“হেই মিস! উইল ইউ বি মাই মিসেস?”
এতক্ষণ বিষণ্ণ মনে বসে থাকা সাঁঝ হুট করেই নিজের মেসেঞ্জারে আসা মেসেজ রিকুয়েস্ট দেখে ক্ষিপ্ত হলো। এরকম মেসেজ প্রায়শই আসে। সাঁঝ সবসময় ঠান্ডা মাথায় এড়িয়ে চলে এগুলো। তবে এখন ওর মন ও মেজাজ, কোনোটাই ভালো নেই।
তীব্র ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে টাইপ করল,“কবুল কবুল কবুল। আসেন। ভার্চুয়ালে সংসার পাতি।”
মেসেজটা সেন্ড করার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে সিন হলো। যেন লোকটা সাঁঝের ইনবক্সেই ছিল। অন্যদিকে হেরফের করেনি। এতক্ষণে সাঁঝ অ্যাকাউন্টের নামের দিকে লক্ষ্য করল। যেখানে ইংরেজি অক্ষরে লেখা আছে ‘Anay Ahmed’। প্রোফাইলে হৃৎপিণ্ডের সুন্দর একটা ছবি দেওয়া। ছেলেরা সাধারণত প্রোফাইলে নিজের ছবি দিয়ে রাখে। কিন্তু এটাতে অন্য ছবি এবং এরকম উলটা-পালটা মেসেজ দেওয়া দেখে সাঁঝ ধরে নিল, এটা ফেইক অ্যাকাউন্ট।
তখনই, আবারও মেসেজ টিউনের সাউন্ড পেল। একই অ্যাকাউন্ট থেকে পুনরায় মেসেজ এলো,“ওকে! ডান।”
সাঁঝের চোখ কপালে উঠে গেল। ফোন হাতে নিয়ে নিজের বিছানার উপরে বসে এক হাত কপালে রেখে বলল,“আচ্ছা লোক তো এটা! এভাবে কীভাবে কী?”
সাঁঝের বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কে হঠাৎ-ই একটা দুষ্টুমি নেড়ে চেড়ে উঠল। বাঁকা হাসল।
বিশেষ এক কারণবশত উদাস, বিষণ্ণ মন নিয়ে নিজ কামরায় বসে, অশ্রু বিলাস করছিল সাঁঝ। ঠিক তখনই! তখনই ‘অনয়’ নামের এই ফেইক অ্যাকাউন্ট থেকে এমন একটা প্রস্তাব আসে। তাও আবার চেনে না, জানে না, ইন ফ্যাক্ট ফ্রেন্ড লিস্টেও নেই এমন একজনের কাছ থেকে।
তাই ভাবল, “একাকিত্ব খানিকটা ঘুচানো যাক। শুরু যেহেতু করেছে সে, তবে একটুখানি মজা নেওয়া-ই যাক।”
অতঃপর রিপ্লাই দিল,“আচ্ছা জান। এখন থেকে তুমি আমার কচিপু বাবু। কেমন?”
ওপাশে সিন হয়েছে। তবে টাইপিং হচ্ছে না। যেন এক ধ্যানে দেখেই যাচ্ছে। সাঁঝ উচ্চশব্দে হেসে আবারও লিখল,“আচ্ছা বাবু কী করো? বাবু খাইসো রাতে?”
এবারও অপর পাশে থমথমে নিরবতা। কিছুক্ষণ বাদে সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে ফেলল। অপেক্ষা করেও কোনো রিপ্লাই না পেয়ে সাঁঝ, অনয় আহমেদের প্রোফাইলে ঢুকল। অতঃপর যা নেত্র সম্মুখে ভেসে এলো, তা দেখে সাঁঝের চক্ষু চড়ক গাছ। বিস্মিত নজরে টাইমলাইন স্ক্রল করতে লাগল। পুরো ওয়ালটাই শুধু মাত্র স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয় দিয়ে ভরে রাখা। এই মাত্র যে ব্যক্তি এরকম মজা নিতে পারে, তার এরকম জ্ঞানী ভাব মোটেও সাধারণ বিষয় ঠেকল না সাঁঝের কাছে। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ উঁচু করে বলে উঠল,“লাইক সিরিয়াসলি?”
“কীরে সাঁঝ? খেতে আসবি না?”
ভাবনার মাঝে হুট করেই সুমিতা বেগমের ডাক পেতেই হাত থেকে ফোন পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু তার আগেই সামলে নিয়েছে। হালকা করে চেপে রাখা তপ্ত শ্বাস ফেলে সুমিতা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,“আসছি আম্মু।”
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসবি।”—বলেই লাগানো দরজার ওপাশ থেকেই চলে গেল সুমিতা বেগম। সাঁঝ আবারও নিজের ফোনের দিকে তাকাল। বা পাশে, নিচে কয়েকটা ডট লাফাচ্ছে। টাইপিং হচ্ছে আর কি!
বিছানার উপর আয়েশী ভঙ্গিতে বসে পড়ল। দুই হাত দিয়ে ফোনটা একদম মুখমন্ডলের নিকটবর্তী করে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে এই টাইপিং-এর দিকে চেয়ে রইল। অপেক্ষা করছে তো করছেই, রিপ্লাই আসছে না।
হুট করেই টুট টুট আওয়াজ করে পুরো স্ক্রিন কালো হয়ে গেল। ফোনটা বিছানার উপর ফেলে এক হাতে কপাল চাপড়ে বলল,“শালার এখনই এই চার্জ শেষ হওয়ার কথা ছিল!”
জলদি চার্জে লাগাল ফোন। তখনই দরজায় কড়া নাড়ানোর আওয়াজ পেয়ে সেদিকে ছুটল। দরজা খুলতেই ওপাশের ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে সাঁঝ ভয়ে এক লাফ দিয়ে পিছু ছুটে নিজ বিছানার উপর উঠে চিল্লাতে লাগল।
___________________
“কীরে! কাহিনী কতদূর এগোল হৃদ সাহেব?”
আকাশের পিঞ্চ মারা কথা শুনে হৃদ কড়া চোখে তাকাল তার দিকে। হৃদের এমন চাহনি, আকাশ একটা মেকি হাসি দ্বারা উপেক্ষা করল।
খোলা অন্তরীক্ষের নিচে গোল হয়ে বসে আছে হৃদ, আকাশ, পুষ্পিতা, সিয়াম, রিয়াদ ও ঊর্মি। বিশেষ ছ'জন বন্ধু আজ বহু বছর পর এক হলো। অতঃপর শুরু হয়ে গেল সেই দুষ্টুমি। একদম কলেজ লাইফের মতোই। যদিও হৃদ, আকাশ ও পুষ্পিতা একই কর্মসংস্থানে আছে। তবুও! ছ'জন আলাদা আলাদা ভাবে এই বন্ধুত্বের প্রাণ। একজন ছাড়া এই সার্কেল একেবারে ফিকে।
ঊর্মি হুট করেই হৃদের হাত থেকে ফোন নিয়ে নিল। হৃদ ব্যতীত বাকি চার জোড়া উৎসুখ দৃষ্টি ঊর্মিকে দেখে যাচ্ছে। ঊর্মি ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে চারিপাশে নজর বুলিয়ে বলল, “যাহ বাবা! মেসেজ ডেলিভার্ড হয়নি। এ তো হৃদের অত্যাচারে রীতিমত অফলাইন চলে গেছে।”
কথাটা শেষ করতেই সবাই ঠোঁট চেপে হাসা শুরু করল। হৃদ রাগী চোখে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,“তোদের মতো টক্সিক ফ্রেন্ড আর কারো না হোক।”
সবার মিটিমিটি হাসায় শব্দ যোগ হলো। উচ্চস্বরে হেসে যাচ্ছে। হৃদ দু'পাশে মাথা নেড়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল।
খানিকক্ষণ বাদে হাসি থামানোর প্রচেষ্টা করে সিয়াম বলল, “একটা মাস মাম্মা! পারবি তো?”
পুষ্পিতা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,“পারবে না মানে? আলবাত পারবে। পারতেই হবে। নাহলে ওর নামও হৃদ না।”
আকাশ বলল,“এমনিতেও ওকে হৃদ নামে ক'জন চেনে? সবাই তো ডক্টর অনয় আহমেদ দ্যা কার্ডিওলজিস্ট নামেই চেনে।”
সিয়াম রিয়াদকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কী বুদ্ধি তোর! আমাদের ফ্রেন্ডজাতির গর্ব তুই।”
কথাটা শেষ হতেই সবাই পুনরায় হাসা শুরু করল। গম্ভীর ও থমথমে মুখে বসে রইল শুধু হৃদ। কেননা অনিচ্ছাকৃত ভাবে তাকে এমন এক কাজ করতে হবে, যা হৃদের ব্যক্তিত্বের বিপরীতে যায়।
কিয়ৎক্ষণ পূর্বে—
বন্ধুমহল একসাথে হলেই কলেজ লাইফের সেসব কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটে। সেরকমটাই হচ্ছিল। সেই গান,সেই আড্ডা। সেই খুঁনসুটি, দুষ্টুমির মাঝেই যাচ্ছিল এই রাত। আড্ডার মাঝে হুট করেই সিয়াম বলে উঠে,“গেম খেলবি তোরা?”
বিপরীতে কোনো প্রশ্ন না করে এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল সবাই। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ট্রুথ এন্ড ডেয়ার গেমের।
হৃদকে উদ্দেশ্য করে সিয়াম বলল,“যা! বোতল নিয়া আয়।”
ছয়বন্ধুর মিলনসভা হৃদের বাসায় করা হয়েছে। আপাতত হৃদের বাসার ছাদটা তাদের আড্ডাস্থল হয়ে আছে। বন্ধুত্ব বিলাস, সাথে চন্দ্রবিলাস। ব্যাপারটা ভারী মজার!
