অনুভবে - পর্ব ২২ - সিজন ২ - নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা - ধারাবাহিক গল্প


দ্বিতীয় মঞ্জিলে সভ্যের রুম। দাদাজান ইনারা ও সভ্যকে রুমে পাঠায় ফ্রেশ হতে। ইনারার সভ্যের বাবাকেও ভালো লেগেছে। সে দাদাজানের মতো মিষ্টি ভাবে কথা বলেছেন তার সাথে। দাদাজানের কন্ঠটা কঠিন হলেও সভ্যের বাবার কথার ধরণ অনেক মিষ্টি। 

ইনারা রুমে এসেই লাফ দিয়ে বসে পড়ে বিছানায়, "আমিতো সেই ক্লান্ত হয়ে গেছি।"
"ক্লান্ত!" সভ্য হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, "সারারাস্তা ঘুমিয়ে তুমি ক্লান্ত হয়ে গেছো?"
"তো কি? হাত পা না ছড়িয়ে ঘুমানো কত শান্তির আপনি জানেন?"
সভ্য মুখ বানায়, "হ্যাঁ, অনেক কষ্টের৷ আমি সারারাত তোমার জন্য ঘুমাই নি তো তাই সঠিক জানি না।"
"কিন্তু জানা উচিত।"
সভ্য বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে , "আসলে কোন পাগলের সাথে যে বিয়েটা করলাম।"
"এই কি বললেন আপনি?"

দরজায় টোকা পরে। ইনারা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে একটি অপরূপ সুন্দরী মহিলা রুমের ভেতর ঢুকছেন। মহিলাটি সভ্যের মা হন। ঢুকেই তিনি সভ্যের বাহুতে জোরে মারল, "তোকে তো গালে মারা উচিত। কত রাগ উঠছে আমার তোর উপর জানিস?"
ইনারা এবার ভয় পেল। সে ভাবল সভ্যের মা'ও তাকে অপছন্দ করবেন। তাই হয়তো রাগ। কিন্তু তিনি উল্টো বলেন, "একতো আমার বড় ছেলে বিয়ে করবে না। আর ছোট ছেলে বিয়ে করে বসে আছে আমাকে জানায়ও নি। কত স্বপ্ন দেখেছিলাম তোদের বিয়ের। কত ফাংশন করব। বউকে পুতুলের মতো সাজিয়ে, ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে ঘরে এনে তুলব। কিন্তু তোরা দুই ভাই তো আমার ইচ্ছার কদরই করিস না। কর তোরা নিজের মর্জি মতো, আমার স্বপ্নগুলো ভেস্তে যাক তাই না?"
বলতে বলতে তার চোখে জল এসে পড়লো। 

সভ্য তার গালে হাত রেখে বলল, "আমার ইমোশনাল মা, এখন তো ব্লাকমেইল করে লাভ নেই। কাজ তো সেরেই ফেলছি। এবার দেখো তো তোমার বৌ'মা দেখতে পুতুলের মতো না'কি?"

ইনারা সভ্যের মা'কে রুমে ঢুকতে দেখেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো এবং কাঁদতে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। তাই যখন সভ্যের মা'কে ঘুরিয়ে তাকে দেখাল, তখন ইনারা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। সভ্য তার মা'কে ঘুরাঘুরি পর সে চমকে গেল। ইতস্তত করে বলল, "আসসালামু আলাইকুম আন্টি।"
সভ্য তার মা'য়ের কাঁধে মাথা রেখে বলে, "পুতুলের মতো লাগছে?"
ইনারা সামনের আয়নায় একবার নিজেকে দেখে মনে মনে বলল, "রাতভর জার্নি করে ভূতের মতো লাগছে আর এই গর্দভটা না'কি জিজ্ঞেস করে পুতুলের মতো লাগছে নাকি? একটু রেডি হতে বলতো। কিন্তু না, আমাকে তো লজ্জায় ফেলতে হবে তার।"

সভ্যের মা সালামের উওর দিয়ে ইনারার দিকে এগিয়ে গেল, "মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ পুতুল থেকেও বেশি মিষ্টি।" 
তিনি ইনারার গালে হাত রেখে আদর করে দিলো তাকে। আরও বলল, "এত মিষ্টি মেয়েটাকে পেলি কীভাবে তুই?"
"একদিন বাঁদরদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ঠুস করে আমার সামনে এসে পড়লো।"
ইনারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সভ্যের দিকে। মা বললেন, "এই ছেলের কথা কানে দিও না তো। দিন দিন ভদ্রতাই ভুলে যাচ্ছে। আগে তো ভালোই ছিলো। বিগত কয়েকবছর যে কিসব ভাষায় কথা বলছে না?"
"সঙ্গদোষ মা, সবই সঙ্গ দোষ।" ইনারাকে উদ্দেশ্য করে বলল সভ্য। ইনারা নিজেকে খুব কষ্টে সামলে হাসি এঁকে রাখল মা'য়ের সামনে। 

"এমন খারাপ সঙ্গ রাখতে নেই। তোকে না বললাম। তাই না মামনী?" মা ইনারাকে কথাটা জিজ্ঞেস করলে। কথাটা শুনে জোরপূর্বক হাসলো। আমতা-আমতা করে বলল, "একদম আন্টি।"
"ওকে বুঝাও। ওর দায়িত্ব তো এখন থেকে তোমার। আর তোমার লজ্জা পেতে হবে না। সভ্যের মা মানে আমি তোমারও মা, বুঝেছ?"
মা শব্দটা শুনে ইনারার ঠোঁটের হাসিটা কিছু মুহূর্তের জন্য আড়াল হলো। কিন্তু পরক্ষণেই একগাল হাসি এঁকে এলো তার ঠোঁটে। তার বুকে কেমন করে উঠলো। কেন যেন অনেক খুশি অনুভব হলো। খুশিতে লাফাতে মন চাইল। কিন্তু সে নিজেকে সামলে বলল, "জ্বি।"
মা নিজের হাতের চুড়িটা খুলে ইনারাকে পরিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু সে বাঁধা দেয়, "আন্টি কি করছেন? এসব লাগবে না।"
"একদম চুপ। এটা আমার দোয়া তোমার জন্য। আমি যখন প্রথম আমার শাশুড়ীর সামনে গিয়েছিলাম তখন উনি আমাকে পরিয়েছিল।"
মা ইনারার হাতে চুড়ি পরিয়ে কপালে চুমু দেয় এবং বলে, "তুমি আজ থেকে কেবল এ ঘরের বউ না, মেয়েও বুঝেছ। এ বাড়িটা তোমার। তাই অস্বস্তিবোধ করবে না। এখন জলদি করে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো নাস্তা করার জন্য। আমি নাস্তা লাগাচ্ছি টেবিলে।"
"জ্বি।"
ইনারা মা'য়ের যাবার দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কেমন একটা মায়া অনুভব হলো তার সভ্যের মা'য়ের কথায়, আদরে।

