প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল - পর্ব ৫২ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


অয়ন লম্বা শ্বাস ফেলছে। মুখশ্রী বেশ করুণ। রুদ্ধশ্বাস নিয়ে একটু নরম গলায় বলল, 'তোমার কী মায়া নেই? আমি কি এভাবে গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে ঘুরেফিরে বেড়াবো? জানো, কতটা ঘুম পেয়েছে আমার? এভাবে ঘুমানো যায় না। শরীর ব্যথা করছে!'

শাবিহা চোরাচাহনি নিক্ষেপ করলো। প্রচন্ড মায়া হলো।তবে তার গলাটাও শুকিয়ে আছে। অনুভূতি ঝেঁকে বসেছে। বুকটা ধড়ফড় করছে৷ অয়নকে সে কীভাবে বলবে, ভয়টা সে নিজেকে নিয়ে পাচ্ছে! নিজের উপর তার ভরসা নেই। খুব ভেবেচিন্তে ছোট গলায় বলল, 'আচ্ছা ঠিকাছে।'

অয়ন যেমন উগ্র সমুদ্রে জাহাজ পেয়ে বসেছে। উড়োজাহাজের গতিতে ছুটলো। বাছাই করা হোটেল রিসার্ভ করে রেখেছিল। সোজাসাপটা গিয়ে পৌছালো। শাবিহা বিরক্ত হলো বটে! ছেলেটা প্রচন্ড খারাপ। খারাপের ঘরে খারাপ। এতক্ষণ যাবত, মুখটাকে প্যাঁচার ন্যায় করে রেখেছিল। 

খুব গোছালো দীর্ঘ কামরা। বড়ো বিছানা। শাবিহা ইনিয়েবিনিয়ে বলল, 'আরেকটা রুম নেওয়া যাবেনা?'

অয়ন শুনেও যেমন শুনল না। টি-শার্ট খুলে বিছানায় ছুড়ে মারল। প্রশস্ত দীর্ঘ পিঠ শাবিহার চোখের সামনে। বুকটা ধক করে উঠলো। দৃষ্টি নড়েচড়ে গেল। শ্বাসপ্রশ্বাস অশান্ত। এদিকসেদিক নজর ঘোরাতে চাইল। পারলো না। বেহায়া চোখজোড়া ফুলো বাহু দেখতে ব্যস্ত। ওয়ার্ক-আউট করা শরীর। দেখতেই আকর্ষণীয়। নজর ফেরানো দায়। অয়ন বেহায়ার ন্যায় ঘুরে দাঁড়ালো। শাবিহা গোপনে হাসফাস করে বারান্দার ছুতোয় চলে গেল। অয়ন আনমনে হাসলো। ওয়াশরুম গেল। শাবিহাকে সে মোটেও বিরক্ত করবে না। কোনো স্পর্শ করবে না। সে শাবিহাকে বাধ্য করবে, যেচে এসে তার স্পর্শ নিতে। তার স্পর্শের আকাঙ্খা গড়তে! 
-----
'পিল নিয়েছিস?'
'হু!'
'কই দেখি বড়ো হা কর।'
'কীসের পিল ছিলো বলেন আগে!'

তন্ময় মহা বিরক্ত হলো। দু আঙুল দিয়ে অরুর ঠোঁট চেপে ধরলো। চোখ রাঙিয়ে ইশারায় বোঝালো, মুখ খুলতে। অরু তবুও খুলছে না। নাছোড়বান্দা! তন্ময় টেবিলের দিক এগোল। আরেকটি নিবে ঔষধ এমন হাবভাব! সেটা দেখে অরু ঘাবড়ে গেল। ছটফট করে মুখ খুলে তন্ময়ের সামনে দাঁড়ালো, 'এইযে দেখেন! আমি খেয়েছি। সত্যি। দেখেন...'

তন্ময় সেই ছোট্ট মুখের দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। গোলাপি ঠোঁট জোড়া দুপাশে ছড়িয়ে। ফুলোফুলো গাল জোড়া, খুব আকর্ষণ কাড়ছে। তন্ময়কে ডাকছে যেমন। সে মুখ বাড়ালো। শক্ত করে কামড় বসালো তুলতুলে নরম গালে। হঠাৎ আক্রমণে অরু তাজ্জব, কিংকর্তব্যবিমুঢ় এবং ব্যথিত! এমনটা তার তন্ময় ভাই করেছে বিশ্বাস করতে পারলো না। বড়ো বড়ো গোল চোখে দেখতে থাকলো। তন্ময় হাসলো নির্বিকার ভঙ্গিতে। হেসে গাল টেনে ধরলো, 'ট্রাস্ট করবো?'
'হু। আমিতো আমাদের ভালো চাই।'
'আমাদের?'

অরু খানিক লজ্জাও পেলো! একটু কষ্ট ও পেলো। কিন্তু সে তো ভালোই চায়। তাই না? ভালোর জন্য একটু মিথ্যে বললে কিছু হয়না। 
______
মাহিন অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে সোফায় বসে। মুখশ্রী বড্ড নাজুক। বেচারা প্রচন্ড ক্ষেপে আছে, প্রকৃতির উপর। এসব রোমান্টিক ওয়েদার কী তার জন্য নাকি! যদি তার জন্য না হয়, তাহলে দরকার নেই এইরকম ওয়েদারের। সে ঘুরতে এসেছে, ঘুরবে। রোমান্টিক বৃষ্টি দেখে, যাকে তাকে নিয়ে ভাবতে বসবে না,'বাল! বৃষ্টিও তন্ময়ের সাইডে মনে হয়। হানিমুন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার সব, ওয়েস দিয়ে দিচ্ছে শালারে! আর আমরা যে ট্যুর দিব ভেবে আসলাম, সেটার কী হবে? বেরোতেই পারছি না। সকাল থেকে বৃষ্টি! দেখতে দেখতে বিকেল! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে ভাই! ঘুরাফেরা কী আদৌও হবে?'

তন্ময় ভ্রুক্ষেপহীন। চুপচাপ বন্ধুদের মধ্যে বসে। মাহিনের থমথমে চেহারার চটচটে মেজাজের বকবক নির্বিকার ভঙ্গিতে শুনছে। ইব্রাহিম শব্দ করে হাসলো। সেলফোন পকেটে ঢোকাল। সাজেশন দিল, 'রেইনকোট পরে নেই চল। তারপর বাইক নিয়ে বেরোই! ব্যাপারটা জোস হবে।'
'হ্যাঁ! তারপর ব্যাচেলর আমি কোনো চিপায় পড়ে মরেটরে যাই। রাস্তাঘাট উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাকেও ভাসিয়ে দিবে শালা!'
'তুই কোনো ব্যাটা না!'
'হ আমি তোর ব্যাটি। দে বাবা বিয়ে দে! পকপক করে মাথা খা.. কাজের কাজ ত...'

মাথা গরম মাহিনকে থামাতে শুহানি নরম সুরে বলল,'আচ্ছা হোম গেমস খেলি? আরেকটা নাইট ইভেন্ট? হাও এবাউট ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার? বাগানে ত ব্যবস্থা করাই। আমরা শুধু খাবার টাবার স্যাট করবো। গানটান বাজাব, খাব, এঞ্জয় করবো। কেমন হবে?'

মাহিন তার বিরক্ত মুখ খুলবে ভাব, পূর্বে শুহানি ওয়ার্নিং দিয়ে দিল, 'খবরদার আমাকে তেঁতো কথা শোনাতে আসবি না। মনে রাখবি আমি মেয়ে।'
'কলিজা কেটে দিয়ে দেই? তুই ভুনাখিচুড়ি করে, সবাইকে বিলিয়ে দে! বালসাল!'

মাথা গরম মাহিনের তেঁতো কথা কমবেশি গ্রুপের সবাই গিলেছে। গিলে কেউই আর আগ বাড়িয়ে সাজেশন দিতে গেল না। তন্ময় দু'পাশে মাথা নাড়াল। তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। কেয়ার টেকার চাচাকে বলল, 'দুটো ছাঁতা হবে? থাকলে দিন চাচা!'

কেয়ার টেকার চাচা 'জি' বলে ছুটে গেল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে নিয়ে আসল। এগিয়ে দিল। তন্ময় একটা ছাঁতা নিয়ে আরেকটা মাহিনের দিক ছুড়ে মারল, 'নে। আয় বাইরে।'

ছ্যাত করে উঠে দাঁড়ালো মাহিন। ছাঁতা হাতে ধেইধেই করে তন্ময়ের পিছু গেল। বিরক্তিতে রীতিমতো তার চাপা কাঁপছে। কাকে ঝাড়া যায়? তন্ময়কে তো একদম নয়। এই ছেলে দেখতে শান্ত। কিন্তু মুখ চললে অশান্ত। খবর করে দিবে তার। 
একপ্রকার বাধ্য ছেলের ন্যায় বেরোলো। তন্ময় ছাতা মাথায় যাচ্ছে বাগানের দিক। মাহিন পিছু চলল। উদাসীন পায়ের গতি। দুজন বাগানের নিরিবিলি জায়গায় আসতেই থামলো। দৃষ্টি দুজনের এদিকসেদিক। নিরবতা ভাঙলো মাহিন, 'আমারে দেখ! কতো মেয়ে পেছনে ঘুরেছে, ঘুরছে কাউন্ট করে শেষ করতে পারবি দোস্ত? পারবি না। অথচ, আধবয়সী ছোট ইঁদুর একটা মেয়ে, আমাকে বুড়ো আঙুল দেখায়। আমি.. আমি মাহিনের কল রিসিভ করে না। কত্তবড় সাহস! এসব একটুখানি মেয়ে আমার দাম বুঝবে কীভাবে! কদর করবে কীভাবে! জানেই না আমি কে! শালার কতো মেয়ে পিছু ঘোরালাম, ডেট করলাম, ছুড়ে মারলাম হিসেব নেই। আর এখন এই বয়সে এসে, কীসব দেখতে হচ্ছে!'

গলা পরিষ্কার করে আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক তাকাল, 'ওই মেয়েটা! মানে মারজি.. ওর ছবি আছে?'

তন্ময় মাথা ঘোরালো। নিবিড়ভাবে মাহিনকে পর্যবেক্ষণ করছে। মাহিন নড়েচড়ে ওঠে, 'এভাবে তাকাস কেন!'
'তোকে সুবিধার লাগছে না।'
'লাগবে কীভাবে! থাকলে দেখা...'

তন্ময় পকেটে হাত দিল। সেলফোন বের করবো। হুট করে মাথা উঁচু করলো। অযথাই চোখ গেল উপরে। দোতলার পশ্চিম দিকের বারান্দায় তার বোকাসোকা অরু দাঁড়িয়ে। বৃষ্টির মধ্যে। এভাবে থাকলে ধীরেধীরে ভিজে যাবে ত! ঠান্ডা লাগবে। তারপর সারাদিন নাক ধরে বসে থাকবে! তন্ময় পা বাড়ালো ঘরের দিক। যাবার আগে বলে গেল, 'পাঠিয়ে দিচ্ছি হোয়াটসঅ্যাপে!'

মেঘ ডাকছে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে। প্রকৃতি বড্ড ঠান্ডা, শান্ত। বাহিরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তাঘাট স্যাতলা! গাছগাছালী নরম এবং ভেজা। আবহাওয়া জানান দিচ্ছে, এই ঝুম বৃষ্টি নামবে বলে! হুট করে বৃষ্টি নামলে অরু ভিজে যেতে পারে। সে তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আসমানের নিচে। সটান মেরে। নড়চড় নেই। একমনে, চিন্তিত মুখে আকাশকুসুম ভাবনায় মশগুল। এতসব ভাবতে গিয়ে ভুলে বসেছে জগৎ। তার তন্ময় ভাইয়া ভীষণ দায়িত্বশীল এবং ধৈর্যবান ব্যক্তি। উপর দিয়ে একটু গম্ভীর আর থমথমে চেহারার অধিকারী। তবে ভেতরে নরম তুলতুলে। খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই, এই লোক বাচ্চাকাচ্চা কতটা পছন্দ করে। 
ছোটবেলা থেকে তন্ময়কে দেখে এসেছে। খুবকরে চেনে তন্ময়কে। এইযে, দীপ্তকে তন্ময় পেলেছে বললে মোটেও ভুল হবেনা। ছোট থেকেই দীপ্ত তন্ময় বলতেই অজ্ঞান! রাতবিরেত মায়ের বুকের দুধ ফেলে, তন্ময়ের সঙ্গে ঘুমিয়েছে। দিন নেই সকাল নেই, তন্ময়কে তার মর্জি মোতাবেক ঘুরতে বেরোতে হয়েছে। এমনকি কোলে করে অফিস গিয়েছে। পাশে রেখে মিটিং সেরেছে। ছোট বোন শাবিহাকেও কম আদরে পালেনি সে! যা চেয়েছে দিয়েছে, দিচ্ছে! না নেই। এসব বিচিত্র চিত্র গুলো সকাল থেকে হানা দিচ্ছে অরুর মস্তিষ্কে। তার তন্ময় ভাইয়া একজন সুপুরুষ। ভালো ছেলে, ভালো ভাই তেমনি একজন ভালো হাসবেন্ড। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই একজন বেস্ট বাবাও হবে? অরু খুব করে চায় তন্ময় বাবা হোক। আর সে মা। তাদের দুজনের অংশ আসুক। হ্যাঁ, তাদের বিয়ের বয়স কম। সে খুব ছোটো। তার সম্পুর্ন ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। তাতে কী! তন্ময়ের তো বাবা হবার বয়স হয়েছে। তাতেই হবে। 
সকাল থেকে গিল্টি ফিল করা অরু আকাশকুসুম ভেবে, মনকে শান্ত করলো। অতি ভেবেচিন্তে সে আর পিলের বিষয়টি তন্ময়কে বলবে না ভাবলো। তাকে কে'টেকুটে নদীতে ভাসিয়ে দিলেও বলবে না! যখন তন্ময় জানবে তখন নিশ্চয়ই একটা চড় মারবে তাকে! মারুক! অরু সহ্য করে নিবে। সবকিছু মুখ বুঝে মেনে নিবে। 

'এই ছোট্ট মাথায় কি খিচুড়ি পাকাচ্ছিস!'

অরু চমকে উঠলো। ভীষণ ভড়কে গিয়েছে। রীতিমতো কেঁপে উঠেছে! কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহায়। অরুর বেলায় বুঝি তাই! তড়িৎ গতিতে পেছনে তাকাল। তন্ময় দাঁড়িয়ে। একদম কাছে...তার পিঠ ঘেঁষে। চেহারায় চিন্তার ভাঁজ। সে খুব গুঁছিয়ে অরুকে দেখে নিচ্ছে। এই মেয়েটাকে সে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনে। মুখমন্ডল, আচার-আচরণ, হাবভাব দেখেই বুঝতে পারে, কিছু একটা তো চলছে! অরু বত্রিশ দাঁত দেখিয়ে বোকার মতো হাসলো। অন্ধকারী বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির সামনে, এই সাধারণ পোশাকে লম্বা চুল ছেড়ে রাখা বোকা অরুকে, এক রাজ্যের মায়াবতী লাগছে। আদুরে লাগছে। তন্ময়ের ছোট্ট সন্দেহ বহু দূরে পালালো। মস্তিষ্ক শীতল পড়ে গেল। থেকে গেল বুকের বা'পাশের চিনচিন ব্যথা। দু'পা এগোল। অরু তখনো নিজেকে বাঁচাতে বেশ তোরজোড় করছে, 'কিছু ভাবছি না। আমিতো মেঘলা আকাশ দেখছিলাম। বলুন আমি কী মিথ্যে বলি! আমার মতো সত্যবাদী কি কেউ....'

