প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল - পর্ব ৪৮ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


আকাশ পরিষ্কার। কালো আকাশ জুড়ে লক্ষ্য লক্ষ্য নক্ষত্র। রয়েছে গোলাকার সাদা ফকফকে চাঁদ। চাঁদের সৌন্দর্য আজ দ্বিগুণ রূপে জ্বলজ্বল করছে যেনো। আলোয় আলোকিত হয়ে আছে চারিপাশ। সম্পুর্ন ছাঁদ জুড়ে মানুষের হাঁটাহাঁটি, হাসাহাসি, তর্কবিতর্কের তীব্র শব্দ। 

ছাঁদের মধ্যখানে গোলাকার ভঙ্গিতে চেয়ার বসানো হয়েছে। চেয়ার গুলোর মধ্যেস্থানে বড়ো টেবিল। টেবিল জুড়ে রয়েছে নানান প্রকার খাবার। ইব্রাহিম সমান তালে খেয়ে চলেছে। চোখমুখ শক্ত। পাশে রুস্তম বসে। সেও চোখমুখ ক্রোধে ললাটে রূপ ধারণ করে খেয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে তর্কবিতর্ক চলছে। দুজন একসময় দাঁড়িয়ে পড়লো। যেমন তর্কাতর্কি এখনম মারামারির পর্যায়ে আসবে। দুজন মুখোমুখি ছুঁইছুঁই হয়ে। চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে একে অপরের পানে। তন্ময়, মাহিন, সৈয়দ তারা ছাঁদে উঠেছে কেবলই। মাহিন চেঁচাল, 'কি রে! এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছিস যেমন চুম্বনে লিপ্ত হবি দুজন! একটা রুমের চাবি কী দিব?'

অপ্রত্যাশিত কথায় ভড়কে গেল ইব্রাহিম। নাকমুখ কুঁচকে গেল মুহুর্তে। সাপের ন্যায় ফোসফোস করে সরে এলো। রুস্তম কম কীসে? সোজাসাপটা তেড়ে গিয়েছে মাহিনের দিক। কিছু বোঝাপড়া এখনই করবে সে। মাহিন দৌড় লাগিয়েছে। হেঁসে উঠেছে বাকি সকলে। খোলামেলা শব্দময় হাসি একেকজনের।

তন্ময় ছাঁদে উঠতেই, তাকে এ-সে অনেকেই ডাকছে। এতদিন পর দেখা৷ ডাকাডাকি স্বাভাবিক। তন্ময় হেসে বলেছে, 'আসছি।' অরুকে চেয়ারে বসতে ইশারা করলো। অরু বসবে না। সে ঐ কোণায় গিয়ে রেলিঙের পাশে দাঁড়াবে। নদীর পানি দেখবে। লঞ্চ ছাড়ার মুহূর্ত উপভোগ করবে। শব্দ করে বললো, 'ওপাশে যাই আমি?'
'না। বোস।'

অরু কিছুই শুনতে পেল না। তীব্র গানের শব্দ। এতো মানুষ, অথচ একটি শব্দ তার কানে আসছে না। অরু ভাবলো এক কানের ইয়ারফোন খুলে ফেলবে। কিন্তু তন্ময় একটু পরপর চেক করছে। কানের দিক ভালোভাবে তাকাচ্ছে। আশ্চর্য! এতো কেয়ারফুল হবার কী আদৌও প্রয়োজন আছে? 

অরু তন্ময়ের চোখ রাঙানো দেখে বসলো এক কোণে। চুপচাপ বসে। হাত দুটো সামনে। তন্ময় হাতের ইশারায় ঠাঁই বসতে বলে, তারপরই অন্যদিকে হাঁটা দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর শব্দ করে অরুর পাশে এসে বসলো সৈয়দ। অপরপাশে শুহানি এসে বসেছে। সামনে রিহান আর মাহিন বসে। অরু চারপাশ হতে ঘেরা। বোকার মতো তাকিয়ে আছে। শুহানি অরুর কান থেকে ইয়ারফোন খুলে নিল। হেসে শুধালো, 'কি গান শুনছ অরু?'

অরু নাম বললো, 'তেরি কাসাম।'

মাহিন হতাশ গলায় বলল, 'আহারে! তুমি এভাবে অন্যের গান কেন শুনবে বলোতো? তোমার ভাইয়া থেকে হয়ে যাওয়া সাইয়া কিন্তু খুব ভালো গান গায়। সেদিন শুনলে না? এই ছেলে ভার্সিটির কতো মেয়েদের কানে কানে গিয়ে গান গেয়েছে, বলে শেষ করা মুশকিল। তোমার কানে গান গেয়েছে?'

অরুর উজ্জ্বল মুখশ্রী বড্ড অসহায় দেখাচ্ছে। শুহানির ভীষণ মায়া হলো। সে অরুকে পাজাকোলে চেপে নিল। ধমকের সুরে মাহিনকে বলল, 'চুপ থাক তুই!'
'তোর নোংরা বাম হাত ঢোকাবি না। খবরদার। কথা বলতে দে। তো অরু! বলো গান গেয়ে শুনিয়েছে কানে কানে?'

অরু মাথা নাড়াল, 'না।'
'ইশ! ওই মেয়েটাকে দেখ। ওইযে জিন্স-টপ পড়ে। তন্ময়ের পাশে দাঁড়িয়ে। আমাদের ক্লাস টপার ছিল। তন্ময়ের জন্য পাগল। এই মেয়েকে কিন্তু তন্ময় কানে কানে গান শুনিয়েছে। আমার নিজের চোক্ষে দেখা।'

অরুর বিশ্বাস হলো না মোটেও। তার গম্ভীর শান্তশিষ্ট তন্ময় ভাই, এমনটা আদোও করতে পারে? অরু বলল, 'সত্যি?'
'হু। এখানে উপস্থিত অনেক মেয়ের সাথেই লাইন ছিলো বুঝলে। সব গোপনে। গোপনীয়তা বজায় রেখে চলত ছেলেটা। দেখতে তো ভোলাভালা। টেম্পো চালাতে জানে, সেটা কে জানত বলো!'

অরুর মুখ ভোঁতা হয়ে আছে। সেই মুখ আরও ভোঁতা করতে রিহান বলল, 'আরে মাহিন তোর শীলার কথা মনে আছে? ওই মাদবরের নাতনি'টা। ওটার সাথে তো তন্ময় ভালোই ঘনিষ্ঠ হয়েছিল! মনে পড়ে?'

মগজধোলাই হওয়া অরুর চোখজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে গেল। মাহিনের মুখের ভঙ্গিমা দেখে তার সব কথা সত্য মনে হতে লাগলো। নিমিষেই চোখজোড়া জ্বলতে শুরু করলো। এরজন্য কী তন্ময় তার কানে ইয়ারফোন দিয়েছে? যাতে সে এগুলো না শুনতে পায়? মাহিন আলগোছে উঠে গেল। তন্ময় আসছে তাড়াহুড়ো পায়ে। রিহান ও ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিকসেদিক তাকিয়ে কেটে পড়েছে। অরুর পাশে শুধু শুহানি বসে। সে নরম সুরে বলল, 'ওদের কথা বিশ্বাস করো না। ফাজলামো করছে তোমার সঙ্গে। তুমিতো জানো, তন্ময় কেমন! তবে কানে কানে গান শোনার আবদার খানা করতেই পারো। এটা কিন্তু আমিও পার্সোনাল ভাবে উপভোগ করেছি। রিহান থেকে। অনুভূতি খুব স্বচ্ছ এবং দারুণ। ট্রায় করতেই পারো।'

অরু তাকাল অসহায় নয়নে। শুহানি শব্দ করে হাসছে। তন্ময় সামনে আসতেই বলল, 'দোস্ত তোর বউয়ের মগজধোলাই করে গেছে ওই দুজন। সামলা তাহলে। আমি একটু আসছি।'

তন্ময় বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল। দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ানো মাহিন, রিহানকে চোখও রাঙাল। ছেলেগুলোর জ্বালায় সে বাঁচবে না বেশিদিন। অরুর ভোঁতা মুখশ্রী খানায় দৃষ্টিপাত করে প্রশ্ন করলো, 'কি হয়েছে?'
'কিছুনা।'
'কী বলেছে?'

অরু চুপ রইলো। তন্ময় হাত বাড়াল, 'দেখি আয়।'

অরু উঠে দাঁড়ালো। তন্ময়ের হাত ধরলো। চুপচাপ সঙ্গে হাঁটছে। তার হঠাৎ মন খারাপ হলো। সে জানে মাহিনের কথা সত্য নয়। তাও কেন মন খারাপ হচ্ছে?

দুজন এসে দাঁড়িয়েছে ছাঁদের এক কোণে। এখানটা বড্ড নিরব। নিরবতা ভাঙলো রুস্তমের গলার স্বরে। লঞ্চ ছাড়া হবে এক্ষুনি। পরপরই শোনা গেল লঞ্চ ছাড়ার তীব্র শব্দ। অরু ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়লো সেই শব্দে। তাকিয়ে থাকলো নদীর পানির দিক। পানির উচ্ছাস অবস্থা। উথালপাতাল গাঢ় ঢেউ। দিশেহারা, অবিকল ভাবে মেতে চলেছে। 

ধীরে লঞ্চ চলতে শুরু করেছে নদীর বুকে। সেই কী অদ্ভুত অনুভূতি! অরু এবার রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ালো আরেকটু কাছে গিয়ে। মাথাটা নিচু করতে চাইল। তন্ময় দিল না। সে অরুর পেছন দাঁড়িয়ে। স্বাস্থ্যসম্মত দু'হাত দুপাশে দেওয়া। দূর থেকে মনে হচ্ছে, অরু তন্ময়ের বাহুতে আটকে। তবে কাছাকাছি তেমনটা মোটেও নয়। দুজনের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে কিছুটা। অরু আঁড়চোখে পেছন তাকাল। তন্ময় তখনো নদীর দিক তাকিয়ে। তবে অরুর নজর ঠিক উপলব্ধি করলো, 'কী?'
'হু।'
'বল।'
'আপনি কখনো প্রেম করেছেন?'

প্রশ্নটা করতেই অরুর বুকের উঠানামার গতি বেড়ে গেল। ভেতরটা ধুকপুক করছে। তন্ময় সময় নেয়নি। মুহুর্তে জবাব দিল,'না।'
'কখনো করেননি?'
'কখনো না।'

অরুর হুট করে খারাপ হয়ে যাওয়া মন স্বতঃস্ফূর্ত হলো মুহুর্তে। জ্বলজ্বল চোখে ফিরে চাইল। তন্ময়কে পলক ভরে দেখে বলল, 'আপনি কখনো কানে কানে গান গেয়ে শুনিয়েছেন?'
'তোর মাথায় কী ঢুকিয়েছে এরা! কানে কানে গায় কীভাবে! আশ্চর্য!'

কানে কানে কীভাবে গান গায় তাই জানে না?শুহানির বলা কথাগুলো অরুর মস্তিষ্কে জড়াল ভঙ্গিতে লেপ্টে এলো। কানে কানে গান শোনার এক আলাদা অনুভূতি আছে। শুহানিকে রিহান শুনিয়েছে। অরুরও আগ্রহ জেগেছে এবিষয়ে। সে চাচ্ছে তন্ময়ও তাকে গেয়ে শোনাক। কেন শোনায় না! অরুও উপভোগ করতে চায় ওই অনুভূতি। নজর ফিরিয়ে নদীর দিক তাকাল। নদীতে চাঁদের ঝলক। আসমানের প্রতিভাব। দেখা মিলছে উপচে পড়া রূপের। 

বেশ খানিক্ষন বাদে কানের কাছে উষ্ণ নিশ্বাসের স্পর্শ পেল অরু। কোমরে শক্ত হাতের ছোঁয়া। জামার ভেতর দিয়ে গিয়েছে সেই হাত। মুঠো করে ধরেছে সেখানে। অরু চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে। তন্ময় বলল,'খুব জ্বালাতন করিস!'

অরু কষ্ট পেল। জ্বালাতন তো তাকে করা হচ্ছে। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,'ছাড়ুন। আমি কী বলেছি শোনাতে!'

তন্ময়ের গম্ভীর কন্ঠের ধীর হাসির শব্দ শোনা গেল।
'ওহ!'
'সরুন।'
'তুই তো দিব্বি আমাকে জোরপূর্বক চুমু খেতি। এখন আমি ধরতে পারবো না? সার্টিফিকেট পেয়েও?'
'কী!'