সভ্য ইনারার পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, "কি দেখছ?"
ইনারা চকিতে তাকায় পিছনে। সভ্য তার পিছনে এসে দাঁড়ানো এটা না জেনেই। সে সভ্যের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যেতে নেয় তখনই সভ্য তাকে ধরে নেয়। এবং বলে, "আয়হায় আমার বউ একটু দেখে শুনে হাঁটো। এমনিতেই তো দাদীজান রেগেমেগে ফায়ার হয়ে আছেন। এর উপর তোমার হাত পা ভেঙে গেলে দুইদিনে ইন কীভাবে করবে শুনি।"
ইনারা সভ্যের পা'য়ে জোরে একটা লাথি মেরে বলে, "আমি বান্দর? বান্দরগিরি করি?"
"বান্দরগিরি আবার কী?" সভ্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
"ওই'যে বললেন আমি বাঁদরদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ঠুস করে আপনার সামনে এসে পড়লাম। আর আমার সঙ্গদোষে আপনার ভাষা এমন হয়েছে?"
"তো কী? বান্দরগিরি আবার কোন শব্দ?"
ইনারা অপ্রস্তুত হয়ে হাসে, "আপনাদের মতো বিদেশে পড়া লোকরা এসব বুঝবেন না। এখন এত শুদ্ধ ভাষা বলতে হয়। যখন কলেজে ছিলাম তখন মুখে যা আসতো তাই বলতাম। আহ কী দিন ছিলো! এই আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন কেন? আন্টির সামনে আপনি আমাকে উদ্দেশ্য করে কত খোঁটামার্কা কথা বলছিলেন কেন? আর একবার এমন দেখলে... "
"দেখলে কী করবে শুনি?"
"আপনাকে আমি ছাড়ব না। মেরে তক্তা বানিয়ে দিব।"
"সভ্য হাসে, " ম্যাডাম এটা আমাদের ঘর নয়। এখানে আপনার দাদাগিরি চলবে না তো। আগে দাদীজানকে সামলে নিজে টিকে নেও, তারপর আমাকে তক্তা বানাতে এসো। এখন যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও, তোমার খারাপ সময় চালু হচ্ছে।"
"দাদীজান কি বেশি রুক্ষ?"
"আরে না, দাদীজান একদম সুইটহার্ট। অনেক সুইট। কিন্তু আমার জন্য, তোমার জন্য না।"
ইনারা মুখ ফুলিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে, "ইতর, পাঁজি, অসভ্য একটা।"
বলে যে রাগে হনহন করে চলে গেল বাথরুমে।

সভ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে, "কিছু হোক না হোক দাদীজান এবং এই জংলীটার রাগ একদম একরকম। কখন এসে নাকে বসে নিজেও জানে না।"
.
.
ফ্রেশ হবার পর সভ্য এবং ইনারা নিচে নামে। ইনারা সকালে উপরে যাবার মতো নিচে নামার সময়ও একতলা এবং দোতলার মাঝের ঝাড়বাতিটা দিকে বেখেয়ালি ভাবে তাকিয়ে রইলো। এই বেখেয়ালি ভাবে তার নিচে নামার সময় পিছলে খেয়ে পড়ে যেতে নেয়। ভাগ্যিস সভ্য সময়ে তাকে ধরে নেয়। এবং বলে, "আজ দ্বিতীয়বার পড়ে যেতে নিলে। এমন বেখেয়ালিভাবে থাকলে কীভাবে হয় বলো তো। কোনদিন না বড়সড় একটা এক্সিডেন্ট ঘটাও তুমি।"
"বকা ছাড়া আর কিছু পারেন না তো তাই না?"
"এখন না ধরলে পরে হাড্ডি ভাঙত। কোথায় কৃতজ্ঞতা জানাবে কিন্তু তা না করে উল্টো...."

সভ্যের সম্পূর্ণ কথাটা শেষও হলো না। একটা মহিলার কণ্ঠ ভেসে উঠল তাদের কানে, "ছিঃ ছিঃ কি জমানা এসে পড়লো রে ভাই। এখন এসব দেখার বাকি ছিলো?"
সভ্য এবং ইনারা দেখল ফুপি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভেংচি কেটে আরও কথা বলতে বলতে গেল ডাইনিংরুমের দিকে।

ইনারা হতভম্ব, "এটা কী হলো?"
"উনার কথায় কান দিও না। ভেজাল লাগানো উনার ফেভারিট টাইমপাস। মা'য়ের সাথেও সারাক্ষণ এসব করে। আমিই বিরক্ত এসব দেখে। আসো, সবাই ওয়েট করছে।"
ডাইনিংরুমে যেয়ে দেখে সবাই বসে নাস্তা শুরু করে দিয়েছে। কেবল সভ্যের মা নাস্তা বেড়ে দিচ্ছেন। তিনি দুইজনকে দেখেই চেয়ার টেনে দিলেন বসার জন্য। ইনারা জিজ্ঞেস করল, "আন্টি আপনি খাবেন না?"
"আমি পরে খাব। তোমরা খেয়ে নেও।"
দাদীজান রাগান্বিত সুরে বলে, "মানুষের লজ্জা শরমও নেই। এতকিছু হলো একটু আগে তারপরও খাবার টেবিলে এসে বসে গেছে খাওয়ার জন্য।"
ইনারা অবুঝের মতো করে বলল, "দাদীজান আপনি চাইলে আমি সোফায় বসেও খেতে পারি। অভ্যাস আছে আমার। যাব?"
উওরে দাদীজানের আরও রাগ উঠলো। কিন্তু কিছু বলার পূর্বেই সভ্য দাদীজানের পাশের চেয়ারে বসে বলে, "দাদীজান প্লিজ রাগ করেন না। আপনি আমাকে এত ভালোবাসেন তাহলে এমন করছেন কেন? আমার খুশিতে আপনি খুশি না?"
কথাটা শুনে বোধহয় দাদীজানের রাগ একটু কমলো। সে বলল, "তোমাদের খুশি থেকে বড় কিছু হতে পারে না'কি?"
সভ্য হেসে দাদীজানের গাল টেনে বলে, "এইত্তো আমার সুইট দাদী। অনেক মাস হলো আপনার হাতে খাই না। আজ আপনার হাতে খাব। খাইয়ে দিবেন না?"
" আমার নাতি আমার হাতে খাইতে চাইবে আর আমি খাইয়ে দিব না?"
দাদীজান নিজের প্লেট থেকে একটা লোকমা খাবার তুলে সভ্যকে খাইয়ে দিলেন।

সভ্যের ফুপি খিটখিটে গলায় বলে উঠেন, "আম্মা জানো একটু আগে কিসব দেখে এসেছি। ছিঃ! আমার তো বলতেই লজ্জা লাগছে। সিঁড়িতেই নতুন বউ সভ্যের সাথে জড়াজড়ি শুরু করে দিয়েছিল। ভাবতে পারছ? আমার তো দেখেই লজ্জা লাগছিলো। আল্লাহ কি যুগ এসে পড়লো।"
সভ্য বিরক্ত হয়ে বলে, "ফুপি যা তা কথা বলো না তো। ইনারা সিঁড়ি থেকে পড়ে যেতে নিয়েছিলো তাকে শুধু ধরেছি।"
ফুপি যেন সভ্যের কথাটা কানেই নিলো না। সে দাদীজানকে বলল, "মা এখানেই খোলামেলা এসব করছে
বাহিরে যেন কি না করে। আরও আছে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। ওখানের মানুষ কেমন হয় জানোই তো। নায়কদের সাথে কত কি করে কে জানে। আমাদের বংশের সম্মান ডুবে যাবে।"
ব্যাপারটা সামলাতে সভ্যের মা মাঝে হস্তক্ষেপ করে, "আপা থাক না এসব কথা। সবে এলো দুইজন একটু নাস্তা করতে দিন।"
"তুমি চুপ থাকো ভাবি। তোমাকে কে এসব বিষয়ের মাঝে কথা বলতে?"
ইনারা এতক্ষন চুপ ছিল। কিন্তু সভ্যের মা'য়ের সাথে বেয়াদবি করতে দেখে সে আর চুপ থাকতে পারে না। গালে হাত দিয়ে হেসেই উওর দেয়, "তো ফুপি এখন উনি হচ্ছেন সভ্যের মা। উনি না বললে কে বলবেন? আপনার দেখি নিজের মেয়ের থেকে বেশি সভ্যের চিন্তা। দেখুন আপনার মেয়ে আমার ভক্ত। আমি যদি খারাপ ছবি করি তাহলে আপনি নিজের মেয়েকে এসব দেখতে দেন। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! আমার তো ভাবতেও লজ্জা লাগছে।"
ইনারার উওর শুনে ফুপি লজ্জায় পড়ে যায়। সভ্যের বাবা নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে শব্দ করে হেসে দেয়। আর দাদাজান বহু কষ্টে নিজের হাসি লুকায়।

দাদীজান ধমক দেয়, "সবাই চুপ। এখানে কী হাসি ঠাট্টা চলছে?"
ফুপি তো রাগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে, "মা দেখেছ মেয়েটা কী বেয়াদব?" সে আবার ইনারাকে বলল, "এই মেয়ে তোমাকে তোমার মা কোনো শিক্ষা দেয় নি এখানে আসার আগে?"
ইনারা চাইলেই কঠিন উওর দিতে পারতো। কিন্তু সবার সামনে সে এমন করল না। অবুঝের মতো বলল, "আমি তো আপনাকে কেবল পরামর্শ দিচ্ছিলাম। বেয়াদবি তো করতে চাই নি। বেয়াদবি মনে হলে সরি। আর আমার মা তো অনেক আগেই মারা গিয়েছেন তাই কোথায় কীভাবে কথা বলতে হয় শিখতে পারি নি। আপনি আমাকে শিখিয়ে দিয়েন ঠিকাছে?"

ইনারার মা নেই কথাটা শুনে টেবিলে বসা সকলে নীরব হয়ে গেল। সভ্যের মা তার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার মা নেই?"
"না, আমি যখন ছোট ছিলাম তখনই মারা গিয়েছেন।"
ফুপি আবারও বলতে নিলো, "মা দেখো সভ্য এই মা মরা মেয়েকে ঘরে এনে উঠিয়ে...."
তার সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই এবার দাদীজান ধমক দিলেন, "চুপ কর। অতিরিক্ত মুখ চলছে তোর। এ বিষয়ে আর একটা কথাও আমি শুনতে চাই না।"
ইনারা দাদীজানের দিকে তাকায়। তার চোখে নিজের জন্য খানিকটা মায়া দেখতে পায়। তাও কিছু মুহূর্তের জন্য। পরে আগের মতোই চোখ দুটো কঠিন হয়ে যায়। 

সভ্যের মা ইনারার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, "আজ থেকে আমি তোমার মা বুঝেছ? আমাকে মা বলে ডাক দিও।"
ইনারা উনার দিকে তাকায়। অনেক খুশি অনুভব হলো তার। কিন্তু কেন যেন সাথে কাঁদতেও মন চাইছে। সে আগ্রহ নিয়ে তাকাল মা'য়ের দিকে, "সত্যি?"
উনি মিষ্টি হাসি দিয়ে ইনারার গাল টেন বলে, "একদম সত্যি। আসো আমি তোমাকে খাইয়ে দেয়।"
মা প্লেটে খাবার নিয়ে আদর করে তাকে খাইয়ে দিতে শুরু করলো। ইনারার চোখ নিচে ঝুঁকানো। তার চোখে খুশির পানি এসে জমেছে। তার স্মৃতিতে ভাসছে সে দৃশ্যগুলো যখন তার মা ছোটবেলায় তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতো। 

খাবারের টেবিলে দাদীজান কেবল বলল, "নতুন বউদের কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। নতুন বউকে কেউ বলে দিও যেন শাড়ি পরে আসে সবার সামনে। আর আগামীকাল নিজের শশুড়বাড়ির জন্য নিজের হাতে কিছু রান্না করে খাওয়ায়।"
ইনারা পড়ে গেল দ্বিধায়। রান্না এবং সে? পানিও ফুটাতে পারে না সে। পড়লো তো এক ঝামেলায়। তবে আজ ভালো লাগছে তার। সে কখনো টেবিলে বসে পরিবারের সাথে খায় নি। কখনো তার পরিবার ছিলোই না। আজ মনে হচ্ছে সে একটি পরিবার পেয়েছে। তার পরিবার।

ফুপিকে ইনারার পছন্দ না হলেও মিনুর সাথে ইনারার কিছুই হয় নি। উল্টো তাকে দেখার সাথে সাথে যেভাবে তার কাছে ছুটে এসে হাত ধরে নিয়েছিল মনে হলো মেয়েটা মিষ্টি। তাই ইনারা নাস্তা শেষে নিজেই তার সাথে কথা বলতে গেল, "হ্যালো।"
মিনু ইনারার দিকে তাকিয়ে প্রথমে আমতা-আমতা করে তারপর সেখান থেকে চলে যেতে নেয়। 
"তুমি কী আমার সাথে রাগ করেছ?" ইনারা বলল। মিনু যে গতিতে গিয়েছিল তার দ্বিগুণ গতিতে ফিরে এসে বলল, "সভ্য ভাইয়াকে বিয়ে করলেন কেন? আমি আপনাকে এত লাইক করতাম এখন আপনিও গেছেন, সভ্য ভাইয়াও গেল। এখন আমি হ্যান্ডসাম সেলিব্রিটি বর কীভাবে পাব?"
অনেকটা কাঁদোকাঁদো মুখ নিয়ে বলল মিনু। ইনারা নিজেকে সামলাতে না পেরে ফিক করে হেসে দেয়। 

মিনু এবার রাগী গলায় বলে, "আমি কী মজার কিছু বলেছি? আমার কষ্টে আপনি হাসছেন কেন?"
"আরে তোমার কষ্টে হাসছি না তো। ওই ব্যাঙের ছাতা অসভ্যকে তোমার হ্যান্ডসাম মনে হচ্ছে শুনে হাসছি।"
"অসভ্য কে আবার?" মিনুর চোখ কপালে উঠে গেল। 
"আরে ওসব বাদ দেও।" ইনারা মিনুর কাঁধে হাত রেখে বলল, "সভ্য কী জিনিস তার থেকে বেশি হ্যান্ডসাম বর আনব তোমার জন্য।"
"সভ্য ভাইয়া থেকে বেশি হ্যান্ডসাম? কিন্তু সে তো সেলিব্রিটি হবে না।"
"আরে সভ্যের তো ডেট চার বছর আগে এক্সপায়ার হয়ে গেছে। নতুন কোন সেলিব্রিটি পছন্দ তোমার বলো। আমি সেট করিয়ে দিব।"
"জোহান জোহান।"
জোহানের নাম শুনতেই ইনারার মুড অফফ হয়ে গেল, "সব ছেড়ে ও? ও তো প্লে বয়। লুইচ্চা। একে ছেড়ে ওকে করতেই থাকে। ভালো টেস্টের একজন বলো।"
"তাহলে আমার সেকেন্ড ফেভারিট হলো..." মিনু চিন্তা করে বলে, "ওয়াসিন খান।"
"আরে জোস চয়েস। লোকটা আসলে হ্যান্ডসাম আছে।" ইনারা বিড়বিড় করে বলল, "যদিও আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিল মনে হয় না সেট করতে পারবো। যাই হোক ট্রাই করতে কি সমস্যা।"
"কিছু বলছেন?" মিনু জিজ্ঞেস করে। 
"না না। প্লানিং করছিলাম কীভাবে তোমাদের সেটিং করাব। সে তো আমার কো-স্টার এই ফিল্মে।"
"বলেন কী সত্যি? আমার সাথে দেখা করাবেন ভাবি?"
"কাজ হতে না হতেই ভাবি ডাকা শুরু। ভালোই তো। আচ্ছা আমি দেখা করাব কিন্তু কিছু সাহায্য লাগবে আমার। তোমার সাহায্য করতে হবে কিন্তু।"
"আমি এক পা'য়ে রাজি। কিন্তু আগে আমি কি আপনার সাথে ছবি তুলে আমার ফ্রেন্ডদের দিতে পারি।"
"অফকোর্স। এরপর তুমি আমাকে দাদীকে পটানোর ভিন্ন ভিন্ন উপায় বলবে। ডিল?"
"ডিল।"
দুইজনে হাইফাই দেয়। তারপর কিছুক্ষণ আড্ডা দেয় দুইজনে মিলে। যতক্ষণ পর্যন্ত ফুপি এসে মিনুকে টেনে না নিয়ে যায়।

মিনুকে নিয়ে যেতেই ইনারা সারাঘরে ঘুরতে শুরু করে। সবটা দেখতে থাকে। বাড়ির ভেতর থেকে সে বাগানে এসে পড়ে। ঘুরে দেখতে থাকে বাগানটা। হঠাৎ করে কেউ একজন তার পিছনে এসে তার কানের কাছে বলে, "এই'যে মহারাণী..."
হঠাৎ এমন হওয়ায় ইনারা ঘাবড়ে যায়। লাফিয়ে উঠে ভয়ে। পিছনে ফিরে সভ্যকে দেখে বলে, "ভূতের মতো আমার মাথার উপর চড়ে বসেছেন কেন? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।"
"দেখলাম মিনুর সাথে ভালো খাতির জমেছে। কাহিনী কি?"
"কাহিনী বাদ দেন। ও একটা মজার কথা বলছিলো বুঝলেন? ওটা শুনে আমি হাসতে হাসতে শেষ।"
"তাই? এমন কী বলল?"
"বলল আপনি না'কি হ্যান্ডসাম। মানে সিরিয়াসলি আপনি!" হাসতে হাসতে বলে ইনারা।
সভ্য সরু দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে, "তোমাকে আমাকে হ্যান্ডসাম মনে হয় না?"
"এহ আসছে। দেখতে ব্যাঙের ছাতা, না ভূতের মাথার মতো তাকে আমি হ্যান্ডসাম বলব।"
ইনারা ভেংচি কেটে যেতে নিলেই সভ্য হাত ধরে নিলো। তার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে কানের কাছে ঠোঁট এনে বলল, "মহারাণী আমি দেখতে যেমন হই না কেন আপনারই বর কিন্তু।"
ইনারা পিছনে ঘুরে বলে, "তো বরসাহেব আপনি যে আমাকে ফাঁসালেন তার কী করব বলুন? আমি আর রান্না দূর দূর পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক নেই। একতো দাদীজান যা কঠিন। এর উপর আপনার ফুপি, আগুনে ঘি এর ডিব্বা উল্টায় দেয়। দাদাজানকে বলে তো দিয়েছি কিন্তু এখন তো ভয় করছে। কী করব?"
সভ্য ইনারার হাত ছেড়ে বলে, "সেটা আমি জানি না। তোমার ব্যাপার, তুমি সামলাও। এ একবছর আমার উপর যে জুলুম করছ তার বদলে তোমাকে চিন্তা করতে দেখেই আমার মন ভরে গেছে।"
ইনারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, "বিশ্বাস করেন এটা আপনার বাড়ি না হলে যে অবস্থা করতাম আপনার, দাদীজানও আপনাকে চিনতো না। আচ্ছা একটা কথা, যখন আমার মা মারা যাবার কথা বলেছিলাম তখন অল্প কিছু মুহূর্তের জন্য দাদীজান আমার দিকে মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো।"
"ওহ সম্ভবত তার নিজের কথা মনে পড়েছিল।"
"নিজের কথা?"
"ছোট থাকতে দাদীজানেরও মা মারা গিয়েছিল। স্বামীর অশান্তি সহ্য করতে না পেরে আত্নহত্যা করেছিলো শুনলাম। এরপর সৎ মা তার উপর অত্যাচার না করলেও কঠিন ব্যবহার করতো। এরপর থেকে তিনিও নিজের মনকে কঠিন করে ফেলল। কিন্তু দাদীজানের মন নরম করা কিন্তু অনেক সহজ। সে দেখায় না কিন্তু সে মা'কেও অনেক ভালোবাসে।"
.
.
.
চলবে.................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন