হাওয়াই মিঠাই |
ঢাকার বাসে উঠে মীরা সিটে হেলান দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করলো। উত্তেজনায় শরীরটা রীতিমতো কাঁপছে। এতদিনের কষ্টের ফল আজ পেলো। রাফির ঠিকানা এখন হাতের মুঠোয়। তবুও একটু ভয় করছে। যদি এই ঠিকানায় গিয়ে রাফিকে না পাওয়া যায়? এতদিন পর্যন্ত তো এটাই হয়েছে৷ বারবার পেয়ে যাবে এমন মুহুর্তেও পায়নি। বাস যখন সাভার পার হয়ে ঢাকার দিকে যাচ্ছে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। এতক্ষণ মীরা একটাও কথা বলেনি। এবার তাহিয়াকে বলল,
"তুই কি ব্যাংকটাউন নেমে বাসায় চলে যাবি?"
তাহিয়া অবাক হয়ে বলল,
"না। কেন?"
"বৃষ্টি হচ্ছে তো। আরো বাড়ে যদি? ছাতাও নেই সাথে। ভিজে যাবি তো।"
তাহিয়া বলল,
"তো তুমি একা ভিজবে নাকি? ভিজতে হলে দুজনে একসাথে ভিজবো।"
এ কথা শুনে মীরা হেসে দিল। তাহিয়া বলল,
"আপু এতক্ষণ একটা কথা বলার জন্য উশখুশ করছি। তোমার মুড অফ ছিল বলে বলিনি।"
মীরা সোজা হয়ে বসলো। বৃষ্টির ছাঁট আসতে শুরু করেছে তাই জানালা লাগাতে লাগাতে বলল,
"মুড অফ না, বল।"
"একটা ভুল হয়ে গেছে। এখন অনেক আফসোস হচ্ছে।"
"কী?"
"শান্তনা আপুর কাছে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছ একটা কথা।"
"কোন কথা?"
"রাফি ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেছে কিনা সেই কথা।"
"ভুলিনি। ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করিনি।"
তাহিয়া অবাক,
"ওমা কেন?"
"বিয়ে হয়ে গেছে শুনে ওকে খুঁজে বের করতে আর আগ্রহ না পাই যদি? অথচ আমার তো আরেকবার ওর মুখোমুখি হতেই হবে। অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকী।"
"বিয়ে নাও তো হতে পারে।"
"সেই আশা নিয়েই খুঁজছি এখন।"
"অবশ্য বিয়ে হলে তো শান্তনা আপু নিজেই বলতো।"
"তুই কীভাবে শিওর হচ্ছিস? আমি কি শান্তনা আপুকে বলেছি আমি রাফিকে কেন খুঁজছি? শুধু বলেছি খুঁজছি। সুতরাং রাফির বিয়ের কথা এখানে আনাটা অপ্রাসঙ্গিক।"
"আরে আপু কী বলছো এসব? আমার টেনশন বাড়িয়ে দিচ্ছ দেখি!"
"বাদ দে। এসব নিয়ে কথা বলাটাই বৃথা।"
"আমি আরেকটা কথাও ভাবছি।"
"কী?"
"তোমার এতগুলো রিলেশনের কথা জেনে যদি রাফি ভাইয়া রাগ করে?"
মীরা এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। তাহিয়া অভিমানী গলায় জানতে চাইল,
"হাসছো কেন?"
"এমনি। আচ্ছা তাহিয়া তুই আরেকটা ব্যাপার ভাবিসনি?"
"কী?"
"রাফিকে খুঁজতে আমি এলাম জাহাঙ্গীরনগর অথচ রাফি ঢাকায়! তাও আমার বাসার এতো কাছে ওর বাসা। হাতিরপুল থেকে নাখালপাড়া আধা ঘন্টার দূরত্বও না।"
"এটা ভাবিনি।"
"এটা ভেবেই সবচেয়ে বেশি অবাক লাগছে আমার। ওর কী একটুও মনে পড়ে না আমার কথা?"
"হয়তো পড়ে।"
"কীভাবে সামলায় ও তখন নিজেকে?"
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না তাহিয়া। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু।
বিকেল প্রায় ৪ টা বাজে। মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। পা দুটো কাঁপছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা পড়ায় কাপড় আধভেজা। তাহিয়া বলল,
"আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে আপু? চলোনা এবার?"
"ভয় লাগে। যদি না পাই?"
তাহিয়া মীরাকে টেনে নিয়ে লিফটে উঠলো। ফোর্থ ফ্লোরে নেমে রুপ'স কম্পিউটার খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেল। কোথাও পেল না। আশা ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরেই বসে পড়লো মীরা। আশেপাশের লোকজন তাকাচ্ছে। একজন এসে বলল,
"উনি কি অসুস্থ?"
তাহিয়া বলল,
"ইটস ওকে। সামান্য মাথা ঘুরে গেছে, ঠিক হয়ে যাবে।"
লোকটা চলে যেতেই তাহিয়া বলল,
"আপু শান্তনা আপুকে একবার ফোন দাও। ফাইজলামির জায়গা পায় না নাকি?"
মীরা হঠাৎ কী মনে করে বললো,
"আচ্ছা এমন কি হতে পারে, শান্তনা আপু যে কাজিনটাকে ফোন করেছিল সে আসলে ঠিকভাবে জানেনা দোকানটা কোন ফ্লোরে?"
"তা হতে পারে।"
মীরা বলল,
"নিচে দেয়া আছে কোন ফ্লোরে কী কী আছে। চল দেখে আসি রূপ'স কম্পিউটার অন্যকোনো ফ্লোরে আছে কিনা।"
আবার গেল নিচতলায়৷ দেখা গেল রূপ'স কম্পিউটার আসলে থার্ড ফ্লোরে। আবার থার্ড ফ্লোরে গিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু। এবার কিছুক্ষণ খুঁজতেই পেয়ে গেল। মীরা দূর থেকেই দেখলো দোকানে রাফি নেই। দোকানে যেহেতু সিসি ক্যামেরা আছে তাই রাফি নেই বলে সে নিজে আর গেল না। তাহিয়াকে পাঠালো খোঁজ নেয়ার জন্য। এদিকে মীরা তাহিয়ার ফোনে কল করলো। তাহিয়া কলটা রিসিভ করে হেডফোন কানে রাখলো যাতে মীরা শুনতে পায় দোকানে কী কী কথা হয়। তাহিয়া দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
"রাফি ভাইয়া দোকানে নেই?"
দোকানের একটা ছেলে বলল,
"না। উনি তো একটু বাইরে গেছে।"
"কোথায় গেছে?"
"তাতো বলতে পারব না আপু।"
"উনি কখন আসবেন সেটা জানেন?"
"না।"
"কখন গেছেন?"
"দুপুরে গেছেন।"
"আচ্ছা ভাইয়ার একটা কার্ড পাওয়া যাবে?"
"জি দিচ্ছি।"
লোকটা কার্ড খুঁজতে খুঁজতে জিজ্ঞেস করলো,
"কী দরকার ওনাকে?"
"আমি একটা ল্যাপটপ কিনব।"
"আচ্ছা কী ধরনের চাচ্ছেন বলেন আমরা দেখাই।"
"না না আমি রাফি ভাইয়ার থেকে নেব। ভাইয়া কখন আসবে জেনে আসব। একটা কার্ড দিন।"
লোকটা একটা কার্ড দিতেই তাহিয়া চলে আসলো। মীরা দূর থেকেই তাহিয়াকে ইশারা দিল ওকে ফলো করতে। হঠাৎ মীরা লিফটে না উঠে নিম্নগামী এস্কেলেটরে উঠে গেল। কারণটা তাহিয়া বুঝতে না পারলেও মীরাকে ফলো করলো। মীরা মার্কেট থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হলো। তাহিয়া রাস্তাটা পার হয়ে একটু দ্রুতপায়ে হেঁটে মীরাকে ধরে ফেলল। কিন্তু কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না। তার আগেই মীরা একটা রিক্সা ঠিক করে উঠে পড়লো। তাহিয়া রিক্সায় উঠতেই মীরা রিক্সাওয়ালাকে বলল,
"মামা সামনের রিক্সাটা ফলো করেন।"
তাহিয়া বলল,
"কেন আপু? ওই রিক্সায় কে? রাফি ভাইয়া?"
মীরা বলল,
"নাহ। আমি তো কলের মাধ্যমে সব শুনছিলামই, আর দূর থেকে দেখছিলাম। তুই যখন দোকানের ওই লোকটার সাথে কথা বলছিলি তখন দোকানের ভেতরে আরেকটা লোক একটা ছেলেকে একটা ব্যাগ দিয়ে বলল, ব্যাগটা রাফি ভাইয়ার বাসায় দিয়ে আসতে। এরপর ব্যাগ হাতে একটাই ছেলে দোকান থেকে বের হলো। আমরা এখন ওই ছেলেটাকেই ফলো করছি।"
"ওহ মাই গড আপু! আমি তো খেয়ালই করিনি।"
"মীরা হেসে বলল,
"এবার আর যাবে কোথায় তোমার রাফি ভাইয়া?"
হেসে ফেলল তাহিয়া।
ছেলেটা হাতিরপুলে যে বাড়িটার সামনে রিক্সা থেকে নামলো, সেই বাড়িটার সামনে নেমে রিক্সা ছেড়ে দিলো মীরা। বৃষ্টি এখন কমে এসেছে তবে যেকোনো মুহুর্তে আবার বাড়তে পারে। ছেলেটা বাড়ির ভেতর গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার বেরিয়ে এলো। ছেলেটা বের হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই মীরা ভেতর ঢুকলো। দারওয়ান এসে জিজ্ঞেস করলো,
"কার বাসায় যাইবেন?"
মীরা ইশারা দিতেই তাহিয়া বলল,
"কিছুক্ষণ আগে ওই ছেলেটা রাফি ভাইয়ার বাসায় গিয়েছিল না?"
"হ্যাঁ।"
"রাফি ভাইয়া বাসায় আছেন?"
"না।"
"রাফি ভাইয়ারা কোন ফ্ল্যাটে থাকে?"
লোকটা খেঁকিয়ে উঠলো এবার,
"আপনারা কারা? কার বাসায় যাইবেন?"
মীরা বলল,
"আমরা কারো বাসায় যাব না।"
এ কথা বলে তাহিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেল মীরা। বাড়িটার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো দুজন। তাহিয়া বলল,
"আপু ওই ছেলেটাকেই তো জিজ্ঞেস করতে পারতে রাফি ভাইয়া কোন ফ্ল্যাটে থাকে সেই ব্যাপারটা।"
"নাহ, রাফিকে বলে দেয় যদি?"
"সেতো দারওয়ানও বলতে পারে।"
"দারওয়ানের সাথে তো রাফির দেখা হবে পরে। তার আগে দেখা হবে আমার সাথে।কারণ আমি এখান থেকে এক পাও নড়ব না রাফি না আসা পর্যন্ত। কিন্তু ওই ছেলেটার সাথে তো রাফির এখনো দেখা হতে পারে।আমি চাইনা রাফি আগেই সাবধান হয়ে যাক।"
"তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু রাফি ভাইয়া কখন না কখন আসে! বৃষ্টি বাড়ছে।"
"আমি ফিরে গিয়ে শান্তি পাব না তাহিয়া। তুই বরং নাখালপাড়া চলে যা। আমার বাসা তো চিনিসই। আমি রাফির সাথে দেখা করে ফিরছি। আজ আর ব্যাংক টাউন ফেরা লাগবে না।"
"পাগল তুমি! তোমাকে একা রেখে আমি যাচ্ছি না।"
তাহিয়া গেল না। দুজনেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। মীরা তাহিয়ার কাছ থেকে রাফির কার্ডটা নিয়ে কিচ্ছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো। রাফির নামটার ওপরে আঙুল ছোঁয়ালো। তারপর তাহিয়ার ফোনটা নিয়ে কার্ডে পাওয়া রাফির ফোন নাম্বারে কল করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কলটা রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই চিরচেনা কন্ঠ,
"হ্যালো।"
মীরার হৃদস্পন্দন থেমে যেতে চাইছে। গত ৯ টা বছর ধরে তৃষ্ণার্ত সে এই কন্ঠটা শোনার জন্য। একটা কথাও বলল না মীরা। রাফি আবার বলল,
"কে বলছেন?"
চোখ ফেটে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল মীরার। রাফি ফোন কেটে দিল। মীরা চোখটা মুছে ফেলতেই তাহিয়া বলল,
"কথা বললে না যে?"
"কথা বলতে ফোন দিইনি। ওর কন্ঠটা শুনলাম একটু। যা বলার সামনাসামনি বলব। অবশ্য আমি কথা বলার আগে আমার হাত কথা বলবে। আমার খুব শখ ওর নাকটা ফাটিয়ে দেয়ার। ফাটাতে না পারলেও এমন জোরে মারব যে আজীবন মনে রাখবে।"
তাহিয়া হাসতে হাসতে বলল,
"আপু তুমি যতবার রাফি ভাইয়ার নাক ফাটানোর কথা বলো, আমার ততবার আকাশ ভাইয়ার নাক ফাটানোর কথা মনে পড়ে যায়। তুমি একটা ঘুষি মারলে আর গলগল করে রক্ত বের হলো তার নাক দিয়ে! উফ কি ভয়াবহ!"
মীরাও হাসলো এবার।
একসময় বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। রাফির কোনো খবর নেই। কিন্তু তার বাসার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মীরা ও তাহিয়া।
পর্ব ২০ | পর্ব ২২ |