অলকানন্দা - পর্ব ৫০ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!১২৫!!

"Arrival of shadow man in Bangladesh
101 mu'r'd'ers of 2012"

বাংলাদেশ শিকার করার ভালো স্থান। মানুষের মাং'সও বড়ই সুস্বাদু। এদের দেহে তেল,চর্বির মাত্রা বেশি। মাং'সও স্বাদ লাগে খেতে। এটা অবশ্য আমার ব্যাক্তিগত অভিমত। আমি হৃদপিণ্ড ভক্ষণ করতে বেশি পছন্দ করি। যদিও কলিজাও আমার প্রিয়। এদেশে মানুষ গু'ম হলেও পুলিশ তাদের নিয়ে এতো তৎপর হয়না। বিষয়টাকে কাজে লাগালাম। বহুস্থানে WCS এর সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমি সিলেটে একটা হাসপাতালে ঢুকলাম। প্রথম বছর আমরা তেমন কিছুই করিনি। সদস্য বাড়িয়েছি কেবল। ঐ তো আমাদের একটাই নীতি মাং'সের বিনিময়ে কাজ। কিছুদিনের মাঝেই বাংলো কিনলাম পাহাড়ে। আমাদের সোসাইটির একটা মিলনস্থান প্রয়োজন। কাজের সূত্রে খাজার সাথে পরিচয়। শক্ত পোক্ত শরীর। যেন কোনো গ্রীক মাইথোলজির শোষক রাজা। চা বাগানে কাজ করে। সে আমাদের একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠলো। খাসিয়া পল্লী, গারোদের আবাসস্থল থেকে আমরা নৃগোষ্ঠী শিকার করা শুরু করলাম। বিকেল, রাত, সন্ধ্যায় চা বাগানে ওৎ পেতে থাকতাম। কাউকে পেলেই ঝাঁপিয়ে শেষ করে দিতাম তাকে। মানব সাপ্লাই, অর্গান সাপ্লাইয়ের ব্যবসা আমার রমরমা। রুৎবা, মাতব্বর শরীফ। দুই স্বামী স্ত্রী। চা বিক্রি করতো তারা। মাতব্বর শরীফের ছেলে ফয়সাল। মূলত ফয়সালকে WCS এর সদস্য করেছি। এরপরই মাতব্বর শরীফ, রুৎবা যোগ দেয়। আমি আরো বিধ্বংসী হয়ে উঠলাম। টাকার নেশা, খু'নের নেশা, মাং'সের নেশায় আমি তখন বদ্ধ উন্মাদ। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম রাতে। খু'ন করে সার্জিক্যাল ব্লেড দিয়ে ছি'ন্ন পা রেখে আসায় অদ্ভুত শান্তি লাগতো আমার। তবে বিষয়টা চাপা রইলোনা। খু'নের সংখ্যা যখন ১০১ ছাড়ালো তখন আতঙ্কিত হয়ে উঠলো দেশবাসী। মিডিয়ায় মিডিয়ায় এই খবর। আজিজের উপর পড়লো এর তদন্ত ভার। এরমাঝেই একটা রহস্য উদঘাটন করলাম। মাতব্বর শরীফের আরেক সংসার আছে। সে ঘরে বউ, মেয়ে আছে। পুলিশ ফাঁদ পেতেছিলো আমার জন্য। আমিও ফাঁদে পা দিলাম। মিস তাজ ছিলো দায়িত্বে। বোকা মহিলা প্রেমে পড়লো আমার। সেই রাতে বাঁচিয়ে দিলো আমাকে। মাতব্বর শরীফের ছেলেটা মারা গেলো।ওর স্ত্রী রুৎবা তখন পাগলপ্রায়। আমাদের অনেক কাজ সম্পর্কেই জানতো রুৎবা। বাইরে মানুষের হাতে খামছে ধরে বলতো তার মৃ'ত্যু সংবাদ। কেউ অবশ্য আমলে নিতো না। ওকে বললাম পুলিশ আমাকে খুঁজছে সমস্ত দায় যেন ও নিজের ঘাড়ে নেয়। সে প্রথমে রাজি হয়নি। আমি নিরবে মাউথ অর্গান বাজালাম কতক্ষণ। দ্বিতীয় সংসারের স্ত্রী, সন্তানের খোঁজ দিতেই রাজি হলো সে। রাজি না হয়েও উপায় নেই। প্রিয়জনকে হারানোর ভয় সবারই থাকে। যদিও পরে তাদের আমি হ'ত্যা করেছি। মাতব্বর শরীফ জানে তারা বেঁচে আছে। তাজ সব ব্যবস্থা করে দিলো। গর্দভ মানবী! কি আছে আমার মাঝে? এর মাঝে আজিজটা আবার সব জেনে গেলো। পরিবার সহ রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলাম। একেবারে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সব শেষ। বুম! 
হা হা হা। আমার সাথে খেলায় নেমেছিলো। মৃত্যু তো তার নিশ্চিত। সিলেট থাকা যাবেনা। ডেভিডকে সিলেটে রেখে ঢাকায় চলে আসলাম বাকিদের নিয়ে। এবারে ছি'ন্ন পা রাখিনা আমি। ঢাকার হসপিটালটা অনেকদিন যাবতই পরিচিতি আমার। আমি পার্টটাইম হিসেবে দেশে আসার পর থেকেই এখানে যুক্ত ছিলাম। যাই হোক এখন একেবারে ডাইরেক্ট খু'ন করি। 

"Exploration of Energy Harvesting Cells"

ক্যালিফোর্নিয়ার এক বিজ্ঞানী আমাকে ৬০ কোটি টাকা অফার করলো। তার ও নেগেটিভ র'ক্তধারী একজন মানব কিংবা মানবী চাই। লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা আর অণুচক্রিকা ব্যতীত আরো একটি বিশেষ কণিকা আছে। বিজ্ঞানী ডেনিয়েল সেই কণিকার নাম দিয়েছেন 'Energy harvesting cells'. তারমতে সারাবিশ্বে কেবল ৫ জন ব্যাক্তি রয়েছে এই EHC ধারী। তাদের সবাইকে একত্র করে রক্তের এই কণিকা সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করলে দেহের শক্তি বৃদ্ধি সম্ভব। যে ব্যাক্তি সেই ফর্মুলা শরীরে নিবে সে হয়ে উঠবে অন্যতম শক্তিশালী মানব। যার রাজত্ব থাকবে সারাবিশ্বে। ডেনিয়েল অনেক টাকা খরচ করেছে এর পিছনে। যদিও তাকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে ক্যালিফোর্নিয়ার ধনী ব্যাক্তিরা। সেসবে আমার মন নেই। আমার শুধু টাকা হলেই চলবে। এরপর সারাদেশে ফ্রী র'ক্ত পরীক্ষা শুরু করে দিলাম। সাথে তাদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা সংগ্রহ। EHC মাপার জন্য বিশেষ যন্ত্র ডেনিয়েল পাঠিয়েছিলো আমায়। একের পর এক পরীক্ষা করে চলেছি। কারোটাই ম্যাচ করছিলো না। ডক্টর জিনিয়া। ওর সাথে আমার পরিচয় ঢাকায় হসপিটালে। এই মানবীও আমাকে ভালোবেসে ফেললো। আমি বুঝিনা নরপিশাচদেরও মানুষ ভালোবাসে? সম্পূর্ণ না জানলেও ও কিছু কথা জানতো আমার। টাকার পাগল জিনিয়া। দশ লাখ অফার করলাম। হসপিটালে আসা প্রত্যেক ব্যাক্তির র'ক্তের নমুনা আর ঠিকানা আমার চাই। ২০১২ এরপর দেড়বছরে ব্যবসা কিছুটা মন্থর চলছিলো। যদিও WCS এর সদস্যরা গভীর রাতে ট্রাক নিয়ে বের হয়ে মানুষ শিকার করতো। তবুও ৬০ কোটি অনেক দরকার আমার। একদিন রাতে জিনিয়া ফোন করে বললো আজ হাসপাতালে দুজন মেয়ে এসেছিলো। রিকশা দুর্ঘটনায় দুজনেই ব্যথা পেয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার মধ্যে একজন মাহা হোসেন যার রক্তে EHC উপস্থিত। 

মাহার হাত থেকে ডায়েরিটা নিচে পড়ে গেলো। এই Shadow man যে সার্থক তা আর তার বুঝতে বাকি নেই। মাহার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা। তবে কি চৈতির মৃ'তুর সাথেও সার্থকের সম্পৃক্ততা আছে? গলা শুকিয়ে আসছে মাহার। বুক ফেটে কান্না আসছে। চারটা বছর এক সিরিয়াল কি'লা'রের সংসার করেছে সে! যে মানুষ ভক্ষণ করে! বাইরে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মাহার চোখ দুটো বারবার ভিজে উঠছে। কেন সত্যের মুখোমুখি হলো সে! বুকটায় কামড়ে ধরেছে কয়েক হাজার পিঁপড়া। "মাহা?" হঠাৎ সার্থকের ডাকে কেঁপে উঠে মাহা। তড়িঘড়ি করে লুকিয়ে রাখে ডায়েরিটা। ক্রন্দনরত লালচে হয়ে আসা অক্ষি যুগলকে মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা চালায় । বাইরে বেরিয়ে দেখে সার্থক সোফায় মাথা এলিয়ে আছে। সার্থকের কাছে যেতেও হাত পা কাঁপছে মাহার। কপালের দুপাশে সূক্ষ্ম ঘামের রেখা। শরীর কাঁপছে থরথর। মাহাকে খেয়াল করে সার্থক হাসে। মাহা বিনিময়ে অনিচ্ছায় হাসে। ভালোবাসার মানুষের দুই রূপে হতভম্ব মাহা। মাহা তো তাকে ভালোবাসে। নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। "মাহা?" 
সার্থক চোখ বুজেই আবার ডেকে উঠে। 
"জ্...জ..জ্বি"
"কি হয়েছে?"
"কিছু না"
"আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও মাহা। ক্লান্ত লাগছে অনেক।"

মাহা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সার্থকের কাছে। কাঁপা কাঁপা হাতটা সার্থকের মাথায় রাখে। গা শিউরে উঠছে তার। সার্থক মাহার একটা হাত চেপে ধরে ঠোঁট ছুঁয়ায়। ছেৎ করে উঠে মাহার হৃদপিণ্ড। চিৎকার করে উঠে তার ভিতরটা। "কেন আমার ভালোবাসার মানুষটা অপবিত্র! কেন? পৃথিবীর বুকে সে ছাড়া আমার আর কেউ নেই। এই যন্ত্রণা আমি কেমন করে সইবো?" 
"তোমার কি মন খারাপ মাহা?"
"না..না তো।"

সার্থক কোনো প্রশ্নই করেনি আর। ডাইনিং টেবিলে মাং'সের তরকারি দেখে বমি আসছে মাহার। ভিতরের সবকিছু গুলিয়ে আসে তার। মুখ চেপে ধরে ছুটে যায় বেসিনে। গড়গড় বমি করে দেয়। চোখে ভাসে মানুষের কা'টা মাং'স। সেগুলো ভক্ষণ করার দৃশ্য। লাল টকটকে র'ক্তে চুবচুবে সদ্য মৃ'ত মানুষের মাং'স। পিছনে ঘুরতে নিতেই মাহা দেখে সার্থক তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে। মাহা খানিকটা ভড়কে যায়। সার্থক মাহার এলোমেলো চুল গুলো গুঁজে দেয় কানের পাশে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে বলে,
"শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?" 
"না। আসলে ঐ.. দুপুরে একটু ভাজাপোড়া খেয়েছিলাম।"
"কি যে করো না তুমি মাহা। আজেবাজে খাবার খেলে তো সমস্যা হবেই। আমার একটা কথাও যদি শুনতে।"

মাহা আর কোনো জবাব দেয়নি। প্রতিদিন সার্থকের বুকে মাথা রেখেই মাহা ঘুমায়। এত শান্তি সার্থকের বুকে! আজ মাহার দমবন্ধ লাগছে। এই যে সার্থক মাহার চুলে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তাও বিরক্ত লাগছে। মন, মস্তিষ্কের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে মাহা। মস্তিষ্কে অত্যধিক চাপ পড়ছে মাহার। ঘাড়ের পিছনে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। মাথায় অসহনীয় চাপ। মনে হচ্ছে দু'দিক থেকে দুইটা দেয়াল মাহার মাথায় চেপে ধরেছে। অসহনীয় এই যন্ত্রণা। ঘুম ভেঙে যায় মাহার। সার্থক ঘুমিয়ে আছে পাশে। মাহা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসলো। হুট করেই কয়েকবছর আগের আবছা স্মৃতিগুলোকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা চলছে তার মস্তিষ্কে! স্মৃতিকে বারবার মনে করতে থাকলে স্মৃতিটি যে নিউরোনে সংরক্ষিত আছে, সেটার সিন্যাপ্স বারবার আন্দোলিত হয়। যত বেশী সিন্যাপ্স আন্দোলিত হবে, সেই স্মৃতি তত শক্তিশালী হবে। মাহার ক্ষেত্রে তা হচ্ছেনা। সিন্যাপ্স আন্দোলিত হচ্ছে তবে কিছু মনে পড়ছেনা। মাহা আরো জোর চালালো মস্তিষ্কে। সিন্যাপ্স আন্দোলিত হচ্ছে বারবার। অসহনীয় যন্ত্রণায় হাত কামড়ে ধরলো মাহা। মাথার শিরা ফুলে উঠলো তার। মাহা উঠে দাঁড়ায়। কাঁচের গ্লাসটা সরিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করে। শো শো করে বাতাস বইছে। চারদিকে অন্ধকার। চৈতির কথা ভিষণ মনে পড়ছে। বারান্দায় বসে মাথা চেপে ধরে মাহা। এই যন্ত্রণা সে সহ্য করতে পারছেনা। চোখমুখ বুজে হেলান দিয়ে নিচে বসে সে। হঠাৎ করেই আবছা কিছু স্মৃতি চোখের সামনে অদৃশ্যে ভেসে উঠে। 
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন