প্রেমাসুখ - পর্ব ১৮ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


নির্বাক হয়ে বসে আছে সাঁঝ। চিঠিটা তার মন মতো হয়নি। ফুঁস করে একটা শ্বাস ফেলে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলল। অর্ণব উপমাকে নিয়ে কোচিং-এর উদ্দেশ্য চলে গিয়েছে। 
সাঁঝের ভীষণ একা একা লাগছে, সবকিছু থাকার পরেও কিছু একটার অপূর্নতা তার অন্তরআত্মা কাঁপিয়ে তুলছে। চারিদিকে সবকিছু তার কাছে অসহনীয় লাগছে।
এই মূহূর্তে সে চিঠি লিখতেই পারবে, খুব গুছিয়েই লিখতে পারবে; তবে তা কেবল বেদনা মিশ্রিত এক যন্ত্রণাচ্ছন্ন কাগজের টুকরো হবে। সেই কাগজের প্রতিটি শব্দে বিষ থাকবে। যে পড়বে, তারই দুঃখ-মরণ হবে। তাই সাঁঝ অপেক্ষা করল তার মন ভালো হওয়ার।
কিন্তু অস্থির, চিন্তিত সাঁঝ তখনই শান্ত হবে; যখন সে অসুখের সান্নিধ্য লাভ করবে। ব্যপারটা কেমন অদ্ভুত, তাই না?

 সাঁঝ বারান্দায় বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল। সময় অতিবাহিত হয়েছে, ছায়ার আকৃতি ও দিক উভয়ই পরিবর্তিত হয়েছে; শুধু পরিবর্তন ঘটেনি সাঁঝের মনের আঁধারের।
ফট করে বারান্দায় দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। প্রকৃতি এই গোধুলি লগ্নে, নতুন বউ রুপে সজ্জিত হয়েছে। 
সাঁঝ বড়ো বড়ো পা ফেলে রুম ত্যাগ করল।

বসার ঘর ত্যাগ করার সময় মনোয়ারা বেগম সাঁঝকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, “কোথায় যাচ্ছ?”

সাঁঝের এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবুও বলল, “গরম লাগছে ভীষণ, ছাঁদে থেকে হাওয়া খেয়ে আসি, ফুপ্পি।”

“আচ্ছা যাও।”

ছাঁদে প্রবেশের আগে তিন তলায় পা থামিয়েছিল সাঁঝ। দেখল, দরজা লাগানো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদে চলে এলো।

ছাদটা বিশাল। চারিপাশ সমান। সাঁঝ একপাশ থেকে অপরপাশ পাইচারি করা শুরু করল।

মেয়ে! মেয়ে মানুষ স্বভাবতই অস্থির প্রকৃতির হয়ে থাকে। তবে সাঁঝের মধ্যে এ অস্থিরতার রেশ কয়েকগুণ অধিক লক্ষ করা যায়। 
যদি কোনো কবি সাঁঝকে এই অবস্থায় দেখে ফেলত; তবে অবশ্যই তাকে নিয়ে একটা অদ্ভুত রকমের কবিতার সৃষ্টি করে ফেলত।
সেখানে সাঁঝের নামের পরিবর্তে লিখত, ‘শ্যামচঞ্চলা নন্দীনী’।

সাঁঝ শান্ত না হলেও অশান্ত মনটাকে খানিকটা কাবু করে ফেলেছে। 
ছাদ থেকে প্রস্থান করে সোজা উপমার রুমে চলে গেল। 
সাদা একটা কাগজ নিয়ে নীল কলম দিয়ে লেখা শুরু করল,

“অপ্রিয় অসুখ,
বড্ড পরিচিত এক নামে সম্বোধন করলাম আপনাকে। ঠিক আপনি যেভাবে বলেছিলেন, ‘প্রেমাসুখ’। সেভাবেই বাহ্যিকতা দেখে মনে হচ্ছে, আপনাকে আমি আমার অপছন্দের মানুষ হিসেবে সম্বোধন করছি। একটু ভেতরটা ঝেঁকে দেখুন, এই অ'প্রিয় হচ্ছে অধিকতর প্রিয়।
আর কি বলব? সব কথা বলতে হবে? অনেকটা আমি বলে দিয়েছি। খানিকটা না হয় আপনি বুঝে নিন।
আপনার প্রতি অনূভুতিগুলো মোটেও প্রেম নয়। প্রেমে আমি এর আগেও পড়েছি। তবে এটা ভিন্ন। গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন আমিটা খুঁজে নিলাম এই অনুভুতির নাম। গোপন থাকুক সে নাম। জানবে আমার হৃৎপিণ্ড, অনুভব করবেন আপনি। প্রেমে পড়লে, মানুষের বুদ্ধি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আমার!
আমার বুদ্ধি-সুদ্ধি দিনকে দিন লোপ পাচ্ছে। কখন কী করছি, নিজেও বুঝতে পারছি না। তবে এটা বুঝতে পেরেছি, আমার মনে অসুখ করেছে। এসব আমার অসুস্থ মনটার কারবার নয়তো আর কী?
অসুখ! শুনেছেন কখনও? কেউ অসুখের খোঁজে মরিয়া হয়! আমি হই। আমার প্রতিটি বিনিদ্র রজনী আপনার খেয়ালে ডুবে কাটে। আর দিন! প্রতিটি দিবস আমার, একটি নির্দিষ্ট ডাক্তারের খোঁজে কাটে। সে ডাক্তার এক অন্যরকম জাদু জানে, তার পাশে থাকলে আপনাকে মনে পড়ে না।
যদি এমন হতো, দু'জনের যে-কোনো একজনের প্রতি এই অনুভূতিটা আসত, তবে আমি চোখ বুঁজে ধরে নিতাম, ‘সাঁঝবালিকা, ইউ আর ইন লাভ!’ কিন্তু এই একই ধরনের অনুভূতি দুজনের প্রতি কেন আসবে?
আমি পাগল হয়ে গিয়েছি, অসুখ। পাগল হয়ে গিয়েছি।
আপনাকে আজ একটা গল্প বলি। গল্পটা এক ষোড়শী বালিকার। বড্ড শান্ত ছিল সে বালিকা। চঞ্চলতার ছিটেফোঁটাও তার মধ্যে ছিল না। সে চুপ থাকতে ভালোবাসত। নিঃস্তব্ধতা তার অধিক প্রিয় ছিল। অত্যন্ত মেধাবীও ছিল। পড়াশোনায় শুরু থেকেই ভীষণ ভালো ছিল। প্রতি বছর নিজ শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করত। তার স্বভাব-ব্যবহারের জন্য এলাকায় সবাই তাকে অন্য রকম স্নেহ করত। বাবা মায়ের গর্ব ছিল সে। মেয়েটার কিছু অদ্ভুত রকমের সাধ ছিল। রাত্রি উপভোগ করাটা তার মধ্যে অন্যতম। এছাড়া ভোরে, মানুষের জাগ্রত হওয়ার পূর্ব মূহূর্তে, সে নিজ এলাকায় একটা চক্কর কেটে আসত, খালি পায়ে, আটপৌরে করে শাড়ি পরে।
অদ্ভুত না? যেই জেনারেশনের বাচ্চা-কিশোর সব ফোনের উপর থাকে, সেই জেনারেশনে এসে মেয়েটি প্রকৃতিবিলাসে সুখ পেত। দিন এভাবেই চলছিল।
তবে ভাগ্য বোধহয় মেয়েটির এমন শান্ত ভাব মেনে নিতে চাচ্ছিল না।
একদিন অনার্স পড়ুয়া এক ছেলে তাকে প্রেমপত্র দেয়। এই যুগে এসে কেউ চিঠি দেয় না কি? মেয়েটার কাছে অদ্ভুত লাগল। তাই সেও ফিরতি চিঠি দিল। তারপর সেই ছেলেটি আবারও দিল। এরূপ কার্যক্রম অব্যহত থাকল কয়েক মাস। মেয়েটি দূর্বল হতে লাগল সেই ছেলেটির প্রতি। তারপর তারা দেখা করল। হাতে হাত ধরে গ্রাম্য রাস্তায় হেঁটে বেড়াল। এগুলো অবশ্য সেই ছেলেটির বায়না ছিল। মেয়েটি না করতে পারেনি।
ধীরে ধীরে সে, সেই ছেলেটির প্রেমে পড়ে যায়। লেখাপড়ার অনিষ্ট ঘটতে থাকে। বাড়ির সবচেয়ে আদুরে আহ্লাদী মেয়েটা অন্যমনস্ক হয়ে থাকে।
একদিন আবারও ভাগ্য সব পাল্টে দিল। ছেলেটা বখাটে নেশাখোর হয়ে বের হলো। মেয়েটাকে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করতে বলল। মেয়েটা সবটা বুঝতে পেরেই সেই সম্পর্কের ইতি টানল। অপ্রাপ্ত বয়সে কারো প্রেমে পড়া ঠিক কতটা বিপজ্জনক, তা হাড়ে হাড়ে টের পেল।
মেয়েটি ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগল। আগে যেটাকে প্রেমে পড়া মনে করেছিল, তা নিছকই মনের একটা ভুল ছিল। মোহ বললেও ভুল হবে না। আগের মতো আহ্লাদ আর এখন করে না সে। মেয়েটির পরিবর্তন ঘটল। মাধ্যমিকের ফলাফল আশানুরূপ পায়নি। পাবে কী করে? অনিষ্ট তো ঘটেছে আরও কয়েক মাস আগে। 
তারপর! তারপর মেয়েটি পাল্টে গেল। আগে কেউ তার সাথে ঝগড়া করত না। করবে কী করে? যেখানে অপর পক্ষ থেকে লড়ার মতো কেউই নেই। সেখানে ঝগড়া করত কার সাথে? কিন্তু এখন! কেউ তাকে এক কথা শোনালে সে তাকে দুই কথা শুনিয়ে দেয়। সে আর আগের মতো দূর্বল নেই। তার ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটেছে আকাশছোঁয়া। 
সে বালিকা অষ্টাদশে পা ফেলল। হুট করে আবারও দূর্বল হয়ে গেল। সে জানে, ভাগ্য এবারও কিছু একটা উলোট-পালোট করে দেবে। হয়তো তাকে সুখ-মৃত্যু দিয়ে জীবন-যুদ্ধে জিতিয়ে দেবে; কিংবা অসুখে জর্জরিত আমরণ এক প্রেম সাধের তৃপ্তি দেবে।
অ'প্রিয় অসুখ, সেই বালিকা আপনারই সন্ধ্যাবতী।
ইতি
সন্ধ্যাবতী”

লেখা শেষে সাঁঝ থম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইল। পূনরায় সম্পূর্ণ চিঠিতে চোখ বুলিয়ে নিল। এ কী করল সে? বিষাদ কাহিনি লিখে ফেলল!
এদিক-সেদিক তাকাল। চিঠিটা ভাজ করে এক বইয়ের মাঝে রেখে দিল। পরে ফেলে দেওয়া যাবে।
সাঁঝ দ্রুত অস্থির পায়ে উঠে দাঁড়াল। ফ্যান ফুল স্পিডে দিয়ে লাইট অফ করে ফেলল।
আবারও বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।
সাঁঝ সেই ঘটনার রেশ তার বর্তমান জীবনে পড়তে দিতে চায়নি, ভুলেই গিয়েছিল। সেজন্যই তো অসুখকে মনে লেগেছিল। কিন্তু অতীত! অতীত বলে, “আমাকে ভুলে যাবে? আমি প্রতি পদে পদে তোমার সামনে আসব।”
সাঁঝের বেলায়ও তাই হয়েছে।

_______________

“জানো, সন্ধ্যের ঢাকা শহর কত সুন্দর?”

“হুম জানি।”

উপমা কপাল কুঁচকে বলল, “কী করে?”

অর্ণব মিহি হেসে বলল, “তুমিই বলেছিলে।”

“ওহ! হ্যাঁ, মনে পড়েছে।”

“নিজের শহরের সুনাম করার সুযোগ পেলে তো ছাড়ো না।”

কথাটা খুবই আস্তে বলেছে অর্ণব। উপমা জিজ্ঞেস করল, “কিছু বললে?”

“বলছিলাম, চলো রিক্সা নিয়ে ঘুরি।”

উপমা খুশি মনে বলল, “দারুণ হবে।”

উপমার হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখে অর্ণবও হেসে রিক্সা ডাকল।

আজ এই শহরের অলিতে-গলিতে প্রেম ছড়াবে তারা। উপমা অর্ণবের কাঁধে মাথা রাখল। মনে মনে বলে উঠল, “ইশ! এখানে কী শান্তি!”

তারা ভুলে গিয়েছে এই পৃথিবীতে দু'জন ভালোবাসার মানুষ নিজেদের ভালোবাসা পেয়ে গেলে, দূর থেকে কেউ একজন না পাওয়ার যন্ত্রণায় মরে। মনে রেখেই বা তাদের কাজ কী?

পরম সুখে উপমা বলে উঠল, “ভালবাসি, হাওলাদার সাহেব।”

অর্ণব আলতো হেসে বলল, “হুম, জানি, ভালোবাসেন।”

উপমা ফট করে মাথা তুলে অর্ণবের দিকে তাকাল। তেজি কন্ঠে বলল, “এটা কী হলো?”

“কোনটা?”

“এই যে ভালোবাসি'র জবাব।”

অর্ণব বাইরের রাস্তায় অবলোকন করে হেসে বলল, “শুনতে চাও?”

“অবশ্যই।”

অর্ণব হাসি বন্ধ করল। উপমার মুখোমুখি হয়ে চোখ দুটোর মাঝে দৃষ্টি স্থির করল। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বড্ড অদ্ভুত স্বরে বলল, “ভালোবাসি, জান।”

এদিকে উপমা! এভাবে বলার পর উপমা হারিয়ে গেল। খুব করে অর্ণবকে বকে বলতে ইচ্ছে করল, “এভাবে বলতে নেই। বুকে ঝড় নামে।” 
কিন্তু কথা বলতেই পারল না।

____________________

উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে। উপমা, অদিতি ও সাঁঝ, তিনজনই জিপিএ 5 পেয়েছে। 
এজন্য অবশ্য তারা তিনজনেই কম পরিশ্রম করেনি। রেজাল্ট পাওয়ার পরপর সাঁঝ ডিএমসি'র উদ্দেশ্য রওনা হলো। কারো অপূর্ণতা অনুভবের মাঝে কি আনন্দ উল্লাস করা যায়? যায় না তো।

হৃদ চেম্বারে বসে রোগী দেখছিল। এই পেশেন্ট যেতেই সেখানে সাঁঝ এলো। হৃদ তখন ফোনে সাঁঝের রেজাল্ট চেক করছিল। দৃষ্টি সেখানে স্থির রেখে বলল, “বসুন।”

রেজাল্ট দেখতেই তার ঠোঁটে হাসির রেশ লক্ষ করা গেল। সাঁঝ কপাল কুঁচকে বলল, “কোন মেয়ের সাথে পিরিত করছেন, ডাক্তার সাহেব?”

হৃদ চকিতে চাইল। চোখের চশমা খুলে আবারও পড়ল। অনেকটা অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে বলল, “সাঝ!”

সাঁঝ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। রাগে গিজগিজ করতে করতে বলল, “এইজন্যই ভার্চ্যুয়াল বরকে বাসায় পাই না। কোন মেয়ের সাথে প্রেম করছেন? আমি দেখব।”

হৃদ তার বিস্মিত ভাব কাটিয়ে বলল, “কোনো মেয়ের সাথে না তো।”

“তাহলে ফোনে কী দেখে হাসলেন?”

হৃদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ এড়াতে বলল, “আপনি এখানে?”

সাঁঝ মিইয়ে গেল। এই প্রশ্নের জবাবে হৃদকে কী বলবে। সাঁঝ চুপ থেকে হৃদের দিকে তাকাল। হৃদকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমতা আমতা করে বলল, “ইয়ে মানে অসুখ করেছে। তাই ডাক্তার দেখাতে এলাম।”

হৃদ অস্থির হয়ে উঠল। অসুখ করেছে তার সন্ধ্যাবতীর। কোথায়, তা তো সে জানে না!
হৃদ জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আপনার?”

“কারো অপূর্ণতা আমায় ক্ষণে ক্ষণে মারছে। আমি বাঁচতে চাই, তাই আপনার শরণাপন্ন হলাম।”
.
.
.
চলবে.................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন