হৃদ অনেকক্ষণ সাঁঝের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আর আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারবেন কি?”
সাঁঝের নিঃসংকোচ জবাব, “পারব।”
“আচ্ছা, তবে বাইরে অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।”
ঢাকা শহরে বিকেল মানে হচ্ছে অতিরিক্ত ভিড়,সড়ক ও যানবাহনের কর্কশতা। তবে, ঢাকাইয়া মানুষজন এটাকে হালকা ভাবে নিয়েই চলে; কারণ তারা এসবে অভ্যস্ত।
এজন্য সাঁঝ অবাক হয়ে হৃদকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে থাকেন কীভাবে?”
হৃদ চারিপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “কিছুটা মায়া, বাকিটা অভ্যেস।”
“এই শহরের জন্য কীসের মায়া? যান্ত্রিক কিছুর প্রতি বুঝি মায়া থাকে?”
“থাকে নয় তো কী?”
“কীভাবে?”
“বলতে পারেন জন্মস্থানের জন্যই।”
সাঁঝ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “এখন কি বাসায় যাবেন?”
”না, চলুন। একজায়গায় নিয়ে যাই।”
“কোথায়?”
“গন্তব্যহীন রাস্তায়।”
সাঁঝ কপাল কুঁচকে বলল, “মানে?”
হৃদ মিহি হেসে বলল, “শহর ঘুরতে।”
সাঁঝ রাজি হয়ে গেল। আসল কারণ, হৃদের পাশে থাকতে পারবে অনেকটা সময়। আজ কতদিন পর হৃদকে দেখল! বুকের মাঝের সেই তীব্র ব্যথাটা কমেছে।
হৃদ রিকশা ডেকে উঠে পড়ল। সাঁঝকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে উঠল, “সমস্যা হবে আমার পাশে বসলে?”
গভীর ভাবনায় মগ্ন সাঁঝ হৃদের কথা শুনে চকিতে তাকাল। অপ্রস্তুত ভাবে হেসে বলল, “না, না। সমস্যা হবে কেন?”
“হওয়ার কথাও না। আমি ভীষন ভদ্র স্বভাবের ছেলে কি না!”
সাঁঝ মুচকি হেসে হৃদের পাশে উঠে বসল।
রিকশা গতিশীল হলো। হৃদ হালকা কেশে সাঁঝের মনোযোগ আকর্ষণ করল। সাঁঝ তাকাতেই বলে বলে উঠল, “এই শহরের অলিতে-গলিতে রটে যাক এক অব্যক্ত অসুখের কাহিনি।”
সাঁঝ অবুঝ কন্ঠে শুধাল, “কী?”
________________
অদিতি টাঙ্গাইল ফিরে এসেছে। নিজের রুমের কাপড়-চোপড় গোচাচ্ছে। এরই মাঝে রুমা বেগম এসে জিজ্ঞেসও করে গিয়েছে, “ফিরে এলি কেন, মা?”
অদিতি মুচকি হেসে বলছিল, “তোমাদের ছাড়া মন টিকল না। এখানেই অনেক ভালো ভালো কলেজ আছে, ভর্তি হয়ে যাবনি।”
রুমা বেগম আর কিছু বলেনি। চলে গিয়েছে নিজের কাজে। অদিতির কাপড় সব ভাঁজ করে আলমারিতে রাখতেই সাঁঝের কল এলো। অদিতি রিসিভ করতে না চেয়েও করল।
সাঁঝ জিজ্ঞেস করল, “শুনলাম বাড়ি ফিরে গেছিস! কবে আসবি?”
“আসবা না?”
“কীহ?”
“বললাম, আর আসব না।”
“দ্যাখ! মজা নিস না। সামনে এক্সাম।”
“মজা নিচ্ছি না।”
“তাহলে কী হলো? চলে গেলি কেন?”
“ঐ শহরে মন টিকল না। তাছাড়া আব্বু-আম্মু এখানে একা আছে।”
অদিতির এভাবে সবটা বোঝানোর পর সাঁঝ বলল, “তুই ভেবে ডিসিশান নিয়েছিস তো?”
“হুম।”
“তাহলে আমার তো আর কিছু বলার থাকল না। আচ্ছা, যা ভালো বুঝিস কর। তোরই লাইফ।”
“হুম, রাখছি।”
অদিতি ফোন রেখে দিল। নিজের ফোনের গ্যালারি থেকে তিন বান্ধবীর একটা ছবি বের করে বলল, “তোদের মুখোমুখি হতে চাই না আর। না পাওয়ার যন্ত্রনা তীব্র হয়ে যায়।”
তখনই রুমা বেগম ডাকল, “অদিতি! মা, খেতে আয়।”
অদিতি তড়িঘড়ি করে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকনা মুছে বলল, “আসছি।”
________________
“অদি সত্যি চলে গেছে?”
উপমার এহেন প্রশ্নে সাঁঝ মন খারাপ করে বলল, “তাই তো বলল। হয়তো মুড সুইং। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই টেনশন করিস না।”
এতে উপমার চিন্তাটা কমলেও, সাঁঝের কমেনি। কেননা সে জানে, অদিতি না ভেবে কোন সিদ্ধান্ত নেয় না আর একবার কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে সেটা নড়চড় করে না।
তখনই মনোয়ারা বেগম এলো। সাঁঝ ও উপমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ক'দিন বাদেই তো এক্সাম। আজকে হৃদ বাবা বলল, সন্ধ্যার পরপর ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে পড়ে আসতে। এতে তোমরা ভালো গাইডলাইন পাবে।”
উপমা বলল, “আচ্ছা, আমরা কোচিং থেকে ফিরেই যাব।”
মনোয়ারা বেগম জবাবে মুচকি হাসল। তবে সাঁঝকে অন্যমনস্ক দেখল।
জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
সাঁঝ মনোয়ারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিছু না, ফুপ্পি।”
“কিছুতো হয়েছেই। না বলতে চাইলে বোলো না। তবে সামনে এক্সাম, এই এক্সামের আগে অন্যদিকে মন দিয়ো না। পড়া-লেখায় কনসান্ট্রেট করো। আজে বাজে টেনশন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”
“আচ্ছা।”
মনোয়ারা বেগম চলে যেতেই সাঁঝ অসুখকে একটা মেসেজ করল।
“কোন ভাবে যদি আমার ঢাবিতে অ্যাডমিশন না হয়, তবে আপনাকে আমি ছাড়ব না, অসুখ!”
কিছুক্ষণ বাদে ওপাশ থেকে রিপ্লাই এলো, “হয়ে গেলে কি ছেড়ে দেবে?”
পরপর আরও একটা মেসেজ এলো, “তোমার এক্সামের জন্যই মেসেজ দিইনি। চেয়েছিলাম, এখনই মন না কাড়তে। এক্সাম শেষেই সব হবে।”
সাঁঝ লিখল, “এটাতে আরও সমস্যা হচ্ছে। দেখা দিন না।”
“এক্সামের রেজাল্ট পজিটিভ আসলে, সেদিন আমাকে তোমার চক্ষু সম্মখে পাবে।”
সাঁঝ কিছুটা স্বস্তি পেল। খুশি মনে লিখল, “প্রমিস?”
“আমার কথায় বিশ্বাস নেই?”
“আছে। তবুও...”
“আচ্ছা প্রমিস।”
সাঁঝকে এত খুশি দেখে উপমা জিজ্ঞেস করল, “কী রে? কার বিয়ের দাওয়াত পেলি?”
