!!১২৬!!
পরীক্ষা শেষ। মাহা আর চৈতি মিলে প্ল্যান করলো তারা ধানমন্ডি লেকে যাবে। আতিয়া জামান চৈতি পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতার আগুন সুন্দরী। কাঁধ সমান চুল, খাড়া নাক। সে কি তেজ! আর তার বান্ধবী মাহা হোসেন। মায়াবী মুখ। অভূতপূর্ব মিষ্টি গলার সুর। হলদে ফর্সা মুখটা। কোমড় সমান কোঁকড়া চুল। শান্ত, ঠান্ডা মেজাজের মেয়ে। এরা দুইজনে দুই মেরুই বলা চলে। তবুও বন্ধুত্ব অটুট। একদিন সময় করে বেরিয়ে পড়লো দুজনে। বাস থেকে নেমে রিকশায় চড়ার পরেই বিপত্তি বাঁধে। হঠাৎ করেই পিছন থেকে একটা বাসের ধাক্কায় রিকশা উল্টে দুজনেই পড়ে যায় সড়কে। ব্যথাও পেয়েছে অনেকটা। আশেপাশের মানুষের সহায়তায় হাসপাতালে আসে তারা। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ফিরে যায় হলে। সেদিন আর ধানমন্ডি লেক দেখা হয় না তাদের। মাহার নামে তোলা একটা সিম চৈতি চালায়। মূলত চৈতির সিমটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। মাহার কাছে দুটো সিম থাকায় একটা চৈতি চালাতো। ঐ সিমটা মাহা ব্যবহার করেনি বেশি একটা। বলা বাহুল্য তারা দুই বান্ধবী এক আত্মা এক প্রাণ। হাসপাতাল থেকে ফিরার পরপরই এক অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে চৈতির ফোনে। এই নাম্বারটা তারা হাসপাতালে দিয়েছিলো। ফোনের ওপাশে থাকা ব্যাক্তি মূলত মাহার খোঁজ করেন। চৈতি নিজেকেই মাহা হিসেবে পরিচয় দেয়। লুবান নামের লোকটার প্রেমে পড়ে যায় চৈতি। মাতৃহীন মেয়েটা ভালোবাসাময় কথায়, স্নেহময় বার্তায় আবেগঘন হয়ে পড়ে। প্রণয়ের ছয় মাস পর লুবান তাকে অফার করে সিলেটে আসার। সিলেটে আসলেই কেবল তার দেখা পাওয়া যাবে। এসব কিছুই চলছিলো মাহা থেকে লুকিয়ে। চৈতির ভয়। মাহা কিংবা লুবান যদি সবটা জেনে তাকে ভুল বুঝে! লুবানকে তখনো দেখেনি চৈতি। তবুও প্রগাঢ় ছিল তার ভালোবাসা। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষে চৈতি মাহাকে সিলেট ঘুরার পরিকল্পনার কথা বললো। মাহা যদিও একটু আঁচ করতে পেরেছে বিষয়টা। কারণ চৈতি প্রচুর কথা বলতো ফোনে। মাহা চৈতির প্রস্তাবে রাজি হয়। সিলেট যাওয়ার পথে ট্রেনে বসেই সব কথা চৈতি মাহাকে খুলে বলে। হঠাৎ করেই ভিষণ অপরাধবোধ জেগে উঠে চৈতির মাঝে। এভাবে মাহা সেজে সে একটা লোকের সাথে দিনের পর দিন কথা বলেছে। মন খারাপ হয়ে সিটে হেলান দিতেই মাহা আশ্বস্ত করে তাকে। অপরাধবোধ কমাতে অদলবদলের সিদ্ধান্ত জানায়। সিলেটে যতদিন থাকবে ততদিন মাহা হবে চৈতি আর চৈতি হবে মাহা। একে অপরকে ডাকবেও সে নামে। কেবল চৈতির অপরাধবোধ লাঘবের জন্য, চৈতির মন ভালো করার জন্য মাহার উদ্ভট বুদ্ধি। শুধু কি তাই? তাদের যারা কল্পনা করছে তাদের ঘোলাটে ধোঁয়াশায় রাখতেই এই চিন্তা। তাদের মস্তিষ্কেও চলতে থাকুক কে মাহা কে চৈতি! মাহার কথা ছিলো পরে সুযোগ বুঝে সত্যিটা জানিয়ে দিলেই চলবে। বিভ্রান্ত কল্পনাকারীরা কল্পনা করলো আতিয়া জামান চৈতি। হলদে ফর্সা গাঁয়ের রঙ, অসম্ভব মায়াবী মুখাবয়ব। কোমড় সমান চুল। অভূতপূর্ব তার গলার সুর। মাহা হোসেন। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির আগুন সুন্দরী। কাঁধ সমান চুল, খাড়া নাক। আদতে তার উল্টো। এই পরিবর্তন কেবল ছিলো বন্ধুর প্রতি বন্ধুর মায়া। বন্ধুটিকে অপরাধবোধ থেকে মুক্ত করার ছোট একটা উপায়। তারপর সিলেট যাওয়ার পর একে একে সব ঘটনা ঘটে। নামের মাহা হোসেনের সাথে ঘটলেও সব ঘটছিলো চৈতির সাথে। অস্বাভাবিক সকল ঘটনার পর তারা উঠলো রুমানার বাড়ি। সেদিন বিকেলে কথা ছিলো দেখা করার। মাহা ওরফে চৈতি দেখা করতে যায়। চৈতি ওরফে মাহা দাঁড়িয়ে থাকে বিরাট এক গাছের পিছনে। হঠাৎ চৈতিকে আঘাত করা হয়। আবছা আলোয় ব্যাক্তিটাকে দেখেনি গাছের আড়ালে থাকা মাহা। সে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে। সেই সুরে এক ঘা'ত'ক তার দিকে দৌড়ে আসে। সে দৌড় দেয় উল্টোপথে। তাকে কেউ একজন ধরে ফেলে। টেনে নিয়ে যায় কোথাও। জ্ঞান ফিরতেই মাহা আবিষ্কার করে সে কোনো অন্ধকার ঘরে বন্দী। ছটফট করে মাহা। নীল চোখ। রবার্ট নাম। সূক্ষ্ম একটা পিঁপড়ার কামড়ের মতো আঘাত মাহা অনুভব করে ঘাড়ে। নীল চোখের রবার্ট চলে যায়। খাজা নামের শক্ত পোক্ত শরীরের লোকটা মাহার শরীরে বাজেভাবে হাত বুলোয়। কামড়ে সেখান থেকে পালিয়ে এলোমেলো ছুটে মাহা। ঘাড়ে আঘাত তখনো। জোরে চিৎকার দিয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
হুট করে চোখ মেলে তাকায় মাহা। এই স্মৃতিগুলো সে ভুলে গিয়েছিলো। কি অদ্ভুত! মাহা উঠে দাঁড়ায়। তাকে সম্পূর্ণ জানতে হবে। তার মস্তিষ্ক এই ধাক্কা নিতে পারছেনা। শব্দহীন পায়ে ঘরে প্রবেশ করে। সার্থক তখনো গভীর ঘুমে মগ্ন। মাহা সুযোগ বুঝে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। নিকষ অন্ধকার ঠেলে ছুটে যায় সেই লাইব্রেরিতে। নিজের মোবাইলটা সাথে ন্যায়। আলো সে জ্বালাতে পারবেনা। মোবাইলের আলোই তার ভরসা। বাইরে তখন নিশুতি রাতের কান্নার শব্দ। ঘেউউউ করে টানা সুরে ডেকে চলেছে এক কুকুর। মাহা লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে। উন্মাদের মতো খুঁজে বের করে সে ডায়েরি। মোবাইলে আলো জ্বলছে। সেটা পাশের টেবিলে রেখে ডায়েরির পাতা উল্টায় মাহা। আর কোনো লেখা নেই। তবে একটা পৃষ্ঠায় নকশা আঁকা। কোনো ঘরের নকশা। অন্ধকার সহনীয় হয়ে উঠেছে চোখে। আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে মাহা বুঝতে পারে। এটা তো এই লাইব্রেরিরই নকশা। নকশায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ পাশে বুক সেলফ দু'দিকে সরানো। ভিতরে রাস্তা। মাহা আরো অবলোকন করে গুলশানে বাসার লাইব্রেরিটা ঠিক এমনই ছিলো। এতদিন মাহার মাথায় আসেনি বিষয়টা। মাহা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দক্ষিণ পাশের বুক সেলফের সামনে দাঁড়ায়। কি করে খুলবে এটা? প্রায় শ'খানেক বই এই সেলফে। একটা করে বই সরিয়েও কোনো কুল কিনারা পাচ্ছেনা মাহা। অপারগ হয়ে ধাক্কালো খানিক সময়। না, কোনো ক্রমেই খুলছেনা। মাহার জানতেই হবে এর পিছনে আরো কি কি রহস্য লোকানো আছে!
.
.
.
চলবে...........................