হাওয়াই মিঠাই |
হঠাৎ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। সকালবেলায় মনে হচ্ছে সন্ধ্যে নেমে এসেছে। অথচ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ঝলমলে রোদ ছিল। বাস ধামরাই পৌরসভার মধ্যে ঢুকে গেছে। এতদূর এসে ফিরে যাওয়াটা বোকামি। তাছাড়া বৃষ্টি না হয়ে মেঘ কেটেও যেতে পারে। ফিরে গেলে পরে তখন আফসোস করতে হবে। বাসে বসে এমনটাই ভাবছিল মীরা। আজও তাহিয়া সাথে আছে।
থানা রোড স্ট্যান্ড নেমে মীরা স্থানীয় লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো, রিক্সা নিলে থানা ১০ মিনিটের পথ। অতঃপর তারা রিক্সায় উঠে থানায় পৌঁছালো। থানার সামনে একটা খোলা জায়গা। সেখানে দেখা গেল একজন মহিলা পুলিশ দুজন কনস্টেবলকে বকছেন। মীরা পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করল,
"ভাই এই থানায় রাজন শিকদার বলে কোনো অফিসার আছেন?"
কনস্টেবল বলল,
"না আপা। এই নামে তো কেউ নাই।"
রাজন শিকদার নামটা শুনে ওই পুলিশ ভদ্রমহিলা এদিকে তাকালেন। তারপর বললেন,
"আপনারা রাজন শিকদারকে খুঁজছেন?"
মীরা এতক্ষণ উল্টোদিকে ফেরা ছিল। ঘুরে তাকিয়ে ভালো করে দেখতেই খেয়াল করলো মহিলা বেশ সুন্দরী এবং শক্ত-সামর্থ্য। বয়স ৩০ এর আশেপাশে হবে। মীরা নেমপ্লেটের দিকে তাকালো, শান্তনা শিকদার। এই শান্তনা শিকদার কি রাজন শিকদারের কেউ? নাকি শুধুই পদবীতে কাকতালীয় মিল? এসব ভাবতে ভাবতে মীরা জবাব দিল,
"জি।"
শান্তনা শিকদার বারান্দায় উঠে এলেন। তারপর বললেন,
"ওকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। নতুন। ভেতরে আসুন।"
মীরা ও তাহিয়া শান্তনা শিকদারের পেছন পেছন ভেতরে ঢুকলো। শান্তনা শিকদার নিজের চেয়ারে বসতে বসতে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বললেন,
"বসুন আপনারা।"
মীরা ও তাহিয়া বসলো। শান্তনা শিকদার জিজ্ঞেস করলেন,
"আমি এসআই শান্তনা শিকদার। আপনাদের পরিচয় কী?"
মীরা বলল,
"আমি মীরা আর ও তাহিয়া। আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথমেটিকস ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী। একটা বিশেষ দরকারে রাজন শিকদারকে খুঁজছি।"
শান্তনা শিকদার মীরার নাম শুনেই ভ্রু কুঁচকে মীরাকে ভালো করে দেখলেন। তারপর বললেন,
"রাজন শিকদারকে কী দরকার?"
মীরা বলল,
"বিষয়টা ব্যক্তিগত। ওনার সাথে দেখা করতে পারলে বা কথা বলতে পারলে ভালো হতো।"
শান্তনা শিকদার বেল বাজিয়ে চা দিতে বললেন। তারপর মীরার দিকে তাকিয়ে বললেন,
"দেখুন রাজন শিকদার এখন এই থানায় নেই। প্রোমোশন পেয়ে ৭/৮ বছর আগেই এখান থেকে চলে যান। বর্তমানে ওনার পোস্টিং ঈশ্বরদীতে। উনি আমার ছোট চাচ্চু। সেজন্যই বলছি দরকারটা আপনি আমাকে বলতে পারেন। আমাদের সম্পর্ক বন্ধুর মত।"
এবার মীরা হেসে বলল,
"তার মানে আপনি রাফির কাজিন?"
"হ্যাঁ।"
"তাহলে তো আরো ভালো হলো। আসলে সরাসরি রাজন শিকদারের সাথে আমার কোনো দরকার নেই। আমি রাফিকে খুঁজছি। খুঁজতে খুঁজতেই একটা খবর পেলাম রাফির চাচ্চু এই থানায় আছেন। তাই এখানে আসা। আপনি কি কাইন্ডলি আমাকে রাফির সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় বলে দেবেন? ঠিকানা বা ফোন নাম্বার কিছু একটা?"
শান্তনা শিকদার হেসে বললেন,
"আমি আপনার নাম শুনে আর হাইট দেখেই গেস করতে পেরেছি যে আপনি রাফিকেই খুঁজছেন।"
মীরা অবাক হয়ে বলল,
"আপনি আমার কথা জানেন?"
চা চলে এলো। শান্তনা শিকদার মীরা ও তাহিয়ার দিকে চা এগিয়ে দিয়ে বলল,
"আপনিও আমাকে চেনেন সম্ভাবত।"
"না আমি আসলে আপনার কথা সেভাবে শুনিনি।"
শান্তনা চায়ে চুমুক দিয়ে হেসে বললেন,
"মীরার কথা শুনেছেন? আপনার আগে রাফির যার সাথে সম্পর্ক ছিল?"
"জি।"
"আমিই সেই মীরা।"
মীরা এবার খানিকটা অপ্রস্তুতবোধ করলো। শান্তনা বললেন,
"আপনার কথা আমি রাহির কাছে শুনেছি।"
মীরার তর সইছে না। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি রাফির ঠিকানা নিয়ে সেখানে চলে যাক। কিন্তু যদি শান্তনা তা না দেয়! এরচেয়ে অনেক সহজ হতো চাচ্চুকে পেলে। মীরা জানতে চাইল,
"রাফি এখন কোথায় থাকে?"
"ঢাকায়। ওর বিজনেস ঢাকায়, তাই সেখানেই থাকে। আগে কয়েক বছর ধামরাই ছিল।"
"কীসের বিজনেস?"
"কম্পিউটার এন্ড এক্সেসরিজের দোকান।"
"দোকানটা কোথায়?"
"মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে।"
"দোকানের এক্সাক্ট ঠিকানাটা দেয়া যাবে আপু?"
"সেটা জানি না। কোন ফ্লোরে সেটা অবশ্য জানতাম, এখন ভুলে গেছি।"
"কোথায় থাকে এখন?"
"বাসা হাতিরপুলে। তবে ঠিকানা জানি না।"
মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই শান্তনা বললেন,
"আসলে আমাদের ব্রেকাপের পর রাফির সাথে আমার আর যোগাযোগ হয়নি। আমি কয়েকবার চেষ্টা করেছি কিন্তু ও আমাকে এতই ঘৃণা করে যে আমার সামনে আসতে চায় না। দাদাবাড়িতে ফ্যামিলি গেট টুগেদারে দেখা হয় তবে ও আমাকে এড়িয়ে চলে। ভদ্রতার খাতিরে কেমন আছি এটাও যেমন জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করে না, ঠিক তেমনি আমি জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয় না। ওর কোনো ফোন নাম্বারও আমার কাছে নেই। ওর সম্পর্কে আমি যতটুকু জানতে পারি তা কাজিনদের মাধ্যমে। আমি বিবাহিত, বাচ্চাও আছে। তাই ওর সম্পর্কে খুব একটা আগ্রহ আমিও দেখাই না।"
"তাহলে আপনাদের দাদাবাড়ির ঠিকানাটা যদি দিতেন খুব উপকৃত হতাম।"
"হ্যাঁ দিচ্ছি। চাইলে রাহির ফোন নাম্বারও দিতে পারি। তবে রাহি রাফির একান্ত বাধ্যগত ভাই, সে কখনোই রাফির খোঁজ আপনাকে দেবে না যতক্ষণ রাফি না চাইবে। দাদাবাড়িতে গেলেও সেখান থেকে অপরিচিত কাউকে ঠিকানা দেবে কিনা বুঝতে পারছি না। আচ্ছা আমি যতদূর শুনেছিলাম আপনাদের অনেক আগে ব্রেকাপ হয়েছিল। এতদিন বাদে হঠাৎ রাফিকে কেন খুঁজছেন?"
মীরা চুপ। ওকে চুপ থাকতে দেখে তাহিয়া এতক্ষণে একটা কথা বলল,
"হঠাৎ নয়, আপু গত ৯ বছর ধরেই রাফি ভাইয়াকে খুঁজছে।"
"ব্রেকাপের পর থেকেই?"
"হ্যাঁ।"
শান্তনা হেসে বললেন,
"রাফি তাহলে ঠিকই বলেছিল।"
মীরা জানতে চাইল,
"কী বলেছিল?"
"আপনাদের সম্পর্ক হওয়ার পর একবার দাদাবাড়িতে রাফির সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ততদিনে আমি রাহির কাছ থেকে আপনাদের সম্পর্কের ব্যাপারে শুনেছি। মানে আপনার নামও মীরা এটুকুই জেনেছিলাম।"
শান্তনা খানিকটা হেসে আবার বলল,
"আসলে ছোটবেলায় আমি খুব দুষ্টু ছিলাম। আপনার নাম মীরা শুনে রাফিকে টিজ করছিলাম। আমাকে ছাড়লো আমার নামটা ছাড়তে পারলো এধরনের কিছু বলছিলাম। ও যথারীতি রেগে তরমুজের মত লাল হয়ে গেল। খুব ঠান্ডাভাবে সে আমাকে কিছু অপমানজনক কথা বলল যার মূলকথা ছিল, নাম এক হলেই মানুষ এক হয় না। তুমি খুব ভাল, ওকে খুব ভালোবাসো। আমার মত ধোঁকাবাজ নও এইসব। এখন দেখছি সত্যিই খুব ভালোবাসো। নাহলে এতবছর ধরে এত অনুভূতি থাকাটা যেমন তেমন ব্যাপার নয়।"
মীরা চুপ। শান্তনা বললেন,
"এই দেখুন কথায় কথায় তুমি বলে ফেলেছি। সরি।"
মীরা হেসে বলল,
"তুমি করেই বলুন না, কোনো সমস্যা নেই।"
শান্তনা একটা কাগজে দাদাবাড়ির ঠিকানা লিখলেন। তারপর সেটা মীরাকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
"এটা রাখো। চেষ্টা করে দেখি অন্য কোনোভাবে সাহায্য করা যায় কিনা।"
এ কথা বলেই তিনি কাউকে ফোন করলেন। ওপাশে ফোন রিসিভ হতেই বললেন,
"শোন, রাফির দোকানটা কয় তলায় রে?"
ওপাশের কথা শোনা গেল না। শান্তনা আবার বললেন,
"আমি যাব না বাপ। আমার যেচে অপমানিত হওয়ার শখ নেই যে ওর সামনে যাব। জাস্ট দোকানটা কয় তলায় সেটা বল। একজন কিছু কম্পিউটার কিনবে। কোত্থেকে কিনবে সাজেশন চাচ্ছে। ভাবলাম জীবনে রাফির এত ক্ষতি করেছি, একটা উপকার নাহয় করি। ফটাফট বলে দে তো।"
ওপাশ থেকে কিছু বলতেই শান্তনা বলল,
"কানের নিচে লাগাব একটা। তুই ফাঁসবি কীভাবে? রাফি কিছুই জানতে পারবে না। যাদেরকে পাঠাব তারা গিয়ে আমার পরিচয় দেবে না। সুতরাং নিশ্চিন্তে দে।"
ওপাশ থেকে আরো কিছু বলা হলো। এবার শান্তনা বললেন,
"তোদের সব ভালোবাসাই তোদের রাফি ভাইয়ার জন্য, তাই না রে? মীরা আপুর জন্য সিকিভাগও নেই!"
ওপাশ থেকে কিছু বলল। সে কথা শুনে শান্তনা আবার বললেন,
"থাক থাক দরদ দেখানো লাগবে না। অনেক বোঝা হয়েছে। এরপর আমার মেয়েকে কোলে নিতে আসলে একেবারে হাত কেটে রেখে দেব।"
ওপাশ থেকে এবার কিছু বলতেই আবার নরম হলো শান্তনা। তারপর জিজ্ঞেস করল,
"দোকানের নাম্বার কত? নাম কী?"
ওপাশ থেকে আবারো কিছু বলতেই শান্তনা বলল,
"আবার আসিস বয়ফ্রেন্ড কেসে ধরা খেয়ে 'মীরা আপু বাঁচাও' বলতে।"
ওপাশ থেকে কিছু বলল। শান্তনা বললেন,
"আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে নিশ্চিত থাক, কেউ কিছু জানবে না।"
ফোন রেখে শান্তনা দাদাবাড়ির ঠিকানার কাগজটা ফেরত নিয়ে লিখলো,
"রূপ'স কম্পিউটার, ফোর্থ ফ্লোর, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা।"
তারপর আবার সেটা মীরার হাতে দিয়ে বলল,
"সরি শপ নাম্বার জানাতে পারলাম না। একটু খুঁজে নিতে হবে। আসলে যাকে ফোন করেছিলাম সে আমাদের এক কাজিন। ও শপ নাম্বার জানেনা। আসলে রাফি প্রচন্ড জেদি এবং একরোখা৷ ও না চাইলে ওর সম্পর্কে জানা কঠিন।"
মীরা কিছু বলার আগেই তাহিয়া বলল,
"আপু, মীরা আপু গত ৯ বছর ধরে ব্যাংক টাউনের গলিতে গলিতে খুঁজেছে। দোকানে দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছে। ধামরাইয়ের একেক এলাকায় গিয়ে গিয়ে খুঁজেছে, একেবারেই আন্দাজে। আপনি তো তাও দোকানের নাম বলেছেন, ফ্লোর নাম্বার বলেছেন। এটাই অনেক। ওইটুকু জায়গায় খোঁজা কোনো ব্যাপার হবে না।"
মীরা বলল,
"অনেক ধন্যবাদ আপু। আপনার কাছে সারাজীবন ঋণী থাকব।"
শান্তনা হেসে বলল,
"আরে ধুর ধুর। কী বলছো! আমি বরং তোমার আর রাফির কোনো উপকার করতে পারলে কিছুটা পাপমোচনের সুযোগ পাব। ছোট ছিলাম, অনেক রকম ফ্যান্টাসি কাজ করতো। না বুঝেই রাফিকে কষ্ট দিয়েছিলাম। মানুষ হিসেবে অনেক ভালো একজন মানুষের ভালোবাসার মান রাখতে পারিনি। যাক গে বাদ দাও। শোনো আমার কাছ থেকে যে ঠিকানা নিয়েছো সেটা কিন্তু গোপন রাখতে হবে।"
মীরা বলল,
"অবশ্যই আপু, গোপন থাকবে। আজ তাহলে আমরা উঠি?"
"তোমরা লাঞ্চটা আমার সাথে করে যাও। খুব খুশি হব।"
মীরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
"আরেকদিন আপু। আমি আজই ঢাকায় যেতে চাচ্ছি।"
"তাহলে আর আটকাবো না, যাও। অনেক শুভ কামনা। আর তাহিয়াকে নিয়ে অবশ্যই একদিন আমার সাথে লাঞ্চ করে যাবে। পাশেই আমার কোয়ার্টার।"
"আচ্ছা।"
শান্তনা মীরা এবং তাহিয়াকে এগিয়ে দিতে বাইরে এলো। মীরার হাত পা সব অসাড় হয়ে আসছে। রাফির ঠিকানা পেয়ে গেছে। এবার তাহলে রাফিকেও পাওয়া যাবে। যাওয়ার আগে হঠাৎ করেই মীরা শান্তনাকে জড়িয়ে ধরলো।
পর্ব ১৯ | পর্ব ২১ |