প্রেমাসুখ - পর্ব ২০ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


গভীর নিস্তব্ধ রাত। সাঁঝ দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে। আর ঐ দূর আকাশে দৃষ্টি মেলেছে। তার ইচ্ছের পাহাড়তো ঐ আকাশে গিয়েই ঠেকেছে। আজ যানবাহনের কর্কশতা সাঁঝের কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না। ভাবনা জুড়ে শুধুই অসুখ ও ডাক্তার সাহেব। তার অতৃপ্ত মস্তিস্ক এই দু’জনকে এক সত্তা বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। 
প্রতিবার দু’জনকে মিলাতে গিয়েও পারে না। অদৃশ্য কোনো এক অনুভূতি তাকে বাঁধা দেয়। অনেক ভালোভাবে সে বুঝতে পারে, হৃদের প্রতি সে দূর্বল। ভীষণ ভাবে দূর্বল। আবার একই অনুভূতি অসুখের প্রতিও আসে। বুঝতে পারছে না, কোনটার কী নাম দেবে। ফোন বের করে গ্যালারি থেকে হৃদের একটা ছবি বের করল। সেদিন লুকিয়ে তুলেছিল। 

ছবিটিতে হৃদ ল্যাপটপ ঘাটছে। সিরিয়াস মুডে। পরনে সাদা টি-শার্ট আর অ্যাশ কালারের টাউজার। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সাঁঝ অনেকক্ষণ ধরে ছবিটি দেখল। অনেক গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণের পর একটা জিনিস লক্ষ করল। হৃদের ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে দৃশ্যমান অতিসূক্ষ্ম এক হাসির রেখা। যা হৃদের চেহারার গাম্ভীর্যকে কয়েক গুণ বেশি আকর্ষণীয় দেখানোর মূখ্য ভূমিকা পালন করছে।

সাঁঝ অদ্ভুতভাবে এই হাসিটা অবলোকন করে গেল। অতঃপর নিজেও হাসল। এমন আলাদা রকমের মানুষের প্রতি না চাইতেও একটা কৌতুহল সৃষ্টি হয়। অসুখ ও হৃদ উভয়ের প্রতিই সাঁঝের এহেন অনুভূতিকে সাঁঝ মূহূর্তেই ‘কৌতুহল’ নামে সম্মোধন করে ফেলল।

কন্ঠভরা আশ্চর্য নিয়ে সাঁঝ বলল, “আমার অগোচরে আমাকে নিয়ে কিছু একটা হচ্ছে, আ’ম ড্যাম শিউর। নিজ থেকে যদি তা ধরতে পারি, তবে ফলাফল অবশ্যই আপনাকে হতাশ করবে, ডাক্তার সাহেব।”

আবারও হাসল সাঁঝ।

তখনই অসুখের মেসেজ এলো, “ভাবলাম, কিছুদিন বাদে তোমার সামনে আসব। কিন্তু, অপেক্ষা বড্ড পোড়ায়।”

সাঁঝ অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দু’বাক্যের এই কথাটা অনেক জটিলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভাবতে গেলে এর হাজারও অর্থ নেত্র সম্মুখে ভেসে আসবে। এর চেয়ে ভালো পন্থা অবলোকন করল সাঁঝ। পরের মেসেজের জন্য অপেক্ষা করল। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানে, এর ব্যাখ্যা হিসেবে আরও একটা মেসেজ আসবে।

হ্যাঁ। তাই হলো। কয়েকমিনিট পর আবারও মসেজ এলো, “কিছু ক্ষেত্রে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে অস্থিরতা নিজ ক্ষমতা দৃশ্যায়ন করে। আমি নিজের ধৈর্য ও ধীরতার জন্য লোক-সমাজে খ্যাতি পয়েছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যাবতী, তুমি আমাকে অধৈর্য বানিয়ে দিয়েছ। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, হঠাৎ এক সন্ধ্যায়, মুখোমুখি হব তোমার। খুউব শিঘ্রই।”

সাঁঝ অবাক হয়ে মেসেজটা দেখে গেল। মস্তিষ্কে যেটা সর্বপ্রথম এলো, সেটাই হবে কি?

_______________

গত সপ্তাহে উপমা আর অর্ণবের কাবিন হয়ে গিয়েছে। আপাতত উপমা ঢাকা থেকেই পড়াশোনা করবে আর অর্ণব টাঙ্গাইলেই থাকবে। এখন আর সাঁঝের বাহানায় তাকে ঢাকায়, উপমার বাসায় আসতে হবে না। উপমার স্বামী স্বরূপই আসতে পারবে। সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছু ঘটেছে। অদিতি আর ঢাবিতে অ্যাডমিশন টেস্ট দেয়নি। তার নিজস্ব কিছু কারণবশত তিন বান্ধবীর বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ ঘটেছে। সে শহরেরই এক কলেজে ভর্তি হয়ে নিয়েছে। উপমা ও সাঁঝ, উভয়েরই ঢাবিতে চান্স হয়েছে। কালই এক্সামের রেজাল্ট পেয়েছিলাম। কী খুশিই না ছিল! তবে এই খুশির মাঝেও একজনের অপূর্ণতা সাঁঝের শ্বাসরুদ্ধ করছিল।
আজ সারাদিন হৃদের সাথে সাঁঝের কথা হয়নি। হবে কী করে? হৃদ বাসায় নেই কাল থেকে। কাল রাতে ফেরেওনি বাসায়। কিন্তু এ-বিষয়ে সাঁঝ অজ্ঞাত। সাঁঝ জানেই না, হৃদ কাল এ-বাসায় পদার্পণও করেনি। 

সাঁঝ হাতের ফোন থেকে দৃষ্টি সরাল। বারান্দার ওপাশে উপমাকে দেখা যাচ্ছে। হালকা ঠান্ডা আবহাওয়া। বৃষ্টির বদৌলতে এমন আবহাওয়া অনুভব করাটা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। উপমার পরনে একটি পাতলা থ্রি পিস। সাঁঝ আবাক মনে ভাবল, “এই মেয়ের কি শীত করছে না!”

অতঃপর একবার নিজেকে দেখে নিল। কালো রঙের টি-শার্ট-নীল প্লাজু, চুলগুলো এলোমেলো করে খোঁপা করা। নিজেকে এভাবে দেখার পর খানিকটা শীত অনুভব করল। পাশ থেকে ওড়নাটা নিয়ে ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিল। এখন সামান্য তৃপ্ত সে। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। পা জোড়া বারান্দার উদ্দেশ্যে গতিশীল হলো।

তখনই সেখানে উপমার কানে ফোন আর ঠোঁটে মিষ্টি হাসি লক্ষ করল। সাঁঝ বুঝতে পারল এখন সেখানে যাওয়াটা তার অনুচিত। মুচকি হেসে বাসার বাইরে চলে এলো। 
মনোয়ারা বেগম রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকায় তা খেয়াল করেনি। এদিকে নুরুল ইসলামও খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে বসে আছেন। এ হচ্ছে একমাত্র কাজ, যেটা করার সময় আশেপাশে চুরি-ডাকাতি হলেও তার খেয়াল থাকে না। 

সাঁঝ সোজা বাসার পেছনের দিকটায় চলে এলো। বড্ড নির্জন-প্রশান্ত-শীতল এই জায়গাটা। গায়ের ওড়নাটা চাদরের মতো করে ভালো করে জড়িয়ে বুক ভরে একটা শ্বাস টানল। আজ সে এই শ্বাসে কোনো কৃত্রিমতা কিংবা ধূলো-বালির ছোঁয়া পায়নি। অদ্ভুত এক ভালোলাগার অনুভূতি পেল।

প্রকৃতি বিলাসী এবার প্রকৃতির গন্ধ নিজ বুকে টেনে, তারই ছন্দে মেতে উঠল। অনুভুতি সব প্রখর হতে লাগল। সাঁঝ ধীরে সুস্থে বুঝে নিল, তার মতো চঞ্চলিনীর চঞ্চলতা নিজ গল্পেই সীমাবদ্ধ। অন্য কারো কলমে নিজেকে কল্পনা করা ভারি দুষ্কর। 

কিছুক্ষণ বাদে বাকা হেসে আকাশের দিকে মুখ ঘুরাল। বিন্দু বিন্দু পানি কণা তার সমগ্র মুখে ছেঁয়ে গেল। চোখ দু’টো বন্ধ তার। অধর জুড়ে হাসির নৃত্য। এ যেন সাঁঝের সবচেয়ে অনন্য-অসাধারণ রুপগুলোর মাঝে সর্বসেরা। 
ঠিক কতটা সময় সাঁঝ নির্বাক, তার হিসেব নেই। সেই হিসেব ধরার আগেই সাঁঝ বলে উঠল, “আপনাদের প্রতি আমার মোটেও ঐ টাইপের ফিলিংস নেই। অসুখের প্রতি আছে কেবলই কৌতূহল। আর...”

সাঁঝ চুপ মেরে গেল। বৃষ্টি যা শুরু হওয়ার কথা ছিল এবং হয়েও গিয়েছিল, সাঁঝের কথার সাথে যেন তাদেরও ইতি ঘটল। তবে তার মুখভঙ্গির পরিবর্তন লক্ষ করা গেল না। সেভাবেই আকাশ পানে, চোখ বন্ধ করে মুখ ঘুরিয়ে রইল। আবারও ধারা পতনের অপেক্ষায় আছে কী? 

বেশ কিছুটা সময় বাদে সাঁঝ কিছু একটা অনুভব করে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল, “আর আপনার প্রতি আমার এমন অনুভূতি কেবলই আমার বয়সের দোষ।”

হাসির রেখাটা সূক্ষ্ম তবে অর্থ অনেক গভীর। সে পুনরায় বলল, “কিন্তুু, প্রেম অধিকাংশ এই বয়সের দোষ থেকেই জন্ম নেয়, ডাক্তার সাহেব।”

হাসি বন্ধ করে চোখ দু’টো খুলে ফেলল। আড়চোখে কিছুটা দূরে এক দৃষ্টিতে হৃদকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, “বুঝলেন?”

_________________

“যে যাকে ভালোবাসে‚ সে তাকে কেন পায়না বলতে পারো?”

অদিতির প্রশ্নে শুভ মাথা উঁচু করে তাকাল। আজ কলেজ থেকে ফেরার সময় আবারও শুভর সাথে দেখা হয়। রাস্তায় সিন ক্রিয়েট করতে চায়নি বলেই পার্শ্ববর্তী ক্যাফেতে চলে আসে। শুভকে দেওয়ার জন্য সে হাতে পাঁচটা মিনিটই রেখেছে। 
পাশাপাশি বসে কিছুক্ষণ নীরব থাকল উভয়ই। অতঃপর নীরবতা কাটিয়ে অদিতি একথা বলল।

শুভ মিহি হেসে উত্তর দিল‚ “কে বলেছে পায় না? পায় তো। ভাগ্যবানরা পায়।”

অদিতি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ঘাড় ঘুরিয়ে তার পাশে বসে থাকা শুভর পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। শুভকে দেখতেই অদিতির হাসি মুখে ঘনকালো ছায়া নেমে এলো। 

গোমড়া মুখশ্রীতে জোর পূর্বক হাসির রেশ টেনে শুধাল‚ “আমাদের ভাগ্যটা এতটা খারাপ না হলেও পারত‚ তাই না?”
   
উপর্যুক্ত কথায় শুভ নিজেও হাসল। যাকে চেয়েছে সে‚ সে চাইল এমন একটা মানুষকে‚ যে চেয়েছে অন্য কাউকে। আবারও খানিকক্ষণ নীরবতায় কাটল। কী কথা বলবে তারা? বলার আছে কী? না আছে গল্পের সূচনা‚ না আছে বেদনা মিশ্রিত একটা উপসংহার। 

নীরবতাকে পিছে ফেলে কিছুটা স্মৃতি তৈরির উদ্দেশ্যে কথা এগোতে বলল, “ঢাকা থেকে চলে আসলা কেন?”

“থেকে কী হতো?”
     
“তোমার না ইচ্ছা ছিল, তিন বান্ধবী মিলে একই ভার্সিটিতে পড়বা। এইই! এক্সাম দাওনি?”

অদিতির সহজ সরল স্বীকারক্তি, “নাহ্! দিইনি।”

শুভ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোমার না ঢাকা শহর ভালো লাগে। কী হয়েছে? বলো তো আমায়।”

“কিছু না। ভালো লাগার কিছু একদিন ঠিকই দমবন্ধকর অনুভূতির জন্য দায়ী হবে, যদি না তাতে ভালোবাসা থাকে। তাই, এই শহরেই থাকব।”
    
অদিতির কথায় শুভ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল। যেই মেয়ের স্বপ্ন ছিল ঢাবি‚ সেই মেয়ে পরীক্ষাই দেয়নি!
   
না চাইতেও শুভ বলল, “কিন্তু কেন?”
    
অদিতি নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। তার সময় শেষ। শুভ লম্বা একটা শ্বাস টেনে অদিতির মুখপানে তাকিয়ে রইল। অদিতি হাতের ব্যাগটা কাঁধে তুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। শুভ তাকিয়েই আছে সেদিকে। অদিতি প্রথম পা এগিয়েই থেমে গেল।

পিছে ঘুরে শুভর চোখে চোখ রেখে বলল‚ “তার সুবাস মিশে আছে এই শহরের প্রতিটি আনাচে কানাচে। তাকে না পেলেও‚ এই ছোটো-খাটো সুখ থেকে বঞ্চিত হতে পারব না। এই ব্যাপারে তোমাকে আর বোঝাতে হবে না। তুমি নিজেও কাল ঢাকা শিফট হওয়ার সব বন্দবস্ত করেছ, জানি। ভালো থেকো। আর দোয়া করবে‚ আমাদের মতো ভাগ্য যেন আর কারো না হয়।”

অদিতি মাথা ঘুরিয়ে নিল। দু'কদম এগিয়ে যেতেই শুভ বলে উঠল, “আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না?”

অদিতির পা জোড়া থমকে গেল। পেছন থেকে আবারও শুনতে পেল, “একবার আমার হয়ে তো দ্যাখো, তোমার নামে ভালোবাসার সুউচ্চ শৃঙ্গ গড়ব।”

_________________

আজ সারারাত ঘুম হয়নি সাঁঝের। অসুখ কথার খেলাপ করেছে। রেজাল্টের সন্ধ্যেতে আসেনি। দেখা করেনি। তার বদলে যে এসেছে, তাকে সে আশা করেনি। তার ডাক্তার সাহেব এসেছিল। ঘুম মূলত এ জন্য হারাম হয়নি। 
সেদিন হৃদ তাকে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। তারপর তো সে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর কাল রাতে! হৃদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফ্ল্যাটে চলে এসেছিল। কাল থেকে অসুখ কল-মেসেজ করে যাচ্ছে। সাঁঝ তা দেখেও পিক করছে না। 

কিছুক্ষণ পর উপমা এলো। হাতের ভাঁজে মুচড়ে ধরা চিরকুটটি সাঁঝের হাতের মুঠোয় দিয়ে যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই চলে গেল । 

সাঁঝ হা করে এহেন কার্য দেখে গেল। মুখ ফসকে বলেও ফেলল, “শুনেছি, প্রেম করে বিয়ে-শাদী করলে মানুষের ফিলিংস বাড়ে, তাহলে এটা রোবট হলো কী করে?”

পুনরায় উপমাকে ডাক দিতে যাবে, তার আগেই হাতের চিরকুটটি খেয়াল করল। নীল রঙা কাগজটা এভাবে মোড়ানো দেখে বিরক্ত হলো। 
বিরক্ত ভরা ‘চ’ উচ্চারণ করে চিরকুটটি খুলল। কালো কালিতে ছোট ও প্যাঁচানো কিছু লেখা। হাতের লেখা পরিচিত লাগল। তৎক্ষনাৎ অসুখের সেই ফোটো মেসেজ দেখল। একই হাতের লেখা। সাঁঝ বুঝে গেল হাতের এই চিরকুটটি কার লেখা। 

তবে ছবিটি দেখে ভ্রু কুচকে ফেলল। জুম করল। প্রেসক্রিপশনটা ঢাকা মেডিকেলের ছিল। আগে তো সেভাবে খেয়াল করেনি!

সাঁঝ মনে হাজারও প্রশ্ন নিয়ে চিরকুটটি পড়ল, “*** ক্যাফেতে চলে এসো কাল বিকেল চারটায়। যদি তার খোঁজ পেয়ে যাও, যাকে খুঁজতে মরিয়া তুমি; তবে ভালো। আর যদি না পাও, তবুও ভালো। প্রকৃতি নিজ সময় মতো এক প্রেম-প্রহর তৈরি করে দেবে, সন্ধ্যাবতী।”
.
.
.
চলবে....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন