হাওয়াই মিঠাই |
সন্ধ্যার পর বৃষ্টি বাড়তে শুরু করেছে। এক পর্যায়ে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। রাত তখন প্রায় ৮ টা বাজে। মীরা এবার তাহিয়াকে বলল,
"তুই বাসায় যা, মাকে ফোন করে দিচ্ছি। আমি ১০ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করব, যদি রাফি এর মধ্যে না আসে তবে আমি চলে যাব।"
তাহিয়া নাছোরবান্দা,
"না আপু তোমাকে একা রেখে আমি যাব না।"
"পাগলের মত কথা বলিস না তো, পুরো ভিজে গিয়েছিস। চেঞ্জ না করলে ঠান্ডা লাগবে।"
"আমি কিছু জানিনা। তোমাকে একা রেখে যাব না। যেতে হয় তুমিও চলো। কাল আবার আসব।"
মীরা বলল,
"কাল আমি আসতে পারব না, আমার অফিস আছে। আবার সুযোগ হবে শুক্রবার-শনিবার।"
"তাহলে এখন আমিও থাকব।"
দুই বোনের তর্কাতর্কির মাঝেই কেউ কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। তারপর বিস্মিত কন্ঠে বলল,
"মীরা!"
মীরা ফিরে তাকাতেই দেখে রাফি দাঁড়িয়ে আছে। ভিজে চুপচুপে। রাফিকে দেখামাত্র মীরা পাথর হয়ে গেল। রাফির যা বর্ণনা শুনেছে তা থেকে তাহিয়া বুঝে নিল ইনিই রাফি। রাফি দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
"তুমি এখানে?"
মীরা থরথর করে কাঁপছে। রাফিকে সামনে পেলেই কীভাবে মারবে, কত কী বলবে ভেবে রেখেছিল সে; অথচ এখন সব গুলিয়ে গেল। রাফি দুহাতে নিজের মুখে জমে থাকা বৃষ্টির পানিগুলো ঝেরে ফেলতে ফেলতে হেসে বলল,
"কত বড় হয়ে গেছ তুমি! আমি তো প্রথমে চিনতেই পারিনি। জাস্ট হাইট দেখে আটকে গেছি যে এটা মীরা হতে পারে।"
মীরা এবার দু পা এগিয়ে রাফির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রাফির চোখে হাসি, ওদিকে মীরার চোখে আগুন। কিন্তু মীরা কী করল? সে হঠাৎ করেই রাফিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো৷ রাফি চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলল, মীরাকে ধরলো না। শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
"মীরা শান্ত হও।"
তারপর সরিয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু মীরা এমনভাবে আঁকড়ে ধরে রইলো যে তা আর সম্ভব হলো না। তাহিয়া দু'চোখ ভরে দেখছে এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। অথচ দেখার কথা ছিল মারামারির দৃশ্য। এতদিন মীরাকে শুধু ছেলেদের মারতেই দেখেছে। এভাবে ভালোবাসা নিয়ে আঁকড়ে ধরতে দেখেনি কখনো। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে মীরার এই কান্নাটাও এখন দেখতে ভালো লাগছে তাহিয়ার। রাফি এবার হেসে বলল,
"মীরা পাগল হলে নাকি? শোনো আমার কথা শোনো, রাস্তার লোকজন কী ভাবছে বলো তো? শান্ত হও প্লিজ। সাথে কে তোমার?"
মীরা এবার ছাড়লো রাফিকে। কোনোরকমে কান্নাটা সামলে বলল,
"ও আমার ছোট বোন, তাহিয়া।"
"বোনকে নিয়ে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজবে নাকি! আমার বাসা এখানেই, বাসায় চলো।"
মীরা রাফির দিকে তাকালো। রাফি হেসে বলল,
"চলো।"
তারপর তাহিয়ার দিকে তাকিয়ে রাফি বলল,
"এসো তাহিয়া।"
রাফি মীরার হাত ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। পেছনে তাহিয়া। দারওয়ান রাফিকে সালাম দিতেই তাহিয়া আগ্নিচক্ষু নিয়ে তাকালো তার দিকে। ভাবটা এমন, 'বিকেলবেলা এত ভাব নিলি যে! এখন দেখ কীভাবে ভেতরে যাচ্ছি।'
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় রাফি জিজ্ঞেস করলো,
"তোমরা এখানে কী করছিলে? কোনো দরকারে এসেছিলে?"
মীরা এখনো চুপ। কোনো কথা বলছে না। তাহিয়া বলল,
"আপনাকে খুঁজতে এসেছিলাম।"
রাফি বিস্মিত কন্ঠে বলল,
"আমাকে খুঁজতে?"
তাহিয়া বলল,
"জি।"
"তারমানে তোমরা জেনেই এসেছ যে এটা আমার বাসা?"
"জি ভাইয়া।"
"তাহলে বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজছিলে কেন? ভেতরে গিয়ে বসতে পারতে তো!"
তাহিয়া এবার আর কথা বলল না। ততক্ষণে দোতলায় রাফির ফ্ল্যাটের সামনে চলে এসেছে। বেল বাজাতেই একটি মেয়ে দরজা খুলে দিল। মেয়েটার বয়স ২৪/২৫ হবে। কিছু কম বা বেশিও হতে পারে। রাফির সাথে মীরা ও তাহিয়াকে দেখে মেয়েটি কিছুটা উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল,
"তোমার ফোনের কী হয়েছে? মা তোমাকে ফোনে না পেয়ে দোকানে ফোন করেছে। সেখানেও না পেয়ে চিন্তা করছিল খুব। আমাকে বারবার ফোন করছিল।"
রাফি ভেতরে ঢুকে বলল,
"ফোনটা বোধহয় গেছে, বৃষ্টির পানি ঢুকেছে। একটা কাজে গিয়ে আটকা পড়েছিলাম। মা তোমাকে কেন ফোন করছিল? বাসায় নেই?"
মেয়েটি বলল,
"না। ধামরাই গেছে।"
"আমি চেঞ্জ করেই মাকে কল দিচ্ছি। আর শোনো দিয়া, ও আমার ফ্রেন্ড। সাথে ওর ছোটবোন। সেদিন যে কাপড়গুলো এনেছিলাম ওখান থেকে ওদেরকে দুটো বের করে দাও।"
এরপর মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
"তোমরা চেঞ্জ করে নাও, নাহয় ঠান্ডা লেগে যাবে। আমি চেঞ্জ করে আসছি।"
রাফি চলে যেতেই দিয়া হেসে বলল,
"আপনারা আমার সাথে আসুন।"
মীরার এবার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রাফি তাহলে তার বউকে দেখাতে বাসায় নিয়ে এসেছে! এত বছর পরে রাফি এই কষ্টটা না দিলেই কি পারতো না? হঠাৎ মনে হলো সে এখান থেকে এখনই চলে যাবে। পরক্ষণেই আবার মনে হলো, এত কষ্ট করে খুঁজে বের করে এভাবে চলে যাওয়া ঠিক হবেনা। রাফির সাথে একটা বোঝাপড়া করতেই হবে। ওদিকে তাহিয়ারও রাফির বউকে দেখে মেজাজ মোটামুটি খারাপ।
মীরা ও তাহিয়া দিয়ার সাথে একটা ঘরে গেল। সেখানে গিয়ে দিয়া দুটো কাপড়ের প্যাকেট বের করে দিয়ে বলল,
"আপনারা শাওয়ার নিয়ে এগুলো পরে নিন।"
মীরা বলল,
"লাগবে না, আমাকে শুধু একটা টাওয়াল দিন।"
দিয়া বলল,
"হেজিটেড ফিল করবেন না। এগুলো ব্যবহৃত না, একদম নতুন। ভাইয়া কিছুদিন আগে ইন্ডিয়া থেকে কাজিনদের জন্য এনেছিল। সবাইকে দিয়ে এক্সট্রা কিছু রয়ে গেছে।"
মীরা ভ্রু কুঁচকে বলল,
"কোন ভাইয়া?"
মেয়েটি বলল,
"রাফি ভাইয়া।"
এবার মীরা একটু নরম হলো। বলল,
"রাফি আপনার কেমন ভাই?"
মেয়েটি এবার হেসে বলল,
"রাফি ভাইয়া আমার ভাসুর। রাহিকে চেনেন? আমি রাহির ওয়াইফ।"
মীরা ও তাহিয়া একে অপরের দিকে তাকালো এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।
ওরা চেঞ্জ করে নিতেই দিয়া বলল,
"আপু আপনারা ড্রয়িং রুমে আসুন। রাফি ভাইয়া আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।"
ওরা ড্রয়িং রুমে যেতেই দেখলো রাফি একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে বসে আছে। মেয়েটা যে রূপ তা বুঝতে অসুবিধা হলোনা মীরার। রূপ কিছু একটা এঁকেছে, সেটাই তার ভাইকে দেখাচ্ছে। রাফি একটা সাদা শার্ট আর চেক ট্রাউজার পরা, সোফায় বসে আছে। ভেজা চুলগুলো কপালের উপরে এসে পড়ে রয়েছে। মীরা সম্ভাবত আবারো নতুন করে প্রেমে পড়তে যাচ্ছে রাফির। মীরা ও তাহিয়াকে দেখতে পেয়েই রাফি বলল,
"এসো এসো। বসো।"
মীরা ও তাহিয়া বসলো। দিয়া আবার চলে গেল ভেতরে। রাফি রূপকে বলল,
"আপু দেখো তো এই আপুটাকে চেনো কিনা?"
রূপ মাথা নেড়ে বলল,
"না ভাইয়া।"
রাফি এবার মীরাকে জিজ্ঞেস করল,
"তুমি চিনতে পারছো মীরা?"
মীরা হেসে বলল,
"সেই ছোট্ট লূপ।"
অন্যদের সাথে সাথে রূপও হেসে দিল। কারণ সবার মুখে গল্প শুনতে শুনতে সে এটা জেনে গেছে যে ছোটবেলায় সে নিজের নাম লূপ বলতো। রূপ লজ্জা পেয়ে বলল,
"উফ ভাইয়া ছাড়ো তো। আমার অনেক হোমওয়ার্ক বাকী আছে।"
রাফি ওকে ছেড়ে দিতেই এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। মীরা জিজ্ঞেস করলো,
"রূপ কোন ক্লাসে পড়ে?"
রাফি বলল,
"ক্লাস ফাইভ। তুমি?"
মীরা বলল,
"সত্যিই জানো না?"
রাফি হেসে বলল,
"হিসাবে তো এখন তোমার মাস্টার্সে পড়ার কথা।"
মীরা এবার চুপ। আসলে তার বলতে ইচ্ছে করছে অনেক কিছুই। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে তা বুঝতে পারছে না। রাফিই জিজ্ঞেস করলো,
"এবার বলো আমাকে খুঁজতে এখানে কীভাবে এলে? বাসার ঠিকানা কোথায় পেয়েছো?"
মীরা বলল,
"সেটা জানা কি খুব জরুরি?"
রাফি বলল,
"না। তারচেয়ে বরং বলো আমাকে খুঁজছিলে কেন?"
মীরা এবার কেন যেন কোনো উত্তরই খুঁজে পেল না। প্রশ্ন করার কথা ছিল তার কিন্তু করছে রাফি। আর রাফির প্রশ্নের কোনো উত্তরও সে দিতে পারছে না। সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। কথা বলতেও ভয় হচ্ছে, পাছে ভুলভাল কিছু বলে ফেলে। মীরা সব বাদ দিয়ে হঠাৎই জিজ্ঞেস করে বসলো,
"বিয়ে করেছো?"
রাফি হেসে বলল,
"এখনো না। তবে রিসেন্টলি করব। মা মেয়ে খুঁজছে।"
মীরা অভিমানী কন্ঠে বলল,
"মা কেন খুঁজছে? নিজের যোগ্যতা নেই?"
"না৷ সেই যোগ্যতা ৯ বছর আগেই ত্যাগ করেছি।"
এ কথার পর মীরার একটা সুযোগ ছিল পুরোনো কথা তুলবার। কিন্তু সে পারলো না। উল্টো অন্য কথায় চলে গেল। জিজ্ঞেস করল,
"রাহি তোমার আগে বিয়ে করলো যে?"
"ওর দরকার ছিল তাই করিয়েছি।"
মীরা আবার কিছু বলার আগেই দিয়া কফি নিয়ে এলো। সাথে নাশতা। এসব দেখে মীরার মনে পড়লো তারা দুপুরে কিছু খায়নি। এবং এতক্ষণ সেটা মনেও পড়েনি। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, তাহিয়াকে সারাদিন না খাইয়ে রাখার জন্য। দিয়া কিছুক্ষণ ওদের সাথেই বসে ওদেরকে এটা ওটা তুলে দিয়ে খাওয়ালো। তারপর দিয়া চলে যেতেই মীরা বলল,
"রাফি আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে।"
রাফি বলল,
"বলো। কথা আছে বলেই নিশ্চয়ই তুমি আমাকে খুঁজছিলে। সেই কথাই তো জানতে চেয়েছিলাম প্রথমে।"
মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
"এখন বলতে পারব না। আমাকে আরেকদিন সময় দিতে হবে।"
"ঠিকাছে কবে কখন আমাকে জানিয়ে দিও।"
এরপর ওয়ালেট থেকে একটা কার্ড বের করে দিল। মীরা কার্ডটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ সেদিকে চেয়ে বসে রইলো। মানুষটা নিজেই একদিন ফোন নাম্বার চেঞ্জ করে হারিয়ে গেল, আবার আজ নিজেই বাসায় এনে বসিয়ে ফোন নাম্বার দিচ্ছে! প্রশ্ন যে আরো বেড়ে গেল!
রাফি উবার ডেকে মীরা ও তাহিয়াকে ওদের নাখালপাড়ার বাসায় পৌঁছে দিলো। মীরা ও তাহিয়া দুজনকে হঠাৎ একসাথে দেখে জাহানারা খুব খুশি হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলেন। সেসবের বেশিরভাগই মীরার কর্ণপাত হলো না। ঝিম মেরে বসে রইলো। জাহানারা চলে গেলে তাহিয়া মীরাকে জিজ্ঞেস করল,
"তোমার কী হয়েছিল বলো তো আপু? যে মানুষটাকে তুমি গোটা ৯ টা বছর ধরে খুঁজলে, খুঁজে বেরও করলে; সে মানুষটা তোমাকে সামনে বসিয়ে তোমার কথা শুনতে চাইলো। অথচ তুমি কিছু বলতে পারলে না?"
মীরা আনমনে বলল,
"জানি না। ওকে দেখার পর আমি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। আমার মাথা কাজ করছিল না।"
তাহিয়ার মনে হলো মীরা এখনো ঘোরের মধ্যেই আছে।
পর্ব ২১ | পর্ব ২৩ |