“ডাক্তার সাহেব,
জানেন? অনুভূতিরা বড্ড রহস্যময়ী হয়ে থাকে। কখনো ঠিক সময়ে সঠিক অনুভূতি হয়ে ধরা দেয় না। আবার সময় ঠিক থাকলে, সে মানুষটা হয় ভুলে পরিপূর্ণ। সময় ও মানুষ, উভয়ই যদি ঠিক থাকে, তবে ভাগ্য খেলে গেইম।
এই যে, আমাকেই দেখুন না! প্রথমে যাকে দেখে মনে হয়েছিল ভালোবাসি, সে মানুষটা আগা থেকে গোড়া ভুল বেরোল। সময়ের তালে আমার সে সময়কার অনুভূতির নামটাও ভুলের ঊর্ধ্বে দেখা গেল। এরপর, ছেলে দেখলেই দূরে দূরে থাকতাম। না যেন, সেও ভুল হয়ে বের হয়!
কিন্তু এত কালের নিয়ম ভেঙ্গে সেবার রাগের বশেই আপনাকে কবুল করে নিলাম। অদ্ভুত না? নিজের এরূপ কর্মকাণ্ডে আমি নিজেই অবাক বনে গেলাম। কীভাবে পারলাম? পরে ভাবলাম, আপনি হয়তো ফেইক, সামনে এসে দাঁড়াবেন না এ জীবনে। ফেইক অ্যাকাউন্টের সাথে মজা নেওয়ার মতো মেয়ে কখনোই আমি ছিলাম না। এতকালের ধরাবাঁধা নিয়ম সব আকাশে ছুঁড়ে সেদিন থেকে আপনার সাথে কথা বলতে লাগলাম। অন্য রকমের আকর্ষণ বল দ্বারা আপনি আমাকে প্রতিবার টানছিলেন। ধীরে ধীরে আপনি হয়ে যান আমার হাসি মুখের কারণ। যতবার আপনাকে একটা করে মেসেজ পাঠাতাম, ততবার যেন মাথা থেকে সব ধরনের স্ট্রেস বেরিয়ে যেত। জাদু জানত আপনার প্রতিটি মেসেজ। আমি তবুও ভাবতাম, এটা একটা ফেইক অ্যাকাউন্ট। কিছুদিন গেলেই ব্লক দেব।
কিন্তু, সময়ের বিবর্তনে আমি আপনাকে ব্লক দেওয়ার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলি। এত এত ভুলের মাঝেও আপনি যেন সঠিক হন, সেই ইচ্ছে পোষণ করি। তারপর! সৃষ্টিকর্তা আমার দোয়া কবুল করে নেন। সেই সন্ধ্যেতেই ভার্চুয়ালের চ্যাপ্টার ক্লোজ করে, আমার সামনে এসে দাঁড়ান। ফোনের শোকে শোকাহত আমিটা সেদিন আপনার পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করি। এরপর থেকে ঝগড়ার কারণ খুঁজি। অজানা, অপ্রত্যাশিত কারণে আপনার সাথে ঝগড়া করে শান্তি পাই। কোথাও শুনেছেন? কেউ ঝগড়া করে শান্তি পায়? আমি পাই। জানেন? ঝগড়াটাও না সবার সাথে করা যায় না। কিন্তু আপনার সাথে করার অধিকারবোধ জাগ্রত হয়। ধীরে ধীরে মনের মাঝে নিষিদ্ধ ইচ্ছে জাগে, আপনার প্রতি। আপনার প্রশস্ত বুকে লজ্জারাঙ্গা মুখ লুকোনোর ইচ্ছে জাগে। কেন বলতে পারেন?
সময় অতিবাহিত হল। জানতে পারলাম, ভার্চুয়ালে যাকে মনে-প্রাণে নকল না হওয়ার আর্জি জানিয়েছিলাম, সে আমার সামনে স্বশরীরে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের জনকে ঘিরেও মনের মাঝে রয়েছে অগাধ অনুভূতি। আমি লজ্জা পেলাম। বাইরে থেকে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টায় মেতে উঠলাম, এসব কিছুই না। আগে যেসব কথা বলেছি, হয়তো সেগুলোর জন্যই এমন লাগছে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে মনে নিজের মনকে, মনেরই অগোচরে প্রশ্ন করলাম, ‘খুশি তো?’
মন আমার উত্তর দিল না। ক্ষণে ক্ষণে অসুস্থ হতে থাকল। আপনি সাথে থাকলে দিন দুনিয়া ভুলে অবাধ্য মনটা ছটফটাতে লাগল। আপনার অনুপস্থিতিতে সব জায়গায় আপনাকে খুঁজতে থাকল। এর মধ্যে এক অচেনা নম্বর থেকে মেসেজ আসা শুরু করল। সেই মেসেজগুলোতে আপনাকে অনুভব করতে লাগলাম। তার নাম দিলাম অসুখ। আমি তার প্রতি দূর্বল হইনি। তার কথাবার্তায় হয়েছি। সে কথাগুলোর মাঝে যে আপনাকে খুঁজে পেতাম!
মনে পড়ে বর্ষণের সেই সন্ধ্যেটা? আমি বৃষ্টি উপভোগ করছিলাম, তখন আপনি এলেন। আপনাকে দেখে সেদিন আমি অনুভূতির প্রখরতা জানলাম। জানেন? অন্যরকমের অধিকারবোধ করলাম।
পড়ানোর সময় আপনার তৃষ্ণার্ত নয়ন জোড়ায় আমি সেই দায়িত্ববোধ দেখেছি, যা আমার ভাইয়ের চোখে দেখতাম। এক্সাম দিতে যাওয়ার আগে যখন আপনার সাথে দেখা হল, তখন আপনার চোখে দুশ্চিন্তা দেখলাম, যা এতকাল আমার মায়ের চোখে দেখে এসেছি। সেদিন এই শহরের রাস্তা পার করার সময় যখন আপনি আমার হাত ধরলেন, তখন সেই হাতের মাঝে যেই ভরসা পেয়েছি, তা বাবার কাছে পেয়েছিলাম।
তবে, আপনার চোখে এ'সকল অনুভূতির পাশাপাশি দেখে এসেছি এক প্রণয়াকাঙ্ক্ষা যা এর আগে না কোথাও দেখেছি, না অনুভব করার দুঃসাহস করেছি। আপনার চোখের সেই দৃষ্টি হৃদয়ে ঝড় তুলতে সক্ষম। সেই চোখের দিকে তাকালে, আমার অষ্টাদশী হৃদয়ের অনুভূতির দফারফা হয়ে যায়। সেই চোখ থেকে দৃষ্টি সরে গেলে, দুনিয়া এফোঁড় ওফোঁড় করে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘ডাক্তার সাহেব! আপনি এই সাঁঝের হয়ে যান। আপনার একার্যেই তার অস্থিরতা কমবে। তার অশান্ত মনটা শান্ত হবে। কিংবা আপনাকে এই আমিটা দিয়ে দিই?’
এতসব কথা বলি বলি করেও হয়তো আর বলা হয়ে উঠবে না। না উঠুক।
জানেন? আপনার পাশে না! আমি নিজের ছায়াকেও সহ্য করতে পারি না। সত্যি বলছি। বুকটা ফেটে যায়। এরকম হিংসুটে তো আমি ছিলাম না। আপনাকে কেউ ছুঁয়ে দিলে, আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে যায়। ইচ্ছে হয়, আপনাকে নিয়ে জনশূন্য কোথাও চলে যাই। যেখানে কেউ নেই, কেউ থাকবে না। সেখানে না! সময় থেমে যাবে। আমি দু’চোখ ভরে দেখে যাব আপনাকে।
এই হিংসুটে আমিটার কী অবস্থা হয়েছিল তখন, যখন আপনি সেই মেয়েটির হাত ধরলেন। হাসি মুখে কথা বললেন, অবশেষে মুখ ফুটে ভালোবাসি বললেন। বুকটা কেঁপে উঠেছিল আমার। এটা তো আমি চাইনি। চেয়েছিলাম তো আপনাকে। আমার মনটা যদি একবার পড়তে পারতেন! তবে মন ভাঙার আগে শতবার ভাবতেন।
বিগত দু’টো দিন ধরে শান্তি নেই আমার। ছটফট করছি। আম্মু ধরে ফেলবে, এই ভয়ে রুম থেকে খুব কম বেরিয়েছি। রাতে ঘুম আসতে চায় না, জানেন? বুকের মাঝে মনে হয় পাথর ভর করেছে। চোখ দুটো ছলছল করতে থাকে। উপমা যাতে বুঝে না যায়, সেজন্য জোর করেই চোখ বুজে শুয়ে থাকতাম। এতে কি যন্ত্রণার অবসান হয়?
অতঃপর সাহারা হল স্লিপিং পিলস। আপনার বিরহ আমায়, এই রাত্রিপ্রিয়াকে ঘুমের জন্য ঔষধ নিতে বাধ্য করেছে। তবুও চোখে ঘুমেরা ধরা দেয় না। এভাবেই কাটল আমার বিগত দুটো দিন।
আচ্ছা! যান। স্বীকার করে নিলাম, এই জঘন্য অনুভূতিটা ভালোবাসা। মানলাম, আপনাকে... আমি আপনাকে ভালোবাসি। কিন্তু, তারপর?
ডাক্তার সাহেব! আপনাকে ভালোবাসার আগে যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতাম, ভালোবাসায় এত যন্ত্রণা! সাদরে মৃত্যু গ্রহণ করতাম। তবুও আপনাকে ভালোবাসার মতো পাপ করতাম না।”
বারান্দায় দাঁড়িয়ে খোলা আকাশপানে অশ্রুসজল চাহনি নিবদ্ধ করে মনের কাগজে লিখে ফেলল এই চিঠি। যা সে ছাড়া কেউ জানবে না। তবে বুকটা হু হু করছে।
তার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি ঝরছে না। মাঝে মাঝে বজ্রাঘাত করছে, এই যা।
দুদিন ধরে সাঁঝের ফোন বন্ধ। সেদিন হৃদের সাথে দেখা হয়েছিল ঊর্মির। চেকআপের জন্য এসেছিল। মাঝে হৃদের সাথে দেখা হয়। সেখানে জানতে পরে, ঊর্মি চারমাসের প্রেগন্যান্ট। সে খুশীতে হৃদের মুখ এত উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। আগেভাগেই গিয়ে ক্যাফেতে বসে। ঊর্মি মূলত হৃদের সাথে সাঁঝকে নিয়েই কথা বলছিল। এদিকে হৃদ কেবল তারই উত্তর দিচ্ছিল। প্রশ্নোত্তরের সংক্ষেপণতায় ঝড় উঠল সাঁঝের হৃদয়ে।
হৃদ সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল সেদিন। সাঁঝ আসেনি। কল দিয়েছিল, সেদিন থেকে ফোন সুইচ অফ। এই দু'দিনের ব্যস্ততায় আর সামনে এসে দাঁড়াতে পারেনি।
উপমাকেও কল দিয়েছে। প্রতিবারেরই আলাপনটা ছিল এরকম—
“হ্যালো!”
“হ্যাঁ, হৃদ ভাইয়া। বলো।"
“সাঁঝ!”
“নিজের রুমে, ঘুমোচ্ছে।”
“ওহ্ আচ্ছা। আল্লাহ্ হাফেজ।”
“আল্লাহ্ হাফেজ।”
বলাই বাহুল্য, হৃদের অনুভূতি সম্পর্কে উপমা অবগত, সেই শুরু থেকেই। হৃদ যে-কোনো ধরনের সাহায্য পেত উপমার কাছ থেকে।
ভাবনার মাঝে হঠাৎ করেই সাঁঝ চমকে উঠল আওয়াজ পেয়ে। পাশে তাকিয়ে দেখল কফি মগ হাতে নিয়ে উপমা দাঁড়িয়ে আছে।
উপমা বিরক্তভরা কন্ঠে বলল, “কখন থেকে ডাকছি! শুনছিস না?”
সাঁঝ শোনেনি। কেন শোনেনি, সে বাহানা দেওয়ার প্রচেষ্টাও করল না। বড্ড শীতল কন্ঠে বলল, “কী বলবি?”
এতে যেন উপমা নিজেও শান্ত হলো। সাঁঝের এমন কণ্ঠে নিজের ভেতর কোথাও একটা যন্ত্রণা অনুভব করল। সাঁঝের কাঁধে হাত রেখে কোমল স্বরে বলল, “মন খারাপ?”
সাঁঝ হাসল। ভাগ্যকে তাচ্ছিল্য করা সেই হাসিতে ছিল যন্ত্রণা। হেসে হেসেই বলল, “দিব্যি আছি। কিছুই হয়নি আমার।”
“দেখে মনে হচ্ছে অনেক কিছুই।”
সাঁঝ কিছু বলল না। যেভাবে ছিল, সেভাবেই রইল। উপমা ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, “তুই না বলতে চাইলে, বলতে হবে না।”
এবারও সাঁঝ নির্বিকার। উপমার এটা সহ্য হচ্ছে না। তার বেস্ট ফ্রেন্ড তো এমন না। তবুও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল, “ড্রইং রুমে হৃদ ভাইয়া আছে।”
সাঁঝ আর নির্লিপ্ত থাকতে পারল না। ফট করে উপমার দিকে তাকাল। হুট করেই যেন তার শ্বাসবেগ বেড়ে গেল বহুগুণে। অস্থির লাগছে খুব। হাঁসফাঁস করতে করতে বলল, “কী বললি!"
“হুম। হৃদ ভাইয়া আধা ঘণ্টা ধরে বসে আছে।”
সাঁঝ আর এক মুহূর্ত এখানে অপেক্ষা করতে পারল না। দৌড়িয়ে ছুটে গেল ড্রইং রুমের উদ্দেশ্যে। হৃৎপিণ্ড এমন ভাবে লাফাচ্ছে যেন এখনই বেরিয়ে আসবে। দরজার সামনেই পা জোড়া থেমে গেল। নিজের মনকে প্রশ্ন করল, ‘কার জন্য এত উতলা হওয়া? যার হৃদয়ে বসত করে অন্য কোনো নারী?’
তবুও সে একেবারে থামল না। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল। সোজা চোখ গেল সোফায় বসে থাকা এক ডাক্তারের উপর। এই ডাক্তারই তো তার মন নিয়েছে। এখন নিজেকে শূন্য শূন্য লাগছে। বুকের মাঝে কোনো কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করছে না। খুব করে হৃদকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘হৃৎপিণ্ডের ডাক্তার হয়ে কী করে অন্য কারো হৃৎপিণ্ড চুরি করলেন আপনি?’
বলতে পারল না। কথাগুলোও যেন মনের সাথে সাথে থেমে গেছে। চোখ দিয়ে দু'ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তাতে কী? সে খেয়াল কি সাঁঝের আছে? সাঁঝ শুধু এই মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজে খানিকটা শান্ত হতেই কপাল কুঁচকে ফেলল। হৃদকে এতটা অগোছালো এর আগে দেখেনি সে। ফরসা মুখশ্রী কেমন যেন সাদা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। রক্তশূন্যতা দেখা দিল না কি? পরনের সাদা শার্টটা ইন করা না। হৃদ নিয়মের বহির্ভূত হলো কবে?
সাঁঝ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অভিমানে জর্জরিত সাঁঝের মনটা যেন খাঁ খাঁ রোদে এক বিন্দু জল পেয়েছে। হঠাৎ সাঁঝের বুকটা ধুক করে উঠল, হৃদের চাহনি এখন তার চোখের মাঝে স্থির।
সাঁঝ সেই চোখের পানে তাকানোর সাধ্য পেল না। আবার যদি হারিয়ে যায়? সোজা রুমের ভেতরে চলে গেল। উপমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাঁঝকে দেখে বাইরে চলে এলো। হৃদের পাশে এসে বসল।
হৃদ একবার চোখ তুলে তাকাল উপমার দিকে। পাশেই সুমিতা বেগম হৃদের সাথে হরেক রকমের কথা বলে যাচ্ছে। হৃদ ‘হ্যাঁ, হুঁ’ করল। শেষমেষ গিয়ে উপমাকে বলল, “ওয়াশরুম...”
সুমিতা বেগম উপমাকে বলল, “তোদের রুমটা দেখিয়ে দে, মা।”
হৃদ দাঁড়িয়ে পড়ল। উপমা হৃদকে রুম দেখিয়েই ফিরে এলো। হৃদ বড়ো বড়ো পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করল। রুমে কাউকে না পেয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেল।
কালো রঙের একটা স্কার্ট পরে আছে সাঁঝ। উপরে ফুল হাতা জামা। চুলগুলো বাতাসে উড়ছে সাঁঝের। বড্ড উষ্কখুষ্ক দেখাচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। সে চোখের অশ্রু এখনও শুকোয়নি। গ্রিলের উপর রাখা সাঁঝের হাতে হৃদ নিজের হাত রাখল। সাঁঝ চকিতে চাইল হৃদের পানে।
মিহি হেসে বলল, “ প্রিয়তমার চোখের প্রতিটি অশ্রু প্রেমিকের বুকের রক্তক্ষরণের ন্যায়। তবে আমার তা হচ্ছে না। তোমায় এরূপে দেখে আমার প্রেম প্রেম পাচ্ছে, সন্ধ্যাবতী।”
সাঁঝ হৃদের কথা শুনে থমকে গেল। এই প্রহর যেন থমকে গেল।
.
.
.
চলবে.......................................