সাঁঝ না চাইতেও উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। খানিকটা দ্রুত গতিতে বলে উঠল, “আপনি ওভাবে ভাবছেন কেন?”
“কীভাবে?”
সাঁঝ হৃদের চোখে চোখ রাখল। সেকেন্ড দুয়েক স্থির রেখে সরিয়ে নিল। এতো গভীর কারো চোখ হয়?
হৃদ হাসল। সাঁঝ সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আসি তবে;খোঁজ নেওয়া শেষ।”
তারপর চলে যেতে উদ্যত হতেই হৃদ সাথে সাথে তার হাত ধরে ফেলল। সারা শরীর কেঁপে উঠল সাঁঝের। চোখ দু'টো বন্ধ করে ফেলল।
হৃদ এগিয়ে গিয়ে সাঁঝের বন্ধরত চোখের পাতার কাঁপুনি দেখল।
কিছুক্ষণ বাদে ফিসফিসিয়ে বলল, “আগেও বলেছি, আবারও বলছি, মানলাম আমি হ্যান্ডসাম, তাই বলে এভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখবেন না। ভেতরে চলে আসবেন, একসাথে বসে কফি খাব। তখন না হয় আপনি আমায় দু’চোখ ভরে দেখে নিয়েন।”
সাঁঝ চোখ মেলল। কী না কী অনুভব করছিল! রাগে উত্তেজিত হয়ে বলল, “দু’লাইন বেশি বোঝেন কেন?”
হৃদ বাঁকা হেসে বলল, “অপরপক্ষ আংশিক কথা বললে, নিজেকেই বেশি বুঝে নিতে হয়।”
সাঁঝের কিছু একটা মনে হতেই সেও বাঁকা হাসল। হৃদ ভ্রু কুঁচকাল। সাঁঝ আঁড়চোখে তাকিয়ে বলল, “কী লাভ এত সুন্দর হয়ে, যেখানে কোনো মেয়েকেই পটাতে পারলেন না?”
হৃদও একথা শুনে হাসল। ধীর কন্ঠে বলল, “কে বলল, কোনো মেয়েকেই পটাতে পারিনি? একটা মেয়েই আমার তিন সত্ত্বাকে ভালোবেসেছে। এটা না জেনেই যে, তিনটাই আমি।”
কথাটার আগা গোড়া সাঁঝ বুঝল না। তবুও বিপরীতে কিছু বলতে যাবে, তখনই ভেতর থেকে চশমা ঠিক করতে করতে হেঁটে এলো আফিয়া আহমেদ।
“হৃদ! এখানে কী করছিস?”
কথাটা বলতেই সাঁঝকে দেখতে পেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাঁঝকে দেখে মুচকি হাসল।
এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,“কেমন আছো, মা?”
সাঁঝ আবেগে আপ্লুত হয়ে আফিয়া আহমেদকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভিষণ ভালো আছি, আন্টি। তুমি কেমন আছো?”
আফিয়া বেগম বলল, “আলাহামদুলিল্লাহ। ভেতরে এসো। এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“না,আন্টি। এখন ছাদে যাব। পরে আসব।”
“প্রতিবারই কোনো না কোনো বাহানা! আচ্ছা যাও।”
“মন খারাপ কোরো না।”
“সে খেয়াল রাখার মতো কেউ আছে?”
“এভাবে বলছ কেন, আন্টি?”
“তো কীভাবে বলব, ছেলে দুইটা একেবারে অবাধ্য। ছোটোটা মাত্র মেডিকেলে পড়ছে, তার একটাই কথা, ‘আম্মু বিয়ে করিয়ে দাও, মেয়ে রেডি আছে আমার।’ আর এই গাঁধা!”
হৃদের কান মলে ধরল। হৃদ ‘আউচ’ শব্দ করে উঠল।
সাঁঝ মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে।
আফিয়া আহমেদ আবার বলল, “এই গাঁধাটাকে ক’বছর ধরে বলছি বিয়ে করতে। কম মেয়ে তো দেখিনি। সে কি না বিয়েই করবে না।”
সাঁঝ এবার বলে উঠল, “এখনি বিয়ে! ওনার বয়সও তো মনে হয় না খুব একটা হয়েছে।”
আফিয়া আহমেদ হেসে বলল, “আসলে আমিও বুঝতে পারছি না, এটা বুড়ো হচ্ছে না কি দিন দিন জোয়ান হচ্ছে! বয়স ক’দিন পর আটাশ শেষ হবে।”
সাঁঝের চোখ কপালে। হৃদকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। হৃদ বলে উঠল, “আমাকে নিয়ে কথা না বললেই নয়?”
হৃদ, সাঁঝের চোখে চোখ রেখে আফিয়া আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বলেছিলাম তো, মেয়ে পছন্দ হলে বিয়ে করব।”
আফিয়া আহমেদ বলল, “হ্যাঁ, ছোটোটাকেই আগে বিয়ে দিতে হবে।”
হৃদ হেসে আফিয়া আহমেদকে বলল, “অচিরেই তোমার বড়ো ছেলের বউ পেয়ে যাবে।”
হৃদ সেখান থেকে প্রস্থান করল। সাঁঝ, আফিয়া আহমেদকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিসিয়ে বলল, “খুব শীঘ্রই ছেলের বউ পাবে, আন্টি। ”
আফিয়া আহমেদ সাঁঝের দিকে তাকাতেই সাঁঝ বলল, “তিন তিনটা মেয়ের সাথে প্রেম করে তোমার ছেলে।”
“বলো কী?”
______________
ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ, সাথে তার ফোন। এই ক’দিনে “অসুখ” যেন তার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। তবে আগের মতো এই নম্বর থেকে মেসেজ এলে অসুস্থ হয়ে যায় না, অদ্ভুত রকমের সুখ সুখ লাগে তার।
প্রতিদিন হাতে গোনা কয়েকটা মেসেজ আসে ঐ নম্বর থেকে। এই সময়টাতে বেশি এসে থাকে। তখনকার অনুভূতির সাথে এই বৃষ্টি-বৃষ্টি আবহাওয়া দারুণ এক অনুভূতির সৃষ্টি করে, সাঁঝের ভীষণ ভালো লাগে সে অনুভূতিটা। তাই তো এখানে দাঁড়িয়ে মেসেজ ওপেন করল।
“বাতাসে আজ প্রেম প্রেম ভাব, ঠিক সেদিনকার মতো। পার্থক্য এটুকুই, সেদিন তুমি আমার হৃৎপিণ্ড চুরি করেছিলে, আর আজ আমি তোমার।”
সাঁঝের এই কথাটা চেনা চেনা লাগল। মাথা খাটাল না তবে।
আজ সাঁঝের কী যেন হলো। কল দিল ঐ নম্বরে। রিং হতে হতে কেটে গেল।
আবারও কল দিল।
মায়ের সামনে ছিল হৃদ। সেখান থেকে নিজের রুমের বারান্দায় গেল। কল রিসিভ করল। দু’পাশ থেকে গভীর নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, কেউ কথা বলছে না।
সাঁঝ মুচকি হাসল। সেটা হৃদ অনুভব করে নিজেও হাসল।
সাঁঝ কথোপকথন শুরু করল, “মি. অসুখ!”
হৃদ আলতো হেসে বলল, “হুম।”
সাঁঝ আরও বলল, “সহজে অসুখ বাঁধে না আমার, জানেন?”
হৃদ জানে না, তাই চুপ থাকল।
সাঁঝ পুনরায় বলল, “আমার জীবনে আপনি আসার পর থেকে আমি বার বার অসুস্থ হয়েছি। বুকের বা পাশের হৃৎপিণ্ড নামক এই যন্ত্রটাকে জোরালো ভাবে অনুভব করেছি।”
হৃদ সাঁঝের কথাগুলো ফোনের ওপাশ ব্যাতীত আরও কোথাও থেকে শুনতে পাচ্ছে। বারান্দায় গ্রিল না থাকায় হৃদ মাথাটা বের করে উপরে তাকাল। সেখানে রেলিংয়ের উপর হাত রেখে সাঁঝকে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখল।
হৃদ মাথা সরিয়ে ভেতরে নিয়ে এলো। সাঁঝকে ডাকল, “সন্ধ্যাবতী!”
সাঁঝ হালকা কেঁপে উঠল, সাথে হাসির রেখা ঠোঁট ছুঁয়ে গেল। হৃদ বারান্দা থেকে রুমে প্রবেশ করে বলল, “চোখ বন্ধ করে আছো কেন? আমাকে আরও প্রখরভাবে অনুভব করার জন্য?”
সাঁঝ এই নেশালো আওয়াজে হারিয়ে যাবে। বড্ড প্রেম আসছে এই আওয়াজের প্রতি, আওয়াজদাতার প্রতি।
হঠাৎ সাঁঝ বুঝতে পারল ওপাশের কথাটা। ফট করে চোখ মেলল।
এদিক-সেদিক চোখ বুলিয়ে নিল তার চমকিত দৃষ্টিতে।
হৃদ বুঝতে পেরে বলল, “কাকে খুঁজছ?”
সাঁঝ বিস্মিত কন্ঠে বলল, “আপনাকে।”
হৃদ হালকা কন্ঠে বলল, “তোমার বুকের বা পাশে আমার অবস্থান। বাহিরে না খুঁজে, ভেতরটা খুঁজে দ্যাখো, পেয়ে যাবে।”
সাঁঝ শান্ত হলো, তবে এবিষয়ে তার ভাবনা গেল না।
তাদের কথোপকথন চলল অনেকটা সময়। সাঁঝ হৃদের আওয়াজ চিনতে পারেনি। ভয়েস কলে প্রায় সবারই আওয়াজের তারতম্য ঘটে থাকে, তাই সেভাবে খেয়াল করেনি। তবে বচন ভঙ্গির সাথে কারো মিল পেয়েছে। কার মিল পেয়েছে, সেটাও বোঝেনি।
________________
আজ উপমা গেস্ট রুমে শুয়েছিল। তার মতে, এখানে অর্ণবের শরীরের ঘ্রাণ মিশে আছে, শান্তিতে ঘুমোতে পারবে।
ফোনের বাজখাঁই আওয়াজে ঘুমন্ত উপমার ঘুম ছুটে গেল। তার এখন প্রচন্ড ইচ্ছে হচ্ছে, এই সকালে যে কল দিয়েছে তাকে তুলে বুড়িগঙ্গায় চুবিয়ে ধরতে। উপমা বিরক্তি নিয়ে বিছানা হাতড়িয়ে বালিশের কাছ থেকে ফোন তুলে কানে নিল।
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, “কে ভাই?”
অর্ণব গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমি তোমার ভাই লাগি?”
উপমা আওয়াজ চিনতে পেরেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে তড়িঘড়ি করে বলল, “ইয়ে স্যরি স্যার, থুক্কু জামাই।”
আবারও জামাই বলল! অর্ণব শব্দ করে হেসে উঠল। অনেকটা শান্ত কণ্ঠে বলল, “শুভ সকাল ম্যাম।”
উপমা হালকা আওয়াজে বলল, “শুভ সকাল।”
“তোমার এই ভয়েসটা শোনার জন্যই এত সকালে কল দিয়েছি। অনেক অনেক অনেক বেশি মিষ্টি লাগে।”
উপমা খানিকটা হাসল। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সাতটা বাজে। অর্ণবকে জিজ্ঞাসা করল, “অফিসে যাবে না?”
অর্ণব বলল, “অফ ডে-তেও অফিসে পাঠাবা আমাকে?”
উপমা জিহ্বাতে কামড় দিয়ে বলল, “মাত্র ঘুম ভাঙল তো এই জন্যই সব ভুলে গেছি।”
অর্ণব একটা শ্বাস ফেলে বলল, “একটা নিউজ দেওয়ার ছিল। ভালো কি মন্দ সেটা তুমিই বলতে পারবা।”
“কী?”
“আম্মু-আব্বু আমাকে বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছে।”
উপমা এটাকে ভালো খবর হিসেবেই নিল। অনেক বেশি খুশি হয়েই বলল, “ইয়ে! বউ সাজব!”
______________________
সকালে খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই সাঁঝ হৃদের বাসার সামনে হাজির। কলিং বেলে হাত রাখতেই হৃদ দরজা খুলে ফেলল। তাতে সাঁঝের কী? সে-তো প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে।
হৃদ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, “কাকে চাই?”
সাঁঝ শয়তানি হাসি দিয়ে বলল, “আপনাকে চাই না; আপাতত আন্টিকে পেলেই হবে।”
হৃদ সাঁঝের ভাব-ভঙ্গি বোঝার চেষ্টায় আছে। তৎক্ষনাৎ সাঁঝ বলে উঠল, “এত শিক্ষিত হয়ে কী লাভ? যেখানে ভদ্রতার 'ভ'-ও জানেন না!
“মানে?”
“সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, ভদ্রতার খাতিরে একবার ভেতরে যেতেও বললেন না।”
হৃদ ‘হা’ হয়ে তাকিয়ে রইল। সাঁঝ তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।
ড্রয়িং রুমে আফিয়া আহমেদ ও রায়হান আহমেদ বসে চা পান করছিলেন। সাঁঝকে সেখানে আসতে দেখেই ওনারা সাঁঝের দিকে তাকালেন। সাঁঝ মিহি হেসে সালাম দিয়ে বলল, “আঙ্কেল-আন্টি, কেমন আছো?”
ওনারা সালামের জবাব দিয়ে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুমি কেমন আছো?”
“ভীষণ ভালো।”
এতক্ষণে সোফায় বসে থাকা আরও একটি ছেলের দিকে সাঁঝের চোখ পড়ল। সাঁঝ ছেলেটিকে চিনতে পারল না। ছেলেটি মাথা চুলকিয়ে হালকা হাসল।
রায়হান সাহেব বিষয়টা বুঝতে পেরে বলে উঠলেন, “ও হচ্ছে আমার ছেলে উদয়, অনয়ের ছোটো ভাই।
‘অনয়’ নামটি শুনেই সাঁঝ চমকে উঠল। খানিকটা জোরে বলে উঠল, “ অনয়!”
রায়হান সাহেব হেসে বললেন, “ হ্যাঁ, ডক্টর অনয় আহমেদ। এই তো তোমার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে।”
সাঁঝ পিছনে ফিরে হৃদের দিকে তাকাল। সাঁঝের এমন অদ্ভুত চাহনি দেখে হৃদ কেশে উঠল।
.
.
.
চলবে.....................................