“আপাতত তোরটা পেয়েছি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সামনে হয়তো আমারটাও পাবি।”
___________________
দু’ দিন পর এক্সাম, পড়তে পড়তে জান যায় টাইপের অবস্থা উপমা ও সাঁঝের।
পড়ার মাঝেই হঠাৎ সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কী যেন তার মাথায় এসেও মনে পড়ছে না। ঠোঁট কামড়ে তা ভাবতে লাগল। দীর্ঘ তিন মিনিট ভাবতেই সাঁঝের মনে পড়ে গেল। এখন যে বইটা পড়ছে, সেটাতেই সেদিন একটা চিঠি লিখে রেখেছিল‚ পরে ফেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু, আর মনে নেই।
পুরো বই তন্নতন্ন করে খুঁজল, পেল না। এরপর তার সবগুলো বই খুঁজল। না পেয়ে উপমার বইয়েও খুজতে লাগল। উপমা বিষয়টা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল, “কী খুঁজছিস?”
সাঁঝ শর্টকাটে বলল, “একটা কাগজ।”
বইগুলোর মাঝে সেই চিঠিটা খুঁজতে খুঁজতেই কথাটা বলল। তারপর থেমে গেল। উপমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই বইয়ে কোনো সাদা কাগজ দেখেছিস? নীল কালি দিয়ে ওটাতে লেখা ছিল কিছু।”
উপমার মনে পড়ছে না। ভাবতে লাগল। সাঁঝ এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সেটা একটা বিষাক্ত চিঠি ছিল। কারো হাতে যদি পড়ে? এই ভেবে সাঁঝ দরদর করে ঘামছে।
উপমার ঠিক মনে নেই, তাই জিজ্ঞেস করল, “কী আছে ওতে?”
“যাই থাকুক, কারো হাতে না পড়লেই হলো। ফেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রেখেছিলাম।”
উপমা সাঁঝের চিন্তা কমাতে বলল, “সাদা কাগজ?”
“হু, দেখেছিস।”
“হ্যাঁ, আমিই হয়তো ফেলে দিয়েছি।”
অতিরিক্ত অস্থির থাকার কারণে উপমার কথাটা ‘হয়তো’ শোনেনি।
বুকে হাত রেখে বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল। ধীর কন্ঠে বলল, “উফ! বাঁচলাম।”
______________
খুব ভোরে উঠে পড়াগুলো রিভিশন দিচ্ছিল সাঁঝ। খানিকক্ষণবাদে এক্সাম। সব পারা জিনিসও কেমন যেন ভুলে যাচ্ছে। সেই টেনশনে আরও বাঁচছে না। ওদিকে উপমারও একই অবস্থা। বেশ কিছুক্ষণ পড়েও সাঁঝের অবস্থা একই। বইটা বিছানায় ফেলে জলদি উঠে পড়ল। সোজা বারান্দায় গেল।
উপমা পেছন থেকে ডাকল, “সব হলো, তোর?”
“না।”
সোজা গলায় বলা সাঁঝের উত্তর শুনে উপমা বলল, “তাহলে রেডি না হয়ে বারান্দায় কী?”
“ভাল্লাগছে না।”
“মানে?”
“উফ! অসুস্থ অসুস্থ লাগছে।”
“ওহ্ আচ্ছা। এজন্য বারান্দায় এলি। ঠান্ডা বাতাস খেতে।”
“না।”
“তো?”
