হাওয়াই মিঠাই |
বাসার সবার সামনে দাড়িয়ে বানিয়ে বলার মতাে কোনাে কথা মীরা খুঁজে পায়নি সেদিন। কারণ তার উপস্থিত বুদ্ধি ছিল শূণ্যের কোঠায়। সত্যি কথা বলার মতাে সাহসও তার ছিল না। ভয়ে হাত পা কাঁপাকাঁপি তাে ছিলােই সাথে গলা, বুক, পেট সব ব্যাথা করতে লাগলাে। সবাই একের পর এক প্রশ্ন করছিল, এর মধ্যে মীরা হঠাৎ করেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলাে। পিয়াল দৌড়ে এসে কোলে তুলে নিল। এরপর মীরার ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। সবার মধ্যেই একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হলাে। তারাও পেছন পেছন এলাে। মীরার চোখেমুখে পানির ছিটা দিতেই সে চোখ খুললাে। পিয়াল তার বাবা সরফরাজ হােসাইনকে বলল,
"বাবা মীরা অনেক ভয় পেয়েছে। সবাইকে একসাথে এই অবস্থায়... ব্যাপারটা আমি হ্যান্ডেল করি প্লিজ? ও কোনাে অঘটন ঘটানাের মেয়ে না, এটা তাে আমরা সবাই জানি। ও সত্যি বলবে। প্লিজ বাবা।"
সরফরাজ হােসাইন কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন মীরার দিকে। চাচা নজরুল হােসাইন ধমকে উঠলেন,
"তাের এত পাকনামি করতে হবে না। তুই যা এখান থেকে। আমরা দেখছি কীভাবে কথা বের করতে হয়।"
ঠিক তখনই সরফরাজ হােসাইন বললেন,
"নজু চলাে। জাহানারা, মুমু, ইরা, লতু সবাই চলাে এখান থেকে। পিয়াল কথা বলুক।"
সরফরাজ হােসাইন বেরিয়ে যেতেই সবাই তার পিছু পিছু বের হয়ে গেল মীরার ঘর থেকে। সবাই যে খুশিমনে বের হয়ে গেল ব্যাপারটা তেমন নয়। তার মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই বলে বেরিয়ে গেল।
সবাই বের হতেই পিয়াল দরজা আটকে দিল। তারপর মীরার পাশে বসে পানি ঢেলে খাওয়ালাে। মীরা পানি শেষ করতেই পিয়াল বলল,
"কীরে ভ্যাঁমনি! প্রেমট্রেম করছিস নাকি?"
মীরা আবার কাঁদতে শুরু করলাে। পিয়াল বলল,
"আমাকে সত্যি কথা বললে তােকে বাঁচিয়ে দেব। তা নাহলে নিশ্চয়ই জানিস বাঁচার জন্য মিথ্যা গল্প বানানাের মত ঘিলু তাের মাথায় নাই?"
মীরা কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
"ভাইয়া আমাকে বাঁচাও। আমি পিকনিকে যাইনি ঠিক আছে কিন্তু সত্যিই জ্যামে আটকা পড়েছিলাম। এইজন্যই দেরি হয়েছে।"
"তাতাে বুঝলাম কিন্তু গিয়েছিলি কোথায়? কার সাথে? যদি অন্যকোনাে বিষয় হতাে তাহলে তুই ঠিকই সবার সামনে বলতে পারতি, যত ভয়ই পাস না কেন। এটা প্রেমঘটিত ব্যাপার বলেই পারছিস না। আমাকে সত্যি না বললে তুই কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারবি না।"
মীরা ঢােক গিলল। বলার প্রস্তুতি নিয়েও আবার সাহস পাচ্ছে না। পিয়াল বলল,
"বলছিস না কেন? তুই কি চাস বাসার সবার কাছে ছেড়ে দেই তােকে?"
"না না ভাইয়া প্লিজ।"
"তাহলে আমাকে বল। কথা দিচ্ছি বাসায় বলবাে না, বাঁচিয়ে দেব।"
মীরার কান্নাটা একটু কমে এলাে। ভয়ে ভয়ে বলল,
"আমি একজনের সাথে সাভার গিয়েছিলাম।"
বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল পিয়াল। কিছুই বলতে পারল না। মীরা বলল,
"অনেক তাড়াতাড়ি রওনা হয়েছিলাম কিন্তু জ্যামের জন্য দেরি হয়ে গেছে।"
বিস্ময় কাটিয়ে উঠে পিয়াল জানতে চাইলাে,
"ছেলেটার নাম কি?"
"রাফি।"
"কোথায় পেয়েছিস?"
"রং নাম্বারে।"
"শিট! বলেছিলাম বাবাকে এই গাধাকে ফোন কিনে দিও না।"
মীরার কান্না আবার বেড়ে গেল। পিয়াল বলল,
"কয়দিন ধরে চিনিস এই ছেলেকে?"
"তিন মাস।"
"মানে তিন মাসের পরিচয়ে তুই একটা অচেনা ছেলের সাথে সাভার চলে গেলি?"
মীরা কাঁদতেই লাগলাে।
পিয়াল এবার মেজাজ দেখিয়ে বলল,
"ভ্যাঁ ভ্যাঁ বন্ধ কর! নাহলে মেরে মুখ ভেঙে দেব। কোন আকাম ঘটিয়ে এসেছিস সেটা বল। সাভার কেন গিয়েছিলি?"
ভয়েই মীরার কান্না বন্ধ হয়ে গেল। কারণ আবার যদি সবার সামনে নেয়া হয়, সে তাহলে সেখানেই মারা যাবে। কোনােমতে বলল,
"ঘুরতে!"
পিয়াল এবার আরাে রেগে গেল,
"সাভার একটা ঘােরার জায়গা হলাে?"
মীরা চুপ। পিয়াল আবার জিজ্ঞেস করল,
"পােলার নাম্বার দে।"
"ভাইয়া মাফ করে দাও। ওর কোনাে দোষ নেই। আমিই সাভার যেতে চেয়েছিলাম। আমার তাে তেমন একটা ঘােরা হয় না। সবসময় বাসাতেই থাকি।"
"সাভার কোথায় গিয়েছিলি?"
মীরা রাফির মুখে একবার শুনেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অনেক সুন্দর জায়গা। তাই সেখানকার কথাই বলল। যদি সত্যিটা বলে তাহলে সম্ভাবত পিয়াল ওকে এখানেই মেরে ফেলবে।
জাহাঙ্গীরনগরের কথা শুনে পিয়াল একটু নরম হলাে। তারপর বলল,
"কয়বার দেখা হয়েছে তােদের?"
"চারবার।"
"এর আগে তিনবার কোথায় দেখা হয়েছে?"
"স্কুলের ওখানে।"
"কোন সাহসে এতদূর গেলি ওর সাথে? যদি তােকে নিয়ে বেচে দিতাে?"
মীরা অবাক হয়ে বলল,
"তুমিও এ কথা বলছাে!"
"মানে?"
"এই একই প্রশ্ন রাফিও আমাকে করেছে। আজ।"
পিয়াল একথা শুনে কী ভাবলাে কে জানে। বলল,
"রাফির বয়স কেমন?"
"২২।"
"ফ্যামিলি সম্পর্কে কিছু জানিস নাকি হুদাই প্রেম?"
"জানি ওর বাবা ব্যাংকে চাকির করে। ওর মা টার্কিশ। ওরা ব্যাংক টাউনে থাকে। ওরা ৩ ভাইবােন। আজকে ওর ছােট ভাই আর ছােট বােনের সাথেও দেখা হয়েছিল।"
"কীভাবে?"
মীরা এবার কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। পিয়াল বলল,
"ওরাও জাহাঙ্গীরনগর এসেছিল নাকি?"
মীরা উত্তর পেয়ে গেল। বলল,
"হ্যাঁ।"
"মা টার্কিশ! পােলা কি সুন্দর দেখতে?"
"হ্যাঁ।"
"সুন্দর ছেলে দেখে একদম পটে মিষ্টিকুমড়া হয়ে গেলি?"
"না। আমরা তাে কেউ কাউকে দেখিনি প্রথমে।"
"বাপরে! না দেখেই প্রেম?"
মীরা ভয়ে ভয়ে বলল,
"হ্যাঁ।"
"রাফির নাম্বার দে। চালাকি করে কোনাে বন্ধ নাম্বার দিবি না। যে নাম্বারে ওর সাথে কথা বলা যাবে সেই নাম্বার দিবি।"
মীরা দু'হাত জোড় করে বলল,
"ভাইয়া মাফ করে দাও। আমি আর কখনাে ওর সাথে কোথাও যাব না। ওকে কিছু বলাে না।"
"কেন শালা কাপুরুষ নাকি? গার্লফ্রেন্ডের ভাইয়ের সাথে কথা বলতে না পারলে প্রেম করেছে কেন? আমার বােন প্রেম করছে, কেমন ছেলের সাথে করছে আমার জানা লাগবে না? তুই যেমন ছাগল ওইটাও তেমন ছাগল হলে তাে রিশতা ক্যানসেল।
"না না। রাফি এমন না। আচ্ছা দিচ্ছি।"
মীরা নাম্বার বলল। পিয়াল নিজের ফোনে নাম্বারটা সেভ করে বলল,
"এখন তাে তাের ফোন নাই কথা হয় কীভাবে?"
মীরা একটু বানিয়ে বলল,
"স্কুলে গেলে বান্ধবীদের ফোন থেকে কল দেই।"
পিয়াল ভ্রু কুঁচকে বলল,
"আচ্ছা ঠিকাছে, শােন। প্রেম করা খারাপ না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আজকালকার পােলাপান ভাল না। প্রেম করবে কিন্তু বিয়ে করবে না। আরাে অনেক টাইপের ভেজাল আছে। তুই ছােট মানুষ, এইসব বুঝবি না। প্রেম করছিস কর, সমস্যা নাই। তবে লিমিটের মধ্যে থাকতে হবে। কোনাে ডেটে ফেটে যাওয়া চলবে না। আমি এরপর থেকে তাের পেছনে লােক লাগাব। কোথায় যাচ্ছিস কি করছিস সব খবর কিন্তু আমার কানে আসবে সুতরাং সাবধান। এখন যেভাবে চলছে চলুক। পরীক্ষার পরেই ফোন পেয়ে যাবি। প্রেম টা যেন ফোনেই সীমাবদ্ধ থাকে। দেখা করলে রাস্তায় দেখা করবি, কোথাও যাওয়া চলবে না। কোনাে রেস্টুরেন্টেও না। রাস্তায় দেখা করলে কেউ দেখে ফেলবে? ফেলুক। বাসায় বলে দেবে? বলুক। আমি সামলাবাে সব। কথা মাথায় থাকে যেন। নাহলে একদম জানে মেরে ফেলব। তােকে না ওই ছেলেকে।"
"আচ্ছা।"
"এভাবে প্রেম করলে তাের কোনাে ক্ষতি হওয়ার আর চান্স নেই। হ্যাঁ, ছ্যাঁকা খাওয়ার চান্স থাকে, তাতে সমস্যা নাই। তাের মত ছাগল একটা দুইটা ছ্যাঁকা খেলে বরং একটু মানুষ হবে।"
মীরা বােকার মত বলল,
"আচ্ছা।"
পিয়ালের হাসি পেয়ে গেল। সে তৎক্ষনাৎ তা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলল। তারপর কাগজে একটা নাম্বার লিখে দিয়ে বলল,
"শােন ছাগল, বাসায় বলব তুই স্কুল পিকনিকে না গিয়ে বান্ধবীরা মিলে ঘুরতে গিয়েছিলি। তুই তাে ছাগল তাই ফ্রেন্ডরা তােকে পটিয়ে নিয়ে গেছে। কোথায় গিয়েছিলি? জাহাঙ্গীরনগর গিয়েছিলি। এই বয়সে চালু মেয়েরা এইসব এডভেঞ্চার করে। তুই ছাগল এইজন্য এইসব খবরও তাের কাছে নেই। পারছিস একটা প্রেম করতে! যাই হােক, যাদের সাথে গিয়েছিলি তাদের কারাে সাথে যদি বাসার কেউ কথা বলতে চায় তখন এই নাম্বারটা দিবি। এটা আমার এক বান্ধবীর নাম্বার। ও তাের বান্ধবী হয়ে কথা বলবে। ওকে আমি সব বুঝিয়ে দিচ্ছি এখনই।"
"আচ্ছা ভাইয়া।"
মীরা বাসায় আসার পর এই প্রথম হাসলাে। পিয়াল মুখ ভেংচে বলল,
"নীরা তাে বান্দরের হাড্ডি ছিল৷ তাও তাে তাের বয়সে প্রেম করার সাহস পায়নি। কোত্থেকে এত সাহস পেয়েছিস?"
মীরা ভাবলেশহীন মুখে বলল,
"জানি না।"
পিয়াল বলল,
"গাধা কোথাকার।"
এ কথা বলে পিয়াল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
পর্ব ১৪ | পর্ব ১৬ |