ইন ফিউচার - তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া - অনু গল্প


#ইন_ফিউচার 
#অনু_গল্প 
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া 



গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে।আকাশ কেমন কালচে রঙের আবরণে ঢাকা পড়েছে।চারদিকে স্তব্ধতা। কোথাও কোন বাতাস নেই। পাখ-পাখিদের গুঞ্জন নেই। গাছপালা কেমন নির্জীব হয়ে গেছে।পৃথিবী এখন অনেক শীতল। অধিকাংশ জায়গায় বরফে ঢেকে গেছে।দিন রাতের তারতম্য বোঝা যায় না ঠিকমতো।মনে হয় প্রকৃতি যেন প্রাণ হারিয়ে ফেলেছে। 
অবশ্য ঠিক সন্ধ্যা বলা চলে না। কারণ এখন যে পৃথিবীর অবস্থা! তাতে সন্ধ্যা আর দিন-রাত সব প্রায় একই রকমের লাগে। 
ড. রায়ান আহমেদ তার ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজে ব্যস্ত। রুম জুড়ে কতগুলো যন্ত্রপাতি আর ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত সে।দুপুরেও খায়নি লোকটা । বলতে গেলে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা কাজে লেগে থাকেন উনি। তার একমাত্র সন্তান রেহান যার বয়স চার বছর কেবল! সে তার বাবার কাছে এসে ইতোমধ্যে কয়েকবার খেতে ডেকে গেছে। কিন্তু যতবার রেহান তাকে ডাকতে এসেছে ততবারই তিনি
 "আরেকটু পর আসছি বাবা!" 
বলে উনি কাজেই মুখ গুঁজে আছেন। ছেলেকে দিয়ে কাজ হবে না বুঝতে পেরে তার স্ত্রী স্পর্শিয়া নিজেই এবার ডাকতে এসেছেন। 
" রায়ান প্লিজ খেয়ে নাও বলছি। হাতের ঘড়ির দিকে একটু তাকিয়ে দেখো তো কয়টা বাজে! "
রায়ান কাজ করতে করতেই বললো,
" উহুম আরেকটু বাকি। একটু পর আসছি।"
স্পর্শিয়া এবার কিছুটা রেগেই বলে আর কতক্ষণ পর যাবে? গত পাঁচ বছর ধরে তো এই এক কাজ করে যাচ্ছে! তাহলে সে কাজ কি আরেকটু সময় পর হওয়া পসিবল? বৃথা চেষ্টা করছে সে।
" দেখো রায়ান আমি বুঝতে পারছি তোমার দায়িত্ব পৃথিবীকে বাঁচানো। আর সেই কারণেই তুমি আর তোমার টিম দিন রাত চেষ্টা করছো কিভাবে পৃথিবীকে আগের পরিবেশ ফিরিয়ে দেওয়া যায়! কিন্তু আমার থেকে তো তুমি এটা ভালো জানে, এরকম কিছু হওয়ার নয়!"
"না সম্ভব! "
স্পর্শিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সে ঠিক কি বলেছে? রায়ান এবার ল্যাপটপ থেকে স্পর্শিয়ার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে হ্যাঁ এবার হয়তো পৃথিবীকে বাঁচাতে পারবে সে।মূলত সূর্য নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবার কারণে পৃথিবী তার নিজস্বতা হারিয়েছে।সূর্যকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারলেই পৃথিবীর আবহাওয়া আবার আগের মতো হবে। দিনে পর্যাপ্ত আলো থাকবে আবার রাতে অন্ধকার।মূল কথা আমরা আবার আমাদের সবুজ শ্যামল পৃথিবী ফিরে পাবো 
! স্পর্শিয়া তার স্বামীর কথায় উৎফুল্ল হয়ে বলে, তাহলে সেটা কিভাবে সম্ভব? রায়ান একটু মুচকি হেসে বলে সেটা একটু কঠিন কাজ! সূর্যে নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণ করাতে হবে। তাহলে হয়তো সূর্যের তাপ পুনরায় উৎপন্ন হবে। স্পর্শিয়া ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না। এর মানে রায়ানকে তার হারাতে হবে মহাশূন্যে। কারণ তার স্বামী কাজের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। 
"রায়ান আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি! "
রায়ান স্পর্শিয়াকে বুকে জড়িয়ে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, 
" আমি কি তোমাকে ভালোবাসি না?"
স্পর্শিয়া হু হু করে কেঁদে ওঠে। রায়ান তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে পুরো পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে এটুকু আত্মত্যাগ করতে হবে তাকে। এখন যদি সে চুপচাপ ঘরে বসে থাকে তাহলে পৃথিবীর যতটুকু নিজস্বতা আছে তাও হারিয়ে ফেলবে। সম্ভবত আর তিন/চার বছরের মধ্যে তাপমাত্রা এত কমে যাবে যে কোন প্রাণী বেঁচে থাকবে না তখন। তাহলে কি ততদিন মরার জন্য অপেক্ষা করবে সে!আর তাদের সন্তান তো এখনো কত ছোট। রায়ানের সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া বাবা হিসেবে তার দায়িত্ব। 
তাহলে কি এখন একটা শেষ চেষ্টা করা ঠিক হবে না? আর নেগেটিভ চিন্তা না করে পজিটিভও ভাবতে হবে। স্পর্শিয়া ভালো করেই জানে নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণ ঘটলে ওখানে থাকা কেউই বাঁচবে না। তবু তাকে সবকিছু মেনে নিতে হবে। কারণ শুধু নিজের কথা ভাবার মতো স্বার্থপর মেয়ে সে নয়। কিন্তু রেহান! ওইটুকু বাচ্চাকে কিভাবে পিতৃহারা হতে দেখবে সে।
"রেহানকে কি বলবো রায়ান? আমি এতটা পাষাণ কি করে হবো বলতে পারো!"
" জানো আমাদের রেহান যখন অনেক বড় হবে তখন ও গর্ব করে বলতে পারবে ওর বাবা পৃথিবীকে বাঁচাতে প্রাণ দিয়েছে। "
স্পর্শিয়া হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার স্বামীকে।
.
.
"ড. রায়ান! ড. রায়ান! আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?"
রায়ান ধীরে ধীরে স্বজ্ঞানে ফিরে আসে। সবাই বেশ খুশি হয়েছে। স্পর্শিয়া রায়ানকে ডাকতে শুরু করে। রায়ান ঢুলু ঢুলু চোখে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, 
"তোমার চোখে পানি কেন? "
"এই যে ইয়াং ম্যান, গত দুবছর যাবৎ তো এই হসপিটালের বেডে শুয়ে আছেন। প্রথম দিকে জ্ঞান থাকলেও পরে আপনি কোমায় চলে গিয়েছিলেন।"

রায়ানের কাছে সবটা গল্পের মতো লাগছে। পৃথিবীর শীতলতা, তার গবেষণা সবকিছুই কি তাহলে তার অবচেতন মনের ভাবনা ছিল? সে একটু ইতস্তত হয়ে ড.নুরকে জিজ্ঞেস করে, 
"স্যার তাহলে আমি এই দুই বছর একটা ঘোরের ভিতর ছিলাম? আমি তো কতকিছু... "
ড.নুর রায়ানকে থামিয়ে বলতে শুরু করে, 
" হ্যাঁ রায়ান। আপনার মস্তিষ্ক অলস সময় পার করছিল। ফলে নিজের ইচ্ছে মতো কিছু চিন্তা ধারা একত্র করে ওসব দেখেছেন। এখন আপনি বাস্তবে ফিরে এসেছেন। আপনার স্ত্রী অধীর আগ্রহে এতক্ষণ ধরে বসে আছেন আপনার সাথে কথা বলবেন বলে।আমি আসছি।"
ড.নুর ইসলাম কেবিন থেকে চলে যান। রায়ানের মাথায় এখানে সেই সব সপ্ন ঘুরছে। স্পর্শিয়া রায়ানের হাত ধরে জিজ্ঞেস করে তার কথা মনে আছে কি-না! রায়ান সব ভাবনা পাশে রেখে স্পর্শিয়ার হাত শক্ত করে আগলে ধরে বলে নিজের অস্তিত্ব ভুলে গেলেও তাকে ভুলতে পারেনি।ঘোরের মধ্যেও সে ছিল তার অর্ধাঙ্গিনী। 
.
রায়ান বাড়ি ফিরে এসেছে। রায়ান একজন বিজ্ঞানী।মহাকাশে প্রেরণকৃত বিভিন্ন যানের তথ্য সংগ্রহের বিষয় সে কাজ করে। রায়ানের পরিবার বলতে শুধু স্পর্শিয়া। একটা কার এক্সিডেন্টে রায়ানের পুরো পরিবার মারা গেছে। আর স্পর্শিয়া তার মায়ের অসুস্থতার জন্য বাবার বাড়ি ছিল। তখন রায়ানও তাদের সাথেই ছিল। ভাগ্য ক্রমে সে বেঁচে গেলেও মাথায় গভীর আঘাত পাওয়ার জন্য গত দুবছর কোমায় ছিল।
এখন কাজ আর স্পর্শিয়া এই নিয়ে তার জগত।
.
.
"স্পর্শিয়া! কি বলছিস এসব? স্পর্শিয়া?"
রেহেনা বেগমের ডাকে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে স্পর্শিয়া। কাল সারারাত অফিসের কাজে জেগে ছিল সে। তাই দিনে একটু বেশি ঘুমিয়ে ফেলেছে মেয়েটা।
" আজ তোর পাকা দেখা রে হতচ্ছাড়ি!আর তুই ঘুমিয়ে ভুলভাল বলছিস?"
"ওহ মা কে-ই বা আসবে দেখতে! রায়ান আর ওর বাবা - মা।ওনারা তো সেই কলেজ লাইফ থেকে আমাকে দেখছেন! এখন আর বকাবকি করো না। এমনিতেই কিসব সপ্ন দেখলাম! "
" আচ্ছা ঠিক আছে। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে রেডি হয়েনে। রায়ান তোকে অলরেডি বিশ বার কল করেছে। শেষে ছেলেটা বাধ্য হয়ে আমাকে কল করে জানিয়েছে ওনারা আসছে। "
স্পর্শিয়া দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে রেডি হয়ে যায়। তারপর রায়ানকে কল করে জানতে পারে ওনারা চলে এসেছেন। বসার ঘরে বসেছেন সবাই। স্পর্শিয়া নিজের হাতে তাদেরকে আপ্যায়ন করে। উভয় পরিবার খুব খুশি।রায়ানের বাবা মা বিয়ের তারিখ ঠিক করে স্পর্শিয়াকে আর্শীবাদ করেন।
.
পড়ন্ত বিকেলে পার্কের বেঞ্চে হাত ধরে বসে আছে স্পর্শিয়া আর রায়ান। দুজনের চোখে নতুন জীবনের সপ্ন। কতশত নতুন আশা, ইচ্ছে, ভাবনা!  
পেশায় দুজনেই বিজ্ঞানী তারা। তবে কাজের ক্ষেত্র আলাদা । 
" তারপর মহারাণী বলুন কি রকম কাজ এগোচ্ছে আপনার? "
"তুমি কিন্তু আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলছো।"
"আরে না রে পাগলি। আচ্ছা বলো তোমার গবেষণা কতদূর? "
"গতকাল রাতে মোটামুটি শেষ করেছি।"
"কি বলছো? তাহলে তুমি টাইম ট্রাভেল মেশিন কিংবা থিউরি আবিষ্কার করে ফেলেছো!"
"সম্ভবত হ্যাঁ। "
"এই চলো না আমরা ভবিষ্যতে গিয়ে ঘুরে আসি।"
"মজা করা অফ করো তো রায়ান। খুব শীগ্রই তোমার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে হুঁ। তবে ফিউচারে যাওয়ার চিন্তা না করাই ভালো। হয়তো বর্তমানটাই আমাদের জন্য বেস্ট। কে বলতে পারে ইন ফিউচার আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে! "
"আচ্ছা বাব্বাহ। আর মজা করেছি না।তবুও গাল ফুলিয়ে বসে থেকো না।"

রায়ান আবারও হো হো করে হেসে ওঠে। স্পর্শিয়া তার বুকে সজোরে ঘুষি মারতে শুরু করে। রায়ান হাসিমুখে স্পর্শিয়ার কপালে আলতো করে ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দেয়। স্পর্শিয়া লজ্জায় রায়ানের বুকে মাথা গুঁজে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। রায়ানের বুকেই যেন তার পরম শান্তির জায়গা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন