অলকানন্দা - অন্তিম পর্ব ৫৫ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!১৩০!!

মৃ'ত মানুষেরেরা কখনো ফিরে আসেনা। এই জগতে মৃ'ত মানুষের ফিরে আসার কোনো নিয়ম নেই। সার্থকও আর ফিরে আসেনি। তার লা'শও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাহা যখন সার্থক কে আঘাত করেছিলো তখন এক পৈশাচিক শক্তিতে ভর করেছিলো তাকে। আ'ঘাতটা এতই তীব্র ছিলো যে মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিলো। র'ক্তে ভেসে গিয়েছিলো মেঝে। 
_____________

নাহার, খাজা থেকে জবানবন্দি নেওয়া হয়। তারা জানায় মাহার এসব কর্মকাণ্ডে কোনো হাত নেই। এদিক থেকে রক্ষা পায় মাহা। কেস থেকে অবশ্য সম্পূর্ণ রেহায় পায়নি। তবে সার্থক কে হ'ত্যা করার কেসটা তখনও চলছে। রেজওয়ান নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে মাহাকে রক্ষা করার জন্য। মাহা! সে এক পাথর মানবী। কোনো অশ্রু তার চোখ দিয়ে বের হয়না। কোনো শব্দ তার কন্ঠে নেই। চুপচাপ, নির্বাক। এশা, রুমানা প্রায়শই আসতো জেলে মাহার সাথে দেখা করতে। সাবিনাও এসেছেন অনেকবার। এশাকে বহুদিন বাদে চোখের সামনে দেখে ফন্দি আঁটেন তিনি। অনেক হয়েছে। এখন যদি এই অপরাধীকে রেজওয়ান ঘরে তুলে তাহলে তা কোনোক্রমেই তিনি মেনে নিবেন না। যদিও তিনি জানেন মাহা নিজেই কখনো যাবেনা। তবুও সাবধান হতে ক্ষতি কি! এশার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলেন তিনি। বহু কসম, ছল ছুতোয় রেজওয়ানকে বাধ্য করেন এশাকে বিয়ে করতে। মায়ের এই রূপে খুবই কষ্ট পায় রেজওয়ান। এশাও পরিস্থিতির শিকার। জেলখানা, কোর্ট সব জায়গায় টানা হেঁচড়া কালে জন্ম নেয় মাহা আর সার্থকের সন্তান। আহা! একেই বলে ভাগ্য! যে মাহাকে চারটা বছর ফুলের টোকা দেয়নি সার্থক। যে মাহার সামান্য অসুখে হাসপাতাল তোলপাড় করে ফেলতো সার্থক। আজ সে মাহা নিজের সাথে লড়াই করে, প্রসব বেদনা সয়ে সরকারি হাসপাতালের এককোণে ডাক্তারদের বহু অবহেলার শিকার হয়ে জন্ম দেয় তাদের ভালোবাসার ফসলকে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কান্না করে মাহা। এতদিনের জমানো সকল দুঃখ, কষ্ট বেরিয়ে আসে তার বুক চিড়ে। মাহার কান্নায় ধরণীও কাঁদে সেদিন। মুষলধারে বৃষ্টি নামে আকাশের বুক হতে। এলোমেলো মাহা সহস্র চুম্বন এঁকে দেয় সার্থকের রেখে যাওয়া শেষ চিহ্নের কপালে, গালে। চিৎকার করে বলে, "বাবা, তোমাকে পেতে আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে বিসর্জন দিলাম। সে নেই। আমার অন্তরটা যে ক্ষ'ত বি'ক্ষ'ত হয়ে আছে বাবা।" নিজের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে অদ্ভুত প্রশান্তি মাহা অনুভব করে নিজের অশান্ত বুকে।

বাংলাদেশ। এখানে একটা কেসের শুনানি চলে মাসের পর মাস। কখনো কেটে যায় কয়েকবছরও। মাহা নিজের সন্তানকে নিয়ে গাজীপুর কারাগারে জীবন পাড় করে। রেজওয়ান আসে। অসহায় চোখে চেয়ে থেকে চলে যায়। কারাগারে মাহার পরিচয় হয় অরি চাকমার সাথে। মাহার থেকে বছর পাঁচেকের বড়। মাহা যখন বাচ্চা হাতে জেলে আসে তখন কি করে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াবে, কি করে কোলে নিবে কিছুই বুঝতে পারতো না। ছেলেটাও ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদতো। মাহা ছেলেকে দেখে কাঁদতো। কেউ এগিয়ে না আসলেও অরি এগিয়ে আসে। মাহাকে যত্ন করে। মাহার ছেলেকে যত্ন করে। অরির বাড়ি ছিলো টাঙ্গাইল। ওর যখন বয়স সতেরো তখন বাবা মায়ের সাথে তাঁত বুনতো অরি। অরির বাবা মা ছিলেন তাঁতি। ছনের ঘর তাদের। একদিন তার মামাতো ভাই মাঝরাত্রে নির্যাতন করতে আসে তাকে। অরি ব'টি হাতে কুপিয়ে হ'ত্যা করে নিজের মামাতো ভাইকে। কেস হয়। জেল হয়। তারপর থেকে অরি এই জেলে। বহুবছর হয়ে গেছে। সাজা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। মাহা ছাড়া পাওয়ার দুদিন আগেই ছাড়া পায় অরি। মাহা খালাস পাওয়ার পিছনে রেজওয়ানের ভূমিকা ছিলো অনেক। মাহার জন্য জেলগেটের বাইরে বসেছিলো অরি। মাহা নিজের ছাড়া পাওয়ার কথা রুমানা, অনিক কে জানায়নি। রেজওয়ান, এশা কেউই মাহাকে আর খুঁজে পেলো না। মাহার সৎমা, ভাই, বোন ওর দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলো তারাও এসে হতাশ হয়। কাউকে না জানিয়ে তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে দূরে পাড়ি জমিয়েছে মাহা। সার্থকের সব সম্পদ সিল করা হয়েছে। সেসবে কোনো আগ্রহও মাহার নেই। 

বছর চারেক পর...

চট্টগ্রামের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। পাহাড়ে ঘেরা চারপাশ। দূরে বয়ে চলেছে নাম না জানা এক নদী। গাছগাছালিতে মুখরিত চারপাশ। কাঠের তৈরি বাড়ি। বাড়ির সামনে উঠোনে তাঁতের কলে শাড়ি তৈরি হচ্ছে। বড় অর্ডার এসেছে। একশ শাড়ি তৈরি করতে হবে। অরি সমান তালে কাজ করে চলেছেন। সময় কম কাজ অনেক বেশি। গেরুয়া রঙের শাড়ি পরুয়া এক নারী। চুলে তার খোঁপা করা। চোখে চশমা। সবার কাজই ঘুরে ঘুরে দেখছেন তিনি। বিশজন মহিলার ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছেন দক্ষ হাতে। এমন সময় পনেরো বছরের এক কিশোরী দৌড়ে আসে। চিৎকার করে বলে,
"মাহা আম্মা, অর্থ বাবারে কোথাও খুঁজে পাইতাছি না।"

ছেৎ করে উঠে মায়ের মন। কলিজার টুকরার কিছু হলে সে কেমন করে থাকবে! 

'পাইতাছোস না মানে!' অরি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে দাঁড়ায়। মাহা তাকে কাজ করতে বলে নিজেই বেরিয়ে পড়ে রিনি নামের কিশোরীর সাথে। কয়েক জায়গায় ঘুরেও অর্থের খোঁজ পাওয়া যায় না। ছেলেটা এত দুষ্টু হয়েছে! মাকে অশান্তিতে না ফেললে ওর হয়ই না। অলকানন্দা ফুলের বাগান। এক অলকানন্দা গাছের সামনে বল হাতে দাঁড়িয়ে আছে অর্থ। গভীরভাবে কি যেন পর্যবেক্ষণ করছে। মাহা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে। মাকে দেখে হকচকিয়ে যায় অর্থ। সার্থকের মতো চোখ, সার্থকের মতো নাক, মুখ। চুলও ঝাঁকড়া। যেন সার্থকেরই কৈশোর রূপ অর্থ। মাহা পাগলের মতো চুমু দেয় অর্থের চোখে,মুখে। অসহায় কন্ঠে বলে,
"মাকে, টেনশনে ফেলে কি সুখ পান বাবা?"

সামান্য হেসে মায়ের চোখের অশ্রু মুছিয়ে অর্থ বলে,
"মা, দেখ কি সুন্দর অলকানন্দা ফুল। একদম তোমার মতো।"

থমকে যায় মাহা। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অর্থের পানে। অতঃপর অর্থের হাত টেনে ধরে রওনা দেয় বাড়ির দিকে। 

পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি অলকানন্দা ফুলের গাছ। সবুজ পাতায় ঘেরা থোকায় থোকায় হলদে ফুলগুলো বড়ই মোহনীয় দেখতে। সেই সাথে রহস্যময়ও। 
.
.
.
সমাপ্ত.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন