প্রেমাসুখ - পর্ব ০৫ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


 একটা বিড়াল! ছাই রং-এর একটা বিড়াল তার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হৃদ কপাল কুঁচকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভেবে যাচ্ছে,এটা এলো কী করে!দরজা লাগানো। জানালা দিয়ে! দৃষ্টি গিয়ে ঠেকল তার রুমের জানালার দিকে। খোলা রয়েছে। হৃদের আর বুঝতে বাকি রইল না, এর আগমনের উৎপত্তি কোত্থেকে। 

হাতে গ্লাভস পরে পুনরায় বিড়ালটির সামনে এলো। জায়গা থেকে হেরফের করেনি। তা দেখে হৃদ কপাল কুঁচকে বলল,“এখানে কী?”

 এরপর গ্লাভস পরিহিত হাত দিয়ে উঠিয়ে বাসার বাইরে রেখে দরজা লাগিয়ে দিল। একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে গ্লাভসটা বিনে ফেলে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। কিচেনে গিয়ে দেখল, খাবার সব ঠিকঠাক আছে। 

___________

আজ রাতটা অন্যরকম। ভরা জোছনায় ছেয়ে আছে সাঁঝের বারান্দা। সাঁঝ এখানে জোছনা বিলাস করছে। মেঝেতে বসে আছে। বাতাসে খোলা চুলগুলো উড়ে যাচ্ছে। একটু পরপর ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিচ্ছে। বা হাতে রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের "ময়ূরাক্ষী" উপন্যাস। পড়ছে সে।

ঠিক কিছুক্ষণ বাদেই ফোনের মেসেজ টিউনের আওয়াজ পেল। হাতে নিয়ে দেখল, হৃদের মেসেজ।

 একটুখানি মন খারাপ ছিল আজ সাঁঝের। বাবা মা-কে ছেড়ে ঢাকা যেতে হবে। সেজন্য সেদিনও মন খারাপ ছিল আবার আজও। কিন্তু অকারনেই হৃদের মেসেজ দেখে সাঁঝের মন খারাপ ভ্যানিশ হয়ে গেল। 

হৃদ লিখেছে, “তা আমার ভার্চুয়াল মিসেস! কী খবর আপনার?”

 সাঁঝ রিপ্লাই দিল, “এইতো! আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। কেমন আছেন প্রাণপ্রিয় ভার্চুয়াল জামাইজান?”

“আপনার অপেক্ষায় থাকতে পেরে ধন্য প্রিয়, ধন্য আমি। কেমন আছি? উমম...যদি প্রিয়ার প্রাণপ্রিয় ভার্চুয়াল জামাইজানের প্রাণনাশিনী ভালো থাকে, তবে আছি ভীষণ ভালো!”

“ওমা ওমা! কী লুমান্তিক কথা বার্তা! আমার শরম করে ক্যান?”

“এই ভার্চুয়াল বউটা লজ্জা পাচ্ছে ক্যান?"

 অতঃপর সুখময় আরও এক রাত্রি যাপন হলো এদের মেসেজ আলাপনে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা দুজনই ভাবছে অপর পক্ষের মানুষটি ফেইক। ভার্চুয়ালে ফেইক মানুষের সংখ্যা অহরহ। তাই তাদের এমন কথোপকথন। ভুলক্রমেও যদি তারা জানত, অপর মানুষটি আসল! তাহলে কথা এগোনোর সাহস করত না। 

___________

 সকালে এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙল হৃদের। ঘুম ভাঙতেই চোখ গেল অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশপানে। মিনিট দুয়েক বাদে ওঠে ফ্রেশ হয়ে নিল। এরপর মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরোবে। এটা তার রোজকার রুটিন। 

 ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই দেখল কালকের সেই বিড়ালটা দরজার সামনে ঘুমিয়ে আছে। হৃদ পুরোপুরি এড়িয়ে গেল ব্যাপারটা। নামাজ পড়ে সকালে বেশ কিছুটা রাস্তা হেঁটে এলো। বাসার পেছনে একটা পার্ক আছে। ওখানে একটা বেঞ্চ ফেলা আছে। হৃদ কিছুক্ষণ বসে রইল। সূর্যোদয় উপভোগ করল। এর মাঝে একটা দৃশ্য প্রায়শই ঘটে থাকে, একই রাস্তা দিয়ে কিছু মেয়ে প্রতিদিনই যাতায়াত করে এবং হৃদের দিকে তাকিয়ে একে অপরের সাথে ফুসুর ফুসুর করে। হৃদ বরাবরই ইগনোর করে। আজও তাই হলো।

সাড়ে ছ'টার দিকে হৃদ বাসায় ফিরল। কিন্তু এবার এড়িয়ে যেতে পারল না। বিড়ালটিকে সেখানেই ঘুমোতে দেখা গেল। সেকেন্ড পাঁচেক বিড়ালটির দিকে তাকিয়ে রইল হৃদ। তারপর ভেতরে চলে গেল। ভাবল, ঘুমোচ্ছে; ওঠলেই চলে যাবে।

 সকালের খাবার হৃদ নিজেই বানায়। এখন সেটাতে মনোযোগী হলো। এরপর রেডি হয়ে মেডিকেলের উদ্দেশ্যে গেল। ক্লাস আছে।

 ______________________

সকালে নাশতা শেষে অর্ণব বলে ওঠল,“এডমিশনের প্রিপারেশন নিতে হবে।”

সুমিতা বেগম, আরিফ সাহেব ও সাঁঝ অর্ণবের দিকে তাকাল। অর্ণব আবারও বলল,“ঢাকায় একটা কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দেব। উপমা আর জেরি একসাথে থাকবে। সেজন্য সামনের সপ্তাহেই ফুপির বাসায় যাব।”

 সঙ্গে সঙ্গে সাঁঝ বলে ওঠল,“কীহঃ! কিন্তু এত জলদি ক্যান?”

অর্ণব সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল, “কীসের জলদি করছি? কিছুদিন বাদেই এডমিশনের টেস্ট শুরু হয়ে যাবে। তোর না ঢাবিতে পড়ার ইচ্ছা আছে?”
    
“সে আছে, তাই বলে এত তাড়াতাড়ি আবারও পড়াশোনা? কিছুদিন ঘুরে বেড়িয়ে কাটাতাম!”

“সময় নেই ওসবের। উপমাকে দেখ, পড়াশোনা নিয়ে কত সিরিয়াস! তোরই তো ফুফুতো বোন। আর এদিকে তুই?”

তখন আরিফ সাহেব বললেন,“আরে আমার আম্মুটা! শোনো, পড়াশোনা করেও তো বেড়ানো যায়। ভর্তিপরীক্ষা তো সারাজীবন থাকবে না। এখন একটু পড়াশোনায় মন দাও। এরপর যত ইচ্ছা সখ-আহ্লাদ পূরণ কোরো।”

 সাঁঝ মিইয়ে গেল। সুমিতা বেগম বলল,“সত্যিই বলছিস অর্ণব! উপমার মতো মেয়ে হয় না। যেমন পড়ালেখায় ভালো, তেমন রূপে গুনে। বড়োদের কী সম্মানটাই না করে! এমন মেয়ে আজকাল পাওয়াই যায় না।”

 অর্ণব হালকা হাসল। সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে অর্ণবের হাসি লক্ষ্য করল। অর্ণব তা দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেল। মেকি হেসে বলল, “কী?”

সাঁঝ ভাবুক ভঙ্গিতে বলল, “উমম...ডাল ম্যা কুচ কালা হ্যায়!”

অর্ণব চট জলদি ওখান থেকে ওঠে গেল। যেতে যেতে বলল,“বেশি ভাবছিস তুই।”

___________

বিকেলের দিকে হৃদ নিজের চেম্বারে বসে আছে। ভিজিটিং আওয়ার চলছে। কিছুক্ষণ বাদে একটা মেয়ে এলো। হৃদ টেবিলের উপর রাখা কিছু রিপোর্টস দেখছে। মেয়েটি দরজা নক করতেই হৃদ দৃষ্টি নিচের দিকে সীমাবদ্ধ রেখে বলল,“কাম ইন!”
    
মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়াল। হৃদ বলল,“বসুন।”
  
সে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকল। হৃদ একবার উপরে তাকিয়ে শর্মীকে দেখে পুনরায় দৃষ্টি নামাল। শর্মীকে উদ্দেশ্য করে বলল,“প্রবলেম বলুন।”

 “অসুখ করেছে।”

“তা না করলে হসপিটালে নিশ্চয়ই আসতেন না! টেল মি ইউর প্রবলেমস।”

“বুকে চিনচিনে ব্যাথা হয়। কিছু করুন।”

হৃদ কিছু মেডিসিন প্রেসক্রাইব করে শর্মীর দিকে প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিয়ে বলল,“গ্যাস্ট্রিকের মেডিসিন দেওয়া হয়েছে। সকালে খাওয়ার আগে নেবেন।”

“এরকম কেন আপনি?”
   
“ইউ ক্যান লিভ নাও।”

“আপনি আমাকে বুঝতে পারেন না কেন?”

“নট ইন্টারেস্টেড। আমার কাজ আছে অনেক। আপনি গেলে খুশি হব।”

শর্মী আলগোছে প্রস্থান করল। হৃদ একটা শ্বাস ফেলে পুনরায় নিজ কার্যে মনোযোগী হলো।

_________

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেই হৃদ তার দরজার সামনে সেই বিড়ালটিকে দেখতে পেল। সরেনি একটুও। এতে করে হৃদ কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে ভাবল। শেষমেষ মায়া হলো এবং নিজের সাথে থাকার জায়গা করে দিল। বিড়ালটিকে সবার আগে ওয়াশরুমে নিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে নিল। বলা বাহুল্য, এটা যেন বিড়াল নয়; একটা বাচ্চার ন্যায় গোসল করে নিল। 

বিড়ালটির এমন হাবভাব দেখে হৃদ হুট করে হেসে দিল। গম্ভীর হৃদের হাসিটা সেই বিড়াল এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে। আদর করে হৃদ এই বিড়ালটির নাম ‘ইভ’ রাখল। 

ইভের জন্য নির্দিষ্ট একটা শোয়ার ব্যবস্থা করে দিল হৃদ। এরপর নিজের বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল, তার ভার্চুয়াল বউয়ের মেসেজ এসছে।

“কী ব্যাপার মিস্টার উলুলুলু!”

সাঁঝের এমন মেসেজ দেখে হৃদ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ‘উলুলুলু!’ এটা আবার কেমন সম্বোধন!

হৃদ এটার মানে জানতে চেয়ে লিখল,“উলুলুলু মানে?”

সাঁঝ তখন গ্রুপ কলে ছিল। ফ্রেন্ডসদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। হৃদের মেসেজ পেয়ে সবাইকে বলল,“এই শোন! ঐ অনয় সাহেব দ্যা ভার্চুয়াল জামাই অব্ অনামিকা, মেসেজ দিয়েছে।”

একজন বলল, “কী দিয়েছে রে?”

সাঁঝ, মেসেজটা পড়ে শোনাল। সবাই হাসল ভীষণ ভাবে। সাঁঝ হাসতে হাসতে রিপ্লাই দিল,“আরে জামাইজান! আপনার নাম আমার মনের পিঞ্জিরাতে ‘উলুলুলু’ দিয়ে সেভ করে রেখেছি। সুন্দর না ভীষণ!”

হৃদ চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলল,“লাইক সিরিয়াসলি? উলুলুলু?”
টাইপ করল,“সুন্দর তো! অনেক সুন্দর। কিন্তু এটা ছাড়া আর নাম পাননি বিবিসাহেবা?”

সাঁঝ একটা স্যাড ইমোজি দিয়ে লিখল,“পেলাম না তো! জানেন? আজকে আমার ফ্যাভারিট কাজ, ঘুমানো বাদ দিয়ে নাম খুঁজেছি। এর চেয়ে ভালো নাম আর খুঁজেই পেলাম না!”

“থাক! আপনার আর নাম খুঁজতে হবে না। কম নাম তো দেননি।”

“তা অবশ্য ঠিক। তবে আপনাকে ‘ভার্চুয়াল জামাই’ নামে ডাকতে বেশি ভাল্লাগে জামাআআআআইই!”

হৃদ হাসল। সারাদিন ব্যস্ততায়, জীবনটা একটা যন্ত্রের চেয়ে কোনো অংশে কম পড়ে না। দিনশেষে যদি এই নকল দুনিয়ায় একটু ভালো থাকা যায়, তবে যাক না! 
.
.
.
চলবে.......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন