অলকানন্দা - পর্ব ৪৬ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!১২১!!

"দেখি হা করো।"

সার্থক মাহাকে স্যূপ খাইয়ে দিচ্ছে। মাহা আনমনে খাচ্ছে। 
"এমন আনমনা কেন?"
"আমার না কি যেন হয়েছে সার্থক। সব খালি ভুলে যাই।"
"খাবার তো নিয়মিত খাও না। তাই স্মরণশক্তি কমে যাচ্ছে। বেশি বেশি খাবে।"
রসিকতা করে বলে সার্থক। তার মুখে আলতো হাসি। মাহা বাঁকা চোখে তাকায়। এই লোকটাকে বোঝা দায়। এমন সিরিয়াস পরিস্থিতিতেও রসিকতা করছে। 
"সার্থক, মুইংচিন কে অনেকদিন যাবত দেখিনা। উনি কি কোথাও গিয়েছে?"
"হুম, চীনে ফিরে গিয়েছে।"

অবাক হয় মাহা। অদ্ভুত মানুষ তো! মাহাকে যাওয়ার আগে কিছু বলে যায়নি। এতদিনের পরিচয়। 
"মাহা, ঘুরতে যাবে?"
"কোথায়?"
"যেখানে আমরা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম।"
"সেই সাঁওতাল পল্লি?"
"জ্বি, ম্যাডাম।"
মাহা ভাবলো খানিকক্ষণ। সার্থককে তো কাছেই পাওয়া যায় না। আর এই বদ্ধ বাড়িতে থাকতেও আর ভালো লাগছেনা। একটু মুক্ত বাতাস, একটু সার্থকের সান্নিধ্য প্রয়োজন। ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। মানসিক শান্তিও পাওয়া যাবে। 
"কি ভাবো? যাবে?"
"যাওয়া যায়।"
"আচ্ছা, এবার একটু কাছে আসো তো আদর করি।"

এমন বেহায়াপনা কথায় ভারী লজ্জা পায় মাহা। দূরে সরে যেতে চায়। তবে সার্থক কি তা হতে দিবে? একটানে মাহাকে নিজের বুকের উপর নিয়ে আসে সার্থক। উত্তপ্ত চুমো খায় অধরে। গভীর হয় স্পর্শ। 
সহস্র সময় বাদে সার্থকের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে মাহা। সার্থক মাহার উন্মুক্ত চুলের ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত।
"মাহা, ঔষধ নিয়মিত খাচ্ছো তো? ঔষধটা কিন্তু তোমার শরীরের জন্য জরুরি।"
"খাচ্ছি"

মিথ্যে বলে মাহা। সে ঠিকমতো ঔষধ খাচ্ছেনা বিগত কয়েকদিন যাবত। ঔষধ তার মোটেও পছন্দ না। 

_____________

দুদিন বাদে মেরি, নাহার, সজল সবাইকে বিদায় জানিয়ে সাঁওতাল পল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় দুজনে। অনেকখানি পথ। আজ দিনটা বড়ই স্বচ্ছ। দুপাশে সারি সারি সুপারি গাছ পেরিয়ে পাজেরো গাড়িটা ছুটছে আপনগতিতে। কালো পোলো টি-শার্ট, জিন্স পরনে সার্থক ড্রাইভ করছে সামনে তাকিয়ে। রুষ্ট পুষ্ট শরীরের হাতের মাসল গুলো ফুলে আছে। ফর্সা মুখটা। ঝাঁকড়া চুলগুলো। ইস! মাহা আবার যেন প্রেমে পড়লো সার্থকের। কিন্তু মনটা ভিষণই খারাপ তার। এই যে মাহা এত সুন্দর কালো জামদানী পরেছে, কাঁচের চুরি পরেছে। কোঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রাখা। সার্থক একবারের জন্যও তার প্রশংসা করেনি। মাহাও এখন পর্যন্ত টু শব্দটি করেনি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে। হঠাৎ গাড়ি থামায় চমকে উঠে মাহা। আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিগুলো দেখা হয়না। প্রশ্নবোধক চাহনি মেলে দেয় সার্থকের পানে। ততক্ষণে সার্থক একদম মাহার কাছাকাছি চলে এসেছে। মাহা চোখ বন্ধ করে নেয়। সার্থক ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয় কপালে। কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
"এক বুক ভালোবাসা দিলাম আমার রমণীকে। ভিষণ সুন্দর লাগছে।"

লজ্জা পেয়ে সার্থকের বুকে মুখ লুকায় মাহা। সার্থক হাসে। বড় প্রাণখোলা সে হাসি। পথিমধ্যে মাহাকে একবার আইসক্রিমও কিনে দিয়েছে সার্থক। সকাল পেরিয়ে বিকেল। একটু পর সন্ধ্যা নামবে। পাহাড়ি উপত্যকা দিয়ে গাড়ি চলছে। আকাশ তখন ধূসর বর্ণ। শো শো বাতাস বইছে। অবশেষে রাতের বেলায় সাঁওতাল পল্লিতে প্রবেশ করে তারা। এখানে আগামীকাল সারাদিন থাকবে দুজনে। ছোট জনপদ। মাটির ঘরগুলোতে মশাল জ্বালিয়ে রেখেছে সকলে। সার্থক মাহাকে নিয়ে নামতেই কানুসহ বাকিরা এগিয়ে আসে হাতে মশাল হাতে। 
"ভালো আছেন বাবু? আপনারা এসেছেন আমরা বড়ই খুশি হয়েছি।"
"ভালো আছি কানুভাই। আপনি ভালো আছেন তো?"
"আছি, আছি। বেশ আছি। চলুন আপনারা আমাদের প্রধানের বাড়ি যাবেন। উনি অপেক্ষা করে আছেন।"

এক হাতে মাহাকে ধরে অপর হাতে ব্যাগ নিয়ে সার্থক চলছে কানুদের সাথে। মিষ্টির প্যাকেট মাহার হাতে। সেই পুরানো ছিমছাম বাড়ি। এই এলাকার সবচেয়ে বড় বাড়ি এটা। ধুতি, ফতুয়া পরনে জগত মুর্মু নিজের আসনে বসে আছেন। কলাপাতার বেড়া পেরিয়ে সার্থক মাহা প্রবেশ করে বাড়ির উঠানে। সার্থকের চোখ যায় বাঁশের তৈরি মাচায়। এই মাচার উপরই মাহাকে নিয়ে বসেছিলো সে। আর মাহা তখনও ঘুমে। সান্তালী ভাষায় কুশল বিনিময় করলেন সাঁওতাল প্রধান জগত মুর্মু। কানু সেসব বিশ্লেষণ করে দিলো। কানুর সাথে কয়েকদিন আগে হাসপাতালে দেখা হয়েছিলো সার্থকের। জগত মুর্মুর মেয়ের অপারেশনে সাহায্য করেছিলো সার্থক। তারপর থেকেই তারা কৃতজ্ঞ সার্থকের প্রতি। দাওয়াতও দিয়ে গিয়েছিলেন। মিষ্টির প্যাকেটগুলো হাতে পেয়ে বড়ই খুশি হলেন জগত। ফতা পরিহিত জগত মুর্মুর স্ত্রী তাদের অতিথি কক্ষে নিয়ে এসেছেন। ভদ্রমহিলা খুবই ভালো। এই ঘরটায় একটা জানালা রয়েছে। মাহা সেই জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। একদিন এক অপরিচিত ব্যাক্তির সাথে এই ঘরে ছিলো মাহা। সময় পেরিয়েছে। আজ সেই ব্যাক্তিটা আর অপরিচিত নেই। মাহার ধ্যান, জ্ঞান সবই তিনি। মাহার একান্তই মনের মানুষ। মাহার আপনজন। মাহাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে সার্থক। 
"কি ভাবছো এতো?"
"সময় কত তাড়াতাড়ি চলে যায়। তাই না সার্থক?"
"কেন এমনটা মনে হলো?"
"এই যে দেখুন না। এই ঘরে বছর চারেক আগেও আমি আপনি ছিলাম সম্পূর্ণ অপরিচিত। আর আজ..
" আজ কি?"
"আজ আপনি আমার একমাত্র আপনজন।"

জানালার পাশে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলো দুজনে। খাবার দিতে ডাকা হয় তাদের। তখনই ধ্যান ভাঙে দুজনের। খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে তারা। বড়ই ক্লান্ত কিনা। ভোরের দিকে সার্থকের ডাকে ঘুম ভাঙে মাহার। একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমে তলিয়ে যায় সে। 
"মাহা, উঠো। উঠো পাখি।"
"উফ্! সার্থক আরেকটু। ঘুমাতে দিন না।"
"আচ্ছা, এসে ঘুম দিও আবার। এখন চলো না প্লিজ।"

অগত্যা মাহাকে উঠতে হলো। রাতে শাড়ি পাল্টে নীল রঙের একটা থ্রিপিস পরেছিলো মাহা। তারই উড়না গায়ে জড়িয়ে নেয়। সার্থক তাড়া দিয়ে মাহাকে বাইরে নিয়ে এসেছে।

"কোথায় যাবেন?"
"আসার সময় একটা বিস্তৃত মাঠ দেখেছিলাম। সেখানে যাবো।"

এই লোকটাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। মাঠ কি পরে দেখলে হতো না। মাহার ঘুম ভাঙালো শুধুশুধু। এত বিস্তৃত না হলেও মাঝারি আকৃতির একটা মাঠ। দূরে কেবল পাহাড় আর পাহাড়। সবুজে ঘেরা চারপাশ। আকাশে তখনো সূর্য উঠেনি। মাঠের ঘাসগুলোতে শিশির বিন্দু জমে আছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। সার্থক শুয়ে পড়লো ঘাস আবৃত মাঠে। সাথে মাহাকেও নিলো। মাহা সার্থকের বামহাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে।
"কি করছেন বলেন তো আপনি? কেউ দেখে ফেললে কি হবে?"
"দেখলে দেখুক। আমার বউ। আমি যা খুশি তাই করবো।"
"পাগল একটা।"

নীলচে আকাশ চিড়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে রক্তিম সূর্য। ধূসর মেঘের দলেরা ভিড় জমিয়েছে চারপাশে। লালচে সূর্যটা এবার সম্পূর্ণ বেরিয়ে এলো। হলুদ, লাল আর নীলের সমন্বয়ে সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। মাহা অবাক নয়নে চেয়ে রইলো। চোখ দুটো চকচক করে উঠে তার। কি মনোরম প্রকৃতি! সার্থক কে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানায় মাহা। তারপর সারাদিন তারা কতকিছু করলো! চা বাগান ঘুরলো, ভাপা পিঠা খেলো। রাতে পোড়া মুরগীর ভোজন করলো। খুবই সুন্দর কেটেছে তাদের সময়। আজ আবার ফিরে যাচ্ছে বাড়ি। আচ্ছা, এটা তো সার্থকের জীবন? অভিশপ্ত জীবন। এত সুখ দুজনার কপালে সইবে তো?
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন