হাওয়াই মিঠাই - পর্ব ২৭ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন মৌরি মরিয়ম'এর লেখা একটি অসাধারণ ধারাবাহিক গল্প হাওয়াই মিঠাই'র সপ্তবিংশ পর্ব
হাওয়াই মিঠাই
হাওয়াই মিঠাই

রাফির বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে মীরা কিছুই বলতে বাদ রাখেনি। আর তাই মা এত ক্ষিপ্ত। সে সোফায় বসে পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকালো। মীরা রাফিকে বলল,

"আমি চাই আন্টি আমাদের বাসায় গিয়ে বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাক।"

রাফি বিরক্ত মুখে বলল,

"আমি চাই না। বিয়ে তো ওয়ান সাইডেড জিনিস না।"

মীরা এবার খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,

"তাহলে বলে দাও যে আমাকে ভালোবাসো না। আমি এক্ষুনি চলে যাব। কখনো আর চেহারা দেখাবো না।"

রাফি মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,

"এত নাটকের প্রয়োজন নেই। সব বুঝেশুনেও আমার জন্য মাকে অপমানিত হতে দিতে পারি না।"

সালওয়া বললেন,

"রাফি তুই কাউকে ভালোবাসিস কিনা সেকথা কতবার জিজ্ঞেস করেছি। কখনো বলিসনি কেন?"

রাফি মায়ের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল,

"সামর্থ্যের বাইরে কোনোকিছু চেয়েছি কখনো?"

"তুই তোর বাপকে দেখেও কিছু শিখিসনি? তোর বাপের কি আমাকে চাওয়ার মত সামর্থ্য ছিল? নাকি আমার ভিনদেশী এক অচেনা ছেলের সাথে অমন শান্তির দেশ ছেড়ে এই অশান্তির দেশে চলে আসার মত সামর্থ্য ছিল? তাই বলে কি সে পিছিয়ে গিয়েছিল? নাকি আমি অসুখী হয়েছিলাম?"

"দেখেছি বলেই নিজের ওরকম কিছু করার সাহস নেই। তোমরা সুখে ছিলে, তোমাদের সন্তানরাও সেরা বাবা-মায়ের সাথে সুখেই ছিল। কিন্তু তোমাদের অবর্তমানে তোমাদের ছেলেমেয়েরা না পেয়েছে দাদাবাড়ির সাপোর্ট না পেয়েছে নানাবাড়ির সাপোর্ট।"

এবার সালওয়া চুপ হয়ে গেলেন। রাফির এই যুক্তির উপর কথা বলার মত যুক্তি তার কাছে নেই। মীরাও চুপ হয়ে গেল। নিস্তব্ধ কিছু সময় কেটে যাওয়ার পর রাফি বললো,

"মীরা বাসায় যাও। আর আমার ভুত মাথা থেকে নামাও। চলো পৌঁছে দিয়ে আসি।"

মীরা সালওয়ার দিকে করুণ চোখে তাকালো। সালওয়া রাফির পাশে গিয়ে বসলেন। তারপর তিনি কিছু বলার আগেই রাফি বলল,

"মা আমার মনে হয় আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতে আমাদের সকলের ভালো হবে।"

সালওয়া রাফির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

"বাবা একবার আমি যাই ওবাড়িতে। ফিরিয়ে দিলে দেবে। সমস্যা তো নেই।"

রাফি এবার কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,

"তুমি কি অপমানিত হতে সেখানে যাবে মা? মীরার জায়গায় রূপকে বসাও। আর আমার জায়গায় একটা অচেনা ইন্টার পাশ ছেলে। অনেস্টলি বলো তো, দেবে রূপকে?"

সালওয়া বললেন,

"সেরকম হলে তো পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।"

রাফি দৃঢ় গলায় বলল,

"আমি দেব না। ঠিক একই কারণে মীরাকেও আমি চাই না।"

রাফি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

"মীরা চলো। তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি আবার দোকানে যাব।"

মীরার এখন খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু এখন আর সে কাঁদছে চাইছে না। কি অদ্ভুত! কান্নাটাকে আটকে বলল,

"আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। একা এসেছি একা যেতেও পারব।"

রাফি বলল,

"তোমাকে তো জিজ্ঞেস করিনি একা যেতে পারবে কিনা। চলো আমার সাথে।"

মীরা এবার খুব শক্ত হয়ে জবাব দিল,

"আমি তোমার হুকুম মানতে বাধ্য নই।"

রাফি খানিকক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর বলল,

"ঠিকাছে। তাহলে তুমি এবার আসতে পারো।"

মীরা সালওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

"আসি আন্টি।"

তারপর সালওয়া বা রাফি কেউ কিছু বলার আগেই মীরা বেরিয়ে গেল। বাসায় ফেরার আগেই মীরার চোখে কান্নার জোয়ার বইতে লাগলো। এত বড় অপমান! রাফি কি করে পারলো!
মীরা চলে যাবার পর সালওয়া রাফিকে ধমকে বললেন,

"রাফি এটা কি করলি তুই? কেন মেয়েটাকে এমন অসভ্যের মত বের করে দিলি বাসা থেকে?"

রাফি বলল,

"এটার দরকার ছিল মা। আমার ভুত ওর মাথা থেকে নামাতে হবে।"

"তোকে যে খারাপ ভাবলো এখন?"

"সেটাই চাইছি। আর কোনোভাবে ওকে দূরে রাখা যাবে না।"

"এত ভালোবেসে কীভাবে দূরে থাকবি?"

"আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। দোকানে যেতে হবে, আসছি।"

এ কথা বলে রাফি বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর দিয়া সালওয়ার কাছে এসে বলল,

"মা আমাকে মাফ করে দিন। একটা ভুল হয়ে গেছে আমার দ্বারা।"

সালওয়ার অবাক হয়ে বললেন,

"কী করেছো?"

"রাহিকে দেখেছি সবসময় মীরা আপুর থেকে রাফি ভাইয়াকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে। রাফি ভাইয়া নাকি সেটাই চায়। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি ভাইয়া ওনাকে এখনো এত ভালোবাসে।"

"তো?"

"মীরা আপুর আসার কথাটা আমিই রাফি ভাইয়াকে জানিয়েছিলাম।"

সালওয়া বললনে,

"তাই বলি রাফি এসময় হুট করে বাসায় এলো কেন!"

"সরি মা।"

"শোনো রাফি যদি মানুষ খুন করে এসে বলে সঠিক কাজ করেছি, রাহির কাছে সেটাই সঠিক। সুতরাং রাফি চেয়েছে মীরা দূরে থাকুক তাই রাহি সাহায্য করেছে। এইযে রাফি এখনো ভালোবাসে জেনে তুমি বুঝতে পারছো যে একটা ভুল করে ফেলেছো। অথচ রাহি কিন্তু ঠিকই জানে যে রাফি মীরাকে ভালোবাসে কিন্তু চায় না। আর রাফি চায় না বলেই রাহিও চায় না। আর সেজন্যই সে কথাটা এতদিন পর্যন্ত আমাদের কাছে গোপন রেখেছে। আমাকে পর্যন্ত জানতে দেয়নি কি আশ্চর্য!"

"মা আপনি হয়তো রাহিকে ভুল বুঝছেন। এমন তো হতে পারে, রাহি নিশ্চয়ই জানে না রাফি ভাইয়া এখনো মীরা আপুকে ভালোবাসে।"

"জানে জানে। এই দুই ভাইকে এখনো চিনতে পারোনি।"

দিয়া করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,

"এখন কী করব মা?"

"এখন আর কী করবে? মীরার ফোন নাম্বার ম্যানেজ করো। ও তো আর যোগাযোগ করবে না, আমাদেরকেই ওর সাথে যোগাযোগ করতে হবে। রাফি যে ওকে কষ্ট দেয়ার জন্য খারাপ ব্যবহার করেছে সেটা বোঝাতে হবে। তারপর ও যা চাইছিল তাই করব।"

"রাফি ভাইয়া যদি রাগ করে?"

"রাগ করলে করবে। ওর খাই বলে কি ওর কথায় চলতে হবে নাকি? জন্ম দিয়েছি না? জন্মঋণ শোধ করুক আগে।"

"কিন্তু মা মীরা আপুর নাম্বারটা কীভাবে ম্যানেজ করব?"

"চিন্তা করো। রাহির ফোনে খুঁজে দেখো তো।"

"সেটা বোধহয় নেই মা। রাহির সাথে কখনো মীরা আপুর কথা হয়েছে এমনটা শুনিনি।"

"তবু খুঁজে দেখো।"

"আচ্ছা মা।"

সেদিন রাতে দিয়া রাহির ফোনটা ঘেঁটে দেখলো কাজিন মীরা ছাড়া আর কোনো মীরার নাম্বার তার ফোনে নেই। রাহি প্রতিদিন ঘুমানোর আগে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখে। আজও তাই করছিল। দিয়া হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো,

"আচ্ছা রাহি, রাফি ভাইয়ার একটা গার্লফ্রেন্ড ছিল না?"

রাহি টিভি থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,

"দুইটা ছিল। দুইটাই মীরা৷ বড় মীরা, ছোট মীরা। কি দারুণ কো-ইন্সিডেন্ট!"

এ কথা বলে রাহি হেসে দিল। দিয়া বলল,

"তুমি কি জানো রাফি ভাইয়া মীরা আপুকে এখনো ভালোবাসে?"

"না জানার কি হলো!"

"তার মানে তুমি জানো?"

"হ্যাঁ জানি। তো?"

দিয়া বিকেলের পুরো ঘটনাটা রাহিকে জানালো। সব শুনে রাহি বলল,

"বাদ দাও না। ভাইয়া যখন চায়না তখন বাদ দাও।"

"না চাক। ভালো তো বাসে এখনো।"

"আমিও একইভাবে বলছি, ভালোবাসুক। চায় না তো আর। চাওয়াটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার।"

"দিস ইজ নট ফেয়ার রাহি। যে মানুষটা নিজে পড়াশোনা না করে তোমাকে করালো। তোমাদের সব দায়িত্ব নিলো, সব চাহিদা মেটালো। এখন সে কীসে ভালো থাকবে সেটা তুমি দেখবে না?"

"দিয়া কী বলছো মাথা ঠিক আছে? ভাইয়া এতকিছু করেছে বলেই তো ওর প্রতিটা কথাই আমার কাছে বেদবাক্য। ও যেটা চায় আমিও সেটাই চাই। ওর ভালো অবশ্যই সেটাতেই হবে যেটা ও নিজে চায়। ওর ভালো থাকাটাই মূল কথা। এখন যদি মীরার সাথে ওর বিয়ে হয় আর ফিউচারে মীরা আফসোস করে তাহলে ভাইয়ার অবস্থানটা কেমন হবে বুঝতে পারছো? মাথানিচু রাফি ভাইয়াকে দেখতে ভালো লাগবে তোমার?"

"কিছুই হবে না। আমি যে তোমাকে এত ভালোবাসতাম, তবু তো প্রয়োজন হলে তোমার মায়ের কাছে এসে এভাবে সেই ভালোবাসার কথা বলার সাহস পেতাম না। অথচ মীরা আপু এই কঠিন কাজটা করে ফেলেছে। সে কতটা নার্ভাস ছিল আমি দেখেছি। কতটা ক্রেজি হলে এই কাজ করা যায় একবার তো ভাবো।"

"ভালোবাসায় ক্রেজ ভালো না।"

"ধুর।"

দিয়া উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়লো। রাহি দিয়াকে টেনে কাছে এনে বুকে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু তার মনোযোগ এখনো টিভিতে। মুখে বলল,

"আরে আমার সাথে রাগ দেখাচ্ছো যে? এসব ইস্যু আমাদের মধ্যে আসছে কেন?"

দিয়া রাহির মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,

"একবার ভাবো, আমাদের বিয়ে না হলে কী হতো?"

রাহি দিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

"কী হতো আবার ব্রেকাপ হতো!"

"আমি পাগল হয়ে যেতাম।"

রাহি আবার টিভির দিকে তাকিয়ে বলল,

"কিছুই হতো না, কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। তোমারও বিয়ে হতো, আমারো। তুমিও ভালো থাকতে অন্যকারো সাথে আর আমিও।"

"উফফ!"

দিয়া ফট করে উঠে গেল বিছানা থেকে। রাহির এধরনের কথা সে একেবারেই নিতে পারে না। রাগে গা জ্বলতে থাকে। এখন যদি সে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসে থাকে তবুও রাহি তাকে ডাকতে যাবে না। কারণ কেবলমাত্র ঝগড়া হলেই রাহি রাগ ভাঙাবে। এটা নাকি ঝগড়া না, মানসিকতার অমিল। এবং এটা তাদের মধ্যে প্রায়ই হয়। তাই এসব অমিলের সূত্র ধরে রাগ দেখানো দিয়া বহু আগেই ছেড়েছে। কিন্তু না দেখালেও রাগ তো উঠেই যায়। দিয়া বারান্দায় গিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। রাগ না কমা পর্যন্ত তার পক্ষে রাহির পাশে ঘুমানো একেবারেই অসম্ভব।
সকালবেলা সবাই বেরিয়ে গেলে দিয়া সালওয়ার কাছে এসে বলল,

"মা রাহির মোবাইলে মীরা আপুর নাম্বার নেই।"

সালওয়া চিন্তিত মুখে বললেন,

"রাফিকে দেখেছো কত স্বাভাবিক! অথচ কোন ঝড় যেন বইছে ওর ভেতরে। ছেলেটা এত ইন্ট্রোভার্ট। কিছু বুঝতে দেয় না! মা হয়েও এতদিনে কখনো বুঝিনি ও কাউকে ভালোবাসে!"

"মা আপনি ঠিক বলেছেন। রাহি সবই জানতো। রাফি ভাইয়া চায় না তাই সেও চায় না।"

সালওয়া হেসে বললেন,

"হুম। চিনি তো ওদেরকে। আচ্ছা শোনো, রাফির মোবাইল থেকে মীরার নাম্বারটা নিতে হবে। এছাড়া আর উপায় দেখছি না।"

"কিন্তু মা রাফি ভাইয়ার ফোন ধরার সাহস আমাদের কারো কি আছে? তাছাড়া, প্রাইভেসির ব্যাপারওতো আছে।"

"আমাদের না থাকুক, রূপের তো আছে।"

দিয়া হেসে বলল,

"আপনার কী বুদ্ধি মা!"

রূপ স্কুল থেকে ফিরলেই ওকে কাজটা বুঝিয়ে দেয়া হলো। কারণ এই বাড়িতে একমাত্র রূপই আছে, যার কিনা রাফির ঘরের সবকিছুতে যখন তখন এক্সেস আছে। রাতের খাবারের পর রূপ রাফির ঘরে গিয়ে দেখে দোকানের অসংখ্য কাগজপত্র নিয়ে হিসাবে বসেছে সে। রূপ ডাকলো,

"ভাইয়া..."

"রূপ! আসো আপু।"

রূপ গিয়ে রাফিকে জড়িয়ে ধরে বলল,

"ভাইয়া তোমার ফোনটা লাগবে।"

"কেন?"

"আমার একটা ফ্রেন্ডকে ফোন করব।"

"মার ফোন থেকে করো।"

"এতো রাতে ফোন করার কথা বললে মা আমাকে মারবে।"

রাফি হেসে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে আবার কাজে মন বসালো। কিন্তু সবভাবে মীরা লিখে সার্চ করেও কোনো নাম্বার পাওয়া গেল না। তারপর এক বান্ধবীকে ফোন করে কিছুক্ষণ কথা বলে রূপ চলে গেল।
রূপ রাফির ঘর থেকে বের হয়ে সালওয়ার ঘরে আসতেই দিয়া দরজা বন্ধ করে দিল। সালওয়া বললেন,

"দে নাম্বারটা দে।"

রূপ ঠোঁট উল্টে বলল,

"মীরা বলে কেউ এক্সিস্টই করে না ভাইয়ার মোবাইলে।"

সালওয়া হতাশ গলায় বলল,

"কি বলছিস?"

"সত্যি বলছি মা। আমি বাংলা ইংরেজিতে সবভাবে লিখে দেখেছি। কোনো মীরার নাম্বার নেই।"

দিয়া বলল,

"মা এখন? মীরা আপুর নাম্বারটা কি ভাইয়ার ফোনে সেভ করা নেই?"

"না থাকতে পারে। আবার অন্যকোনো নামেও সেভ করা থাকতে পারে।"

"তাহলে এখন উপায়? কীভাবে পাব মীরা আপুকে?"

রূপ জিজ্ঞেস করলো,

"তোমরা তাকে কেন খুঁজছো?"

সালওয়া এবং দিয়া দুজনে নিজেদের মধ্যে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

পর্ব ২৬পর্ব ২৮

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন