হাওয়াই মিঠাই |
কথায় আছে যতদিন শ্বাস ততদিন আশ। ইদানীং তাহিয়ার মনে হয় মীরার অবস্থাটা বুঝি এখন এমনই। মীরার সাথে পরিচয় হবার পর থেকেই সে অবাক হয়ে ভাবতো তার মীরা আপু এমন অদ্ভুত কেন? এত সাহসী এত বেপরোয়া মেয়ে সচারাচর দেখা যায় না। এখন অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে আছে। মীরা ব্যাংক টাউনে বাসা খুঁজতে গিয়ে রাফিকেই খোঁজে বেশি। তার দৃঢ় বিশ্বাস রাফিকে সে পাবেই। এই বিশ্বাস নিয়েই চলছে ৯ বছর ধরে। মাঝেমধ্যে তার মনে হয় মীরার কাছে ৯ বছর কোনো ব্যাপার না। মীরা হয়তো আজীবন খুঁজবে এই মানুষটাকে। কারো মনের মধ্যে এমন জায়গা সৃষ্টি করা মুখের কথা নয়, যা রাফি করতে পেরেছে। করতে পেরে আবার হারিয়ে গেল কেন, সেই উত্তর খুঁজতে গেলে প্রতিবার খেই হারিয়ে ফেলে তাহিয়া।
মীরার চাকরি হয়ে গেছে। রিসেন্টলি যেখানে ইন্টারভিউ দিয়েছে সেখানে না হলেও আগে ইন্টারভিউ দেয়া এক জায়গা থেকে কনফার্ম করেছে। অফিস মিরপুর ২ নাম্বার। একটু দূরে হলেও মীরা চাকরিটা নিয়ে নিল। নিজে একটা বাসা নিয়ে থাকার জন্য চাকরিটা তার খুবই দরকার। পরে সুযোগমতো চেঞ্জ করা যাবে।
মীরা ও তাহিয়া দু'তিনদিন ধরেই ব্যাংক টাউনে বাসা খুঁজছে। সবদিক মিলিয়ে পাচ্ছে না। আজ ব্যাংক টাউনে ঢুকেই তাহিয়া বলল,
"আপু কোল্ড ড্রিংক খাব।"
মীরা একটা বড় কনফেকশনারি দোকান থেকে কোল্ড ড্রিংক কিনতে গিয়ে লক্ষ্য করলো দোকানের ক্যাশে এক বয়স্ক লোক বসে আছে। ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে মীরা বলল,
"আসসালামু ওয়ালাইকুম চাচা।"
ভদ্রলোক সালামের জবাব দিয়ে একটু বিস্মিত চোখে তাকালেন। বললেন,
"জি মা বলেন।"
মীরা হেসে বলল,
"চাচা আমরা এলাকায় নতুন এসেছি। বাসা খুঁজছি। দু'বোন থাকব শুধু। কোনদিকে বাসা নিলে ভালো হবে?"
ভদ্রলোক হেসে বললেন,
"বেশি ভিতরের দিকে যাবেন না মা। ছয়/সাত নাম্বার রোড পর্যন্ত যেতে পারেন। এরপর যাওয়া ঠিক হবে না। ওদিকটা বেশি নিরিবিলি।"
মীরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে জিজ্ঞেস করল,
"আচ্ছা আচ্ছা, আপনি এই এলাকায় কতদিন?"
"আছি ৭/৮ বছর হবে।"
"আচ্ছা চাচা এই এলাকায় কোনো বিদেশী থাকে?"
ভদ্রলোক বললেন,
"না। কেন বলেন তো?"
"তেমন কিছু না চাচা। আচ্ছা আজ আসি। এলাকায় আসলে আবার আসব।"
"আচ্ছা।"
মীরা দোকান থেকে বের হতেই তার হাত থেকে কোল্ড ড্রিংকের বোতলটা নিল তাহিয়া। বোতলের মুখ খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো,
"তোমার মনে হয় এভাবে লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেই রাফি ভাইয়াকে পাবে?"
মীরা পার্সটা সাইড ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল,
"আমি এই একটা উপায়ই বাদ রেখেছিলাম তাহিয়া। চাচাকে দেখে হঠাৎ মনে হলো এই উপায়টা ট্রাই করা উচিৎ। এত ছোট একটা এলাকা। দেখ চার/পাঁচ নাম্বার রোডের পর আর তেমন বিশেষ কোনো দোকানপাটও নেই। সুতরাং কিছু লাগলে এইটুকুর মধ্যেই কিনতে আসে সবাই। কেউ না কেউ তো চিনবেই।তাছাড়া পুরো এলাকায় একটা মাত্র বাজার৷ অথচ সেখানে খুঁজিনি। কতবড় বোকামি করেছি! চল এখন বাজারে যাব।"
তাহিয়া আর কথা বাড়ালো না। মীরার সাথে হাঁটা ধরলো। ব্যাংক টাউনে ঢুকলে হাতের বামের এক নাম্বার রোডে একটা প্রাইমারি স্কুল আর ডানের এক নাম্বার রোডে বাজার। বাজারে ঢুকে তারা দেখলো মাত্র দুটো মুরগির দোকান। চার পাঁচটা মাছের দোকান। হাতে গোনা দু'তিনটা সবজির দোকান। দু'তিনটা মুদি দোকান। এত ছোট বাজার দেখে প্রথমে মীরার খুব আনন্দ হলো। জনে জনে ধরে জিজ্ঞাসা করা যাবে। প্রথমে মুরগির দোকানে গেল। দোকানদার বলল,
"আপা মুরগি দিতাম কয়ডা?"
মীরা হেসে বলল,
"ভাই আমরা এলাকায় নতুন। বাসা খুঁজছি। ভাবলাম বাজারটা দেখে যাই। এসে নেই, মুরগি অবশ্যই নেব। আমার ছোটবোনের আবার মুরগি খুব পছন্দ।"
দোকানদার একগাল হাসতেই মীরা ফট করে জিজ্ঞেস করল,
"ভাই এলাকায় রাফি বলে কাউকে চেনেন?"
লোকটা মাথা চুলকে বলল,
"রাফি তো কয়েকটা আছে কার কথা কন?"
"লম্বা ফরসা।"
"একজন ছাড়া সবাই তো লম্বা ফরসা।"
"অনেকটা বিদেশিদের মত দেখতে।"
"না তো আপা এমন কাউরে তো চিনি না।"
"আপনি এখানে কতদিন?"
"হইব ৫/৬ বছর।"
মীরা একে একে বাজারের সব দোকানকদারদের জিজ্ঞেস করলো। কেউই বিদেশীদের মত দেখতে কোনো রাফিকে চেনে না। ৯ বছর ধরে আছে এমন কেউইও নেই। বাজার থেকে বের হয়ে মীরা বলল,
"এবার সেলুনগুলোতে খোঁজ নিতে হবে।"
তাহিয়া বলল,
"মীরাপু তুমি কি পাগল হলে?"
"শোন বাজার অন্যকাউকে দিয়েও করাতে পারে রাফি। বা ধর শাশুড়ি আম্মা ফেরিওয়ালা থেকেও বাজার করতে পারে। কিন্তু শালা চুল না কেটে তো আর পারবে না।"
পুরো এলাকায় দুটো সেলুন। দুটোতেই খোঁজ নেয়া হলো। সেখানকার লোকজনও বিদেশীদের মত দেখতে কোনো রাফিকে চেনে না। সেলুন থেকে বের হতেই এবার তাহিয়া বলল,
"আপু ব্যাপারটা এমন নয় তো যে রাফি ভাইয়া এখানে থাকেই না?"
"এমনটা হতে পারে। ধর ও হয়তো অন্যকোথাও চাকরি করে, সেখানেই থাকে। তবে ওর নিজের বাসা যখন এখানে। আসা যাওয়া তো থাকবেই। ওদের বাসাটা খুঁজে বের করতে পারলে ওকে পাওয়া যেত।"
তাহিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
"কীভাবে খুঁজব তাহলে আমরা?"
"আজ এ পর্যন্তই। চল আমরা আপাতত আমাদের জন্য বাসা খুঁজি। আজ অনেক সময় চলে গেছে বাজারে ঢুকে।"
"আচ্ছা। চলো।"
একটা বাসা থেকে বের হয়ে মীরা বলল,
"বাসাগুলো বড় বড়। এত বড় বাসা দিয়ে আমরা দুজন কী করব বল তো?"
"কসম আপু আমিও তাই ভাবছিলাম।"
মীরা হেসে উঠলো। তাহিয়া হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গি করতেই মীরা বলল,
"কী হয়েছে?"
তাহিয়া চোখ নাচিয়ে বলল,
"তোমার বদমাইশ বান্ধবী ত্রিশার ভাইটাও কি বদমাইশ?"
"না।"
"তাহলে তার কাছে রাফি ভাইয়ার খোঁজ নাওনি?"
মীরা মুখে ভেংচি কেটে বলল,
"নেইনি আবার! খোঁজ নিতে যাওয়াতেই তো ত্রিশা জানতে পেরেছিল রাফি নিঁখোজ। রাফি আমার সাথে সাথে সব বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল।"
"ওমা তো ভার্সিটি যেতো না ভাইয়া?"
"নাহ ভার্সিটিতে নাকি আর কখনোই যায়নি।"
"ভার্সিটি থেকে বাসার ঠিকানা ম্যানেজ করা সম্ভব না?"
"সেই চেষ্টা পিয়াল ভাইয়া করেছিল। কিন্তু এভাবে তো আর কোনো ভার্সিটি কোনো স্টুডেন্টের ঠিকানা দেয় না। তপন ভাইয়ারা চেষ্টা করলে দিতো হয়তো যেহেতু তাদের বন্ধু ছিল৷ কিন্তু আমি ত্রিশাকে মারায় তারা সেই চেষ্টা টাই করেনি।"
"ইশ!"
মীরা তার ব্যাগটা তাহিয়ার হাতে দিয়ে চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতে বলল,
"তুই আফসোস করিস না তো। দেখিস কীভাবে খুঁজে বের করে ফেলি। বেঁচে থাকলে তো খুঁজে বের করবই আমি ওকে।"
একটা টু-লেট দেখে মীরা ফোন করল। বাড়িওয়ালা ফোনে ঠিকানা বলল ডান পাশের তিন নাম্বার রোডের ২৩ নাম্বার বাসা। ৩ নাম্বার রোডের সামনেই ছিল তারা। ভেতরদিকে ঢুকে ২৩ নাম্বার বাসা খুঁজতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে তাহিয়া হঠাৎ বলল,
"আচ্ছা আপু এমন কি হতে পারে না যে আংকেল মারা যাওয়ার পরে রাফি ভাইয়ারা টার্কি শিফট করে গেছে? না মানে আন্টি যেহেতু ওখানকার। ওদের জন্য সেখানেই বেশি সুবিধা হওয়ার কথা নয় কি?"
"হতে পারে তবে সম্ভাবনা কম। কারণ আম্মাজানের বাসায় তাদের বিয়েটা মেনে নেয়নি কখনোই। ওইযে ওইবার টার্কি গেল? সেবারই নাকি প্রথম গেছে বিয়ের পর। হঠাৎ কী কারণে গিয়েছিলেন, সেটা রাফি আমাকে বলেছিল তবে এখন আমার ঠিক খেয়াল নেই।"
"ওহ আচ্ছা।"
"উল্টোদিকে রাফির বাবার বিশাল ফ্যামিলি।নিজের বাসা ব্যাংক টাউনে। সব চাচাদেরই নিজস্ব ঘরবাড়ি আছে সাভার ও তার আশেপাশের এলাকায়। তাই ওদের জন্য এখানে থাকাটাই সেফ। তাছাড়া রাফিকে সেদিন বসুন্ধরায় দেখেছি। তার মানে ও এখন দেশেই আছে।"
"বুঝেছি।"
"কিন্তু মরার ২৩ নাম্বার বাসাটা কোথায়? পুরো রাস্তা খুঁজে ফেললাম ২৩ নাম্বার কি উধাও হয়ে গেল নাকি?"
তাহিয়া একটা বাসার সামনের গেটের সিঁড়ির উপর ধাপ করে বসে পড়ে বলল,
"আবার ফোন দাও আপু। আর হাঁটতে পারছি না।"
মীরা আবার ফোন করল। বাড়িওয়ালা ওপাশ থেকে বলল,
"আপনি কোথায় আছেন বলুন তো?"
মীরা আশেপাশে দেখে বলল,
"৩ নাম্বার রোডে ৬ নাম্বার বাসার সামনে আছি।"
"ওহো আপা আপনি ভুল রাস্তায় চলে গেছেন। ১৮ পর্যন্ত ওই রোডে। আপনি ওই রোড থেকে বের হয়ে সোজা মেইন রোডে না গিয়ে একটু ডানে আসবেন এরপর আবার ডানে।"
বাড়িওয়ালার ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী গিয়ে মীরা বাসাটা পেল। বাসা দেখার পর সে বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল,
"আচ্ছা এটা ৩ নাম্বার রোড কীভাবে হয় এটা তো ৪ নাম্বার হওয়ার কথা ছিল তাই না?"
বাড়িওয়ালা বললেন,
"৩ নাম্বার রোডের সাথে মসজিদটা দেখলেন না? ওই মসজিদের নিচতলায় মার্কেট। দোতলায় মসজিদ। জায়গাটা বেশ বড়। ওটার জন্যই ৪ নাম্বার রোড একটু দূরে পড়েছে। কিন্তু পেছনটা একরকমই রয়ে গেছে। এখন এই দুটো রোড যদি ৩ আর ৪ করে তাহলে মেইন রোড থেকে তো ৪ পাবেই না লোকে তাই ৩ নাম্বার রোড দুটো হয়ে গেছে। কারণটা লোকমুখে শোনা। ভুলও হতে পারে। আমি এলাকায় নতুন। দু'বছর আগে বাড়িটা কিনেছি।"
"আচ্ছা আচ্ছা। আজ আসি তাহলে। আপনার ফোন নাম্বার তো নিলাম। বাসাটা নিলে আজ বিকেলের মধ্যেই কনফার্ম করব।"
বাসাটা থেকে বেরিয়ে মীরা তাহিয়াকে বলল,
"আমার মনে হচ্ছে এই রোডেই রাফির বাসা।"
তাহিয়া চমকে গিয়ে বলল,
"কি বলছো! মনে পড়েছে তোমার?"
"শোন এর আগে যতবার খুঁজতে এসেছি আমি তো ৩ নাম্বারে ঢুকে ওই রোডেই গেছি। এরপর আবার বেরিয়ে ৪ নাম্বারে ঢুকেছি। এই রোড তো কখনো চোখেই পড়েনি। এটা পুরোপুরি বাদ পড়েছে। চল শেষ মাথায় গিয়ে দেখি। ওদের বাসাটা নদীর পাড়ে ছিল।"
নদীর পাড়ে গিয়ে কোনো একতলা বাসা পাওয়া গেল না। তবে বড় একটা এপার্টমেন্ট দেখা গেল। মীরা রাস্তার পাশের একটা গাছে হেলান দিয়ে এপার্টমেন্টের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তাহিয়া বলল,
"এটা?"
মীরা চোখের উপর পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল,
"ওদের বাসাটা একতলা ছিল। যদি ধরে নেই বাসাটা এপার্টমেন্টে দিয়ে দিয়েছে তাহলে শুধু ওদের জায়গা নয় সাথে অন্যদের জায়গাও আছে। যাই হোক, সেটা আমাদের হেডেক না। আমাদের এই এপার্টমেন্টের অথরিটির সাথে যোগাযোগ করতে হবে।"
"তো চলো যাই।"
"উহু এভাবে না। আগে এলাকায় এসে নেই। তারপর খোঁজ করব।"
পর্ব ১৭ | পর্ব ১৯ |