অলকানন্দা - পর্ব ৪৪ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!১১৭!!

"কোকিল, কোকিল রে আমার রাতুল কই চলে গেলো! আমার মানিক।"

মাহাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো রুমানা। এশা পাশে দাঁড়িয়ে। পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে সে। 
"আমার মা মারা যাবার পর এই পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ ছিলোনা। মাকে আমি কতটা ভালোবাসতাম তুই তো জানিস, কোকিল। আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। অনিক আমাকে রাতুল এনে দিলো। আমার স্বর্গসুখ। আজ কই গেলো আমার মানিক।"

চিৎকার করে কান্না করছে রুমানা। মাহা নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি জবাব দিবে বুঝে উঠতে পারছেনা। সার্থক অনিকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অনিকের মুখ গম্ভীর। চোখেমুখে গভীর বেদনা ভেসে উঠেছে। সার্থক জিজ্ঞেস করে,
"পুলিশকে জানিয়েছেন?"
"জানিয়েছি। প্রথমে তারা অভিযোগ নিতে চাচ্ছিলো না। পরে উপর মহলের সাথে কথা বললাম। তারা বললো সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। এতঘন্টা পেরিয়ে গেলো কোনো খোঁজই তারা দিতে পারছেনা।"

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিক। ছেলেদের তো কাঁদতে নেই। রুমানা তো মেয়ে। তাই হাউমাউ করে কান্না করে নিজের বুকের ব্যথা প্রকাশ করতে পারছে। কিন্তু অনিক! বাবা হয়েও সে চাইলেই কাঁদতে পারছেনা। অনিকের যে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ভিষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সার্থক কেবল চেয়ে আছে। স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে। নিজের সন্তান হারিয়ে ঠিক এভাবেই ভেঙে পড়েছিলো সে। সব ভুলে নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলো আপনার চেয়েও আপনজনের সাথে। তা কি হয়! এই জীবন যে সার্থকের জীবন! 'অ্যা হ্যাপি ফ্যামিলি' যে সার্থকের জীবনে মানায় না। অনিকের বাবা-মা নেই। রুমানার মতো সেও এতিম। দুজনের সুখী পরিবার যেন রাতুলের আগমনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। আজ কোথায় আছে সেই রাতুল! অজানা! রুমানাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে মাহাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠে সেই পুরানো স্মৃতি। মেয়েটা! ক'ব'রে একা শুয়ে। মাহাকে ডাকছে। মাহাকে ভিষণ প্রয়োজন। মাহা সোফায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। তড়িৎ গতিতে সার্থক ধরে ফেলে মাহাকে। রুমানা তখন নিজের মাঝে নেই। এশা এগিয়ে আসে। 
"ভাইয়া, মাহা আপুর কি হয়েছে?"
অনিকও চিন্তিত। সার্থক মাহাকে কোলে নেয়। 
"প্রেশার ফল করেছে। আমি ওকে নিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছি।"

এশা আর বাঁধা দিলোনা। সার্থক একবার রুমানার পানে তাকায়। রুমানার কোনো খোঁজ খবর নেই। বিলাপ করে যাচ্ছে। মাহাকে কোলে নিয়ে অনিকের সামনে বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়ায় সার্থক। 
"চিন্তা করবেন না মিঃ অনিক। আপনাদের বাচ্চা ফিরে আসবে।"

বলেই বেরিয়ে পড়ে সার্থক। মাহাকে পিছনে শুইয়ে দিয়ে ড্রাইভ করছে সার্থক। অবচেতন মন বারবার বলছে, 'এটা মেনে নেওয়া যায় না। সন্তান তুমিও হারিয়েছো। মর্ম বুঝতে পারো। কতটা কষ্ট হয় বুঝতে পারো।'
বাড়ি ফিরে মাহার শরীরে ইনজেকশন পুশ করে সার্থক। মাহা গভীর ঘুমে। 

!!১১৮!!

"বাচ্চাটা কোথায়?"
"জানিনা"
"সত্যিই জানোনা?"
"না।"
"মিথ্যা বলোনা। আমি মিথ্যা পছন্দ করিনা।"

ছায়া মানবের প্রশ্নে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তি নিশ্চুপ। 
"চুপ কেন? জবাব চাই আমার!"

টেবিলে ঘুষি দিয়ে চিৎকার করে ছায়ামানব। নিচে বসে থাকা ব্যাক্তি কেঁপে উঠে। এতদিন অন্যের ক্ষেত্রে ছায়ামানবের এই ভয়াবহ রূপ দেখতো ব্যাক্তিটা। আজ দেখছে নিজের বেলায়। 
"কি হলো! কথা বলো!"
"আমি কিছু করিনি।"

টেবিলের উপর থেকে নিরবে মাউথ অর্গান তুলে নেয় ছায়ামানব। বাজাতে থাকে পাগলের মতো। অদ্ভুতুড়ে সে সুর! শরীর কাঁপানো, মন ভুলানো সে সুর। মানবদেহে হাজারো বিষ পিঁপড়া ছেড়ে দিলে পিঁপড়াগুলো যখন সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে। বিষাক্ত একেকটা কামড়ে দেহে যেমন ব্যথা অনুভব হয় ঠিক তেমন ব্যথা অনুভব হয় মস্তিষ্কে। ব্যাক্তিটা মাথা চেপে ধরে বলে,
"বন্ধ করো। প্লিজ। আমি সব বলছি।"

বাঁকা হেসে মাউথ অর্গান বাজানো বন্ধ করে ছায়ামানব। 
"কোথায় বাচ্চাটা?"
"খেয়ে ফেলেছি।"
"হোয়াট!"

অবাক হয় ছায়ামানব। রাগ দমন করা দায় হয়ে পড়ে তার জন্য। 
"কেন এমন করলে তুমি!"
"টুমি জানোনা আমি বাচ্চাদের কচি মাং'স বালোবাসি।"
"চুপ!"

ভয়ংকর চিৎকার করে উঠে ছায়ামানব। সামনে থাকা ব্যাক্তিটা আর কিছু বলার সাহস পায়না। 
"আমি মানা করেছিলাম না?"

ভয়াবহ নিরবতা চারপাশে। বহুদিন বাদে আবারো তরল গলগলে উষ্ণ রক্তিম পদার্থে রাঙা হয় ছায়ামানবের শরীর। দেহ খন্ড বি'খ'ন্ড করার সময় প্রথম বারের মতো একটু কেঁপে উঠে ছায়ামানব। যেমনটা বাবাকে করার সময় হয়েছিলো। আজ বহুবছর পর বিশস্ত ব্যাক্তিটা কে হত্যা করলো ছায়ামানব। 

_____________

মাহা বিষণ্ণ হয়ে থাকে এখন। কয়েকবার রুমানার বাড়িতেও গিয়েছিলো মাহা, সার্থক। রুমানা বদ্ধ উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছে। আজ রাতুল হারিয়ে যাওয়ার পনেরো দিন চলছে। কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি রাতুলের। রেজওয়ান কথা বলেছে সিলেট পুলিশের সাথে। তারা চেষ্টা করছে। হঠাৎ সার্থক বাইরে থেকে এসে বললো,
"মাহা, চলো।"
"কোথায়?"
"পুলিশ স্টেশনে।"
"কেন?"
"রাতুল কে যে অপহরণ করেছে তার সন্ধান মিলেছে। স্কুলের কিছুটা সামনে এক সিসিটিভি থেকে পুলিশ অপরাধীকে শনাক্ত করেছে।"

বাকি কথাগুলো আর শুনেনি মাহা। গাড়িতে করে কখন পুলিশ স্টেশনে পৌঁছালো তা সে নিজেও জানেনা। এশা, রুমানা আর অনিক বসে আছে৷ মাহা রুমানার কাছে ছুটে যায়। রুমানার মুখে আজ খানিক হাসি। রাতুল কে আবার ফিরে পাবে তারা। পুলিশ অফিসার অনিক এবং সার্থক কে ডেকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। বাইরে রুমানার পাশে এশা আর মাহা বসে।
"আমার রাতুল কে আবার ফিরে পাবো কোকিল। আমার মানিক আমার বুকে ফিরবে।"

সময় যাচ্ছে। একেকটা সেকেন্ড যেন এক বছরের সমান। অনেকক্ষণ বাদে সার্থক, অনিক বেরিয়ে আসে। অনিকের মুখ রক্তশূণ্য। সার্থকেরও মুখ গম্ভীর। রুমানা দৌড়ে অনিকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। 
"রাতুলকে ওরা খুঁজে পেয়েছে, অনিক?"

অনিক অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে রুমানার দিকে। 
"কথা বলছো না কেন তুমি? আমার রাতুল কই?"

অনিক শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রুমানাকে। সমাজের সব নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে অনিক। রুমানা স্তব্ধ হয়ে যায়। অনিকের মতো ছেলে কাঁদছে! 
"আমাদের রাতুল আর আমাদের মাঝে ফিরবেনা রুমানা। তোমার ভাই জিদান সম্পত্তি না পাওয়ার ক্ষোভে আমাদের বাচ্চাটাকে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছে রুমানা। আমাদের রাতুল আর নেই।"

রুমানা জ্ঞান হারায়। 
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন