হাওয়াই মিঠাই |
মীরার অফিস মাসের মাঝামাঝিতেই শুরু হলো। পরবর্তী মাসের ১ তারিখে সে তাহিয়াকে নিয়ে ব্যাংক টাউনের নতুন বাসায় উঠলো। মীরা যে এপার্টমেন্টকে রাফির বাসা বলে ধারণা করছে তার উল্টোদিকের বাসায় তিনতলার একটা ফ্ল্যাট খালি ছিল। বাসাটা একটু বড় হলেও সেটাই নিল মীরা। যদিও এদিকের বাসা ভাড়া খুবই কম তবু এত বড় বাসা ওদের পড়েই থাকবে। এই বাসার বারান্দা থেকেও নদী দেখা যায়। বাড়িওয়ালা যেন নদী দেখার জন্যই এই বিশাল বারান্দা বানিয়েছে। পুরো বারান্দায় গ্রিল দেয়া, চাইলে ১২ মাস এখানে বিছানা পেতে ঘুমানো যাবে। বারান্দাটা এতই বড় যে বৃষ্টি এলে ছাঁটও লাগবে না। মীরা দুজন বসার মতো এক টুকরো কাঠ কিনে দোকান থেকেই ফুঁটো করে এনেছে। এরপর তাতে মোটা দড়ি বেঁধে বারান্দায় দোলনা টানিয়েছে। সেই দোলনায় বসে থাকতে মীরার ভীষণ ভালো লাগে।
বাসায় ওঠার সপ্তাহখানেক পরেও যখন মীরা ওই এপার্টমেন্টে খোঁজ নিতে গেল না, তখন তাহিয়ার খানিকটা অদ্ভুত লাগলো। যাকে খোঁজার জন্য এত কষ্ট করেছে সে, তার বাসার এতো কাছে এসেও কেন চুপচাপ বসে আছে? নাকি খোঁজ নিয়েছে সে জানে না! নাকি আসলে এটা রাফির বাসাই না?
একদিন বারান্দায় দোলনায় বসে দুই বোন চা খাচ্ছিল। এই এলাকায় আসার পর থেকেই এলাকার বেশকিছু ব্যাপারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে মীরার। তার জন্য সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে এই এলাকায় মুরগি ড্রেসিং এর ব্যবস্থা নাই। ছিলে আনতে হয়। অথচ মুরগির চামড়া তার ভীষণ প্রিয়! ব্যাংক টাউন বাজারের আরেকটা বাজে ব্যাপার হচ্ছে সবকিছুর চড়া দাম। জাহাঙ্গীর নগরে যেটা ৫ টাকা, এখানে সেটা ১৫ টাকা। আরেকটা দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, মীরা ছোটবেলা থেকে সবসময় দেখে এসেছে নতুন ভাড়াটিয়া এলে মা তাদেরকে প্রথমদিনের খাবার রান্না করে দিয়ে আসতো৷ যাতে সব গোছাতে গোছাতে খাওয়ার চিন্তা না করতে হয়। অথচ এই বাসার বাড়িওয়ালা একটা খোঁজ পর্যন্ত নিল না বাসায় কোনো সমস্যা আছে কিনা। একটা কল নষ্ট ছিল সেটাও মীরাকেই গিয়ে জানাতে হলো। প্রথমদিন কিনে খেতে হলো। হোটেলের রান্নাগুলো ছিল অখাদ্য। কোনো একটা ভালো রেস্টুরেন্টও নেই। এসব নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। হঠাৎ করেই মীরা বলল,
"ওইযে কৃষ্ণচুড়া গাছটা দেখছিস? গাছটা তখন ছোট ছিল। রাফির বাসার ছাদে ওই গাছটার কিছু অংশ এসে পড়তো। রাফি একগোছা ফুল ছিঁড়ে আমার কানের পাশে গেঁথে দিয়েছিল। তখন আমি হাসছিলাম, সাথে সাথে ও একটা ছবি তুলে দিয়েছিল। অত সুন্দর ছবি আমার বোধহয় আর একটাও নেই।"
তাহিয়া চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
"ছবিটা নিশ্চয়ই রাফি ভাইয়ার কাছে রয়ে গেছে?"
"হ্যাঁ।"
"তোমার কাছে রাফি ভাইয়ার কোনো ছবি নেই?"
মীরা চা শেষ করে কাপটা নামিয়ে রেখে বলল,
"আছে। বের করিনা, দেখলেই অস্থির লাগে।"
তাহিয়ার খুব ইচ্ছে ছিল রাফি কেমন সেটা দেখার কিন্তু এ কথা শুনে আর দেখতে চাওয়ার সাহস হলো না। কিন্তু তখনই হঠাৎ করেই তার মাথায় অন্য চিন্তা কাজ করতে লাগলো। চিন্তা করতে করতে এক পর্যায়ে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেই বসলো,
"তার মানে তুমি এই জায়গাটার ব্যাপারে শিওর! তাহলে তুমি যাচ্ছোনা কেন ওই বাসায়?"
মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোলনাটা দোলাতে দোলাতে বলল,
"ভয় লাগে।"
তাহিয়া এবার নড়েচড়ে বসলো। পুরোপুরি মীরার দিকে ফিরে বলল,
"কীসের ভয়?"
"যদি গিয়ে দেখি রাফি এখন বিবাহিত?"
"তুমি না সেদিন বললে সতীন নিয়ে..."
মীরা হেসে বলল,
"ধুর বোকা, দুষ্টুমি করেছিলাম। সত্যিই কি আর তা সম্ভব?"
তাহিয়া এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মীরা আবার বলল,
"এইযে এখন একটা আশা নিয়ে বেঁচে আছি, রাফিকে খুঁজে পাবো। আবার তার হাওয়াই মিঠাই হব। তখন তো সেই আশাটা থাকবে না।"
"আপু মাত্র কয়েকদিন খুঁজেই আমার অস্থির লাগতে শুরু করেছে। আর তুমি কীভাবে এত ধৈর্য্য ধরে আছো?"
মীরা উঠে দাঁড়ালো। দুইহাত পেছনে নিয়ে এক হাতে আরেক হাত ধরে পায়চারি করতে করতে বলল,
"আমি ওকে কতটা খুঁজেছি, কতভাবে খুঁজেছি তা হয়তো তুই কল্পনাও করতে পারছিস না। সত্যি বলতে প্রথমদিকে ধৈর্য্য ছিল না। অনেকবারই খোঁজা শুরু করে না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি। কিছুদিন পর স্মৃতিকাতর হয়ে আবার খোঁজা শুরু করেছি৷ এভাবে কতবার খুঁজেছি আর কতবার হাল ছেড়ে দিয়েছি সেই হিসেব আমার নিজের কাছেও নেই। অনেকবার ভেবেছি ওকে আর খুঁজব না। ওকে মাথা থেকে বের করার জন্য কত প্রেম করলাম! ওর শূণ্যস্থানটা পূরণ করতে পারলাম না। অনেকেই আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে, কিন্তু আমি কাউকে ভালোবাসতে পারিনা। অনেক চেষ্টা করেও পারিনা। ওর প্রতি অভিমান সবসময় আমাকে খিঁচিয়ে রাখে। সবার সাথেই খারাপ ব্যবহার করে ফেলি। আমার সব ভালোবাসা নিয়ে পালিয়ে গেল বেঈমানটা।"
তাহিয়া দৌড়ে গিয়ে মীরাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,
"তুমি ভেঙে পড়োনা মীরাপু। তোমাকে শক্ত দেখলে একটা জোর পাই।"
মীরা ঘুরে তাহিয়ার দিকে ফিরলো। তার চিবুক ধরে বলল,
"পাগল মেয়ে আমি তো শক্তই আছি। রাফিকে নিজের করে পাই বা না পাই, কিছু প্রশ্নের উত্তর তো আমার জানতেই হবে। সেইজন্যই তো খুঁজি। তবে কেন জানিনা এতটা কাছে এসে কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়েছি৷ ওকে সামনে পেলে ডেফিনিটলি মেরে বসব। অন্তত নাকের উপর একটা ঘুষি তো মারবোই৷ সিন ক্রিয়েট হয়ে যবে।"
তাহিয়া চোখমুখ শক্ত করে বলল,
"যে তোমার পুরো জীবনটাতেই সিন ক্রিয়েট করে চলে গেল, তার জীবনে দু'একটা সিন ক্রিয়েট হলে কিছু হবে না। চলো এখনই যাব।"
মীরা হেসে বলল,
"কী বলছিস, এখন?"
"হ্যাঁ এখন। আজ শুক্রবার আছে। সবাইকে বাসায় পাওয়া যাবে। বিকেল শেষ, লোকজনের ভাতঘুমও শেষ। এখনই উপযুক্ত সময়।"
মীরা নার্ভাস হয়ে বলল,
"নাহ আরেকদিন যাব।"
"মীরাপু চলো। বড় বোনদেরকেও দেখি আজকাল শাসন করতে হয়। কলিযুগ এসে পড়েছে।"
তাহিয়া হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল মীরাকে। এপার্টমেন্টের দারোয়ানের কাছে গিয়ে মীরা বলল, মালিক সমিতির সভাপতির সাথে দেখা করতে চায়। দারওয়ান ইন্টারকমে তাকে ফোন করতেই সে পরিচয় জানতে চাইলো। পরে মীরা বলল, ফোনে কথা বললেও হবে। দারওয়ান ফোনটা মীরাকে দিতেই ভদ্রলোক বললেন,
"বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি?"
"আসলে আমি এই জমির পুরোনো মালিকের সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলাম। মানে এই জমির উপর শেষ বাসাটা যাদের ছিল।"
"আচ্ছা আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি আপনি রায়হান সাহেবের খোঁজ করছেন। উনি ফ্ল্যাট টু-বিতে থাকেন। দারওয়ানকে বলুন, যোগাযোগ করিয়ে দেবে।"
"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।"
মীরার কিছুতেই রাফির বাবার নাম মনে পড়ছিল না। রাফির পুরো নামে রায়হান নাম টা তো ছিল না! ভদ্রলোককে ফোন করতেই তিনি নিচে নেমে এলেন। মধ্যবয়স্ক এক লোককে দেখে মীরা তাকে চিনতে পারলো না। রায়হান সাহেব বললেন,
"আপনারা আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলেন?"
মীরা বলল,
"না মানে। আসলে আমি রাফিকে খুঁজছিলাম। আমি যতদূর জানি এই এপার্টমেন্টের জমির শেষ বাসাটা রাফিদের ছিল। আপনি কি রাফির ফ্যামিলির কেউ?"
ভদ্রলোক বললেন,
"না না। আমি রাফির ফ্যামিলির কেউ নই। রাফির বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর ওরা বাড়িটা বিক্রি করে দেয়। তখন আমি কিনেছিলাম।"
মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাহিয়া বলল,
"রাফি ভাইয়ার কোনো ঠিকানা দেয়া যাবে? অথবা ফোন নাম্বার?"
ভদ্রলোক বললেন,
"আসলে ওদের সাথে তো যোগাযোগ নেই। তবে যতদূর জানি ওরা এখান থেকে ওদের দাদাবাড়িতে শিফট হয়েছিল।"
মীরা জানতে চাইলো,
"ধামরাইতে?"
"হ্যাঁ।"
মীরা বলল,
"আমার আসলে ওনার সাথে খুব জরুরি দরকার ছিল। ধামরাইতে দাদাবাড়িটা ঠিক কোন এলাকায়?"
"সেটা আমি জানিনা। তবে রাফির ছোট চাচা ধামরাই থানার পুলিশ ছিলেন। এক ঝামেলায় উনি আমাকে সাহায্য করেছিলেন। এখন তো ওনার সাথেও যোগাযোগ নেই। নাহলে তো ওনাকে পেলে রাফিকেও হয়তো পাওয়া যেতো।"
"রাফির চাচার নাম?"
"ওনার নাম রাজন শিকদার।"
"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।"
এ কথা বলে মীরা চলে যাচ্ছিলো। রায়হান সাহেব ডেকে বললেন,
"শুনুন, আপনাদের পরিচয়?"
মীরা হেসে বলল,
"আমরা আপনার সামনের বাসায় থাকি।"
বাসায় গিয়ে মীরা বারান্দার দোলনায় বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর তৌহিদ ফোন করল। জীবনে প্রথমবার মীরা একবারেই তার ফোন ধরল।
"বলো তৌহিদ।"
"এটা কেমন রিলেশনশিপ মীরা? ভালো না বাসলে বলে দাও। আমার এমনিতেও মনে হয় না তোমার আমার প্রতি কোনো ভালোবাসা আছে।"
মীরা স্পষ্ট স্বরে বলল,
"নেই।"
"নেই মানে?"
"সত্যিই নেই। আমার কাউকেই বেশিদিন ভালো লাগেনা৷ আর ভালো তো বাসতেই পারি না।"
"মীরা বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু।"
"আমি এই রিলেশন আর রাখতে চাচ্ছি না। ব্রেকাপ করছি।"
"তুমি ব্রেকাপ বললেই ব্রেকাপ হয়ে গেল? কোনো কারণ ছাড়া ব্রেকাপ হয় নাকি?"
"কেন কারণ ছাড়া ব্রেকাপ শুধু ছেলেরাই করতে পারবে? আর মেয়েরা চেয়ে চেয়ে দেখবে? মেয়েরাও কারণ ছাড়া ব্রেকাপ করতে পারে।"
"মীরা অনেক সহ্য করেছি তোমার পাগলামি। আর করব না কিন্তু।"
"করো না।"
"তোমাকে এত সহজে ছেড়ে দেব না আমি।"
"এরপর আর বারবার ফোন করে আমাকে বিরক্ত করবে না।"
মীরা লাইন কেটে তৌহিদের নাম্বারটা ব্লকলিস্টে ফেলে দিল।
অনেক রাত হয়ে যাওয়ার পরেও যখন মীরা ঘরে যাচ্ছিলো না তখন তাহিয়া এসে বলল,
"আপু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো না। আর কত রাত জাগবে?"
"আমি বড় ক্লান্ত রে তাহিয়া।"
পর্ব ১৮ | পর্ব ২০ |