বিকেলের শেষাংশ। দূর আকাশে লালচে আভা দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতি অশান্ত। বাতাসে রমরমা ভাব। ছাদে রাখা বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল সাঁঝ। তার ঠিক সামনে রয়েছে উপমা। খোশ মেজাজে শুকিয়ে যাওয়া কাপড়গুলো তুলে নিচ্ছে এবং মিষ্টি সুরেলা কন্ঠে গুনগুনিয়ে যাচ্ছে। সকালের মতো ওমন মন ভার আর তার নেই এখন। থাকবে কী করে, যার জন্য মন খারাপ ছিল, সে নিজেই অনেকটা আদুরে ভঙ্গিতে সামলিয়েছে। কল দিয়ে দীর্ঘক্ষণ প্রেমালাপ করেছে। আর কথাও দিয়েছে, খুব শীঘ্রই সে পুনরায় এই শহরে ফিরবে; বোন এখানেই রয়েছে, ফিরতে তো হবেই।
হাত মুঠো করে ধরে রাখা আপেলে একটা কামড় বসিয়ে, তা চিবাতে চিবাতে বলল,“মনে রাখলাম!”
উপমা কাপড় গোছানো বাদ দিয়ে থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ সাঁঝের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কী?”
সাঁঝ উপমার কথা কানে নিল না। নিজ ভঙ্গিতে আপেলটা খেয়ে যাচ্ছে। উপমা চোখ পিটপিট করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তার দিকে। কিন্তু সাঁঝ! সে তো নিজ কার্যে মত্ত। উপমা পুনরায় কাপড় ওঠানোতে লেগে পড়ল। আজ শুক্রবার। সপ্তাহের সমস্ত কাপড় ধোয়ার দিন। সেই হিসেবে সম্পূর্ণ ছাদের অর্ধেকটা জুড়েই কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছিল।
সবগুলো কাপড় পাশের চেয়ারে রেখে, সাঁঝের সামনে রাখা বেতের চেয়ারে বসে পড়ল। সাঁঝ একবার চোখ তুলে দেখল উপমাকে। তারপর আবার চোখ নামিয়ে নিল। উপমা জিজ্ঞেস করল,“ফটাফট বলে ফেল, কী মনে রাখবি?”
এবার সাঁঝ কোনো ভনিতা না করেই বলে উঠল,“এই যে তুই! সকালে ছ্যাঁকা খেয়ে ন্যাকারাণী আর দিন গড়াতে না গড়াতেই খোশমেজাজে গুনগুনাচ্ছিস!”
উপমা কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করল,“তাই কী?”
“কতবার জিজ্ঞেস করেছি? বলেছিস?”
উপমা একটা শ্বাস ফেলে বলে উঠল,“আর কিছু?”
সাঁঝ চুপ মেরে নিজের জায়গায় বসে রইল। ধীর কন্ঠে বলল,“নাহ্!আর কিছু না।”
উপমা মুচকি হাসল। তার হবু ননদিনী অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। এই ফুলকো গালদুটো দেখতে যে তার ভারী ভালো লাগছে। কিছুক্ষণ বাদে উপমা সাঁঝকে ডাকল,“সাঁঝ!”
সাঁঝ জবাব দিল না।
উপমা সাঁঝের বাহুতে চাপড় মেরে বলল,“ডাকছি তো!”
সাঁঝ পূর্বভঙ্গিতে বসে রইল; হেরফের করল না।
উপমা কিহুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাপড়গুলো ভাঁজ করতে করতে বলা শুরু করল,“তোর কাছ থেকে তো কোনো কিছু লুকোই না আমি, না? আসলে পারিও না লুকোতে। এটাও বলব। কিন্তু সময় হয়নি এখনও। আর আমার বুদ্ধিমতী সাঁঝ তো জানেই, প্রতিটি কাজের নির্দিষ্ট একটা সময় ও সুযোগ আছে; এর আগে করতে গেলে কাজটা বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৯০%। আমিও সেই সুযোগের জন্য সঠিক মুহূর্তের অপেক্ষায় আছি। এখন তুই এভাবে থাকলে আমার এখনই বলে দিতে হবে। তারপর.... ”
এটুকু বলে উপমা সাঁঝের দিকে তাকাল। দেখল, সাঁঝ এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। উপমা ঠোঁট এলিয়ে হালকা হাসল। বিপরীতে সাঁঝও খানিক হাসল। হাসির রেখাটা একদম সামান্য।
সাঁঝ ধীর কন্ঠে বলল,“যখন ইচ্ছে হয় বলিস, কিন্তু দেরি করিস না।”
“আচ্ছা।”
হঠাৎ সাঁঝের মস্তিষ্কে কিছু এলো; এমন ভাবে উপমাকে শুধাল,“আচ্ছা! সব ঠিক আছে। কিন্তু ঐ খাটাশ হৃৎপিণ্ড এই বাসায় কবে এলো?”
“কবে মানে?”
সাঁঝ ‘চ’ টাইপের একটা আওয়াজ করে আরও খানিকটা গুছিয়ে বসে বলল,“আরে! এ'বছরের শুরুতেও তো আমি এসেছিলাম। কোথায়? দেখলাম না তো তাকে!”
“সে-কী! জানিস না? হৃদ ভাইয়া তো বিগত দুই বছর ধরে এখানেই থাকে!”
মুহূর্তেই সাঁঝ তাজ্জব বনে গেল। চোখ তার কপালে ওঠে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে জোরালো আওয়াজে বলে উঠল,“তাহলে যেই ঝগড়াগুলো তিন বছর আগে হওয়ার কথা ছিল, তার সময়সীমা বছর দুয়েক পিছিয়ে গেল কোন সুখে?”
থমকে যাওয়া সাঁঝের এমন কথায় উপমার দু'ঠোঁট কিঞ্চিৎ ফাঁকা হয়ে ‘হা’ আকৃতির হয়ে গেল।
“দুই বছর আগে কেন ঝগড়া করতে পারলি না, সেজন্য আফসোস হচ্ছে?”
“তা নয়ত কী?”
উপমা বিরক্তি ভরা বিস্মিত কন্ঠে বলল,“মজা নিচ্ছিস সাঁঝ?”
“হোপ! এমন সিরিয়াস ব্যাপার-স্যাপারে মজা নেওয়ার মতো মেয়ে, এই সাঁঝ না।”
উপমা এখনও কিংকর্তব্যবিমূঢ়! মুহূর্তেই নিজের এমন বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে উঠল। সে কেন স্তব্ধ, হতবিহ্বল হবে? জানেই তো, সাঁঝ এমন। হাফ ছাড়ল উপমা। কিন্তু, এখনও একটা কিন্তু থেকে যায়।
চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে সাঁঝকে জিজ্ঞেস করল,“তুই কবে থেকে বাইরের মানুষের সাথে এভাবে ঝগড়া শুরু করলি?”
প্রশ্নটা ছুঁড়ার সাথে সাথেই সাঁঝের মস্তিষ্কে গেঁথে গেল। তৎক্ষনাৎ, আপনমনে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল, “আমি কবে থেকে বাইরের মানুষের সাথে ঝগড়া শুরু করলাম!"
মস্তিষ্কে চিনচিনে এক যন্ত্রণা অনুভূত হলো। প্রশ্ন আছে ঠিকই, বেশ গোছালো প্রশ্ন। তবে উত্তরের ‘উ’ও নেই। এই বিষয়ে ভাবতে চাচ্ছে না। কিন্তু, মানুষ স্বভাবতই কৌতূহলী প্রাণী! একটা প্রশ্ন যদি ভুলক্রমেও মাথায় এসে যায়; যতক্ষণ না উত্তর খুঁজে পায়, ততক্ষণ শান্তি পায় না। অশান্ত মনটা ছটফট করতে থাকে।এদিকে সাঁঝ আবার মনের ছটফটানো রোগটাকে ভয় পায়; অবশ্যই ব্রেকআপের ফল এটা। সাঁঝ মাইন্ড ডাইভার্ট করার চেষ্টা করল।
উপমাকে বলল,“ওসব ছাড়! যেটা জিজ্ঞেস করলাম, সেটা বল।”
“কোনটা?”
“ঐ হৃৎপিণ্ডটা আমার শকুনি নজর থেকে রেহাই পেল কীভাবে?”
উপমা মিহি হেসে বলল,“বলা যায় একটা কো-ইনসিডেন্ট।"
সাঁঝ ভ্রু-যুগল একটুখানি উঁচুতে তুলে বলে উঠল, “কো-ইনসিডেন্ট!”
উপমা মিহি হেসে বলল,“একদম! তাছাড়া আর কী? হৃদ ভাইয়া যেই দুই বছর ধরে আছে, এই দুই বছরে তুই এসেছিস আটবার; সাথে অর্ণব এসেছিল দুইবা...”
সাঁঝ কথার মাঝেই গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে, ভাব-গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল,“অর্ণব! অর্ণব ভাইয়া হবে। বড়ো তোর।”
উপমা ঘাবড়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে হাসির রেখা প্রশস্ত করে বলল,“হ্যাঁ হ্যাঁ। যা বলছিলাম, শোন। প্রতিবার থেকেছিস তিন-চারদিন করে। এখানে, আমরা ঘুম থেকে উঠতাম সকাল নয়টার পর। আবার বিকেল হলেই ঘুরতে বেরতাম; ফিরতে ফিরতে গভীর রাত। ওদিকে হৃদ ভাইয়া ওঠে সেই ভোরে। হসপিটাল থেকে ফিরতে ফিরতে আবার সন্ধ্যে। কেবল অফডে-তে বাসায় থাকে। আর তুই তো, সেদিন রুম থেকেই বের হোস না; বড়োজোর ছাদে আসিস! কিন্তু, হৃদ ভাইয়া কখনোই ছাদে আসে না।”
টানা এতটুকু বলে দম ছাড়ল উপমা। এরপর আবারও বলল,“এই এত এত অমিলের জন্য তোর ঝগড়া হয়ে ওঠেনি।”
সাঁঝ হা করে শুনছিল সব কথা। উপমা কথা শেষ করতেই বলল,“বাব্বাহ! এত এত অমিলে মিলল এই ঝগড়াটাই?”
“কী বলিস? এদিক দিয়েও অমিল। হৃদ ভাইয়া মোটেও ঝগড়া করে না।”
“হ্যাঁ, সে-ই! সে তো সাধু। তার উপর লাগে তোর ভাই। সে ক্যান ঝগড়া করবে?”
“এইতো, এখন বুঝেছিস।”
তখনই সাঁঝ নিজের পায়ের কাছে রোমশ কিছুর ছোঁয়া পেয়ে ভড়কে ওঠে। খানিকটা ভয় পেয়ে যায়। যেই না নিচে তাকাল, ওমনিই তার ভয়-ভীতি বেড়ে গেল। তবে স্বল্প-সময়ের জন্য। ছাই রঙের একটা বিড়াল, সাঁঝের পায়ের নিকট বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখদুটো তার কেমন মায়াবী! সাঁঝের হাত আপনা-আপনিই বিড়ালটির পিঠে চলে গেল। পরম যত্ন সহকারে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এমন মিষ্টি আদুরে ছোঁয়ায় ইভ আপ্লুত! আলতো স্বরে ‘মিয়াও’ টাইপের একটা দীর্ঘ আওয়াজ করে উঠল। তার সাথে সাথে সাঁঝের পাতলা ওষ্ঠদ্বয়ে ছোট্ট একটা হাসির রেখার দেখা মিলল।
উপমা সাঁঝকে ডাকল, “কীরে সাঁঝ!”
তৎক্ষনাৎ সাঁঝ নিজের হাত সরিয়ে নিল। উপমা বলল,“তুই তো পোষা প্রাণী পছন্দ করিস না। ছোট বেলায় কুকুরের দৌড়ানি খাওয়ার পর থেকেই তো এসব প্রাণী থেকে দশ হাত দূরে থাকিস। আর আজ! হুট করেই তোর এত পরিবর্তন আমি মানতে পারছি না। কিছু ভর করল না তো আবার?”
“ধ্যাৎ! কী বলিস? এমন কিছু না। তুই দ্যাখ, এই বিড়ালটাকে! চোখদুটো দেখ! কত মায়াবী! এদের থেকে দূরে থাকা যায় না।”
“হুম, তা তো বটেই!”
কথাটুকু বলেই দৃষ্টি গেল সাঁঝের ঠিক পেছনে, ছাদের দরজার দিকে। উপমা মুচকি হেসে কিছু বলার জন্য উদ্যত হলো, তখনও সাঁঝ বলে উঠল,“তোদের বাড়িতে এবার এসে এই বিড়ালটাকেই ভালো লাগল। বাকিরা তো সুযোগ খোঁজে ঝগড়া করার। ঐ হৃৎপিণ্ডকেই দ্যাখ!”
উপমা দাঁতে দাঁত চেপে জোরপূর্বক হেসে বলল,“সাঁঝ! চুপ যা।”
সাঁঝের তেজ বাড়ল। জোর কন্ঠে বলল,“খাটাশ একটা! দেখা হওয়া থেকে আমার মেজাজ বিগড়ানো ছাড়া কিছুই করেনি। শুরুতে আমার হতে হতে হয়ে যাওয়া সংসারকে না হওয়া সংসার বানিয়ে দিল। এরপর দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে উলটা-পালটা বলল। আমি নাকি হ্যান্ডসাম ছেলে দেখার লোভে সেখানে গেছি!”
“বইন! থাম তুই।”
“তুই থাম, বলতে দে। মানলাম দেখতে একটু সুন্দর! আচ্ছা! একটু না। দেখতে ভালোই সুন্দর! তাই বলে এত দেমাগ! বউ জুটবে না। এই সাঁঝ বলে দিচ্ছে, আমার মত শান্ত মস্তিষ্ক আর কারো নেই, সহ্য করবে না তার অত্যাচার; সোজা খুন করে ফেলবে।”
উপমা পুনরায় সাঁঝের পিছনে তাকিয়ে বলল,“বইন আমার! এবার না থামলে আমার কিছু না হলেও, তোর অনেক কিছু হয়ে যাবে রে!”
পেছন থেকে গম্ভীর একটা কন্ঠ বলে উঠল, “ওনাকে ডিস্টার্ব কোরো না উপমা। কিছু হবে না, ওনার কিছু করার সাহস নেই কারো। বলতে দাও।”
তার সাথে তাল মিলিয়ে সাঁঝ বলল,“হ্যাঁ, কিছু হবে না। কোনো শালা কিছু করতে এলে একটা কিক দেব, এক্কেবারে চান্দে গিয়ে ল্যান্ড কর...”
সঙ্গে সঙ্গে সাঁঝ থেমে গেল। ছাদে নিজের সাথে উপমার আওয়াজ ব্যতীত তৃতীয় কোনো ব্যক্তির গম্ভীর কণ্ঠ শুনতে পেরে চুপ থেকে বোঝার চেষ্টা করল। কণ্ঠদাতাকে চিনতে পেরে শুকনো একটা ঢোক গিলে উপমাকে বলল, “ফুপ্পি ডেকেছে না একটু আগে? যাই আমি।”
কথাটা শেষ করেই পেছনে ছুটল। যাওয়ার সময় হৃদের পাশ কাটিয়ে গেল; এক দমকা হাওয়া হৃদের গা ছুঁয়ে গেল। সাথে এক মিষ্টি সুবাস তার ঘ্রানেন্দ্রিয় হয়ে যেতেই আঁখিদ্বয় বন্ধ করে ফেলল। বড্ড মোহময়ী সে সুবাস! নারী সুবাস বড়োই অদ্ভুত এক সুবাস! পুরুষ হৃদয়ের অন্তঃস্থলের সেই বিশাল তাণ্ডবের মূল এই সুবাস!
“ভাইয়া! সরি!”
উপমার কোথায় হৃদ সম্বিত ফিরে পেল। উপমাকে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলল,“কিছু মনে করিনি।”
“তবুও সরি একসেপ্ট করো ভাইয়া, গিলটি ফিল হচ্ছে ভীষণ!”
হৃদের ভাবুক দৃষ্টি কিছুক্ষণ এদিক সেদিক তাকাল।ঠোঁটের কার্নিশে বড্ড সূক্ষ্ম এক রেখা ছড়িয়ে বলল,“আচ্ছা! তবে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে, উইদাউট এনি কুয়েশ্চন।”
“আচ্ছা ভাইয়া। এখন এটা বলো, তুমি ছাদে কী করছ? কখনো তো আসো না!”
“এভাবেই এলাম। ভাবলাম, ইভকে নিয়ে একটু ঘুরি!”
“ইভ!”
উপমা বিস্মিত কন্ঠে বলল। কারণ, হৃদ তার বাসায় একা থাকে। তাছাড়া কখনো এই নামে কাউকে দেখেওনি।
হৃদ তার পা ঘেঁষতে থাকা ইভকে ইশারায় দেখাল। উপমা চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলল,“তুমি তো পেট পছন্দ করো না! তবে?”
হৃদ একটা শ্বাস টেনে ইভের দিকে তাকিয়ে বলল,“এটাকে ভালো লেগে যায়। দিনশেষে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলে, ইভকে দেখলেই ঠোঁটে হাসি ফোঁটে।”
উপমা মিষ্টি হেসে ‘ও আচ্ছা’ বলতেই হৃদ বলল,“এখন একটা জিনিস প্রয়োজন।”
___________________
নিজ রুমে বসে ভাবছিল সাঁঝ, কীভাবে হৃদকে জব্দ করা যায়! ওর শান্তি লাগছে না। অজ্ঞাত কারণবশত, হৃদের সাথে ঝগড়ার মাধ্যমেই সাঁঝ অন্তঃতৃপ্তি পাচ্ছে।
রাতের শুরু। আজ সন্ধ্যেটা সাঁঝের বড়োই বিচিত্র ভঙ্গিতে কেটেছে; বড্ড চুপচাপ, শান্ত, স্থীর হয়ে শূন্যে তাকিয়ে। আজকের আকাশে সন্ধ্যেটা নীল ও লালের সমন্বয়ে ছিল। কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল! সাঁঝের ইচ্ছেরা সব এলোমেলো ও অগোছালো হয়ে যাচ্ছিল। অবশ্য সাঁঝ তা বুঝতেও পেরেছিল। অবাধ্য মন হুট করেই কিছু চেয়ে বসে। আজ চাচ্ছিল, এ সময় যেন থমকে যায়! তবে বহমান সময়, সাঁঝের চাওয়াগুলো উপেক্ষা করে নিজ স্রোতের ধারা অব্যাহত রেখেই চলে গেল পেছনে, নেমে এলো রজনী। চাওয়াগুলো না পাওয়া রূপে বুক চিরে এক অন্তরীক্ষ দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো। অবসান ঘটল নিশ্চুপ সাঁঝের।
অতঃপর আবারও সাঁঝ তার আগের ফর্মে চলে গেল। বিছানায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসে হৃদকেই ভাবছিল। তখন সেখানে উপমার আগমন ঘটল, ফোন কানে নেওয়া অবস্থায়।
সাঁঝের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,“তোর ভাই।”
সাঁঝ ফোন কানে তুলল, তার আগে উপমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তোরও ভাই।”
উপমা তৎক্ষণাৎ বলল,“তাকে ভাই মানি না।”
এবং আলগোছে প্রস্থান করল। সাঁঝ ওটা নিয়ে কিছু ভাবার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে অর্ণব বলে উঠল,“কেমন আছিস জেরি?”
“আছি আছি, একদম ফার্স্ট ক্লাস। তুই?”
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে অর্ণব বলে উঠল,“তোর না টম অ্যান্ড জেরি কার্টুন ভালো লাগে ভীষণ! কখনো ভেবেছিস, জেরি ছাড়া শুধু টম! আচ্ছা, কেমন লাগবে? তোর কী মনে হয়, টম কেমন থাকবে?”
সাঁঝ ভেবে বলল,“জেরি ছাড়া টম একদম বিন্দাস থাকবে! ঝামেলাহীন জীবন! কেউ জ্বালাবে না তাকে। সবসময় নিশ্চিন্তে থাকবে। লাইফটা ঝাকানাকা!”
অর্ণব মলিন হাসল। সাঁঝ তখন আবারও বলল,“কিন্তু ঝামেলাহীন জীবন একেবারেই বোরিং। এরকম ফ্যাকাশে লাইফ তো টম আর জেরির জন্য একদমই না! আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, তারা একে অপরে অভ্যস্ত! দু'জন আলাদা ভালোই থাকবে, তবে সেই ভালো থাকায় প্রশান্তির ছোঁয়া থাকবে না।”
অর্ণব এবারও হাসল। তবে এই হাসিতে মলিনতার বিন্দু মাত্র স্পর্শ নেই; আছে শুধু অপর পাশের ব্যক্তিকে নিজের অবস্থা বোঝানোর প্রাপ্তি। হেসেই বলল,“ঠিক তেমনটাই আছি।”
সাঁঝ বুঝল। ব্যথিত কন্ঠে বলল,“মিস ইউ ভাইয়া!”
“ভাইয়া মিস অলসো জেরি।”
আবারও অর্ণব বলল,“একটা পার্সেল আসবে আজ।”
“কী?”
“দেখে নিস।”
আরও কিছুক্ষণ কথা শেষে ফোন রেখে দিল। মনোয়ারা বেগম দরজার চৌকাঠে এসে ডাক দিল সাঁঝকে। দরজার সামনে মনোয়ারা বেগমকে দেখতে পেয়ে সাঁঝ মুচকি হাসল। মনোয়ারা বেগম ভেতরের দিকে অগ্রসর হলো।
“এটা নাও। মাত্রই এলো।”–কথাটা বলেই হাতের প্যাকটা সাঁঝের দিকে এগিয়ে দিল।
সাঁঝ জিজ্ঞেস করল,“এটা কী?”
“অর্ণব পাঠিয়েছে। একটু আগেই ডেলিভারি বয় এসে দিয়ে গেছে।”
সাঁঝের তখন মনে পড়ল অর্ণবের কথাটা। মনোয়ারা বেগম “থাকো, চুলায় ভাত বসিয়ে এসেছি” বলেই প্রস্থান করল। সাঁঝ ভাবুক ও উৎসাহিত ভঙ্গিতে আনপ্যাক করতে লাগল। দেখতে পেল, একটা ফোন। খুশিতে শব্দ করেই বলে উঠল,“লাভ ইউ ভাইয়া!”
_____________
নিশীথা প্রহর। চারিপাশে সাই সাই বাতাস ও একই সাথে যানবাহনের কর্কশ শব্দে মনটা একাধারে স্নিগ্ধ হলো এবং বিষিয়ে গেল। এমন আবহাওয়া তো কেবল গ্রাম্য প্রকৃতিতেই মানায়! সাঁঝ বরাবরই প্রকৃতিবিলাসী। বদ্ধ ঘরে থাকতে পারে, তবে কিছুদিনের জন্য কেবল; এভাবে বছরের পর বছর থাকা যেন ভীষণ পীড়াদায়ক! ভেবেছিল, বারান্দায় কিছুটা শান্তি পাবে। কিন্তু নাহ্!
বিরক্ত হয়ে রুমে এসে ফোনটা অন করল। সিম ঢুকিয়েছে এটাতে। ফোন অন করার সঙ্গে সঙ্গে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ এলো। কৌতূহল নিয়ে পড়ল সাঁঝ। সেখানে লেখা ছিল—
ভোরের সূর্যের প্রথম কিরণ যখন পড়েছিল,
তুমি নামক এক অদ্ভুত বিষ আমার সর্বাঙ্গে ছেঁয়ে গিয়েছিল।
বিষক্রিয়ায় হাঁসফাঁস করতে করতে যেই না কাটল অগণিত প্রহর,দরজায় করা নাড়ল অসুখ এসে।
সেই বিষের উপশম করতে আবারও আমার আঙিনায় এলে অসুখ বেশে।
এই ধরণীর বুকে, আমার নয়ন সম্মুখে, পুনরায় পদচারণ করলে।
আমার জীবনের রক্ত-লাল অধ্যায়ে এক বিষ-নীল সন্ধ্যা হয়ে আগমন ঘটালে।
নাম দিলাম, সন্ধ্যাবতী।
ওহে সন্ধ্যাবতী! স্বাগতম তোমায় এই প্রেমাসুখে...
.
.
.
চলবে.....................................