“অসুখকে কল দেব। অসুখই অসুখকে কাটাতে পারবে।”
সাঁঝের এমন অযৌক্তিক কথাবার্তা উপমা বুঝল না। সাঁঝও আর কিছু না বলে দোলনায় চড়ে বসল।
কল লাগাল হৃদকে। সবে মাত্র শাওয়ার নিয়ে এলো হৃদ। হুট করে এত সকালে সাঁঝের কল পেয়ে অবাক বনে গেল। অবশ্য খানিকক্ষণ পর সে নিজেও কল দিত।
কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সাঁঝ গটগট করে বলে গেল, “অসুখ! অসুখ! বাঁচান। ”
হৃদ অস্থির হয়ে অপ্রস্তুতভাবে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“কী হয়নি বলেন! পড়া মাথায় ঢুকছে না।”
ধীরে ধীরে সাঁঝ পুরোটা গুছিয়ে বলল।
সবটা শুনে হৃদ বলল, “তোমাকে চিন্তা করতে বারণ করেছিলাম তো! যথেষ্ট ভালো প্রিপারেশন তোমার। এতসব ভেবো না।”
“কিন্তু, আমি যে কিছুই পারছি না। বই খুললেই মনে হচ্ছে, তাহাদের সাথে আজ আমার বহু যুগ পরে দেখা হলো। উফ! সবকিছু নতুন নতুন লাগে।”
হৃদ কপাল কুঁচকে ফেলে বিরক্তভরা কন্ঠে বলল, “ভাবনায় তো রেখেছ দুই দুইটা পুরুষকে। এতসবের পরও অ্যাকাডেমিক বুকগুলো মাথায় ঢুকবে কীভাবে?”
“ইনসাল্ট করছেন?”
“যা খুশি ভাবো।”
তখনই সাঁঝ বলল, “ওয়েট অ্যা মিনিট!”
হৃদ বুঝতে পারল না।
সাঁঝ বলল, “আপনি কী করে জানলেন, আমার ভাবনায় দু’টো পুরুষ?”
হৃদ অপ্রস্তুত হাসল। কী বলবে। তখনই হৃদকে এই মাইনকার চিপা থেকে উদ্ধার করতে সেখানে ইভের আগমন ঘটল। ইভ তার নিজস্ব ভাষায় ডেকে উঠল।
সাঁঝ বিড়ালের ডাক শুনে জিজ্ঞেস করল, “বিড়াল? আপনি বিড়াল পোষেন?”
হৃদ হাফ ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ, কয়েক মাস হলো।”
সাঁঝের অদ্ভুত লাগল। হৃদ ও অসুখ, দুজনেই বিড়াল পোষে।
“কী নাম?”
হৃদ মুচকি হেসে বলল, “তোমারই নামে এর নাম রেখেছি, সন্ধাবতী।”
সাঁঝ ভাবনায় পড়ে গেল। হৃদ আবারও বলল, “একদম ওভার থিংকিং করবে না। এখন বড়ো বড়ো কয়েকটা শ্বাস ফেলে তৈরি হয়ে নাও। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করবে। উত্তেজিত হয়ে কিন্তু পারা জিনিসটাও ভুল করে আসতে পারো। বুঝলে?”
“হুম, বুঝেছি।”
“আচ্ছা ভালোভাবে এক্সাম দিয়ো।”
“আচ্ছা।”
“সাবধানে যেয়ো, সাবধানে এসো।”
“আচ্ছা।”
“নিজের খেয়াল রেখো।”
“এমনভাবে বলছেন যেন ওয়ার্ল্ড ওয়ার থ্রি করতে যাচ্ছি।”
হৃদ ওপাশ থেকে আলতো হাসল।
সাঁঝ মিষ্টি হেসে বলল, “সব খেয়াল রাখব।”
“আচ্ছা।”
“তাহলে ফোন রাখি?”
“ঠিক আছে।”
অতঃপর দু’জনেই চুপ রইল বেশ কিছুটা সময়। না কল কাটল, না কান থেকে ফোন সরাল।
অনেকটা সময় বাদে হৃদ বলল, “শোনো!”
সাঁঝ ধীর কন্ঠে বড্ড গভীর অনুভূতি নিয়ে বলল, “শুনছি।”
হৃদ একটা বিশাল শ্বাস টেনে বলল, “আই নিড ইউ।”
সাঁঝ থম মেরে গেল। এটা কেমন প্রেমবাক্য? কেউ এভাবেও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করে বুঝি!
.
.
.
চলবে.....................................