হাওয়াই মিঠাই |
মীরা আরো ভাল একটা চাকরি পাওয়ায় আগেরটা ছেড়ে দিল। নতুন অফিস গুলশানে। ব্যাংক টাউন থেকে প্রতিদিন এতদূর যাওয়া-আসা করা কঠিন। তাছাড়া, এখন আর সাভারের প্রতি তার কোনো পিছুটান নেই। বরং ঢাকায় থাকলে এখন সবদিক দিয়েই সুবিধা। তাই ব্যাংক টাউনের বাসা ছেড়ে ঢাকায় নিজের বাসায় গিয়ে উঠলো। মীরা-তাহিয়া দুজনের কেউই হলের সিট ছাড়েনি। তাই তাহিয়ারও হলে ফিরে যেতে কোনো সমস্যা হলো না।
মীরা রাফির সাথে আর দেখা করেনি তবে কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। রাফি সরাসরি এড়িয়ে যায় না আবার কোনো সুযোগও দেয়না। একদিন মীরা সিদ্ধান্ত নিলো আর ফোন করবে না। সে এখন যেমন তাতে তার এগুলো করা মানায় না, আত্মসম্মানে লাগা উচিত। যা করার সরাসরি করতে হবে। তাই আর ফোন করল না। নতুন চাকরিতে জয়েনিং এবং ঢাকায় শিফট হওয়া নিয়ে মীরা কদিন প্রচন্ড ব্যস্ত ছিল। সব সামলে নিয়ে কিছুটা ফ্রি হয়ে এক শুক্রবার বেরিয়ে পড়লো। গন্তব্য মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার।
মীরাকে দোকানের সামনে দেখেই রাফি বেরিয়ে এলো। বরাবরের মতোই দাঁত বের করে বলল,
"আরে তুমি এখানে? কিছু লাগবে?"
মীরা হেসে বলল,
"হ্যাঁ রাফিকে লাগবে।"
রাফি মাথা চুলকে হাসতে হাসতে বলল,
"ভেতরে এসে বোসো।"
মীরা ভেতরে বসলো। রাফি কফি আনাতে চাইলে মীরা বলল,
"এখানকার কফি খাব না। বাইরের কফি খাব। বাইরে চলো আমার সাথে।"
দোকানের সবাই আড়চোখে মীরাকে দেখছে। তার কথা বলার ধরণে সবাই মোটামুটি অবাক। সবার চোখে একই প্রশ্ন, তাদের রাফি ভাইয়ার উপর খবরদারি করছে এই মেয়ে কে? রাফির অবশ্য সেসব দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে অবাক হয়ে বলল,
"এখন?"
"হ্যাঁ।"
"একটা ফোন করে আসতে পারতে তো।"
"কেন তুমি ব্যস্ত নাকি?"
"যদি দোকানে না থাকতাম?"
"আছো তো!"
রাফি হেসে বলল,
"আচ্ছা চলো।"
দোকানের ম্যানেজারকে কিছু কাজ বুঝিয়ে দিয়ে মীরার সাথে বেরিয়ে গেল রাফি। বের হয়ে রাফি জানতে চাইল,
"কোথায় যাচ্ছি আমরা?"
মীরা ঘাড় নাচিয়ে বলল,
"যেখানে নিয়ে যাব।"
রাফি হেসে দিল।
মীরা রাফিকে নিয়ে কাছেই একটা কফিশপে ঢুকলো। এক কোনার টেবিলে গিয়ে বসলো। রাফি মুখোমুখি বসতেই মীরা বলল,
"তোমার সাথে আমার কথা আছে।"
"জানি। আমাকে তো আর শুধু শুধু তুলে আনোনি।"
মীরা বিস্মিত কন্ঠে বলল,
"আমি তুলে এনেছি তোমাকে?"
রাফি হেসে বলল,
"হ্যাঁ গুণ্ডাদের মতো।"
মীরা এবার রেগেমেগে বলল,
"রাফি প্লিজ তুমি এই দাঁত কেলানোটা বন্ধ করবে?"
রাফি মুখ টিপে হেসে বলল,
"চেষ্টা করব।"
মীরার এবার সত্যি রাগ উঠে গেল। রাফি সিরিয়াস হয়ে বলল,
"আচ্ছা সরি। বলো কী বলবে?"
"কোল্ড কফি খাব।"
সত্যি সত্যিই কফি আসার আগ পর্যন্ত মীরা কিছুই বলল না। কফি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করে তারপর বলল,
"রাফি আমার তোমার কাছে কিছু কথা জানার ছিল। যদি তোমার আপত্তি না থাকে।"
"বলো কী জানতে চাও?"
"তোমার জীবনে এখন বিশেষ কেউ কি আছে যার জন্য আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ?"
"আমি তোমাকে কখন এড়ালাম? সেদিন দেখা করতে চাইলে করলাম। জাহাঙ্গীরনগর যেতে চাইলে, গেলাম। আজ আবার বেরিয়ে আসতে বললে, আসলাম।"
"তুমি তো আর সবার মতো করে এড়াও না। খুব সূক্ষ্মভাবে এড়াও।"
রাফি এবার আর হাসলো না। সিরিয়াস হয়েই কথা বলল,
"আমার বিশেষ কেউ নেই মীরা। প্রেম ভালোবাসার মধ্যে থাকতে চাইলে তোমার সাথে সম্পর্ক ভাঙতাম না।"
"তারপর আর কোনো সম্পর্ক হয়নি?"
"না।"
"বিয়ের কথা চলছে যে? কারো সাথে কথা আগায়নি?"
"ওটা মায়ের ডিপার্টমেন্ট। পুরোপুরি ফাইনাল হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি জড়াব না।"
মীরা হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করলো,
"এখনো আমাকে ভালোবাসো?"
রাফি এবার ইতস্ততবোধ করল। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
"মীরা অবান্তর প্রশ্ন করছো। তোমার সাথে ব্রেকাপের কারণ জানার ছিল তোমার। বলেছি সব। এখন আবার এসব কেন?"
"আমার চোখের দিকে তাকাও।"
রাফি সাথে সাথেই তাকালো। তারপর বলল,
"তাকালে কী হবে? এইতো তাকালাম।"
"এবার বলো এখনো আমাকে ভালোবাসো?"
রাফি আবার অন্যদিকে নিচে তাকালো।বলল,
"মীরা তুমি চাইছোটা কী? কেন অবুঝের মত আচরণ করছো?"
"আশেপাশে এত কী দেখছো? আমার চোখের দিকে তাকাতে ভয় পাও?"
রাফি আবার তাকালো। মীরা বলল,
"বলো ভালোবাসো কিনা। ভালো না বাসলে সেটা বলতে সমস্যা কী?"
রাফি এবার মীরার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখমুখ কঠিন করে বলল,
"হ্যাঁ এখনো ভালোবাসি। তো?"
মীরার চোখে খুশির ঝিলিক। মুখ টিপে হেসে বলল,
"গত ৯ বছরে তোমার জীবনে আর কেউ আসেনি তার মানে এই ৯ টা বছর ধরেই তুমি আমাকে ভালোবাসো তাই না?"
"হ্যাঁ তাতে কী হয়েছে? আমি কাকে ভালোবাসবো কতদিন ধরে ভালোবাসবো এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার নয় কি?"
মীরা হেসে বলল,
"অবশ্যই অবশ্যই। আমি জানতাম, তবু তোমার মুখে শুনে নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলাম।"
"কেন?"
"দরকার আছে।"
"দেখো মীরা, আমি এখন কোনো পাগলামি চাই না। যে কারণে ৯ বছর আগে ব্রেকাপ করেছিলাম সেটা এখনো অব্যাহতই আছে। তখন যেটা ধারণা করেছিলাম এখন সেটা বাস্তব।"
রাফিকে খানিকটা রাগিয়ে দিতে পেরে মীরার মনে এক ধরণের পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। সে বলল,
"রাফি আমার আসলে এটাই জানার ছিল তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা। জেনে গেছি, এখন তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনা আর। তুমি দোকানে যাও। আমিও উঠি, কাজ আছে।"
রাফি বিদায় নিয়ে দোকানে চলে গেল আর মীরা ফিরে গেল বাসায়। পিয়াল এখন অষ্ট্রেলিয়া থাকে। তাকে সাথে সাথেই ফোন করে পাওয়া গেল না। পরে সে ফ্রি হয়ে ফোন করতেই মীরা প্রথম কথাটা বলল,
"ভাইয়া বাঁচাও।"
পিয়াল ওদিকে উদ্বীগ্ন গলায় বলল,
"কী হয়েছে তোর?"
"রাফিকে খুঁজে পেয়েছি।"
পিয়াল হেসে বলল,
"আরে সর্বনাশ। কংগ্রাচুলেশনস। কিন্তু বাঁচানোর কথা বলছিস কেন? শালা কি বিয়েসাদী করে ফেলেছে?"
মীরা করুণ গলায় জানালো,
"না।"
"তাহলে কি রিলেশনশিপে আছে?"
"না একেবারে পিওর সিঙ্গেল। এখনো আমাকে ভালোবাসে।"
পিয়াল হেসে বলল,
"বাহ। তাহলে সমস্যা কোথায়? বাবা-মাকে বল।"
মীরা এবার আরো করুণ গলায় বলল,
"একটু ভেজাল আছে ভাইয়া। রাফি এই সম্পর্কটা আর চাচ্ছে না।"
পিয়াল কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
"কী ভেজাল?"
"রাফি ইন্টারের পর আর পড়াশোনা করেনি। তাই সে ভাবছে, সে আমার অযোগ্য।"
পিয়াল অবাক হয়ে বলল,
"কী বলিস! রাফি না কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তো?"
মীরা রাফির বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে পিয়াল বলল,
"দুঃখজনক। আর আমরা বাবা মায়ের ছায়ায় কত আরামে থেকে এসেছি এতটাকাল চিন্তা কর। তবু শুকরিয়া করি না।"
"এখন কী করব ভাইয়া?"
"দেখ মীরা রাফি ছেলে ভাল। ঠিক কথাই বলছে। বাস্তব অনেক কঠিন। এই সম্পর্ক হয় না।"
"কেন ভাইয়া রাফির তো অনেক বড় ব্যবসা। ভালো টাকা আয় করে।"
"আমাদের ফ্যামিলির কি টাকার অভাব রে? যে টাকা দেখে তোকে কারো হাতে তুলে দেবে? আর সেরকম হলে রাফির চেয়ে কত বেশি টাকাওয়ালারা তোর জন্য প্রোপোজাল পাঠায়, কোনো আইডিয়া আছে তোর? বরং রাফি শুধু শিক্ষিত হলে টাকা না থাকলেও চলতো। ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া যেতো"
"ভাইয়া প্লিজ হেল্প মি। পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি বলে তো আর রাফি একেবারে অশিক্ষিত না। আনস্মার্টও না।"
"সেটা তুই এখন বুঝবি না। সংসার করতে গেলে বুঝবি তোর আর ওর জ্ঞানের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তখন আফসোস করে কূল পাবি না।"
"ভাইয়া তুমি তো জানো আমি অন্ধভাবে ভালোবাসি রাফিকে। আমার শুধু ভালো থাকতে রাফিকেই চাই, আর কিছু না। যেসব আফসোসের কথা বলছো সেসব আমার মাথাতেই আসবেনা কখনো।"
"আচ্ছা তাহলে তুই কী চাইছিস? রাফি নিজেই যেখানে রাজি না। আমি কীভাবে সাহায্য করব?"
"বাবা-মাকে তুমি ওর কথা বলবে।"
"আরে রাফিই তো রাজি না। বাবা-মাকে বলে লাভ কী?"
"বাবা-মা রাজি হলে রাফিকে রাজি করানো আমার এক চুটকির কাজ।"
"আমার মনে হয় না বাবা-মা রাজী হবে। রাফির অন্য যেকোনো ল্যাকিংস থাকলে রাজী করানো যেত।"
"ভাইয়া এটা তোমার দায়িত্ব। তুমি কীভাবে করবে জানিনা। তুমি জানোনা রাফিকে হারিয়ে কী অবস্থা হয়েছিল আমার? আবার হারালে বাঁচাতে পারবে না।"
"উল্টোপাল্টা কথা বললে এক থাপ্পড় মেরে তোর দাঁতগুলো সব ফেলে দেব। এরপর দন্তহীন মেয়ে রাফি এমনিতেও বিয়ে করবে না।"
মীরা অভিমানী গলায় বলল,
"যা সত্যি তাই বলেছি।"
পিয়াল ধমকে উঠল,
"চুপ! একদম চুপ। বাবা-মায়ের সাথে কথা বলছি আমি।"
পিয়াল বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে খুব একটা সুবিধা করতে পারল না। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিল, রাফির সাথে বিয়ে না দিলে মীরা যদি অন্যকোথাও বিয়ে করতে না চায়, তো না করুক। কিন্তু কোনো অশিক্ষিত ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া হবে না। আত্মীয়স্বজন যখন জিজ্ঞেস করবে জামাইয়ের পড়াশোনা কতদূর তখন কী বলবে? পিয়াল অনেক বোঝালো কিন্তু কোনো লাভ হলো না।
বাবা-মায়ের সিদ্ধান্ত শুনে মীরা তাদেরকে কিছুই বললো না। পরদিন খোঁজ নিয়ে রাফি বাসায় নেই এমন সময় রাফির বাসায় গেল। দরজা খুলল দিয়া। মীরাকে দেখে বলল,
"আরে আপু আপনি? আসুন আসুন। কেমন আছেন?"
মীরা হেসে বলল,
"ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?"
"আমিও ভাল আছি। বসুন আপু।"
মীরা ড্রয়িং রুমে বসলো। তারপর জিজ্ঞেস করল,
"আন্টি বাসায় আছেন?"
"হ্যাঁ কিন্তু আপনি মায়ের কাছে এসেছেন? আমি তো ভাবলাম রাফি ভাইয়ার কাছে বুঝি।"
মীরা হেসে বলল,
"নাহ আমি আসলে আজ আন্টির কাছেই এসেছি। যদি একটু ডেকে দিতেন, খুব ভালো হতো।"
"জি ডাকছি। আপনি বসুন।"
দিয়া শাশুড়িকে ডেকে দিলো ঠিকই কিন্তু রাফির এক্স এসেছে মায়ের সাথে দেখা করতে, ব্যাপারটা দিয়ার একটু খটকা লাগলো। কারণ রাহির মাধ্যমে মোটামুটি পুরো ঘটনাই সে জানে। তাই সে রাফিকে ফোন করলো। বলল,
"ভাইয়া মীরা আপু বাসায় এসেছে।"
শান্তনার কথা বলছে ভেবে রাফি রাগ হয়ে বলল,
"তো আমি কী করব?"
"ইয়ে মানে, তুমি কি ভাবছো শান্তনা আপুর কথা বলছি? না কিন্তু। ছোট মীরা আপুর কথা বলছি। যাকে সেদিন বাসায় নিয়ে এসেছিলে।"
রাফির এবার টনক নড়লো।
"বলো কী? কখন?"
"এইতো এখন।"
"কিন্তু ওর তো আমার সাথে কথা হয়েছে। আমি বাসায় নেই এটা জানে তাহলে আবার বাসায় কেন গেল?"
"মায়ের সাথে দেখা করতে চায়।"
"সর্বনাশ! মা কোথায়?"
"মা ঘরেই ছিল। মীরা আপু ডেকে দিতে বলল, আমি ডেকে দিয়েছি।"
"শিট। কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে আজকে। আমি আসছি।"
পর্ব ২৪ | পর্ব ২৬ |