন্য ব্যকুল হচ্ছে সে। সুরাইয়াকে তাগাদা দিয়ে বেচইন সুরে বলে,
- বল, তাড়াতাড়ি বল। কি শুনলি? আরে গাধী! তোর হাঁপানি থামা। তাড়াতাড়ি বল! এমনেই কথাটা শোনার জন্য তর সইছে না। জলদি বল।
বড় একটা ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করলো সুরাইয়া। শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে নিচু স্বরে বললো,
- ভাইয়া আসছে বুবু, উনি নাকি শীঘ্রই আসছে। আমিযে কতো খুশি হয়েছি, কি পরিমাণ আনন্দ লাগছে! আমি শুধু এদিনটার অপেক্ষায় ছিলাম বুবু। মেহনূর যে কতো বাড় বেড়েছে, সেটা এখন ক্যাচ ক্যাচ করে ভাইয়া কেটে দিবে। নিচে হারিকেন দিতে গেছিলাম। বড়মা দেখি চোরের মতো কথা বলছে। খটকা লাগতেই পুরো ঘটনা শুনে ফেলেছি। ভাইয়া হয়তো ভরণপোষণের জন্য টাকা সেধেছিলো, বড়মা নেয়নি। আর জানো, ওই এমপির কলটা ভাইয়াই করিয়েছে। এবার বুঝো এই ভদ্রলোক কি ভয়ংকর! দূর থেকেই চেয়ারম্যানকে আচ্ছা মতো প্যাঁদিয়েছে। আমিতো শুনেই অবাক! ভিড়মি খেয়ে না-পারতে তোমার কাছে ছুটে আসলাম।
মুখে হাত চাপলো সাবা। হা হয়ে সুরাইয়ার দিকে তাকাতেই সুরাইয়া ' হ্যাঁ ' সূচকে মাথা নাড়াতে লাগলো। সাবার দিকে আরেকটু এগিয়ে নিচু স্বরে বললো,
- একদিকে যেমন আনন্দ হচ্ছে, অন্যদিকে তেমন চিন্তা হচ্ছে সাবা বুবু। ভাইয়া খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ। উনি যেভাবে সবকিছু দেখাশোনা করছেন, সবার প্রতি খেয়াল রাখছেন, মেহনূর কি ওটা নিতে পারবে? তোমার কি মনেহয় মেহনূর জেদটা ছেড়ে দিবে?
কথাটা শুনে ঠোঁট ভিজালো সাবা। অন্যমনষ্ক দৃষ্টিতে ভাবনার রাজ্যে ডুবে গেলো। কথাটা ভুল বলেনি সুরাইয়া। একপার্শ্বিক দৃষ্টিতে চিন্তা করলে মেহনূরকে সঠিক মনে হবে। নিজের আত্মগরিমায় দাগ লাগলে কোনো মেয়ে চুপ রইবে না। হয় নিজের আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ করে দিনের-পর-দিন স্বামীর ঘর করবে, নয়তো সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিজের জন্য আগাবে। মেহনূর সবসময় শান্তসুলভ থাকতো। মানুষও খোঁচাতে দেরি করতো না। কিন্তু ধৈর্য্যের শেষ সীমাটা যখন অতিমাত্রায় পেরিয়ে যায়, তখন মানুষের আত্মকেন্দ্রী চেতনা কখন তেজীভাবে রুখে, সে নিজেও জানে না। ভাইয়া সেদিন কি কারণে কথাগুলো বলেছেন, সেটার একমাত্র উত্তর উনিই দিতে পারবেন। কেনো এতোদিন যাবৎ গা ঢাকা দিয়ে থাকছেন, হালাল ভাবে স্বামী-স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কেনো তিনি দূরত্ব রেখে চলছেন, কেনো আড়ালে থেকে সবকিছু দেখাশোনা করছেন, তাও আবার দুটো বছর ইচ্ছাপূর্বক যোগাযোগ চ্ছিন্ন রেখেছেন, সবকিছুর যুক্তিপূর্ণ উত্তর আছে। মাহতিম ভাইয়া অকারণে কোনো ভুলভাল কাজ করবে না, অন্তত এ ব্যাপারে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। অন্য চেতনায় নিবিষ্ট ছিলো সাবা। হঠাৎ সুরাইয়ার উদ্দেশ্যে শক্তভাবে জবাব দিলো,
- ঠান্ডা মাথার মানুষ ঠান্ডা ভাবেই সামলাবে। মূর্খের মতো জবরদস্তি করবে না। মেহনূরকে উনি বুঝে বলেই চুপ মেরে আছেন। একবার আসুক। সবটা জানতে পারবি। আরেকটু ধৈর্য্য ধর্। পুরো ঘটনা না জেনে মতামত ছোঁড়াটা বোকামি হবে। শিক্ষিত হয়েও মূর্খের মতো লাফালাফি করাটা চলবে না।
কথাটার ভেতর কি ছিলো, সুরাইয়া জানে না। কিন্তু সাবার চোখদুটোতে অদ্ভুত তেজ ঝিকমিক করছিলো। যেনো সাবার ভেতরকার সত্ত্বা কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে। আগ বাড়িয়ে মাহতিমের ব্যাপারে কথা বলতে নারাজ। শানাজের পর সবচেয়ে যুক্তিবাদী চেতনা রাখে সাবা। মাঝে-মাঝে উড়নচণ্ডী আচরণ দেখালেও কিছু ক্ষেত্রে প্রচণ্ড শক্ত ব্যবহার করে। শানাজের কাছে সকল সমস্যার সমাধান মেলতো। সব বোনের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ আচরণটা শানাজের জন্য বজায় থাকতো। কিন্তু আজ সেই আচরণ সাবা পালন করে। সাবা আগের চেয়ে কিছুটা রোখা হয়েছে। নিস্তব্ধ রুমটার ভেতর জোরে নিশ্বাস ফেললো সাবা। শব্দটা রুমের দেয়ালে-দেয়ালে ছড়িয়ে গেলো। সাবাকে নিঃশ্চুপ দেখে কোমল হলো সুরাইয়া। কন্ঠস্বর নিচু করে প্রসন্ন গলা বললো,
- তুমি ওই ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়েছো?
চট করে চোখে চোখ ফেললো সাবা। তীর্যক চাহনিতে কাঠ-কাঠ ভঙ্গিতে বললো,
- কেন? ওই ব্যাপারে প্রশ্ন করছিস কেন? জেনে কি করবি?
লাগাতার প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই মিনমিন করলো সুরাইয়া। অপ্রস্তুত একটা হাসি দিয়ে আমতা-আমতা সুরে বললো,
- মানে বুবু, তুমি একটু শান্ত হও। আমার কথা না শুনে ক্ষেপতে যেও না। আসলে, ওই ছেলেটা আমার সাথে দেখা করেছে। ও তোমার কাছে মাফ চেয়েছে বুবু। বলেছে, চেয়ারম্যানের ব্যাপারটার জন্য সে খুব লজ্জিত। তুমি যদি তার সাথে কথা বলে মিটমাট করে নাও, তাহলে ---
ভয়ে-ভয়ে থেমে গেলো সুরাইয়া। বাকি কথাটা কোনোভাবেই শেষ করতে পারলো না। সাবার রুক্ষমূর্তির চেহারা দেখে বহুকষ্টে ঢোক গিললো। ভীতবিহ্বল চোখদুটো বিছানায় এঁটে বললো,
- পরশু তো বিদায় অনুষ্ঠান। কলেজের কাজে ব্যস্ত থাকবে। এজন্য কাল তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। ঝাউতলার মোড়ে সকাল এগা ---
পুরো রুমটার ভেতর ঠাস করে শব্দ হলো। কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের জন্য হারিকেনটা কেঁপে উঠলো। এরপর সবকিছু থম লাগানো অবস্থা। ক্রোধের আক্রোশে চড় লাগিয়েছে সাবা। এরকম আগ বাড়ানো স্বভাব তার কষ্মিনকালেও সহ্য না। সুরাইয়া বাঁগাল ধরে চোখ নিচু করেছে, এখনই আকস্মিক বর্ষণের স্বীকার হবে সে। সুরাইয়ার নতমুখ দেখে শক্ত চোখে তাকালো, কর্কশ কন্ঠে চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো সাবা,
- আমি ওর সাথে দেখা করবো না। তোকে শেষবারের মতো শা:ষিয়ে দিচ্ছি, ওই ছেলের সামনে তুই যাবি না। তোকে দ্বিতীয়বার বিরক্ত করলে মেহনূরের মতো স্যান্ডেল খুলে মা:রবি। কথাগুলো মনে রাখিস।
.
কলেজের মাটিতে আজ শেষ দিন। দুটো বছরের সময়সীমা আজ ইতি টানতে চলেছে। জীবনের দ্বিতীয় স্তরটা দেখতে-দেখতে শেষের দিকে। অবলীলায় কতোগুলো বছর হারিয়ে দিলো। শৈশবের দিনগুলো এখন সজীব পাতার মতো লাগে। ইচ্ছে হয়, সেই ছোট্টবেলায় ফিরে যাই। সেই অবুঝপনার দিনগুলোতে আবার ডুব দেই। সবাইকে নিয়ে আনন্দ কল্লোলে আবার মেতে উঠি। পরিবারের কাছে ছোট্ট বাচ্চাটি হয়ে যাই। আবারও সেই পুরোনো দিনের মতো আদরে-আদরে বেড়ে উঠি। মায়ের কাছে বকা, বাবার কাছে আদর, বোনের কাছে খুনশুটি, বড়দের কাছে ভালোবাসা নিয়ে আবার বড় হই। কিন্তু হায়! সে কি হয়? চলে যাওয়া সময়গুলো কখনো ফিরে আসে? কলেজের শেষ ক্লাসটি করে মাঠে বসেছে মেহনূর। মাঠের জমিনটা সবুজ ঘাসে ঘেরা। ডান হাতে ঘাসগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে মেহনূর। খোঁচা-খোঁচা ঘাসগুলো হাতের তেলোয় সুড়সুড়ি অনুভূতি জাগিয়ে দিচ্ছে। নাকে আসছে বেলী ফুলের সুগন্ধ। গা শীতল করে ঠান্ডা হাওয়া ছুটছে, উড়িয়ে দিচ্ছে কানের এলোমেলো চুল। ঘাসের দিকে নরম দৃষ্টি ছুঁড়ে স্মৃতি বুনছে সে। ডানহাতের নিচে সুড়সুড়ি কাতর অনুভূতিটা মাহতিমের মতো লাগছে। পাগল লোকটা সবসময় শেভ্ করতো। দুগালে কখনো দাড়ি রাখেনি সে। ফিল্ডের নিয়ম মানতে গিয়ে গালদুটো ক্লিন শেভ রেখেছে। ঘুমন্ত মাহতিমের গালটা যখন কোমল হাতে ছুঁতো, তখন প্রাণচাঞ্চল্য অনুভূতিটা আষ্টেপৃষ্টে ছড়িয়ে যেতো। মুখে ফুটে উঠতো একচিলতে হাসি। মনের আনাচে-কানাচে লেগে যেতো এক টুকরো সুখ। প্রথম স্পর্শ, প্রথম অনুভূতি, প্রথম পুরুষ, প্রথম ভালো লাগা, প্রথম আনন্দ, প্রথম শান্তি সবকিছুই সেই লোকটা দখলিস্বত্ব করেছে। এতোদূরে এসে থাকছে, তবুও ক্ষণেক্ষণে মনের ভেতর উত্তাল চালিয়ে যাচ্ছে। আজ দূরত্বের পাল্লাটা ভারি, খুব ভারি। বিষাক্ত স্মৃতিগুলো বাটখারার কাজ করছে। ক্রমে-ক্রমে দূরত্বের পাল্লাটা আরো ভারি করছে। কিন্তু দিনশেষে মনের উপর বাটখারার দাগ লাগেনি, স্মৃতিগুলো পদদলিত হয়নি। আকাশটা কখন মেঘে ঢাকা পরেছে, খেয়াল করেনি মেহনূর। নিজের অতীত নিয়ে এতোটাই বিভোর ছিলো যে, প্রকৃতির চেহারা দেখতে পায়নি। টুপটুপ করে ফোঁটায়-ফোঁটায় বৃষ্টি পরছে। হাতের উপর গোলাকার বিন্দুটা পরতেই সংবিৎ ফিরে পেলো। বাতাসের শোঁ শোঁ ধ্বনি যেনো খিলখিল সুরে হাসছে। চন্ঞ্চল কিশোরীর ন্যায় বৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠেছে। ঝপ করে মেদিনী ভিজিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। ঘাসের চেহারা বদলে গিয়ে দারুণ রূপ ধরলো। কিছুক্ষণের ভেতর পুরোপুরি ভিজে গেলো মেহনূর। বৃষ্টি দেখে একটুও উঠলো না সে। দুচোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ তুললো। বৃষ্টির অজস্র ফোঁটা সারা মুখ ছুঁয়ে ঝরছে। বুক ফুলিয়ে গভীর নিশ্বাস নিলো মেহনূর। মনের কোণে শীতল অনুভূতি আবদ্ধ করতেই আনমনে বলে উঠলো,
- যেই বৃষ্টি ছুঁয়ে একদিন আপনাকে চেয়েছিলাম, সেই বৃষ্টি আবারও আমাকে ভিখিরি বানিয়ে দিচ্ছে। আপনার জন্য প্রাণপণে আবদার করেছিলাম, আজ ফরিয়াদ করার জন্য মন ব্যকুল হচ্ছে। যদি এই বৃষ্টির মতো হুট করে চলে আসতেন, ঠিক এভাবেই না-জানিয়ে হাজির হতেন! জানি আর্জিগুলো কবুল হবে না।
বৃষ্টির মিঠাস্বাদের সাথে নোনা অশ্রুগুলো ঝরে গেলো। গাল বেয়ে, দুচোখের কোণা ছেড়ে ঘাসের উপর পরলো। আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে ব্যাগটা কাধে তুললো মেহনূর। ভিজতে-ভিজতে মাঠ পেরিয়ে গেটের বাইরে চলে গেলো। আগামীকাল বিদায় অনুষ্ঠান। বোর্ড পরীক্ষার জন্য মাত্র দুই মাস বাকি। কলেজ কর্তৃপক্ষ ছোটখাট আয়োজনের জন্য অনুষ্ঠান রেখেছে। সেই উপলক্ষ্যে কলেজ জুড়ে উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে। অনুষ্ঠান নিয়ে প্রচুর এক্সাইটেড সুরাইয়া। সকালের বৃষ্টি থামতেই শেফালির কাছে শাড়ির জন্য গেলো। শেফালি তখন মাহমুদার জন্য বনাজি ঔষুধ বানাচ্ছে। সুজলা পাশ থেকে ঔষুধের রস নিংড়ে চলছেন। সুরাইয়া কাছে আসতেই হাঁটু গোঁজ করে বসলো, মায়ের উদ্দেশ্যে মিনতি স্বরে বলল,
- আম্মা, কালকের জন্য একটা শাড়ি দিবা? সবাই সুন্দর শাড়ি পরে যাবে। আমার একটা সুন্দর শাড়ি দরকার। ও বড়মা? আপনি আমাদের শাড়ি পছন্দ করে দেন। কি রঙের শাড়ি পরবো বুঝতে পারছিনা।
সুজলা দুহাতে রস নিংড়ে বললেন,
- তাহলে তোর মায়ের কাছে প্যানাচ্ছিস কেন? আমার ঘর চিনিস না? চল, ঘরে চল। দাঁড়া, হাত ধুয়ে নেই।
পাশে থাকা বালতিতে হাত ধুলেন সুজলা। বসা থেকে উঠতে-উঠতে আঁচলে হাত মুছলেন। সুরাইয়াকে নিয়ে ঘরে চলে গেলে বাকি দুজনকে ডেকে পাঠালেন। সাবা ও মেহনূর বড়মার ঘরে আসতেই বিছানাভর্তি শাড়ির বাহার দেখলো। বেনারসি, জামদানি, তাঁত, সুতি, সিল্ক, কাতান সব ধরনের শাড়িতে বিছানা ভরা। সাবা শাড়ির অবস্থা দেখে কৌতুহলে বললো,
- আম্মা, শাড়ি ছড়িয়ে বসে আছো কেন? শাড়ি বিতরণ চলছে নাকি?
সাবার প্রশ্ন শুনে একগাল হাসলেন সুজলা। দুজনকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। সাবা ও মেহনূর কাছে আসতেই বিগলিত সুরে বললেন,
- কাল যে অনুষ্ঠান, তোরা গা:ধার দল একটাবারও বলেছিস? সবাই সেজেগুজে যাবে। আর এই বাড়ির ফকিন্নিগুলো গিন্নি সেজে বেরুবে। সাবা? এদিকে আয়। এ্যাই মেহনূর? তোকে কি নেমতন্ন পাঠিয়ে আসতে বলবো? দুটোই সুরাইয়ার পাশে বস্।
বড়মার আদেশটা চুপচাপ পালন করলো। দুবোন একসাথে বিছানায় বসে পরলো। সুজলা হাতড়ে-হাতড়ে দুটো শাড়ি বের করলেন। সাবা ও সুরাইয়ার সামনে রেখে স্বচ্ছল গলায় বললেন,
- এই তাঁতের শাড়িটা সাবা পরবি। তোর গায়ের সাথে খয়েরী রঙটা মানাবে। সুরাইয়া? সুতির শাড়িটা তুই পরবি। শোন, মন খারাপ করবি না। তুই সাবার মতো গরম সহ্য করতে পারিস না। এজন্য তোকে হালকা গোলাপী রঙের কাপড় দিলাম। সকালে বাগান থেকে তিনটা গোলাপ ফুল ছিঁড়ে আনবি। আমি খোঁপায় বেঁধে দেবো। এটার সাথে সাদা ব্লাউজ পরবি না। গরমের জন্য সাদা রঙ বিশ্রী লাগবে। তোর গোলাপী ব্লাউজ আছে না? ওটাই পরিস।
খুব সুক্ষ্মভাবে দুজনকে বুঝিয়ে দিলেন সুজলা। ঠিক মায়ের মতো সবকিছু বাতলে দিলেন তিনি। শাড়ির এমন চমৎকার পছন্দ দেখে দুজনই প্রসন্ন হাসি দিলো। সুরাইয়া খুশিতে গদগদ বিহ্বল সুরে বললো,
- অনেক সুন্দর হয়েছে বড়মা। আমি মনে-মনে এমন রঙটাই চাচ্ছিলাম। আমি কাল সকাল-সকাল বড় দেখে ফুল তুলে আনবো। আমাকে সুন্দর করে বেঁধে দিবেন। ও বড়মা? আমি কিন্তু কাজল দিতে পারি না। আমাকে একটু গাঢ় করে কাজল লাগিয়ে দিবেন।
সাজগোজের আলাপ বাড়তেই সাবার খটকা লাগলো। আম্মা যে মেহনূরের জন্য শাড়ি দিলো না। সে কি ব্যাপারটা ভুলে গেলো নাকি? মনে পরতেই মায়ের উদ্দেশ্যে ফট করে বললো,
- মেহনূরের শাড়ি কই? ওর শাড়ি যে দিলে না। ও কাল কি পরবে?
প্রশ্নটা নেহাত সুজলার জন্য ছিলো। কিন্তু সেটা বিফল করে মেহনূর জবাব দিলো,
- আমি কোনো শাড়ি পরবো না বুবু। তোমাদের সাথে আমাকে জড়িও না।
এমন রসশূন্য কথা শুনে ভ্রু কুঁচকালেন সুজলা। চড়ের জন্য হাত উঠিয়ে কপট রাগে বললেন,
- একটা মা:রবো! তুই কি আলাদা নাকি? ওরা শাড়ি পরবে মানে তুইও পরবি, সোজা হিসাব। আয় আমার সঙ্গে। তোর শাড়ি আমি দেখাচ্ছি। উঠ্ এখন।
অগত্যা বসা থেকে উঠে গেলো মেহনূর। বড়মার পিছু-পিছু আলমারির কাছে গেলো। বাকি দুজন নিজেদের শাড়ি পেয়ে চুপচাপ সটকে পরলো। সুজলা আলমারির দ্বিতীয় দ্বার খুললেন, ভেতর থেকে একটান দিয়ে শপিংব্যাগ আনলেন। মেহনূরের সামনে ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করলেন। মেহনূর সেটা দেখে সমান্তরাল কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। সন্দিহান দৃষ্টিতে বড়মার দিকে তাকাতেই সুজলা একটি শাড়ি মেলে ধরলেন। জামদানি কাপড়ের গাঢ় নীল শাড়ি। নিচের একপ্রস্থ পাড়টা কুচকুচে কালো। পুরো শাড়িটার উপর কালো সুতার বুনন। মেহনূর হঠাৎ অস্থির অনুভব করলো। রঙটা খুব পরিচিত, খুব বেশি ঘনিষ্ঠ। ওই রঙটার কাছে মন বারবার হেরে যায়, খুব অদ্ভুত কারণে আসক্ত হয়। ঠোঁট নিঃসৃত হয়ে শুধু একটাই শব্দ বেরুয় ' নেভি '। শাড়িটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই সুজলা সেটা এগিয়ে দিলেন। মেহনূরের ডানহাত টেনে শাড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
- এটাই পরিস। তোকে খুব সুন্দর লাগবে। ভেতরে ব্লাউজ-পেডিকোট সব মাপমতোন আছে। কাল সুন্দর করে পরিস।
কিচ্ছু বলতে পারলো না মেহনূর। কিচ্ছু বলতে পারলো না। শাড়িটা হাতে নিয়ে নির্বাক হয়ে গেছে। প্রত্যুত্তরে কি বলা দরকার, সেই হুঁশ নেই। কোনো কথা না বলে রোবটের মতো বেরিয়ে গেলো। খালি দরজার দিকে দৃষ্টি ফেলে মুচকি হাসলেন সুজলা। বহুদিন পর কারোর সুপ্ত ইচ্ছাটা পূরণ করলেন তিনি।
শাড়ি হাতে নিজের রুমে ফিরলো মেহনূর। দুহাত নামিয়ে শাড়িটা বিছানার উপর রাখলো। সকালের ঝিরঝিরে হাওয়াটা এখনো শীতল। সেই হাওয়াটা রুম ছাপিয়ে দাবড়াচ্ছে। জানালার পর্দা উড়াচ্ছে, মেহনূরের চুল উড়াচ্ছে, আরো উড়াচ্ছে টেবিলের কাগজ। পড়ন্ত বিকেলের শান্তমূর্তির চেহারা দিগ্বিদিক ছাপিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু হবে। উচাটন মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না, কেমন যেনো হচ্ছে। এ অনুভূতি কি ভয়ের না অভয়ের বুঝতে পারছেনা মেহনূর। দৃষ্টিটা উদভ্রান্তের মতো দিশেহারা হতেই অস্থির অনুভব করছে। কানে আসছে কাগজ উড়ার শব্দ। কোনো শব্দই আজ স্বাভাবিক লাগছে না। শব্দের খোঁজে ডানে তাকাতেই টেবিলের খাতাটা দেখতে পেলো। তখনই অন্যদিক থেকে ফোন বিপ্ করে উঠলো। ম্যাসেজের টিউনটা তোয়াক্কা করলো না মেহনূর। টেবিলের দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো। মুখের উপর একগুচ্ছ চুল ঝাপটা খেতেই উড়ন্ত পেজে চোখ পরলো। তৎক্ষণাৎ বুকটার মধ্যে ধ্বক করে লাগলো! কেউ যেনো সজোরে করাঘাত মারলো! অবিরাম নিশ্বাস নিতে-নিতে খাতার শেষভাগে তাকালো মেহনূর। সেই Ans থেকে Ansari লেখাটায় থমকে গেলো সে। বাতাসের উচ্ছ্বাসময় অবস্থা এখনো পেজটা উড়াচ্ছে। ফোনের দিকে একটুও ধ্যান গেলো না ওর। খাতাটা বন্ধের জন্য লেগে পরলে ফোনের ব্যাপারে ভুলেই গেলো। মেহনূর জানতেও পারলো না ফোনটার কাহিনি। ধরতেও পারলো না, কেনো ফোনটা বিপ্ হলো। নোটিফিকেশনের পর্দায় ছোট্ট ম্যাসেজটা দেখতে পেলো না সে। সাইড ব্যাগের ভেতরে এখনো স্ক্রিনটা জ্বলে আছে। স্ক্রিনের উপর ভেসে আছে গানের গোটা-গোটা শব্দ,
' আমি জানি কোনো একদিন,
কোনো এক নতুন ভোরে।
দেখা হবে আমাদের আবার,
এক স্বপ্নের শহরে। '
***
অদ্ভুত দোলাচলে ফাঁসলো মেহনূর! সকাল থেকেই অশান্ত অনুভব হচ্ছে। কি নিয়ে অবচেতন মন হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, টের পায়নি সে। ঘুম থেকেই উদভ্রান্তের মতো মায়ের রুমে চলে যায়। গিয়ে দেখে মা ঘুমাচ্ছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। মেহনূর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে না, চুপচাপ চলে আসে। একটু পরেই অনুষ্ঠানের জন্য রেডি হতে হবে। সেটা নিয়েই সাবা ও সুরাইয়ার মধ্যে বিশেষ আলোচনা হচ্ছে। সাবা পায়েল পরবে, না নূপুর পরবে, সুরাইয়া চুড়ি পরবে, না ব্রেসলেট পরবে, এসব নিয়ে দফায়-দফায় মতামত রাখা হচ্ছে। মেহনূর একবার ওদের দিকে তাকালো, পরক্ষণে চোখ নামিয়ে রুমের দিকে চললো। সিঁড়ির ধাপে পা ফেলছে, আর এলোমেলো ভাবনাগুলো প্রশ্ন হয়ে ছুটছে। সকালের ঘুমটা বীভৎস স্বপ্ন দেখে ভেঙ্গেছে। স্বপ্নটার আগাগোড়া ধরতে পারেনি সে। রাত থেকে উদ্ভট-উদ্ভট খেয়াল ঘুরপাক খাচ্ছে। একটুও স্বস্তি পাচ্ছে না মেহনূর। রুমে ফিরতেই অগোছালো বিছানায় হাত দিলো। কাঁথাটা ভাঁজ করতে-করতেই ঘড়ির দিকে তাকালো। সকাল আটটা বেজে চল্লিশ মিনিট। অনুষ্ঠান শুরু হবে দশটার দিকে। রওনা দিতে হবে পৌণে দশটার দিকে। মেহনূর আজ অস্থিরচিত্তের জন্য স্বস্তিবোধ করছে না। সবকিছুতে অর্থবহ দিকটা যেনো ফুটে-ফুটে আছে। এই যেমন, সকালবেলাটা রোজকার মতো লাগছে না। মনেহচ্ছে সকালের জ্বালাময়ী রোদটা আজ একটু মিষ্টি। প্রকৃতির বাতাসটা পোষ মানা হরিণের মতো নরম। গাছের ডালপালা নড়ার শব্দটা শ্রুতিমধুর। রুমের ভেতর অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি আলো ঢুকেছে, একটা মিঠে গন্ধ চর্তুদিকে মিলেমিশে আছে। আজকের মতো ব্যাপারটা কি প্রতিদিন ঘটে? প্রতিদিন একইরকম ছবি নিয়ে সবকিছু বহাল থাকে? নাকি শুধু আজকের বেশভূষা বদলে গেছে? সবকিছুতে মায়া লাগানো উচ্ছ্বাস অনুভূত হচ্ছে, নাকি সবই ভ্রম? নাকি সবই মস্তিষ্কের চাতুরতা?
.
উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছেন সুজলা। রাত থেকে ঘুম নেই। নিরুপায় ভঙ্গিতে জিকির করছেন তিনি। প্রতিমূহুর্তে চিন্তায়-চিন্তায় আরো গুটিয়ে যাচ্ছেন। এবার সত্যিকার অর্থেই মাহমুদা নেতিয়ে পরেছে। মাহমুদার মুখে যেই কালো ছাপটা লেগেছে, সেটা ভয়ংকর। মুখে ব্যক্ত করা মুশকিল। সচরাচর কাদের মুখের ওরকম ছাপ পরে, এ নিয়ে ভালোভাবে জানেন তিনি। আগাম পরিস্থিতি কেমন হবে, সেটা নিয়ে জল্পনা করে শেষ। শুধু একাগ্রচিত্তে নিজেকে শান্ত রেখে চলেছেন। তিনি যদি ভেঙ্গে পরেন, পুরো খুঁটি উলটে সব নষ্ট! এখনো কাধে দায়িত্বভার আছে। সংসারের সবকিছু দেখার পাশাপাশি দুই বিবাহযোগ্যা মেয়ের চিন্তা আছে। মেহনূরকে আগলে রাখার জন্য শক্ত চেতনা থাকা লাগবে। শেফালির পাশে ঢাল হিসেবে থাকার জন্য বদ্ধপরিকর হতে হবে। সুজলা দুচোখ বন্ধ করে বুকভরা নিশ্বাস নিলেন। ডানহাতের তসবীটা ঠোঁটে ছুঁয়ে চুমু খেলেন। তিনি আজ বড়ো একা। উনার পাশে সাহস জোগানোর মানুষ নেই। তিনি সকলের কাছে শক্ত প্রতিমা সেজে থাকেন, কিন্তু নারীহৃদয়ের অবলুপ্ত চেহারা চার দেয়ালের ভেতর গুটানো। শ্বশুরের কলঙ্ক দিনের-পর-দিন মাথায় নিয়ে চলছেন, তবুও নির্বিকার চিত্তে দৃঢ়তার সাথে বসবাস করে যাচ্ছেন। আজ যেনো মুমূর্ষু ঘন্টার সংকেত না বাজুক। কারিস্মার মতো সব যেনো ঠিক হোক। মেহনূরকে নিজের পেটে ধরেননি ঠিকই, কিন্তু মাতৃস্নেহের আদরটা কোনোঅংশে কম রাখেননি। শানাজ ও সাবাকে যেই নজরে এতকাল বড় করলেন, তেমনি ছায়াতল দিয়ে প্রতিটাক্ষণ আগলে রেখেছেন। অপরদিকে তন্নতন্ন করে মাহতিমের দোষটা আজও খুঁজে পাননি। যদি স্ত্রীর প্রতি ক্ষোভ বা বিরক্তি থাকতো, তাহলে মাসে-মাসে বেহুদা কারণে টাকা পাঠাতো না। মেহনূর এখনো কিছু জানে না। তাকে জানানোর জন্য নিষেধ করা হয়েছে। ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে জিকির করছেন সুজলা, সেই ভঙ্গিতেই রুম ছেড়ে মাহমুদার রুমে গেলেন। দরজা ভেজিয়ে তার শিউরের কাছে বসলেন। বহু ধরনের আমল পড়ে মাহমুদার মুখে ফুঁ দিলেন। মুখের উপর ফুঁকার অবস্থা টের পেলো। ঘুমন্ত মাহমুদা চোখ খিঁচুনি দিয়ে আস্তে-আস্তে তাকালো। ঝাপসা জ্যোতিহীন দৃষ্টিতে সুজলার নতমুখ দেখে দূর্বল গলায় বললো,
- ভাবী..
সুজলা পরাজয়ের মতো চোখ বুজে ফেললেন। এই রুগ্ন চেহারা দেখে নিজেকেই গালাগাল করছেন। দুনিয়ার নিষ্ঠুর নিয়মটা বড়োই অসহ্য। তাকে কি বলে আশ্বস্ত করবেন? কিভাবে সুস্থতার খেতাব নিয়ে অটল থাকতে বলবেন? চোখ খুললেন সুজলা। সরাসরি মাহমুদার দিকে দৃষ্টি পরলো। মাহমুদা অভয় নয়নে শান্ত শিশুর মতো তাকিয়ে আছে। যেনো মায়ের কাছে অব্যক্ত প্রশ্নের উত্তর চাচ্ছে। তসবীটা নিজের কোলে রেখে জীর্ণ কপালে হাত ছুঁয়ে দিলেন। সবটুকু নিরাশা মাটি করে হাসি মুখে বললেন,
- ও শাড়ি পরছে ছোটবউ। আজ দেখিও কেমন করে সাজে। তোমার মেয়েটা এতোদিন যা অবস্থা করলো, ভুলবো না। এই সালোয়ার-কামিজের জন্য কম যন্ত্রণা পোহাইনি। মিয়া-বিবির টানাপোড়নে আমি একদম শেষ। এখন কি নিয়ে চিন্তা হচ্ছে জানো? মাহতিমকে নিয়ে। ছেলেটা খুব ভরসা করে শাড়িগুলো পাঠাতো। এতোদিনে শাড়িগুলো কি করেছি শুনলে, না-জানি কেমন অবস্থা করবে। যাইহোক, তুমি ঘুমাও। তোমাকে একঘন্টা পর ঔষুধ দেবো, ঠিকআছে?
.
ফর্সা দেহটা স্নানে সিক্ত। স্নান শেষে চামড়াটা সোনালি রোদ্দুরের মতো ঝিকমিক করছে। অদ্ভুত শোভায় লালিত্য হয়ে মনোহর লাগছে। গামছায় পেঁচানো চুলগুলো ছেড়ে দিলো মেহনূর। মেঝের উপর আকস্মিক বর্ষণের মতো টুপটাপ পানি ঝরলো। কিছু পানি চুয়ে-চুয়ে ঘাড় বেয়ে গায়ের বসন ভিজিয়ে দিচ্ছে। ব্লাউজটার পিঠ একটু-একটু করে পানি শোষণ করছে। সকালের একটু মিষ্টি, একটু ঝাঁজালো রোদটা মেহনূরকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। বাতাসের কল্লোলটা ভেজা চুলগুলো নাড়াতে ব্যস্ত। লম্বা চুলগুলো আজ যত্ন করে ধুয়েছে। কেনো ধুয়েছে জানা নেই। চুলের মিষ্টি ঘ্রাণে পুরো রুমটা ছেয়ে গেছে। সেই সুঘ্রাণের সাথে তরতাজা ফুলের গন্ধ জুড়ে আছে। গাঢ় নীল পেডিকোটটা একদম ঠিকঠাক। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দর করে ফিতাদুটো বাঁধলো মেহনূর। টেনশন ছিলো মখমলের নীল ব্লাউজটা নিয়ে, সেটাও দেখি মাপমতো হলো। কি আশ্চর্য! বড়মা তো সবসময় মাপ নিয়ে ভুল করতো। ভুল না হলেও গড়পড়তা ঠিকই করতো। এবার ব্যতিক্রম হলো কি করে? না, এটাও স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে ফেলা যাচ্ছে না। কেনো এমন হচ্ছে? সবকিছুতে অন্যরকম ছোঁয়া লেগে আছে। শাড়ির ব্যাপার নিয়ে সবসময় দুটো মানুষ ঠিক থাকতো। প্রথমটা ছিলো আম্মা, দ্বিতীয়টা ছিলো মাহ ---, আর চিন্তা করলো না সে। এমন আবোলতাবোল চিন্তার মানে আছে? হাতে বেশি সময় নেই। একটু দ্রুত রেডি হলে ওরই লাভ। শাড়িটা চটপট করে পেডিকোটের ভাঁজে-ভাঁজে গুঁজতে থাকলো। সেই পুরোনো দিনের মতো দক্ষ হাতে রপ্ত করে শাড়ি পরে ফেললো। আঁচলটা বাঁ-কাধের সাথে মজবুত করে আঁটকালো। আয়নায় দেখলো, ব্লাউজটার স্লিভ কনুই পযর্ন্ত থেমেছে। এটাও কি অস্বাভাবিক ব্যাপার না? বিয়ের পর সবসময় এ ধরনের ব্লাউজ পরতো। তাও একজনের ইচ্ছানুসারে পরতে হতো। তাহলে এটা ---, আবার মাথা ঝাড়া দিলো সে। অদ্ভুত চিন্তা দূর করতে হবে। মাথার ডানদিকে তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে সিঁথি কেটে নিলো। চিরুনি তুলে চুলগুলো আঁচড়ে ফেললো। মুখে লাগালো স্বাভাবিক মাত্রার প্রসাধনী। না কম, না বেশি। যতটুকু লাগালে একটা মানুষকে জাঁকজমক লাগবে না, মেহনূর নিজেকে সেই ধারায় রাখলো। বড় বড় আঁখিদুটোয় কাজল টেনে নিলো। সাবার দেওয়া ভ্রঁ পেন্সিলটা একটুখানি ছোঁয়ালো। নরম-কোমল-আরক্ত ঠোঁটদুটোতে লিপস্টিক ছুঁইয়ে নিলো। কর্ণলতির সুক্ষ্ম ছিদ্রে টপ ঢুকিয়ে ফেললো। দুহাত ভরে রিনঝিন শব্দে নীল চুড়ি পরলো। নিজেকে দেখার জন্য আয়না থেকে দু'কদম পিছিয়ে গেলো মেহনূর। পুরো প্রতিবিম্বটা আয়নায় ফুটলে দরজায় করাঘাত পরলো। চট করে ডানে তাকালো সে। দরজার হাসিমুখে সাবা দাঁড়িয়ে আছে। দুহাতের মুঠোয় সাদা-সাদা গোলাপ ফুল। ভেতরে ঢুকে কাছে আসতেই আমোদ গলায় বললো,
- আয়, নীল পরীকে সাদা ফুল লাগিয়ে দেই।
সাদা ফুলের দিকে একপলক তাকালো মেহনূর। লোভাতুর ফুলগুলো চুলে দেওয়ার জন্য ছটফট হচ্ছে। টাটকা ফুলের গন্ধে আরেকটু সিক্ত হওয়ার জন্য মনটা বড্ড চন্ঞ্চল। মেহনূর দুঠোঁট প্রসার করে হাসি দিয়ে বললো,
- তাহলে লাগিয়ে দাও। দেরি কিসের?
খুশিতে ফুল নিয়ে চলে এলো সাবা। মাথার পেছনে একটা-পর-একটা ফুল সারিবদ্ধ করে বেঁধে দিলো। মেহনূরকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আপাদমস্তক দেখলো সে। ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল উঁচিয়ে এমন ইশারা করলো, যেটার অর্থ হচ্ছে, ' একদম ফাটাফাটি লাগছে। পার্ফেক্ট! ' বোনের কাছ থেকে প্রশংসা শুনে খিলখিল করে হাসলো মেহনূর। কাধে ব্যাগ তুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। দুবোন রুম থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি হাঁটছিলো। সাবা মাথা চুলকানোর ভান ধরে ফিসফিস করে বললো,
- ইশশ, যদি নেভির মানুষজন দেখতো..
মেহনূরও ফিসফিস করে মলিন হাসিতে বললো,
- সেটা জীবনেও সম্ভব না। দিনেরবেলা কখনো চাঁদ উঠে না।
.
গ্রাম্য কলেজ হলেও আয়তন বিশাল। সেই বিশাল আয়তনের গোলাকার মাঠে প্যান্ডেল বসানো হয়েছে। বাঁশের খুঁটি গেড়ে-গেড়ে পুরো মাঠ সাজানো হয়েছে। মাথার উপর সাদা-নীল-গোলাপী রঙের তেরপাল টাঙানো। নীল রঙের চেয়ার বিছিয়ে বসার স্থান রেখেছে। গান বাজনার জন্য চারটা বড়-বড় সাউন্ড সিস্টেম। স্টেজে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে ' হ্যালো মাইক টেস্টি, ওয়ান টু ' বলা হচ্ছে। কলেজের চর্তুদিকে শিক্ষার্থীদের ভীড়। অবস্থা এমন, যেনো বিরাট উৎসব লেগেছে। সেখানে সবাই জাঁকজমকের সাথে সেজেগুজে এসেছে। কলেজটা মেয়েদের হলেও আজকের জন্য সেটা উন্মুক্ত করা। ফলে, ঝালমুড়ি, ফুচকা, ভেলপুড়ি, আচার-সহ সব খোলা খাবারের পসরা বসেছে। মানুষের কিলবিল অবস্থা যেনো চোখ ধাঁধানোর মতো। সুরাইয়া এমন অনুষ্ঠানে আসতে পেরে খুশিতে আত্মহারা! একটু পরপর ফুচকার জন্য ছুটে যেতে চাইছে, কিন্তু সাবার চোখ রাঙানি দেখে সাহস পাচ্ছে না। আধঘন্টার ভেতরেই উপস্থাপনার জন্য ছুটে যাবে সুরাইয়া। উপস্থাপনার ব্যাপারটা সাবাও একটু আগে জেনেছে। সুরাইয়া ভেবেছিলো, সাবা ইচ্ছামতো বকবে। কিন্তু, না, বকেনি। শুধু চিন্তার সুরে বলেছে,
- আম্মা জানলে রক্ষে নেই। সেটা নিয়ে কিছু ভেবেছিস?
সুরাইয়া অপরাধীর মতো ' না ' সূচকে মাথা নাড়লো। দোষীদের মতো নিচু সুরে বললো,
- এজন্যই আগ বাড়িয়ে জানাইনি। আমার উপস্থাপনা করার খুব শখ। ফেরদৌসী ম্যাডাম আছে না? ওই ম্যাডাম আমার উপস্থাপনা দেখে অনেক প্রশংসা করেছে।
এরপর আর কথা হয়নি। সাবা শান্তভাবে বুঝিয়ে দিলো, বাড়ির ব্যাপারটা বাড়িতেই দেখা যাবে। আপাতত এই কাজে মনোযোগ দিতে। সাবার সায় ও সম্মতি পেয়ে সবটুকু সঙ্কোচ ঘুচে যায় ওর। আনন্দে-খুশিতে দুহাতে জাপটে ধরে সাবাকে। অনেকগুলো ধন্যবাদ জানিয়ে স্টেজের জন্য চলে যায়। সাবা আশেপাশে নিরীক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এখনো আসেনি কেন? আর কতক্ষণ ওয়েট করবে? বেশি ভীড় হলে কথা বলাটা মুশকিল হবে। সাবার বেচইন অবস্থাটা ধরতে পারলো না মেহনূর। সে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। ভীড় ছেড়ে সেখানে বসার জন্য সাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
- ওই কৃষ্ণচুড়া গাছটার কাছে যাই। চলো, ওখানে গিয়ে বসি। সুন্দর ঘাস আছে। জায়গাটাও নিরিবিলি। এখানে ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না বুবু। চলো না, ওখানে যাই?
কথামতো দূরের গাছটার দিকে দৃষ্টি রাখলো সাবা। মনে-মনে বললো, এটাই মোক্ষম সুযোগ! যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। মেহনূরকে ওখানে পাঠানোর জন্য ছোট্ট কৌশল খাটালো। মেহনূরের দিকে একটু উদ্বিগ্ন হয়ে তাকালো সাবা।কিছুটা চিন্তিত ভান ধরে বললো,
- ওখানে বসতে চাচ্ছিস? মানুষই তো নেই। বেশি নিরিবিলি জায়গা হলে সমস্যা। যদি সাপ থাকে?
মেহনূর আশ্বস্ত সুরে জানালো,
- কোনো সমস্যা নেই বুবু। আমি আগেও ওখানে গিয়েছি। জায়গাটা একদম পরিষ্কার। তুমি আমার সঙ্গে আসো।
প্রসঙ্গটা কাটাতে চাইছে সাবা। ওখানে যাওয়া যাবে না। যে করেই হোক, মেহনূরের কাছ থেকে দূরে সরতে হবে। মেহনূর যতক্ষণ সাথে থাকবে, ততক্ষণে পযর্ন্ত নিস্তার নেই। আরেকবার সবদিকে সতর্কতার সাথে দৃষ্টি বুলালো। হঠাৎ ফুচকাওয়ালার পাশে চোখ আঁটকে গেলো। এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে সুরাইয়ার দিকে তাকালো সাবা। সুরাইয়া এখন স্টেজে ব্যস্ত। ঢোক গিললো সে। খুব ঠান্ডা মাথায় মিথ্যা বানাতে হবে। একটু ধাতস্থ হয়ে মেহনূরের দিকে তাকালো। ঠোঁটে মিথ্যা হাসি টেনে স্বচ্ছ গলায় বললো,
- আমার বান্ধুবী নুসরাতকে চিনিস? আমি ওর জন্য দাঁড়িয়ে আছি। ও আমাকে এখানেই দাঁড়াতে বলেছে। যদি এসে খুঁজে না পায়? তখন আবার বকাবকি করবে। তুই একটা কাজ কর্। তুই বরং ওদিকটায় বস। আমি এখুনি ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করি, দেখি কোথায় আছে।
চট করে ব্যাগে হাত ঢুকালো সাবা। চেইন খুলে মোবাইল বের করলো। মেহনূরকে আরেকটু ঘোলাটে করার জন্য কানে ফোন চাপলো। মেহনূর ' ঠিকআছে ' বলে চুপচাপ চলে গেলো। হেঁটে-হেঁটে গাছটার নিচে চলে আসলো সে। পাতার ফাঁকফোকর গলে সূর্যের আলো ঘাসের উপর পরছে। চর্তুদিকে রক্তিম ফুলগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সবুজ ঘাসের উপর লালবর্ণটা চমৎকার!কাধের ব্যাগটা ঘাসের উপর রাখলো মেহনূর। হাত বাড়িয়ে বড় একটা ফুল তুলে নিলো। ঘ্রাণ শুঁকার জন্য চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিলো। বেলীফুল বা গোলাপের মতো সুঘ্রাণ নেই। তবে রঙটা এতো রাজকীয় যে, চোখের কাছে মারাত্মক লাগে। ফুল নিয়ে ব্যস্ত হতেই হঠাৎ ভ্রুঁ কুঁচকে গেলো। যেদিকটায় সাবা দাঁড়িয়েছিলো, সেখানে সে নেই। পুরোপুরি খালি। সাবা সেকেন্ডের ভেতর কোথায় গেলো?
.
মাঠ পেরিয়ে কলেজে বাইরে গেলো সাবা। সামনে আগাচ্ছে, আর বারবার ডানকাধের কাছে মুখ এনে আড়চোখে তাকাচ্ছে। পিছু-পিছু সে আসছে কিনা, এটাই দেখছে সে। শাড়ি ধরে দ্রুতপায়ে পাশের পরিত্যক্ত জায়গায় ঢুকলো। সেখানে এসময় কখনো মানুষ থাকে না। মেহগনি গাছের নিচে ছায়া দেখে সেখানে যাচ্ছিলো সাবা। পিছু-পিছু উক্ত ব্যক্তিও হাজির। সবটুকু নিরবতা চুরমার চেঁচিয়ে ডাকলো সে,
- সাবা!
খট করে দাঁড়িয়ে পরলো সাবা। তবে মাথা পিছু ঘুরালো না। পেছনের উক্ত ব্যক্তি সাবাকে থামতে দেখে একদৌঁড় দিয়ে সামনে আসলো। সাবার মুখোমুখি হতেই ভ্রুঁদুটো কুঁচকে বললো,
- তুমি আমাকে কোন্ সাহসে ইগনোর করছো?
সাবার চাহনি কঠোর। দাঁত যে রাগে কটমট করে সেটা স্পষ্ট! নাক ফুলিয়ে দম ছাড়লো সে, রাগী সুরে ধীরে-ধীরে কথা টানলো,
- আপনার মামার ঘটনা ভুলিনি তানভীর। নিশ্চয়ই সেটা আঙ্গুল দিয়ে বোঝাতে হবে না। ওইদিন আমার বোনদুটোকে শয়তানের মুখে ফেলে দিয়েছো। আমার আম্মাকে কি পরিমাণ অপমান করেছো, আমি ভুলিনি।
প্রতিটি বাক্যের মধ্যে রাগ মেশানো। জ্বলন্ত শিখার মতো সেটা জ্বলছে। রোষের আগুনটা চেহারার উপর আশ্চর্যভাবে প্রভাব ফেলেছে। তানভীর নিরুত্তেজ চোখে তাকালো, নিজেকে দোষী সাবাস্ত করে বললো,
- আমিতো ভুল স্বীকার করছি। কেনো আমাকে সুযোগ দিচ্ছো না? আমাকে কেনো ফিরিয়ে দিচ্ছো? আমার মধ্যে কি নেই সাবা? তোমাকে বিয়ে করতে চাইলাম, সেটাও ফিরিয়ে দিলে।
তৎক্ষণাৎ চিৎকার করলো সাবা। তর্জনী উঁচিয়ে রুষ্ট গলায় বললো,
- চুপ! আমি সাফাই শুনতে আসিনি। শুধু এটাই বলতে এসেছি, আমার পিছুটা ভদ্র মানুষের মতো ছেড়ে দিন। আমাকে সহজভাবে নিয়েছেন, সেটার জন্য এখনো চুপ করে আছি। আমার আম্মার কানে যদি কথা লাগাই, এখনই আপনার চামড়া ছিঁড়ে লবণ লাগাবে।
ক্ষুদ্ধ চাহনিতে এক-পা এগুলো তানভীর। আকস্মিকভাবে আগানো দেখে পিছিয়ে গেলো সাবা। ক্রুদ্ধভাবে গলা উঁচালো তানভীর, রাগের কাছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভুল কথাটা বলে ফেললো,
- তোমার মেইন সমস্যাটা আমার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে। যেদিন থেকে শুনেছো শহরে থাকি, এখানে কাজের জন্য এসেছি, সেদিন থেকেই আমাকে ইগনোর করে যাচ্ছো। ব্যাপারটা বুঝিনি মনে করছো? আরে, হান্নান মোল্লার কাহিনি শুনেনি? তোমার আনসারী ভাইয়ের ঘটনা শুনিনি? সবই শুনেছি। তোমার ছোটবোনের জন্য আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছো সাবা। ওই মেয়ে স্বামীর কাছে লাত্থি খেয়ে ফিরেছে, সেটার জন্য তুমি আমার সাথে ---
প্রচণ্ড ক্ষোভে বাতাসের তাল কেটে চড় মারলো! ঠাস জাতীয় আওয়াজটা চর্তুদিকে ছড়িয়ে পরলো! তানভীর মূর্তির মতো ডানগাল ধরে থমকে গেছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে সাবার পানে তাকিয়ে আছে। সাবা ফুসতে থাকা রাগের চোটে আবার তর্জনী তুললো, পূর্বের চেয়ে দ্বিগুন ক্ষোভ দেখিয়ে ' না ' সূচকে মাথা নাড়ালো,
- আমার পরিবার নিয়ে একটাও কথা না! যেখানে আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলা করা হয়েছে, সেখানে আমি চুপ থাকবো না। আমাকে অতো স্বস্তা ভেবে ভালোই ভুল করেছেন। ভেবেছিলেন, গ্রামের মেয়েকে যা বুঝাবো, তাই বুঝে যাবে। আহ্, এতোই সহজ? আমাদের গ্রামে আসিয়েন, আমাদের তল্লাটে ঢুকলে আসল চেহারা চিনিয়ে দেবো। হান্নান মোল্লা সবার সাথে খারাপ করেছে। কিন্তু আমাদের সাথে গলা উঁচিয়ে কথা বলেনি। অন্তত আমার দুলাভাই নিয়ে কথা বলার আগে নিজের যোগ্যতা দেখিয়েন। আমি আমার বাকি বোনদের মতো শান্ত মেয়ে না। যদি আমার আশেপাশে দ্বিতীয়বার দেখি, খবর আছে। ভুলেও আমার বোনদের পিছু ঘাঁটাতে যাবেন না। কপালে কোন্ শনির আঁচড় বসাবো, সেটা সময় মতো দেখতে পাবেন।
দম্ভভরে তর্জনী নামালো সাবা। দুহাতে এক ধাক্কা মেরে তানভীরকে সরিয়ে দিলো। কোনো মেয়ের কাছে এই প্রথম অপদস্থ হলো তানভীর। বুকের চিতা পযর্ন্ত থরথর করে কাঁপছে। রাগ সংবরণ করতে দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করেছে। মাটি থেকে দৃষ্টি তুললো তানভীর, সাবার শেষ যাওয়াটার দিকে বিক্ষুদ্ধ চাহনিতে ঢোক গিললো।
.
- মেহনূর?
নিজের নাম শুনে চোখ তুললো মেহনূর। সামনে বাংলা বিভাগের লাকী মজুমদার ম্যাডাম দাঁড়িয়ে আছে। ম্যাডামকে দেখে ত্রস্তভঙ্গিতে দাঁড়াতেই মেহনূর সম্মানসূচকে বললো,
- আদাব ম্যাডাম, কিছু বলবেন?
ম্যাডাম একটু ক্লান্ত গলায় অনুরোধ করে বললো,
- আদাব, একটু হেল্প করবে? কাল কলেজ বন্ধ দেখে পাঠাগার থেকে বই আনতে গেছিলাম। ভুলে পাওয়ার চশমাটা ফেলে এসেছি। একটু এনে দেবে?
কলেজের ছাত্রীরা যখন মেহনূরের সংসার নিয়ে হাসাহাসি করতো, তখন এই ম্যাডামই সবাইকে তিরষ্কার করেছে। মানবিক অবক্ষয় নিয়ে এমন লেকচার ছুঁড়েছে, আজ অবধি নির্বিঘ্নে কলেজ করলো মেহনূর। তাই শ্রদ্ধাভরে আদেশটা মেনে নিলো সে,
- আপনি ওদিকটায় বসুন ম্যাডাম। আমি এক্ষুনি আপনার চশমা এনে দিচ্ছি।
ঘাসের উপর ব্যাগ ফেলে পাঠাগারের রাস্তা ধরলো। পাঠাগারটা একটু দূর। একদম কোলাহলমুক্ত শান্ত জায়গা। দোতলা বিল্ডিংয়ের পুরোটাই পাঠাগার করা হয়েছে। আজ সেটা খোলা থাকলেও লাইব্রেরিয়ান কাকা ছুটিতে। মেহনূর পায়ে-পায়ে হাঁটে পাঠাগারে পৌঁছলো। চারটা সিঁড়ি পেরিয়ে কাঠের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকলো। ভেতরে একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। মেহনূর সুইচবোর্ডে আঙ্গুল চেপে দুটো বাতি ধরিয়ে নিলো। ভেতরে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাতেই কাঠের টেবিলে চশমা দেখতে পেলো। সেখানে যেতেই একপ্রস্থ হাসি দিয়ে চশমাটা হাতে তুললো মেহনূর। যাক, বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। চশমার ডাঁটদুটো বন্ধ করতে নিলে অদ্ভুত একটা আওয়াজ হলো। ধপ্ ধপ্ শব্দটা কিসের? পায়ের আওয়াজ না? শব্দটা তীব্র থেকে তীব্রতর হতেই চট করে পিছু তাকালো মেহনূর, ওমনেই এক চিৎকার দিয়ে পিছিয়ে গেলো সে! বুকটা ধক্ ধক্ করে লাফাচ্ছে! হৃৎপিন্ডটা বুঝি খাঁচা চিঁড়ে বেরিয়ে আসবে! মাথার ভেতর রি-রি জাতীয় বারি খাচ্ছে। ভয়ে একদম বিবর্ণ অবস্থা, মেহনূর কথাই বলতে পারছেনা। এই ছেলে এখানে কি করছে? মেহনূর অনেক কষ্টে ঢোক গিললো, সমস্ত ভয় চেপে প্রশ্ন করে বসলো,
- এখানে কি? কিসের জন্য এসেছেন?
তানভীর একটু চুপ থেকে অদ্ভুত গলায় বললো,
- আপনার জন্য। প্রচুর হিসাব-নিকাশ বাকি তো। বলুন, কোথা থেকে শুরু করবো? কিভাবে করলে আপনি খুশি হবেন?
নিশ্বাসটা যেনো আঁটকে এলো। এই ছেলের মতলব কি? কথার ভাবগতিক স্বাভাবিক না, একদম স্বাভাবিক না। এখান থেকে চিৎকার দিলেও বাইরে পৌঁছবে না। গরমের জন্য মাথা ঝিমঝিম করছে। শান্ত থাকতে হবে, খুব শান্ত হবে। ভয়ের চেহারা দেখলেই আশকারা পেয়ে যাবে। আঁচলটা শক্ত করে খামচাতেই তানভীর নড়ে উঠলো। পায়ের দিকে তাকাতেই শরীর কাঁটা দিলো মেহনূরের। তানভীর একপা করে এগুচ্ছে। হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলে তৎক্ষণাৎ শিষ বেজে উঠলো। চমকে উঠলো তানভীর। শিষ বাজালো কে? তানভীর সামনে তাকিয়ে দেখলো, মেহনূর বিস্ফোরণ চোখে তাকিয়ে আছে। থপ্ করে হাতের চশমাটা পরে গেলো ওর। তানভীর কৌতুহল গলায় শুধালো,
- পেছনে ভূত নাকি? শা:লার ভূতেরাও বুঝি শিষ মা:রে!
গা:লিটা ছুঁড়েই পিছু তাকালো তানভীর। বিষ্ময়ে-অবাকে চূর্ণ হয়ে তাজ্জব বনে গেলো। এই লোক শিষ বাজালো কেন?
.
.
.
চলমান................................