“ওকে! আ'ল ডু দিস।” —এ যেন কোনো বাক্য ছিল না। ছিল একটা ধনুক নির্গত তীর। যা সোজা গিয়ে সবার বুকে বিঁধল। হৃদ যে এভাবে রাজি হবে, তা সবার ধারণার বাইরে ছিল।
হৃদ ডেয়ার নেয়ার পর ঊর্মি রিয়াদের কানে ফিসফিস করে বলল,“আর কিছু পাস নাই? যদি মাইয়াটা বুড়ি হয়? তখন?”
রিয়াদ হালকা হেসে ঊর্মির ভঙ্গিতেই বলল,“হৃদের ভাগ্য সবসময়ই ভালো হয়। এবারও ব্যাপারটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দে।”
ঊর্মি এতে একটু শান্ত হলো। আকাশ ও পুষ্পিতার দৃষ্টি সম্পূর্ণটাই হৃদের দিকে। হৃদ তা দেখে ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করল,“হোয়াট?”
পুষ্পিতা ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,“তোর শরীর ঠিক আছে তো? ডক্টর অনয়ের এমন বিহেভিয়ারের সাথে তো আমরা পরিচি...”
সাথে সাথে ঊর্মি, পুষ্পিতার মুখ চেপে ধরল। মেকি হাসি দিয়ে হৃদকে বললো,“তুই ভুলেও যদি এমনটা করে থাকিস, তবে এই ভুলটাই ভালো। ঠিক হতে হবে না।”
এরপর পুষ্পিতাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,“তুই চুপ যা।”
হৃদ ডেয়ারটা নিতো না। তবে... হ্যাঁ, একটা কিন্তু আছে। ফোন বের করে ফেসবুকে প্রবেশ করলো হৃদ। সেখানে পিপল ইউ মে নো-তে প্রথম পেয়েছে একটা অ্যাকাউন্ট। নাম তার অনামিকা হাওলাদার। প্রোফাইলে পদ্মফুলের ছবি। তারপর মেসেজ করতে গেল।
তখনই সিয়াম খোঁচা মেরে বলল,“উহুম উহুম! ভালো কিছু, এন্ড ডেফিনেটলি ডিফারেন্ট কিছু।”
যেহেতু ফ্লার্ট করতে হবে, সুতরাং শুরুটা করল ওভাবেই। কিন্তু রিপ্লাই পেয়ে হৃদের চোখ কপালে উঠে গিয়েছে। হৃদ যতদূর জানে, মেয়েরা এসব মেসেজের রিপ্লাই দেয় না কিংবা ব্লক দিয়ে দেয়। এই আশাতেই ডেয়ারটা নেওয়া। কিন্তু, এগুলো না করে মেয়েটা কবুল বলল! কৌতূহল দমাতে না পেরে হৃদ কনভারসেশন এগোল। কিন্তু অনামিকা ওরফে সাঁঝের রিপ্লাই যেন হৃদকে বরাবর অবাক করছে। এই অন্য রকমে মেয়ে সম্পর্কে জানার কৌতুহল জাগছে।
হৃদ মনে মনে শুধু একটা কথাই বলল,“স্ট্রেইঞ্জ!”
____________
সাঁঝ চিৎকার দিয়ে বলল,“তুই ভালো হবি না ভাইয়া?”
স্ক্যারি মাস্কটা খুলে অর্ণব হাসতে হাসতে বলল,“এই জীবনে না।”
সাঁঝ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে অর্ণবের মাথায় হাত দিল। চুল সব টানতে টানতে বলল,'আজ তোর চুলগুলো আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।'
অর্ণব কোনো ভাবে সাঁঝকে ছাড়িয়ে দাঁড়াল। মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,“আমি ভেবে পাই না, তুই কীভাবে ভয় পেলি? না মানে, পেত্নীরাও ভয় পায়?”
“কীহঃ! আমি পেত্নী?”
“আমি কবে বললাম তুই পেত্নী? তুই নিজেই স্বীকার করলি।” —কথাটা শেষ করেই দৌড় দিল অর্ণব।
অর্ণবের পিছে দৌড়াতে দৌড়াতে সাঁঝ বলল,'ভালো হচ্ছে না। দাঁড়া তুই। আমি মা*র*ব তোকে। দাঁড়া।'
অর্ণব তার দৌড় কার্যক্রম অব্যাহত রেখেই পিছু মুড়ে বলল,“পারলে আগে আমাকে ধর জেরি।”
ডাইনিং-এর সামনে আসতেই সুমিতা বেগমের নজরে এলো তার দুই ছেলে মেয়ের এই টম অ্যান্ড জেরির খেলা। দুজনের এমন দুষ্টমিতে সুমিতা বেগম কখনোই রাগেন না। এসব চোখে পড়তেই, বুকের ভেতর প্রশান্তির শীতল হাওয়া বয়ে যায়। তবুও কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল,“তোরা এখন না থামলে, দুটোর একটাও আমার হাত থেকে রেহাই পাবি না।”
অকপটে থেমে গেল দুজন। নাকের পাটা ফুলছে সাঁঝের। আড়চোখে অর্ণবের দিকে তাকাল। অর্ণব ঠোঁট চেপে হাসছে।
পেছন থেকে আরিফ সাহেব, সুমিতা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, 'আহ্ সুমি! রেগো না।' তুমি রাগলে এই বুড়ো বয়সে ঐ গানটা গাইতে ইচ্ছে হয় -"রাগ করে না! সুন্দরী গো! রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো।" কিন্তু সে বয়স কি আছে? তাই রেগো না।”
সাঁঝ এতক্ষণ রেগে থাকলেও, আরিফ সাহেবের কথায় ফিক করে হেসে দিল। সাথে হাসল অর্ণবও। এটা দেখে সুমিতা বেগম টেবিলে খাবার গোছাতে গোছাতে বলল,'উলটা-পালটা কথা না বলে খেতে বসেন। বয়স যেন দিন দিন কমে যাচ্ছে তার।'
শেষোক্ত কথাটি ফিসফিসিয়ে বলল। যদিও সবাই শুনেছে। এতে আরিফ সাহেব হালকা কেশে উঠলেন। সুমিতা বেগম সাঁঝ ও অর্ণবের উদ্দেশ্যে বলল, “সং-এর মতো দাঁড়িয়ে না থেকে তোরাও বসে পড়।”
______________
ঝিরঝির বৃষ্টি। ক্যালেন্ডারে এখন বৈশাখ মাস। তবে প্রকৃতি জানাচ্ছে, এটা বর্ষা। সারারাত ভারী বর্ষণ শেষে মাত্র এই ধারার বেগ কমল। তবুও থামেনি। বৃষ্টিতে একেকজনের একেক রকমের ইচ্ছে থাকে। কেউ কবিতা লেখে, কেউ রান্না করে, কেউ ভিজে একাকার হয়ে যায়, কেউ কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে, কেউ বা গান শোনে। অনেকে ব্যালকনিতে বসে বসে চা খায় এবং উপন্যাসের পাতা উল্টোয়।
সাঁঝ ব্যতিক্রম। সে এক দৃষ্টিতে আকাশপানে তাকিয়ে থাকে। বাড়ির পেছনে একটা বেলী গাছ আছে। সাঁঝের রুমটা বাড়ির পেছন দিকে হওয়ার দরুন গাছটি একদম সাঁঝের রুম বরাবর। ব্যালকনি থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। শুভ্র রং কার না ভালো লাগে!আর সাঁঝের পবিত্র অন্তর ঠিক যেন এই ফুলের ন্যায় শুভ্র। তার নয়ন জোড়া সেই শুভ্র রঙা বেলী ফুলের গাছটিতে গিয়ে ঠেকল। ফুলে ফুলে পরিপূর্ন দেখাচ্ছে। ঠোঁট এলিয়ে হালকা হাসল। মিষ্টি এই মেয়েটির হাসিটা সবচেয়ে বেশি মিষ্টি।
অবশেষে বৃষ্টি থামল। হয়ত এখনো দুয়েক ফোঁটা জল এই মাটি ছুঁয়ে দিচ্ছে। ভীষণ ইচ্ছে জাগল সাঁঝের মনে। আলমারি খুলে একটা জলপাই রঙ্গা সুতির শাড়ি পরে নিল। অবেলায় অকারণে শাড়ি পরাটা যেন মেয়েদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য থেকে হাতে গোনা কিছু সংখ্যক মেয়ে বাদ গেলেও, বাকিরা এক জাতের।
খোলা চুল, পায়ে নূপুর আর শাড়িটা পরেছে আটপৌরে করে। আঁচলের অংশটুকু একহাতে পেঁচিয়ে ফেলে রাখা; যা মাটিতে পড়েছে। সেদিকে খেয়াল নেই তার। মুখে কোনো ধরনের প্রসাধনী মাখেনি। শ্যামাঙ্গিণী এই মেয়েটার আবার এসব সয় না। সামান্য কাজলটাও লাগাতে পারে না। তবে শাড়ি, চুড়ি, নূপুরের প্রতি লোভ তার জন্মলগ্ন থেকে। আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে হালকা হাসল। সে রূপবতী না, তবে মায়াবতী অবশ্যই।
ব্যালকনির দরজা পেরিয়ে এই কাঁদা-ভেজা মাটিতে দৌড়িয়ে গেল সেই গাছের দিকে। খালি পা দুটোতে কাঁদা লেগেছে। সে লাগুক গিয়ে! সাঁঝ চুপিসারে বেলী ফুল গুলো কুড়িয়ে নিল। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে তার মালা গেঁথে হাতে পরে নিল। কিছুটা ফুল তার পড়ার টেবিলের সামনে রেখে দিল। এর সুবাস না-কি তার ভীষণ প্রিয়!
ব্যক্তিগত ডায়েরিটা বের করে নিল সাঁঝ। যেখানে লেখা আছে বিগত বছরগুলোতে সাঁঝের সকল চাওয়া-পাওয়া। কলম তুলে লিখতে বসল আবারও কিছু চাওয়া। যা পাওয়ার আকাঙ্খায় তার হৃদয় ব্যাকুল! অদ্ভুত মিষ্টি মাখানো হাসি ঠোঁটের কোণে টেনে সে লিখতে বসল কিছু কথা। না হওয়া এক ব্যাথা।
______________________
অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে অর্ণব। এমন সময়ে তার ফোন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিতেই সে একটুখানি বিরক্ত হয়ে গেল। সচরাচর তার এই নম্বরে আননৌন কোনো নম্বর থেকে কল আসে না। তাই কিছুটা অবাকও হলো। রিসিভ করে কানে তুলল ওপাশের ব্যক্তির কথা শুনতে।
কিন্তু চুপ সে। আগ বাড়িয়ে অর্ণব বলল,“হ্যালো!”
ফোনের ওপাশে অদিতি সময় নিয়ে বলল,“আসসালামু আলাইকুম।”
মেয়ে মানুষের কন্ঠ পেতেই অর্ণব বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলল। তবুও সালামের জবাবে বলল,“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
অতঃপর দুইপাশেই চুপ। অর্ণব জিজ্ঞেস করল, “কী চাই?”
অজ্ঞাত কারণবশত অদিতি এবারও চুপ। তা দেখে অর্ণব কল কাটার জন্য উদ্যত হলো। তখনই অদিতি বলে উঠল,“আমি অদিতি।”
অর্ণব পুনরায় ফোন কানের সাথে লাগিয়ে বলল,“সো নাও, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?”
অদিতি অকারণে নার্ভাস। পরপর দু'বার শ্বাস ফেলে বলল,“আমি সাঁঝের ফ্রেন্ড। ওর ফোন অফ পাচ্ছিলাম বলে আপনাকে কল দিলাম।”
“ওয়েট! হাও ডিড ইউ গেট মাই নাম্বার?”
অদিতি চুপ করে গেল আবারও। এই নম্বরটা পেতে তার কম বেগ পোহাতে হয়নি। কিন্তু সেটাতো এখানে বলা যায়না। তাই প্রসঙ্গ এড়াতে বললো, “কী করছেন এখন?”
পুনরায় একরাশ বিরক্তি অর্ণবকে ছেঁয়ে গেল। অদিতির উদ্দেশ্যে বলল,“হোল্ড অন।”
এরপর কান থেকে ফোন সরিয়ে সাঁঝের রুমের দিকে গেল। রুমের সামনে গিয়ে নক করল। সাঁঝ তড়িঘড়ি করে নিজের ডায়েরি লুকাল। এরপর দরজা খুলল। পাক্কা গিন্নী সেজে থাকা সাঁঝকে দেখে অর্ণব মোটেও অবাক হয়নি। যা প্রায়শই ঘটে, তা নিয়ে অবাক কেন হবে?
বোনের এমন কাহিনি দেখে অর্ণব বিরক্তি ভুলে গেল। বাচ্চা বোনটার সাথে যতটা ঝগড়া করে তার চেয়ে সহস্র গুন বেশি ভালোবাসে। ভালোবেসে ‘জেরি’ নামে সম্বোধন করে। এটা কোনো নাম না, আস্ত একটা ভালোবাসা।
“কী-রে ভাইয়া? কিছু বলবি?”
এক দৃষ্টিতে নিজের প্রিয় বোনকে দেখে যাচ্ছিল অর্ণব। এতক্ষণ একটা কথাই ভাবছিল, এত আদরের বোনটা বড়ো হয়ে গেল। কিছুদিন বাদে বিয়েও হয়ে যাবে। তারপর বিদায়!এসব ভেবে চোখের কার্নিশে জল এগিয়ে এলো। তখনই সাঁঝের ডাকে অর্ণব নড়ে চড়ে উঠে বলল,“তোর ফোন কী করেছিস?”
সাঁঝ, অর্ণবের চিকচিক করতে থাকা অক্ষিদ্বয় দেখল। কিন্তু কিছু বলল না।ফোনের বিষয়টা শুনতেই তার খেয়ালে এলো, কাল থেকে তো এটা সুইচ অফ। চটজলদি জিভে কামড় দিল। দ্রুত গিয়ে বিছানার পাশে থেকে ফোন হাতড়ে নিল।
অর্ণবের দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দিয়ে বলল, “হেহে! ভুলে গেছিলাম এটার কথা।”
অর্ণব নিজের ফোন সাঁঝের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,“তোর ফ্রেন্ড কল দিয়েছে। নে।”
সাঁঝ, অর্ণবের হাত থেকে ফোন নিয়ে কানে তুলল। অর্ণব প্রস্থান করতেই সাঁঝ অদিতির উদ্দেশ্যে বলল, “কী? কী হইছে?”
“তোর খোঁজ নিলাম। আর কী?”
“আমারে বলদ পাইছিস তুই? এখন কোনো ইমারজেন্সিও তো না। ফোন অফ থাকলে পরেও দিতে পারতিস। আম্মুর নম্বরও তো আছে। তাহলে?”
“ঐ আর কী! কিছু না। বল, কী খবর তোর?”
“কথা এড়াবি না একদম। ফোনের এপাশ থেকে থাবড়া খাবি। কাহিনি বল এখন-ই।”
“কী কাহিনি?”
“ওরে আমার সাধু রাণী! এখন তো তুমি ভাজা মাছটা উল্টাতেও জানো না, তাই না?”
“কী বলিস এসব?”
“চুপ! জলদি বল কী হইছে?”
অবশেষে অদিতি মুখ খুলল,“প্রতি বারের মতোই। পাত্তা পেলাম না।”
সাঁঝ আর কীভাবে বোঝাবে? কী-ই বা বোঝাবে? তবুও বলল,“এই গাঁধার মধ্যে কী পাইছিস বইন? দুনিয়াতে আর ছেলে নাই?”
“এত বড়ো এই দুনিয়ায় অনেক ছেলে আছে। তবে ভালোলাগার মতো মানুষ এই দুনিয়াতে সবার জন্য কেবল একটা পিসই আছে। তাকে পেয়ে গেলে, আর কাউকেই ভালো লাগবে না। তার চেয়ে হাজার গুণ বেটার অপশন পেলেও সেই মানুষটাকে ছাড়া আর কিছুই নজর কাড়বে না। আর যদি সে হয় বাচ্চা কালের ভালো লাগা! লোকে বলে, সেটা আবেগী সময়। যে কাউকে ভালো লেগে যায়। কিন্তু তারা এটা বোঝে না, সেই ‘যে-কেউটা-ই হৃদযন্ত্রের মালিকানা পেয়ে যায়। জন্ম জন্মান্তরের জন্য।”
আপাতত অদিতির এই লম্বা ভাষণের এক বিন্দুও সাঁঝের ছোট্ট মস্তিষ্ক বুঝতে পারল না। ব্যর্থ চেষ্টা না করে বলল,“এক্সাম তো হয়ে গেল। এখন রেজাল্ট নিয়ে টেনশন হচ্ছে।”
অদিতি আলগোছে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণা মুছে বলল,“টেনশন ফ্রি থাক। আমাদের এক্সাম ভীষণ ভালো হয়েছে। সব ভালোই হবে।”
আর কিছুক্ষণ পর তাদের কথা শেষ হলো। তারপর সাঁঝ ডায়েরীটা বের করে লিখল,“আমার ব্রেকআপেও আমি এতটা কষ্ট অনুভব করিনি, যতটা যন্ত্রণা আমি কোনো অব্যক্ত প্রেমিকার এক তরফা প্রেম কাহিনী শুনে পাই। জীবন না-কি বড্ড নিষ্ঠুর! দেখা যাক! এটা সুখ না-কি অসুখ!”
.
.
.
চলবে..................................