অরু আশ্চর্যের শেষ সীমানায় চলে গেল। কীসব বলছে! সেই কবে অরু গালে একটা চুমু দিয়েছিল, সেটা নিয়ে বসে আছে। তখন তো অরু ছোট, অবুঝ ছিল। অনুভূতির চাদরে ঢেকে কয়েকটি ভুল স্টেপ নিয়েছিল। তাই বলে এভাবে বলবে? সেও তো অরুর সাথে কতকিছু করেছে। অরু তো বলতে যায়নি, 'আমি কখনো এমন করিনি। মানে.. মাত্র একবার।'
'একবার? আচ্ছা ওই একবার কেন চুমু খেয়েছিলি?'

অরু দিশেহারা হয়ে পড়লো। কেন খেয়েছিল! না খেলে এতকিছু তো শুনতে হতো না। দুঃখিত গলায় বলল, 'ভুল হয়ে গেছে।'
'শাস্তি তো পেতে হবে।'

 হঠাৎ কানের কাছটায় নিশ্বাসের ইঙ্গিত পেল। কেঁপে উঠলো অরু। এভাবে কানে মুখ নিয়ে রেখেছে কেন! পরপর নরম ঠোঁটের ছোঁয়া। দম আটকে রাখল অরু। ভালোভাবে শ্বাস নিতে পারছে না। রুদ্ধশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে উঠলো তন্ময়ের বাহুতে। কিন্তু সরতে পারলো না। তন্ময় শক্ত করে ধরে রেখেছে তাকে। ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করে যাচ্ছে কানের লতিতে। বিচরণ করছে সেখানে। পরপর সেই চিরচেনা গম্ভীর স্বরে সুরের তাল শুনতে পেল। ভীষণ কাছ থেকে। খুব ধীরে। অরুর উথালপাতাল ধুকপুক বেড়ে গেল শত গুনে। 

'যাব তেরি উঙলিয়া মুঝকো ছু যাতি হে, 
তু কাহি খোয়াব দিল মে জাগা যাতি হে,
ইতনি বে-রাঙ ভী তো নেহি জিন্দেগী, 
হার মুলাকাত মুঝছে এ কেহ যাতি হে.. 

তেরি-হি বাহো মে, ফানাহো-মে, 
রেহনা মুঝে হার দাম ছাদা, 
তেরি-হি ইয়াদো-মে, নিগাহো মে 
রেহনা মুঝে হার দাম ছাদা... 

তেরি জুলফ যাব ভী বিখার যাতি হে, 
অ্যা হাসি তু হাসি, ওর হো যাতি হে, 
যো কিতাবো-মে পাঢতে রাহে আজ তাক, 
ওহ পারি হাম-কো তুঝ মে নাজার আতি হে, 
___________
রাত তিনটা পঁয়ত্রিশ। অরু সোফায় বসে। হাতে কফির মগ। ধীরে কফিটুকু খাচ্ছে। চোখজোড়া জ্বলছে রীতিমতো। মাথাটাও ভাড় হয়ে আছে। এমন গান শুনিয়েছে লোকটা যে অরু দু'দন্ড আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি ছাঁদে। হাঁটু কেঁপে ভেঙে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস তন্ময় ধরে রেখেছিল নাহলে তো পড়ে যেতো। বুকের ভেতর এখনো সমানতালে কাঁপছে। গলাটাও শুকিয়ে যাচ্ছে। 

তন্ময় একটা পঁয়তাল্লিশে বেরিয়েছে। বাহির থেকে রুম লক করে গিয়েছে। সঙ্গে ভেতর থেকেও করতে বলেছে অরুকে। সেলফোন দিয়ে গিয়েছে দরকার পড়লে কল করতে। অরুর প্রয়োজন পড়েনি। সে চুপচাপ বসে থাকলো পুরো সময়। লঞ্চ নারায়ণগঞ্জের ত্রিসীমা চলে এসেছে। দূর থেকে দেখা মিলছে বড়ো অট্টালিকার। গাছপালা, ঘন জঙ্গল সবই আবছা দৃশ্যমান। অরু বারান্দার চেয়ারে বসে তাকিয়ে রইলো। বুকে হাত চেপে রাখল। চোখ বুঝল। 
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন