!!১১৪!!
"আপনি আর কখনো মা হতে পারবেন না মিসেস ফায়রাজ।"
আজ মাহার চেক-আপ ছিলো। ডাক্তারের বলা শেষ বুলিটাই কেবল ঘুরছে মাহার মাথায়। মাহা আর কখনো মা হতে পারবেনা! গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে মাহা। মনটা ভিষণ বিক্ষিপ্ত। সার্থক পাশে ড্রাইভিং করছে। ধূসর বর্ণের আকাশ। মন কেমন করে উঠা আকাশের মতিগতি। আজ মাহার সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশেরও বুঝি মন খারাপ? এক নির্জন রাস্তায় গাড়ি থামায় সার্থক। দুপাশে ঘন সুপারি গাছের বাগান। নাম না কত পাখির ডাক ভেসে আসছে! দুজনেই নিরব হয়ে রইলো। সহস্র সময় বাদে মুখ খুলে সার্থক।
"মাহা?"
মাহা আনমনে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। সার্থকের ডাক বোধহয় পৌঁছায়নি তার কানে।
"মাহা, শুনছো?"
মাহার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরালো সার্থক। চোখ দুটো উদাসীন মাহার। নিজের সিট বেল্ট খুলে শক্ত করে মাহাকে জড়িয়ে ধরে সার্থক। কি যে হলো মাহার! কান্নার বাঁধ ভাঙে এবার। জীবনটাই গেলো কাঁদতে কাঁদতে। এখন কান্নারাও হার মেনে গিয়েছে যেন। মাহা ছিল শান্ত, ধীর, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন এক মেয়ে। কঠিন পরিস্থিতিও ঠান্ডা মাথায় কাজ করতো মাহা। আর আজ? কেন একজনের জীবনেই এত কষ্ট থাকে! একটু সুখের দেখা পেয়েও সেই সুখ ছোঁয়ার আগেই হারিয়ে গিয়েছে। নির্জনতা ছাপিয়ে আকাশে বাতাসে প্রতিফলিত হচ্ছে মাহার করুণ কান্নার সুর। এক হৃদয় ভাঙার সুর।
"চুপ, মাহা। আর না প্লিজ।"
মাহার কান্না যে সার্থকের সহ্য হয়না। অপারগ হয়ে বলে উঠে সার্থক। মাহার পিঠে হাত বুলায় অভ্যাসমত।
"আমি আর কখনো মা হতে পারবোনা সার্থক। আমি আপনাকে বাবা ডাক শোনার সুখ দিতে পারবো না। আমার যে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে সার্থক। আমার জন্য আপনি বাবা ডাক শুনতে পারবেন না।"
"চুপ, মাহা। আমার কিছু চাইনা। শুধু তুমি হলেই চলবে।"
"না, সার্থক। এটা হয়না। আপনি..আপনি আরেকটা বিয়ে করে নিন সার্থক। আমি চলে যাবো দূরে কোথাও।"
"বেশি বলে ফেললে না, তুমি? আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তুমি? এতো সাহস তোমার? কোথায় গিয়ে লুকাবে? পৃথিবীর যেই প্রান্তে যাও না কেন আমি সেখান থেকেই খুঁজে বের করবো তোমাকে, মাহা!"
মাহাকে ছেড়ে দিয়ে গর্জে উঠে সার্থক। মাহা হতভম্ব। সার্থক এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে ও কখনো ভাবেনি। সার্থক কোনোদিন মাহার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনা। গাড়িটা খুব দ্রুত চলছে। এমন সামান্য একটা কথায় সার্থক এতটা ক্ষেপে যাবে কল্পনাও করেনি মাহা। এ যেন অন্য সার্থক। এতটা রাগী! সারা রাস্তা আর একটা কথা বলার সাহস হয়নি মাহার।
______________
ঢাকার এক প্রসিদ্ধ বাস স্টেশন। আর কিছুক্ষণ বাদে বাস রওনা দিবে সিলেটের উদ্দেশ্যে। জানালার ধারে সিটে বসে শ্যামবতী এক পূর্ণ বয়স্ক রমনী। গাঁয়ে সাদামাটা হলদে রঙের শাড়ি। হাঁটু সমান চুলগুলোতে সবসময়ের মতো এলোমেলো বেণী। রমনীর চোখদুটো ভিষণ উদাস। আজ আবার বাবা-মাকে ছেড়ে, প্রিয় শহর ছেড়ে পাড়ি জমাবে সিলেটে। সেই সাথে না হওয়া প্রিয় মানুষটাকেও। রেজওয়ানকে এক তরফা ভালোবেসেছে এশা। সেই ছোটবেলা থেকে। তাই তো প্রিয় মানুষটার দেওয়া সামান্য আঘাতই ক্ষত বিক্ষত করেছে এশার হৃদয়কে। পাড়ি জমিয়েছে সুদূর বিদেশে। অপরিপক্ক থেকে পরিপক্ক হয়ে উঠেছে। পথটা বড়ই কঠিন ছিল। কিন্তু সেই মানুষটা? এতগুলো বছর কেটে গেলেও তিনি বিয়ে করেন নি কেন? ত্রিশের কোঠা পেরিয়েছেন সেই কবে। তবে কিসের এত অপেক্ষা? কার জন্য এত অপেক্ষা? পাখি তো নীড় ছেড়েছে বহুদিন আগে। হুম! মাহা অবুঝ হলেও এশা অবুঝ নয়। নিজের চোখে যে তৃষ্ণা ছিলো সেই তৃষ্ণা সে দেখেছে রেজওয়ানের চোখে। আফসোস! নিজের জন্য নয়। মাহা আপুর জন্য। এই কথাটা এশা কখনো কাউকে বলেনি। হৃদয়ের গোপন তালাবদ্ধ এক কুঠুরিতে যত্ন করে রেখেছিলো এতকাল। মাঝেমাঝে ভিষণ হিংসা হতো মাহা আপুর উপর। গাঁয়ের রঙের জন্যই কি তবে রেজওয়ানের ভালোবাসার রাণী মাহা? পরে আবার নিজেকে ধিক্কার দিয়েছে সহস্রবার। না, রেজওয়ান এমন মানুষ নন। মাহার বিয়ের খবর শুনে এতটা খুশি হয়েছিলো এশা! এবার বুঝি রেজওয়ানকে আপন করে পাবে তবে। না, সেটাও হয়নি। একবুক ভালোবাসার বদলে মিলেছে এক আকাশ অপমান, অবহেলা আর উপেক্ষা। এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে এশার বুক চিড়ে। ভালোবাসা না পাওয়ার হাহাকার। হঠাৎ কি মনে করে জানালা দিয়ে পিছনে তাকায় এশা। এটা স্বপ্ন? রেজওয়ান দাঁড়িয়ে। তার গাড়ির সামনে। আশেপাশে কি যেন ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজে চলেছে। ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে এশার বাস। তবে কি এএসপি রেজওয়ান এশাকে খুঁজতে এসেছে? হা হা করে হেসে উঠে এশার অদৃশ্য এক ছায়া। 'তোমাকে খুঁজতে আসবে? পাগল হলে? তুমি কি হও তার?' সত্যিই তো এশা তো কিছু হয়না। কিছু না। এশা সন্তপর্ণে চোখের জল মুছে ফেলে। আবারও বাইরে তাকিয়ে রেজওয়ানের প্রায় মিলিয়ে যাওয়া অবয়বটাকে বলে,
"ভালো থাকবেন। ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে আমাদের।"
রেজওয়ান হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। কেউ কি তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বললো? রেজওয়ান এখানে এসেছিলো এশার সাথে কথা বলতে। এশার বাড়িতে গিয়েছিলো। সেখান থেকেই জানতে পারে এশা আজ সিলেট চলে যাচ্ছে। বাস স্টেশনে তাই শেষবারের মতো আবার এসেছিলো ক্ষমা চাইতে। রেজওয়ান নিজেও জানেনা কেন এসব করছে? তবে মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে ক্ষমা না পেলে তার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু এশাকে বহু খুঁজেও পেলোনা রেজওয়ান।
.
.
.
চলবে.........................