হৃদ যেতেই সিয়াম সবার উদ্দেশ্যে বলল,“শালারে সেই যুগ থেইকা সিঙ্গেল দেখতাছি। কলিজা ফাইটা যাইতাছে। কিছু কর তোরা।”
সবাই এই ভাবনায় লেগে গেল। ছয় জনের তিন জন বিয়ে করেছে। সিয়াম আর রিয়াদের গার্লফ্রেন্ড আছে খুব শীঘ্রই তারা বিয়ে করবে। কিন্তু হৃদ! সে শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত সিঙ্গেল। গালে হাত দিয়ে ভেবে যাচ্ছে পুষ্পিতা ও আকাশ। হুট করেই পুষ্পিতার জিনিয়াস মস্তিষ্কে একটা কথা চলে এলো।
পুষ্পিতা উৎসাহিত কণ্ঠে ঊর্মিকে প্রশ্ন করল, “ঐ ঊরু! তোর আর রাতুল ভাইয়ার প্রেম কীভাবে যেন হয়েছিল?”
সবাই পুষ্পিতার করা এমন প্রশ্নে চোখ বড় বড় করে ঊর্মির দিকে তাকাল। যদিও সবাই উত্তরটা জানে।
তবুও ঊর্মি লাজুক হেসে বলল,“জানিসই তো! কলেজে থাকতে, প্রেম হয়েছিল আমাদের। ফেসবুকে আলাপ হয়। ওর পার্সোনালিটির উপর ফিদা হয়ে যাই। বাকিটা আমি সামলে নিই। আসলে, ক্রাশ খেয়েছিলাম তো। এরপর বিয়ে।”
পুষ্পিতা অধর কোণে বিশাল এক হাসির রেখা টেনে বাকিদের দিকে তাকাল। আকাশ ভ্রু কুঁচকে পুষ্পিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী করতে চাইছিস তুই?”
তখনই রিয়াদ চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,“পাইসি মাম্মা! পাইসি। ওরে পুষ্প! এমন আইডিয়া দেওয়ার জন্য তোরে চুম্মা খাইতে ইচ্ছা করতা....”
রিয়াদ আর কিছু বলতে পারল না। আকাশের রাগী চাহনি তাকে থামিয়ে দিল। থমথমে কন্ঠে বলল,“উলটা পালটা কথা বলবি না। ভুলে যাস না। অনেক সাধনার বউ এটা আমার।”
একথা শুনে রিয়াদ, সিয়াম ও ঊর্মি একত্রে বলে উঠল, “ওহো! কী প্রেম!”
পুষ্পিতা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। দীর্ঘ দশ বছর। দশটি বছর আকাশ পুষ্পিতার পিছু পিছু ঘুরেছে। এন্ড ফাইনালি দুই বছর আগে তাকে নিজের ঘরের ঘরণী রূপে পেয়েছে।
তখন সেখানে হৃদের প্রবেশ ঘটল। গেম শুরু হলো। খেলতে খেলতে এক পর্যায়ে বোতলের মুখ হৃদের দিকে যায়। সবাই উৎসুক নেত্রে হৃদের পানে চেয়ে আছে। কী নেবে হৃদ!
সবার এমন চাহনিকে তাচ্ছিল্য করে হৃদ ডেয়ার নিল। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুমহল শয়তানি হাসিতে মেতে উঠল।
আগে থেকেই সবাই প্ল্যান করে নিয়েছে, এমন এক ডেয়ার দেবে, যাতে প্রেম হয়। কিন্তু কী দেবে, এটা ভাবেনি। তাই সবাই মিলে ভাবনায় পড়ে গেল। ভাবনার মাঝেই রিয়াদ, হৃদের উদ্দেশ্যে ডেয়ার ছুঁড়ল,“তোর ফেসবুক অ্যাকাউন্টের, পিপল ইউ মে নো-তে প্রথম যেই মেয়েকে পাবি, তার সাথে একমাস ফ্লার্ট করতে হবে। হাই লেভেলের ফ্লার্ট। এন্ড দ্যা মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট থিং ইজ, ঐ মেয়েকে পটাতে হবে।”
এমন আধ্যাত্মিক ডেয়ার শুনে সবাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। একবার রিয়াদ, তো অন্যবার হৃদ; দু'জনের দিকেই পালাক্রমে চেয়ে যাচ্ছে। বলা যায়, ডেয়ারটি সকলেরই মনের মতোই হয়েছে।
সবার বিস্মিত নয়নকে সপ্তম আকাশে পৌঁছে দেবার জন্য হৃদ বলে উঠল,'ওকে! আ'ল ডু দিস।'
.
.
.
চলবে…...............................