পিঠে এবং হাঁটুর নিচে হাত চেপে অরুকে পাজাকোলে তুলে নিল তন্ময়। ঘটনাটি বেশ দ্রুত ঘটেছে। ভীতু অরু কুকড়ে গিয়েছে। চোখমুখ খিঁচিয়ে মৃদু আর্তনাদ করেছে। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জাপ্টে ধরেছে তন্ময়ের গলা। আসমান তখনও কাঁদতে ব্যস্ত। জল ভীড় জমিয়েছে তন্ময়ের ঘাড়ে। টি-শার্ট জুড়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ছাপ। অরুর উদাসীন চেহারার রঙ বদলাতে শুরু করেছে। লাল বর্ণের আভা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বাঙ্গে। মাথা নত, দৃষ্টি লাজুক। এদিকসেদিক তাকাচ্ছে। চোখ তুলে তন্ময়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাতে পারছে না৷ মস্তিষ্কে ঘুরেফিরে চলে এলো রাতের দৃশ্য। আরেকদফ লজ্জার সম্মুখীন। ছোট করে 'নামিয়ে দিন' বলতেও দ্বিধাবোধ করছে। তন্ময় ভেতরে হাঁটা ধরেছে। 
ঘর এখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এইতো সকালে কেয়ার টেকার চাচা কাজের লোক দ্বারা পরিষ্কার করিয়েছেন। 

বিছানায় বসে অরু হাসফাস করছে। ঘরবন্দী ভালো লাগছেনা। বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে। আঁড়চোখে তন্ময়কে দেখে নিল। এলোমেলো চুপসে যাওয়া গলায় আবদার ধরলো, 'বাইরে যাবো না?'

তন্ময় ঘুরে তাকাল, 'বৃষ্টি হচ্ছে!'
'সুন্দর আবহাওয়া তো।'

তন্ময় কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
'রেডি হয়ে নে।'

অরু হাসলো। ল্যাগেজ থেকে জামাকাপড় নিয়ে ছুটে গেল ওয়াশরুমের দিক। সে আর তার তন্ময় ভাই বেরোবে। লং-টার্ম ড্রাইভিংয়ে। হে হে....তারা ত হানিমুনে আছে। 
_______
বৃষ্টি যেমন শপথ নিয়ে নেমেছিল। তিনদিন পইপই করে ঝরতে থাকলো। মেঘলা আকাশ রয়ে গেল সর্বক্ষণ। আজ তাদের যাওয়ার পালা। ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। এইতো আর মাত্র দু'ঘন্টা। প্রায় চলে এসেছে। অরু গভীর রাতের উষ্ণতা মাখিয়ে নদীর পানির স্রোতের পানে চেয়ে। খুব উপভোগ করেছে এই তিনদিন। এমন কিছু ঘটেছে যা আর কখনো ঘটেনি। তার আর তন্ময়ের একান্ত ব্যক্তিগত সময় গুলো, এতটাই প্রাইসল্যাস ছিলো যে অরু ভাবতে বসলেই, এক রুপকার রাজ্যে হারিয়ে যায়। অনুভূতির সাগরে ভেসে বেড়ায়। খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বাড়িতে গেলে তো আর এমন হবেনা। একসাথে থাকা হবে না। একসাথে ঘুমোনো হবে না। এইযে এই তিনদিন অরু তন্ময়কে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে। তন্ময়ের বুকে মাথা রেখেছে ঘন্টার পর ঘন্টা। তন্মুয়ের শরীরের সুগন্ধি শুকতে শুকতে শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলেছে। এগুলোতো আর করতে পারবেনা। অরুর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে! বুকে যন্ত্রণা অনুভব করছে! 
'কী হয়েছে?'

তন্ময়ের গম্ভীর গলা। সে মাত্রই এলো। এতক্ষণ বন্ধুদের সঙ্গে বাহিরে ছিলো। প্রচন্ড গরম। শরীরের ঘর্মাক্ত শার্ট খুলে ফেলল মুহুর্তে। ল্যাগেজ হতে টিশার্ট নিতে নিয়ে অরুর মুখশ্রী দেখতে পেল। মেয়েটা কেঁদেছে নাকি? তন্ময় চিন্তিত ভাবে এগিয়ে গেল। থুতনি চেপে মুখ তুলে ধরলো চোখের সামনে। তুলতুলে নরম মুখ। লালচে নাক। ভেজা চোখ। বেশ আবেদনময়ী বৈচিত্র্য, 'প্রশ্ন করলাম তো!'
'কিছু না।'

তন্ময় যেমন সব বুঝতে পারে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অরুকে বুকে মিশিয়ে নিল। তার উদোম প্রশস্ত বুকে গিয়ে ঠেকেছে অরুর ভেজা গাল। গরম উষ্ণ আভাস। শরীর শিউরে উঠলো অরুর। তীব্র ব্যাগে ছুটছে রক্ত চলাচল। ঘনঘন তপ্ত শ্বাস ফেলছে। হৃদয় খানাও বাজতে ব্যস্ত। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালো লাগা ছেয়ে বসেছে। নিবিড়ভাবে চোখজোড়া বন্ধ করে রাখল। মনোযোগী হলো তন্ময়ের বুকের গতিপথ মাপায়। জীবন থমকে যাক এখানেই, এভাবেই, এসময়! 

লঞ্চ থেমেছে। শাব্বির শেখ সাহেব দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে। পেছনে দু'হাত গম্ভীরমুখে পেঁচিয়ে রেখেছেন। তন্ময় অরুকে নিয়ে ল্যাগেজ হাতে এগিয়ে গেল। সালাম জানাল। কুশল বিনিময় করে নিল। ঘড়ির কাঁটা তিনটা বিশে। তন্ময় অয়নকে কল করলো। ছেলেটার সঙ্গে তার রাত দশটায় একবার কথা হয়েছে। বলেছে সদরঘাট সময় মতো চলে আসবে। এসেছে কিনা! মাহিনকে বিদায় দিয়ে, সামনে এগোল। বেরোতেই একগাদা সিএনজির মধ্যে সাদা গাড়ি দাঁড়ানো দেখতে পেল। শাবিহা ছুটে আসছে। হাস্যজ্বল, ভরাট মুখশ্রী। তিনদিনে মেয়েটার সবকিছু কেমন উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে যেমন! অরু সেই যে হাত ধরেছে শাবিহার, ছাড়ার নাম নেই। গাড়িতে উঠেও সে শাবিহার সাথে লেপ্টে বসে থাকলো। অয়ন দিব্বি তাদের ঘোরাফেরার বর্ননা করছে। অরু মনোযোগ সহ শুনছে। হুটহাট প্রশ্ন করছে। কাহিনি শোনার আগ্রহ প্রকাশ করছে। সে প্রেম বিষয়ক টপিকে ভীষণ চঞ্চল!
_____
মোস্তফা সাহেব আর আনোয়ার সাহেব সোফায় বসে। দুজন এই রাতবিরেত চা খাচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ঢুলতে ঢুলতে মুফতি বেগম এলেন। হাতে ট্রে! সেখানে আরও দু'কাপ চা। সেই বারোটা থেকে চা বানিয়ে চলেছেন। না ঘুমিয়ে দু ভাই, চায়ের পর চা পান করছেন, ঘুম তাড়াবার জন্য! কেন ভাই! বাড়ির ছেলেমেয়ে ফিরবে, ফিরে তো ঘুমোবে। সকালে দেখা করা যাবে না? আশ্চর্য! বিরক্ত মুফতি বেগম একা নন। জবেদা বেগম ও চরম বিরক্ত। তিনি একটু আগে গটগট পায়ে ঘুমোতে গিয়েছেন৷ পরপর আবার ফিরে এলেন। আসলে তিনি নিজেও ছেলেমেয়ের চিন্তায়। তিনটা দিন ধরে ঘরবাড়ি ফাঁকা হয়ে আছে। নিস্তব্ধ, নির্জন। এতো খারাপ লেগেছে বলে বোঝানো যাবেনা। আর কিছুক্ষ মাত্র। সব আগের মতো হবে। ঘরবাড়ি উজ্জ্বল হয়ে পড়বে। এইতো অরু এসেই নাক টেনে বলবে, 'বাবা! চাচ্চু! তোমাদের কী আমার উপর মায়া নেই? এইযে আমি তিন ধরে বাহিরে। কই আমার তো খবর নিলে না!' বলতে বলতে হয়তো কেঁদেও দিতে পারে....
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন