বেহিসেবী বর্ষা অঝোর ধারায় ঝরে প্রকৃতি রুষ্ট করতে এখনো ব্যস্ত। থেমে থেমে চমকাচ্ছে মেঘেদের দল। আঁধার পৃথিবীকে ক্ষনিকের আলোর ঝলকানি দেখিয়ে দিচ্ছে। অশান্ত বাতাস তেড়ে আসতে চাইছে বাড়ির ভেতরে।
স্তব্ধতা ভেঙে, অরু সজোরে চিৎকার করে ওঠে। আর্তনাদ! কেমন ধড়ফড়িয়ে ছুটে এগোল। অগ্রাহ্য করে বসলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা, কাঁচের টুকরো গুলো। নরম তুলতুলে পায়ের তলা কাঁচ ঘেঁষে যেতেই, র'ক্তের ছোপ ছোপ দাগ ভেসে উঠল মেঝেতে। ভড়কে উঠলেন আনোয়ার সাহেব। বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। পরপরই দ্রুত হাতে মেয়েকে বুকে আটকে নিলেন। তন্ময় বেশ দুর্বল। দাঁড়াতে পারছে না। তাকে ধরে আছে মোস্তফা সাহেব, ওহী সাহেব। পেছনে অয়ন, আকাশ ও সাহায্য করছে। সেখানে অরু কিভাবে যাবে? তাই আটকে রেখেছেন। কিন্তু অরু ছটফটিয়ে উঠছে। এখন আর সে চিৎকার করছে না। হাউমাউ শব্দে কাঁদছে। নিজেকে ছাড়াতে চাচ্ছে। দুয়ারে দাঁড়ানো তন্ময়কে ছুঁতে চাওয়ার অসীম প্রচেষ্টায় মগ্ন সে। আনোয়ার সাহেবের বুঝ তাকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে না। তার চোখের সামনে শুধু র'ক্ত! তন্ময়ের বিষণ্ণ মুখশ্রী। দুর্বল শরীর!
রেজাউল সাহেব তখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। ভেজা তন্ময়কে দু'হাতে আগলে ধরেছেন, লম্বাচওড়া সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মোস্তফা সাহেব। ওহী সাহেবের সাহায্যে ছেলেকে ভেতরে নিতে নিয়ে, ব্যাকুল গলায় বিড়বিড়িয়ে আওড়ালেন, 'কি হয়ে গেল এসব আব্বা! এই তন্ময়!'
রেজাউল চটপট জবাব দিল,' এক্সিডেন্ট! কবরস্থানের ওদি..'
অ্যাক্সিডেন্ট শুনেই থমকে যান জবেদা বেগম। খোদার নাম নিয়ে রীতিমতো হেলে পড়েছেন। মুফতি বেগম এবং সুমিতা বেগম না ধরলে, তিনি পরে যেতেন ফ্লোরে।
_____
ইতোমধ্যে শাবিহাও চলে এসেছে। ভাইয়ের এই করুণ হাল, সেও মেনে নিতে পারছে না। দু'চোখ ভিজে উঠেছে। কিছুক্ষণ আগের উত্তেজনা, ভালো লাগা কোথায় যেন উবে গেল। একরাশ ভয়, আতঙ্ক বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে দিল। সোফায় একান্তে বসে ফুপিয়ে কাঁদছে। তন্ময়কে কামরায় নেওয়া হয়েছে। সবাই সেখানে। শাবিহাও গিয়েছিল। দাঁড়ানোর যায়গা নেই বিদায়, বড়দের জায়গা দিয়ে সরে এসেছে। অয়ন ও তার পিছু পিছু এসেছে। চারিপাশে নজর বুলিয়ে পাশে বসেছে। খানিক কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়েছে। শাবিহার কান্নার স্বর মিইয়ে গেল মুহুর্তে। তবে চোখ তুলে তাকাল না। শব্দহীন কান্নায় নিমজ্জিত সে।
অয়ন স্বান্তনার সুরে বলল, 'কাঁদছ কেন? কান্না থামাও। ভাইয়ার কিছু হয়নি। সকালেই দেখবে সুস্থ!'
শাবিহা ভেজা গলায় বিড়বিড় করল, 'কি হয়ে গেল! কেন হলো! এইতো বিকেলেও সুস্থসবল ছিল!'
'তুমি এভাবে কাঁদলে অরুকে সামলাবে কে? মেয়েটা কেমন করছে দেখেছ? প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। এই অবস্থায় এতো হাইপার হওয়া ওর জন্য ভালো না।'
শাবিহা মাথা দোলাল। দু'হাতে চোখমুখ মুছল। উঠে দাঁড়ালো। তাদের অরু তো এখন একা নয়। অরুর ভেতরে আরেকটি অরু আছে। দুজনের খেয়াল রাখতে হবে। অয়ন হাসলো। সেও উঠে দাঁড়ালো। পুনরায় চারপাশে নজর বোলালো। কেউ নেই! মুহুর্তে শাবিহার হাত টেনে বুকে জড়িয়ে নিল। শক্ত করে, দৃঢ় বন্ধনে। শাবিহা চমকে উঠলো। ছাড়াবার জন্য ছটফট করছে, 'আরে..কি করছ!'
অয়ন হেসে সশাবিহাকে বাহু বন্ধন হতে মুক্ত করলো। হাত বাড়িয়ে শাবিহার চোখের জল মুছিয়ে দিল, 'আজকে একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম। তোমার চোখে পানি আমার সহ্য হয়না। বুকে যন্ত্রণা অনুভব করি।'
শাবিহা চোখ আড়াল করলো। মুখমণ্ডল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধালো, 'এখন কি আমি কাঁদতেও পারব না?'
অয়ন হাসলো, 'যাও। অরুকে দেখ।'
শাবিহা আড়চোখে তাকাল। মাথা দুলিয়ে অগ্রসর হলো পূর্ব দিক। সেদিক থেকে অরুর গলা শোনা যাচ্ছে। মেয়েটা কীভাবে কাঁদছে! তার কান্নার তোড়ে বাকিরা চুপসে গেছে। কেউই আর নিজেদের আবেগ দেখাচ্ছে না। বুকে গেঁথে রেখেছে। তাদের শান্ত দেখে হয়তো অরুর কান্নাকাটি থামবে। তার হৃদয় শীতল হবে।
___
প্রকৃতি প্রাণবন্ত, ভেজা-ভেজা। আবহাওয়া ঠান্ডা। নির্জন চারিপাশ। মৃদু বাতাস বইছে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে। বৃষ্টি থেমেছে। আকাশ এখনো মেঘলা। প্রকৃতি আঁধারে।
পর্দা গুলো দাপিয়ে দুলছে। এলোমেলো ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দিচ্ছে অরুর মুখশ্রী। সে জানালা আর বিছানার মধ্যে বসেছে। পর্দাগুলো তাকেই পেয়েছে জ্বালানোর জন্য। বিছানায় মাথা পেতে রেখে, বসেছে সে ফ্লোরে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত জেগে ছিলো। চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে ছিল তন্ময়ের পানে। সহস্র চুমু খেয়েছে মুখমন্ডল জুড়ে। কতটাই না শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছিল মানুষটাকে। ভয়ে সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপেছে। তন্ময় চোখ মেলে তাকিয়েছে। অস্পষ্ট স্বরে জানিয়েছে, সে ঠিকাছে! তখনই একটু শান্ত হয়েছে মেয়েটা! তার আগ পর্যন্ত শুধু কেঁদেছে। আর্তনাদ করেছে। পাগলের ন্যায় ছটফট, ধড়ফড় করেছে।
গলাটা শুকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে এসেছে তন্ময়ের। কয়েক প্রচেষ্টার পর আধো-আধো চোখ মেলে তাকায়। মাথা সহ শরীর বেশ ভাড় হয়ে আছে। বড্ড যন্ত্রণা অনুভব করছে সর্বাঙ্গে। চোখ জোড়া কুঁচকে, কপালে হাত চেপে ধরে। অনুভব করে ব্যান্ডেজের। দৃষ্টি পরিষ্কার করে পাশে তাকায়। তার ব্যান্ডেজ করা বাম হাত, জাপ্টে ধরে ঘুমাচ্ছে অরু। তন্ময়ের চোখের ভাঁজের মাত্রা দ্বিগুণ হয়। এতো কষ্ট করে ঘুমানোর মানে কি? ঘাড়ে ব্যথা পাচ্ছে না? তন্ময় উঠে বসতে চাইল। পারলো না। শরীর বেশ দুর্বল।
দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে জবেদা বেগম। সারারাত তিনি জেগেই কাটালেন। ক্ষনে ক্ষনে এসে দেখছেন ছেলেটা উঠেছে কিনা! কিছু লাগবে কিনা! তন্ময়কে নড়তে দেখেই এগিয়ে আসলেন। গলার স্বর নামিয়ে শুধালেন, 'কি লাগব আব্বা? উঠে না!'
বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন৷ আঁচলে মুখ মুছলেন। তন্ময় মায়ের হাত টেনে পাশে বসালো। ভাঙা গলায় বলল,'আমি ঠিকাছি মা।'
'কই ঠিক আছস? ভালোভাবে কথাটুকু বলতে পারতেছস না!'
তন্ময় চোখের ইশারায় অরুকে দেখাল, 'ও এভাবে শুয়ে আছে কেন? কিছু বলোনি!'
'তোর বাবা, চাচ্চু আমি সবাই কত করে বললাম! কথা শুনল না। এসময় কতো গুঁছিয়ে চলতে হয়। মেয়েটা কোনো কথাই শোনে না। এখন কি ও একা? কবে...'
ছেলের প্রশ্নবোধক চাহনিতে দৃষ্টি মিলতেই, জবেদা বেগম হুট করে থেমে গেলেন। মনে পড়লো ছেলে তার কিছুই জানে না। জবেদা বেগম এবার প্রগাঢ় দৃষ্টিতে ছেলের মুখশ্রী দেখে নিলেন। বিচিত্র ভঙ্গিতে ঠোঁটের কোণ ঠেসে হাসি ছুটলো তার। তন্ময়ের সন্দেহজনক স্বর, 'কি হয়েছে মা অরুর?'
জবেদা বেগমের হাসির রেখা বড়ো হলো, 'অরুর দায়িত্ব কার এখন? ও না-হয় ছোটো? তুই ও কি ছোটো? দেখেশুনে রাখবি না! কতটুকুই বা বুঝে!
হেলাফেলা চলবে না। সচেতন হ। খেয়াল রাখ। দায়িত্ব নে!'
তন্ময় ঘাবড়াল। গলার স্বর বেশ সচেতন, 'হয়েছে কী?'
'কি হবে? অরু প্রেগন্যান্ট! বাপ হতে যাচ্ছস আর জানস ও না! পোলাপান মানুষ করবি কেম্নে?'
তন্ময় পলক ঝাপটাল। পরপর থমকাল। দৃষ্টি নিথর। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে। অসামান্য বড়ো হয়ে আছে চোখ। বেশ খানিক সময় নিল, 'কী! মানে..'
জবেদা বেগম হেসে ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। বোলালেন। উঠে এক গ্লাস পানি এগিয়ে রাখলেন। যাবার পূর্বে বলে গেলেন, 'খাবার নিয়ে আসি। খাবি! তোর বাপ কিচ্ছুটি মুখে নেয়নি। এখন যদি তোর দেখাদেখি একটু খায়।'
তন্ময় তখনো থমকে বসে। মায়ের কথা বুঝতে বেশ সময় লাগলো তার। দৃঢ় দৃষ্টি ফেললো অরুর নরম ঘুমন্ত মুখশ্রীর পানে। মাদক চাহনিতে খুব করে দেখে নিল। হাত বাড়ালো। আঙুলের সাহায্যে গাল ছুঁয়ে দিল। নিস্তব্ধ কক্ষে আওড়াল, 'সত্যি?' চোখ বুজল। লম্বা শ্বাস নিল। দমবন্ধ হয়ে আসছে। সুখে কী? এক অদ্ভুত উত্তেজনায় সর্বাঙ্গ শিরশির করছে। ভাগ্যের উপর চরম বিরক্ত সে। এই মুহুর্তে তাকে অ্যাক্সিডেন্ট করতে হলো? এইযে অরুকে পাজাকোলে তুলতে পারছে না। আদরে দিশাহারা করতে পারছে না! অসম্ভব ভাবে চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে। বাবা হবার খুশিতে?
__
উইকেন্ডস ছাড়া মাহিন খুব পরিপাটি মানুষ। ঠিকঠাক সময় মতো খেয়ে নেয়। রুটিন মাফিক ঘুমোয়। ন'টায় অফিস থাকে! আটটায় বাড়ি ফিরে। উইকেন্ডের বিষয় আলাদা। সেদিন আড্ডা দেয় বন্ধুদের সঙ্গে। ঘুমোতে দেরি আর উঠতেও। সেই সময়নুমাফিক চলা ছেলেটা আজ কোথায় হারিয়ে গেল? অফিস থেকে ফিরে কথা বলা শুরু করেছে, এখনো করছে। ভোর হতে চলেছে। মারজি ঘুমঘুম গলায় কিছু একটা বলছে। মাহিন শুনছে। হাতে কফির মগ। এই নিয়ে তিনটা কফি শেষ করলো। কত ঘন্টা ধরে কথা বলছে? চার-পাঁচ ঘন্টা তো হবেই। না এবার থামতে হবে। টিনএজেরদের মতো করলে চলবে নাকি? মেয়েটাকে তো ঘুমোতে হবে! কাল আবার নাকি তার ক্লাস আছে! মারজির বকবকানি মাঝপথে থামিয়ে মাহিন বলল, 'ক্লাস আছে না? ঘুমোতে যাও!'
'তুমি কি ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলছ? বিরক্ত হচ্ছ?'
মাহিন নিঃশব্দে হাসলো। জবাব দিবে পূর্বেই ইনকামিং কল আসার, নোটিফিকেশন দেখা গেল। এসময় ইব্রাহিমের কল? মাহিন তাগাদা দিল, 'শুয়ে পড়ো। গুড নাইট।'
মারজি অভিমান করতে চাইল। হলোনা। ঘুমে চোখ বুজে গিয়েছে। মুহুর্তে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাল। কান থেকে সেলফোন ও সরানো হলো না।
'কি হয়েছে?' মাহিনের সচেতন গলার স্বর।
ইব্রাহিম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। কোনো বাজে সংবাদ শুনবে, বুঝে নিয়েছে মাহিন। হলো ও তাই। ইব্রাহিম জানালো, 'তন্ময় অ্যাক্সিডেন্টে করেছে!'
'হোয়াট? আর ইউ কিডিং?'
'খবর পেলাম মাত্র। আকাশ বললো। অবস্থা তেমন খারাপ না। ঠিক আছে।'
'কেম্নে কী!'
'জানি না। যাবি?'
'হ। কল দে শুহানি ওদের। জানা! গেলে মিলেমিশে যাই৷'
'কল দিতেছি দুপুরের দিক।'
'উম!'
___
ঘরের বাতি বন্ধ। পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে। কামরা মৃদু আঁধারে তলিয়ে। তন্ময় ভাঙা পা আর দুর্বল শরীরে উঠে দাঁড়িয়েছে। অরুকে জাপ্টে ধরে তুলেছে। পুরো শরীর ব্যথায় নিল হয়ে গেল! কাঁ'টা ক্ষত গুলো এখনো কাঁচা। টান লেগেছে অরুকে তুলতে গিয়ে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সে দেয়াল ধরে ঘনঘন শ্বাস নিল। তারপর ধীরে বিছানায় উঠে বসলো। অরুর পাশে শুয়ে পড়লো। শরীরে কাঁথা মেলে নিল। অনিমেষ ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলো। কেঁদেকেটে মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। লাল হয়ে আছে মুখমণ্ডল। চোখের জলের দাগ এখনো দৃশ্যমান। তন্ময় ঘনিষ্ঠ হলো। অরুকে বুকে নিল আলগোছে। মুখের কাছে মুখ এগিয়ে নিল। দু'চোখের পাতায় চুমু বসালো। গলা নামিয়ে ডাকল, 'অরু!'
জবাব এলো না। তন্ময় হাত নিচে নামাল। অরুর পেটে ছুঁয়ে দিল। খুব করে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে এখানটায়! কান পেতে বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে! তার ছোট্ট অরু মা হবে। তার অনাগত সন্তানের মা। ভাবতেই শরীর লোমকূপ দাঁড়িয়ে উঠছে। তন্ময় মুখ ডোবাল ঘন রেশমি চুলে। গোঙাল, 'ধন্যবাদ জান। আই লাভ ইউ।'
.
.
.
চলবে..............................