প্রেমাসুখ - পর্ব ১৫ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


“আপনি না হৃৎপিণ্ডের ডাক্তার!তবে বলুন, কেন এখানে যন্ত্রণা হলো?”

হৃদ অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। তার সন্ধাবতী জেলাস! এটা তো তবে প্রথম অভিমান ছিল, প্রথম অভিযোগ করল, অধিকার দেখাল। হৃদ হতবিহ্বলের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। 
তার এই জীবনে অনেক মানুষের প্রেম দেখেছে। কীভাবে শুরু হলো –সবটা দেখেছে। কিন্তু, নিজের বেলায় যে এতটা ব্যাতিক্রম হবে, বোঝেনি।
ঝগড়া করে প্রেম! অন্যের সাথে কেন ঝগড়া করল, এজন্য জেলাসি! পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বোধহয় এই নারী জাতিই।

“বলুন না, ডাক্তার সাহেব!”

সাঁঝের ডাকে সে সম্বিত ফিরে পেল। কিন্তু এক্সপ্রেশন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। কী এক্সপ্রেস করবে?

খানিকক্ষণ বাদে বলে উঠল, “ফিলিংসটা কেমন?”

সাঁঝ বুঝল সে হৃদের অনেকটা কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দু’কদম পিছু হটল। হৃদ এতে করে হেসে দিল।

হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “হার্টের ফিলিংসটা কেমন ছিল?”

সাঁঝ বোঝার চেষ্টা করে বলল, “উম... অদ্ভুত ছিল।”

“কেমন অদ্ভুত? ”

“ভীষণ অদ্ভুত। অদ্ভুতের চেয়েও অদ্ভুত। ”

হৃদ দু’কদম এগিয়ে সাঁঝের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “দুনিয়াতে অনেক অদ্ভুত কিছু আছে। এর উপরের দিকে আছে মেয়ে মানুষ। তার চেয়েও বেশি অদ্ভুত, অদ্ভুতের চেয়েও অদ্ভুত হচ্ছে ‘প্রেম‘। প্রেমে পড়ে গেলেন না তো আবার?”

এমন ফিসফিসানো কথাতে সাঁঝের হৃদযন্ত্র থেমে গিয়েছে। হৃদ আলতো হেসে প্রস্থান করল। সাঁঝও চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। অন্যদিকের খেয়ালে নেই সে, তাই আফিয়া আহমেদকে না বলেই চলে গেল।

_______________________

অর্ণব একের পর এক ফোন দিচ্ছে। উপমা একদম রিসিভ করছে না। বুঝতেই পারছে না, কোন মুখে কী বলবে।
বুক ফেটে চিৎকার আসছে তার। কিন্তু অশ্রু গড়াচ্ছে না।

তখন সেখানে সাঁঝ এলো। তার মুখেও হাসি নেই। রুমে প্রবেশ করে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। তার চিন্তায় মাথা গরম হয়ে আছে। আগে তা ঠান্ডা করতে হবে।

আবারও অর্ণবের কল এলো। উপমা না চাইতেও এবার রিসিভ করল।

ওপাশ থেকে অর্ণব অনেক খুশি মনে বলে উঠল, “ভালোবাসি, মহারাণী।”

উপমার এই কথাটা কানে গেল না। নিজ ভঙ্গিতে বলল, “পালিয়ে যাই, চলো।”

অর্ণব ভ্রু-কুঁচকে সজোরে বলে উঠল, “মানে!”

_________________

পরদিন দুপুরের খাওয়ার সময় মনোয়ারা বেগম বিয়ে সম্পর্কিত কথা-বার্তা বলছে, উপমা শুধু শুনছে; যেন সে পাথর বনে গিয়েছে। আর সাঁঝ! সে তো খাচ্ছেই না। আঙুল দিয়ে খাবার নাড়ছে। নিজের এমন অনুভূতির সাথে সে একেবারেই অপরিচিত।
সেই ‘অসুখ’ নামের লোকটার প্রতি দূর্বল সে। তার প্রতি প্রেম-প্রেম অনুভূতি জাগে, এত প্রেম এই ত্রি-ভুবনে কারো প্রতি আসে না। আবার হৃদ! তাকে দেখলে নিজের কী যে হয়, সে বুঝতেই পারে না। তার সাথে ঝগড়া করতে পারলে শান্তি লাগে; অথচ সে অন্য কারো সাথে ওভাবে ঝগড়া করলে হিংসে হয়, গা জ্বলে যায়। কেন এরকম হয়!
তার মনে পড়ে গেল, সেই বর্ষণ মুখর সন্ধার কথা! হৃদের সেই ভয়ঙ্কর চাহনি!
মাঝে মাঝে সে ‘অসুখ’ ও ‘হৃদ’- এর প্রতি অনুভূতিগুলো গুলিয়ে ফেলে। সাঁঝ ভাবল, “যেভাবে আমায় ভার্চ্যুয়াল জামাই ও ডাক্তার সাহেব একই মানুষ বেরোলো, সেভাবে যদি আরও একটা কো-ইনসিডেন্ট হতো! ডাক্তার সাহেবই যদি আমার হৃদয় হরণকারী অসুখ হতো!”

মনোয়ারা বেগম সাঁঝ ও উপমার বেখেয়ালী ভাব দেখে জিজ্ঞেস করে উঠল, “কী ব্যাপার? খাচ্ছ না কেন তোমরা?”

সাঁঝ ও উপমা, দুজনেই চকিতে চাইল মনোয়ারা বেগমের পানে। তাদের চমকিত চাহনি দেখে মনোয়ারা বেগম ভ্রু-কুঁচকে ফেলল।

সাঁঝ মেকি হেসে বলল, “কিছু না তো, ফুপ্পি।”

“তা খাচ্ছ না কেন?”

“আসলে, পেট ভরে গেছে তো!”

মনোয়ারা বেগম এবার উপমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই খাচ্ছিস না কেন?”

উপমা টেবিল ছেড়ে উঠে বলল, “খিদে নেই।”

এরপর মনোয়ারা বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
এদের লক্ষণসব গভীর নয়নে পর্যবেক্ষণ করল মনোয়ারা বেগম। এই বয়স সে অনেক আগে পার করে এসেছে।

_____________________

সন্ধার দিকে উপমা মন খারাপ করে গেস্ট রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মাথা কাজ করছে না তার। প্রচন্ড ভাবনা তার এই ছোট্ট মস্তিষ্কে জেঁকে বসেছে। কী করবে এবার সে। ভালোবাসে অর্ণবকে। ভালোবাসার উপলব্ধির আগে থেকেই ভালোবাসে। এই তো! মাস্টার্স পড়ুয়া অর্ণব, দশম শ্রেণির উপমাকে বলল, “পিচ্চি, তোমাকে ছাড়া নিজেকে খালি খালি লাগে কেন আমার? কী করেছ আমাকে তুমি?”

সেদিন প্রথম উপমা, অর্ণবের চোখে নিজের জন্য অগাধ ভালোবাসা দেখেছিল। আর নিজেও বলেছিল, “তোমাকে ছাড়া আমারও খালি খালি লাগে, হাওলাদার সাহেব!”

বড্ড আহ্লাদি ছিল সেই ডাকটা। বয়স ছিল তখন সবে ষোল। কবি বলেছেন, “এই বয়সেই মেয়েরা আবেগে গা ভাসায়।” প্রেম-ভালোবাসার উপলব্ধি তো এই বয়স থেকেই আসে।

সেই থেকে শুরু হয় উপমা ও অর্ণবের প্রণয়। মাধ্যমিক শেষে, সেই বিশাল ছুটিতে, উপমা চলে আসে মামাবাড়ি। উপমার সাথে তখনই অদিতির বন্ধুত্ব আরও প্রগাঢ় হয়। প্রায়শই সেও এ বাড়িতে চলে আসত। আর, অর্ণবের প্রতি অদিতিরও মন লেগে যায়। কী আর করবে? সব বয়সের দোষ। 

এসব জানত না উপমা। দু’দিন আগেই সাঁঝ বলেছে তাকে। উপমার কিচ্ছুটি ভালো লাগছে না। সবকিছু বিষাক্ত লাগছে। চোখ দু’টো কাঁটা কাঁটা লাগছে; যেন ঘুমোয় না কতকাল হলো! হুট করে পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সেদিকে তাকাল।

অর্ণব মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উপমা পাত্তা দিল না। মনে মনে অর্ণবকে মস্তিষ্কের ভ্রম মনে করে আবারও আকাশপানে তাকাল।

অর্ণব জিজ্ঞেস করল, “মন খারাপ?”

অর্ণবের আওয়াজ শুনে উপমা চকিতে চাইল তার পানে। পরিষ্কার শুনেছে অর্ণবের আওয়াজ। এটা মনের ভ্রম হতেই পারে না।

অর্ণব আবারও বলল, “ভেবেছিলাম এই কথাটা শুনে খুশি হবে, কিন্তু মহারাণীর দুঃখ বোধহয় ভীষণ প্রিয়।”

উপমা অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে তাকাল। বুক ফেঁটে কান্না আসছে তার। সে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর প্রয়াস চালিয়ে বলল, “এটা খুশির খবর ছিল অর্ণব?”

অর্ণব এবার সিরিয়াস হলো। উপমা সাধারণত তাকে নাম ধরে ডাকে না। যখন ডাকে, বুঝে নিতে হবে সে ভীষণ সিরিয়াস। তবুও অর্ণব উপমার মন খারাপের কারণ বুঝতে পারছে না। তবে কি উপমা এখন বিয়ে করতে অনিচ্ছুক!

মুখের আদলে প্রশ্নের ছাপ রেখে বলে উঠল, “তুমি না বউ সাজতে চেয়েছিলে?”

উপমা কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি তো তোমার জন্য বউ সাজতে চেয়েছিলাম। অন্য কাউকে কল্পনাও করতে পারি না।”

অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু বোঝার প্রয়াস চালাল। অতঃপর তার চেহারাতে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ পাওয়া গেল। শ্যামলা মুখশ্রী লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। কান দিয়ে তার ধোঁয়া বেরোচ্ছে। অনেকটা জোরে বলে উঠল, “তো, তোমাকে কি পাশের বাড়ির আবুলের সাথে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, স্টুপিড!”

কিছুক্ষণ থেমে আবারও বলে উঠল, “নিম্ন লেভেলের স্টুপিড একটা!”

____________________

প্রায় সপ্তাহে একবার অর্ণব এ বাড়িতে আসে আজকাল। বোনের অজুহাতেই আসে। আজ সাঁঝ জানতে পারল, উপমার সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে আর কেউই না, অর্ণব। নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরালো করতেই আরিফ সাহেব তার বোনকে ওমন প্রস্তাব দেন।

এরপর সাঁঝের মনে পড়ে যায় অদিতির কথা, এসব শুনলে যদি উপমার সাথে ওর সম্পর্ক নষ্ট হয়! সে বিষয়ে কথা বলার জন্য উপমাকে খুঁজতে গেস্ট রুমে যেতেই অর্ণব আর উপমার কথপোকথন শুনতে পায়। এরপর যা বোঝার, বুঝে নেয়। এতকালের পাওয়া সবগুলো ক্লু এক সুতোয় বেঁধে সে সবটা জেনে, লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর কী-ই বা করার আছে!

রাত বারোটার উপরে বাজে। আজ উপমা শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। কী চিন্তাই না করেছিল। 

রাগে কিছুক্ষণ চিল্লিয়ে অর্ণব বলেছিল, “আরে পাগলি মেয়ে! বিয়েটা আমার সাথেই হচ্ছে।”

উপমা তখন বাচ্চাদের মতো কেঁদে কেঁদে বলেছিল, “পাওয়ার আগেই বিচ্ছেদ যন্ত্রণা সহ্য করলাম। এতো ভয়ংকর কেন হয় বলতে পারো?”

অর্ণব তখন তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিল, “কিছু শুনতে পাচ্ছ? হৃৎস্পন্দন! তোমার নামে বেজে চলেছে এটা।”

কিছুটা থেমে আবারও বলেছে, “এই যে বুকে টেনে নিলাম, ঠিক এভাবেই তোমাকে বুকের বা পাশে আগলে রাখব। আই প্রমিস, এই কান্নাই তোমার জীবনের শেষ কান্না হবে। এরপর না হয়, আমি মারা গেলে কেঁদো। ” 

ঘুমের মধ্যেও সেই মূহূর্তটা অনুভব করে উপমা হেসে উঠল।

তবে সাঁঝের চোখে ঘুম নেই। সে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে অজ্ঞাত। হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে কেঁপে উঠল। হাতে নিয়ে দেখল, অসুখ! চোখ দু’টো বন্ধ করে বলে উঠল, “কী জ্বালায় পড়লাম!”

হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। খুব সম্ভবত, ওভাবে কাঁদলেই শান্তি পেত।
ফোন রিসিভ করে কানে তুলল। ওপাশ থেকে হৃদ ধীর কন্ঠে বলে উঠল, “সন্ধাবতী!”

সাঁঝ কেঁপে ওঠে দু’চোখ বন্ধ করে নিল। এ আওয়াজেও ঘোর লাগা টাইপের একটা ব্যাপার আছে।
হৃদ পাতলা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। বাইরে বৃষ্টি। প্রকৃতি ঠান্ডা। শুয়ে থাকলেও এ মূহূর্তে হৃদ কিংবা সাঁঝ, করোরই অক্ষি পল্লবে ঘুম নেই। তারা তো অন্যরকম। এ সময়টা তাদের কাছে ঘুম হারাম করা সময় মনে হয়।

দু’জনেই ওঠে বারান্দায় চলে গেল।

সাঁঝ জিজ্ঞেস করল, “ঘুমোননি?”

হৃদ বাইরে হাত রেখে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে বলল, “বৃষ্টির এই সময়টাকে প্রেয়সী ঘুমের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। এই সময়ে শুধু একটা কাজেরই কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।”

“কী?”

“প্রেম!”

“ছিঃ!”

হৃদ হেসে উঠল। সাঁঝ অবাক হয়ে সে হাসি অনুভব করল। এই পুরুষের হাসিটা তার জান নিয়ে নেবে।

এসব ভাবতে ভাবতেই হৃদ আবারও বলে উঠল, “বারান্দায় আছো?”

“আপনি কী করে জানলেন?”

“জানি না, প্রশ্ন করেছি।”

“ওহ্! হুম, বারান্দায়ই আছি।”

“তবে হাত দু’টো বাড়িয়ে দাও।”

“কেন?”

“বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার সাথে আমার আগমন ঘটবে। যদি চাও, আমি আসি তোমার আঙিনায়; তবে দাও, হাত বাড়িয়ে দাও। ”

সাঁঝ ফোনটা কাঁধের সাথে কানে বাঁধিয়ে দু’টো হাত বাড়িয়ে দিল। চোখ দু’টোও বন্ধ করে নিল। হৃদ তার বারান্দার পাশে লাগানো শিউলিগাছ থেকে কিছু ফুল ছিঁড়ে নিচে ছুঁড়ে দিল। বৃষ্টির ছিটের সাথে মাত্র তিনটা ফুল সাঁঝের হাতে পড়ল, বাকিগুলো মাটি স্পর্শ করল। হৃদ ভেতরের দিকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, “বর্ষণের শুভেচ্ছা আমার হৃদয়হরণকারীকে।”

সাঁঝ অবাক পানে নিজের হাতের ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।
.
.
.
চলবে...................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন