হাওয়াই মিঠাই |
কিছুদিন মীরা খুব কাঁদলো। তারপর স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করতে লাগলো। কারণ তার আশার শেষ প্রদীপও নিভে গেছে। ৯ বছরে রাফি আসলে অনেকটা বদলে গেছে। পরক্ষণেই আবার ভাবলো, নাকি রাফি প্রথম থেকেই এরকম ছিল? সে বুঝতে পারেনি, এটা হয়তো তার ব্যর্থতা। অন্ধভাবে ভালোই বেসে গেছে শুধু। আত্মসম্মান জ্ঞান ভুলে চূড়ান্ত বেহায়া হয়ে রাফিকে পাওয়ার সবরকম চেষ্টাই সে করেছে। অথচ অবশেষে রাফি বুঝিয়ে দিল মীরা রাফির জীবনে মূল্যহীন একটা স্মৃতি মাত্র!
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে রাফির ঘরের সামনে দিয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার সময় সালওয়া দেখলেন রাফি ডায়েরিতে কিছু লিখছে। এই দৃশ্য দেখে তার হঠাৎ মনে পড়লো রাফির ডায়েরি লেখার অভ্যাস আছে। কাছের মানুষদের জন্মদিন, জরুরি ফোন নাম্বার এবং ঠিকানা সবকিছুই রাফি ডায়েরিতে লিখে রাখে। কোনো ডায়েরিতে মীরার নাম্বারটা যদি লেখা থাকে?
রাফি কাজে বেরিয়ে গেলে সালওয়া রাফির ঘরে ঢুকে টেবিলের সামনে গেল। নানা আকারের অসংখ্য ডায়েরি এই টেবিলের ওপর! কোনটাতে কী লিখেছে কীভাবে বুঝবে? সব ঘাঁটবে? মানুষের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র এভাবে ঘাঁটা ঠিক না। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো মীরার ফোন নাম্বার অথবা ঠিকানা কিছু একটা পেতেই হবে। সে দিয়াকে ডেকে নিলো। দুজন মিলে একটা একটা করে ডায়েরি দেখতে লাগলো। বেশিরভাগ ডায়েরিতে সংসারের খরচের হিসাব, বাজারের হিসাব, দোকানের কিছু হিসাব লেখা। তবে কিছু ডায়েরি পাওয়া গেল যেখানে জন্মদিন, ফোন নাম্বার আর ঠিকানা লেখা আছে। দিয়া একটা ডায়েরি ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল,
"মা এখানে সব রিসেন্ট ডায়েরি। মীরা আপুর নাম্বার থাকলেও পুরোনো ডায়েরিতে থাকার কথা। এখানে তো অত পুরোনো একটাও মনে হচ্ছে না।"
সালওয়া বললেন,
"তাই তো দেখছি। ড্রয়ারগুলো দেখো তো।"
দিয়া ড্রয়ার খুললো। সেখানেও কিছু ডায়েরি পাওয়া গেল। একটা ডায়েরি র্যান্ডমলি খুলতেই দিয়া উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
"মা দেখেন এখানে মীরা আপুর কথা লেখা।"
সালওয়া ডায়েরিটা হাতে নিয়ে দেখল সেখানে লেখা,
"মীরা, আমার হাওয়াই মিঠাই... চলো আমরা আবার ৯/১০ বছর পেছনে ফিরে যাই। কথা দিচ্ছি, এবার আর ভালোবাসা শেখাবো না তোমায়। তোমার কাকচক্ষু জলের ওই দিঘিসুলভ চোখেও মরব না আর। তোমার প্রেমে..."
এটুকু পরে সালওয়া থেমে গেলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
"এসব ব্যক্তিগত কথাবার্তা পড়ার দরকার নেই। তুমি শুধু নাম্বার বা ঠিকানা খোঁজো।"
দিয়ার খুব পড়তে ইচ্ছে করছিল। ওই কাঠ কাঠ মানুষটা এত আবেগী কথা লিখলো কী করে? বাকি ডায়েরিতেই বা আর কী কী লেখা আছে? কিন্তু শাশুড়ির মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই। তাই পড়লো না আর। একে একে সব ডায়েরিই খোঁজা শেষ। মীরার ফোন নাম্বার বা ঠিকানার কোনো হদিস কোথাও পাওয়া গেল না।
সালওয়া'র হাতে শেষ ডায়েরিটা, সেটার পৃষ্টা ওল্টাতেই মীরার জন্মদিন কবে সেটা লেখা পেল। এই ডায়েরিটা বেশ পুরোনো। এখানেও কী কিছু লেখা নেই? ভালোভাবে খুঁজলো। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল। একটা ফোন নাম্বারের পাশে লেখা পিয়াল। ব্রাকেটে লেখা মীরার ভাই। সালওয়া সাথে সাথে সেই নাম্বারে ফোন করলো। কিন্তু নাম্বারটা বন্ধ।
সালওয়া এবার শান্তনা শিকদারকে ফোন করে বললেন,
"তোমাকে একটা নাম্বার দিলে, সেই নাম্বারের গ্রাহকের ঠিকানা বের করে দিতে পারবে?"
শান্তনা কোনো প্রশ্ন না করেই বললেন,
"জি চাচী পারব, নাম্বারটা মেসেজ করে দিন।"
সালওয়া নাম্বারটা মেসেজ করে দিল। কিন্তু শান্তনা কল ব্যাক করলো পরদিন। কল করেই বলল,
"সরি চাচী। একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই দেরি হলো।"
"সমস্যা নেই, কাজ হলো?"
"ওই নাম্বারটা রেজিস্ট্রেশন করা নেই চাচী। পুরোনো নাম্বার। তখন তো আর রেজিস্ট্রেশনের বালাই ছিল না। কিন্তু কার নাম্বার এটা?"
"তুমি চিনবে না। ঠিকাছে বাদ দাও।"
"আচ্ছা চাচী। আর কোনো সাহায্য লাগবে?"
"না মা। আর লাগবে না।"
ফোন রেখে দিলেন সালওয়া। অথচ একবার যদি শান্তনাকে বলতেন যে তিনি মীরাকে খুঁজছেন। তাহলে সাথে সাথেই মীরার নাম্বারটা পেয়ে যেতেন।
আরো কিছুদিন পর সালওয়া'র হঠাৎ মনে পড়লো মীরা বলেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথমেটিকসে পড়ে। তৎক্ষনাৎ তিনি দিয়াকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন। ম্যাথমেটিকস ডিপার্টমেন্টে গিয়ে একজন স্টুডেন্টকে জিজ্ঞেস করতেই সে মীরার হলের রুম নাম্বার বলে দিল।
মীরা চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে রেগুলার ক্যাম্পাসে আসে না, থাকেও ঢাকায়। তাই হলে তাকে পাওয়া গেল না। তবে মীরাকে না পেলেও তাহিয়াকে পাওয়া গেল। তাহিয়াকে দেখেই চিনতে পারলো দিয়া, তাহিয়াও দিয়াকে। কথাবার্তা বলার পর সালওয়া বললেন,
"তুমি যখন বাসার ঠিকানা জানো, তাহলে সেটাই দাও। সরাসরি ওর বাসায় গিয়েই কথা বলি। আমি আজই যেতে চাই। এম্নিতেই মাসখানেক কেটে গেছে।"
তাহিয়া বলল,
"আন্টি আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি আপনাদেরকে মীরাপুর বাসায় নিয়ে যাই?"
সালওয়া বললেন,
"তুমি যাবে! তাহলে তো আরো ভালো হয়।"
"ঠিকাছে আন্টি আপনারা ৫ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি জাস্ট জামাটা পাল্টে আসছি।"
"ঠিকাছে আমরা বসছি। তুমি যাও।"
পর্ব ২৭ | অন্তিম পর্ব ২৯ |