প্রেমাসুখ - পর্ব ২১ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


“আম্মু! তুমি!”

সকাল সকাল মায়ের ডাক শুনে ঘুম থেকে উঠল সাঁঝ। চোখের সামনে সুমিতা বেগমকে দেখে রীতিমতো চিৎকার করে উঠল। পাশেই ঘুমিয়ে ছিল উপমা। রাতভর অর্ণবের সাথে কথা বলে, সূর্যোদয়ের পরেই ঘুমিয়েছিল। সাঁঝের মাইকের মতো আওয়াজে তার ঘুম ছুটে গেল। বিরক্তি ভর করল মাথায়। 

ঘুম মিশ্রিত কন্ঠে বলল, “বইন ঘুমোতে দে না। রাতে তোর ভাই ঘুমোতে দেয়নি। এখন তুই জ্বালা...”

সুমিতা বেগমের আবছা আবছা প্রতিবিম্ব চোখের ক্যানভাসে ভেসে উঠতেই উপমা থেমে যায়। দুইহাত দিয়ে চোখ ডলে। 

তবুও সুমিতা বেগম সরছে না দেখে সাঁঝকে জিজ্ঞেস করল, “এ্যাই! এ্যাই, সাঁঝ! রাতে পানির জগে উলটা-পালটা কিছু মেশাশনি তো! মনে হচ্ছে আমার নেশা হয়েছে। সামনে শাশুড়িকে দেখতে পাচ্ছি।”

সাঁঝ ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে, এখানে সত্যি সুমিতা বেগম এসেছে। এতক্ষণ সুমিতা বেগম চুপ থাকলেও, এখন বলে উঠল, “আর কোনো গোপন বিষয় ফাঁস করার আগে বলে দিচ্ছি, এখানে আমি স্ব-শরীরে এসেছি। তিনদিন থাকব।”

কথা শুনে উপমার ঘুম পুরোপুরি উবে গিয়েছে। পরপর দু'বার শুকনো ঢোক গিলে সাঁঝের দিকে তাকাল। সে কখনোই সুমিতা বেগমকে ভয় পায়নি, তবে একটু আগে ভুলবশত নিজের বলা কথাগুলো তাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে। 
সুমিতা বেগম এদের হাবভাব দেখে বলল, “রান্না হয়ে গিয়েছে, ওঠো। খাবে।”

সাঁঝ ঘড়িতে দেখল সকাল আটটা বাজতে ১৫ মিনিট বাকি আছে। তাই জিজ্ঞেস করল, “এতো সকালে!”

“হুম, একসাথে খাবে। এসো।”

বিস্ময় কাটিয়ে সাঁঝ বাধ্য হয়ে উঠে পড়ল। উপমা ওঠেনি। বসে বসে ভাবছে। এখন এই মুখ কীভাবে দেখাবে? খুব করে তো বলল, অর্ণব ঘুমোতে দেয়নি। এমন পরিস্থিতিতে উপমার কান্না করতে করতে অর্ণবকে বকতে ইচ্ছে করছে।

ফ্রেশ হয়ে সাঁঝ সোজা ছাঁদে চলে এলো। সকালবেলা সে খেতে পারে না, যত হালকা খাবারই হোক না কেন, হজম হয় না। তাই ভাবল, একটু ছাদ থেকে ঘুরে এলে মন্দ হয় না।
এখন সূর্যের তাপ ভীষণ মিষ্টি। সাঁঝের ইচ্ছে হচ্ছে, দু'হাতে জড়িয়ে গায়ে মাখতে। সাথে ফিসফিসিয়ে বলতে, “আপনি না হয় আমার প্রেমিক পুরুষ হয়ে যান। আপনার ভাষ্যমতে আমি এভাবেই আলোক রশ্মির ন্যায় বিষ ছড়াব। যে বিষে থাকবে প্রেম, প্রেম ও কেবল প্রেম।”

অনেকটা সময় অতিবাহিত করে ছাদ থেকে নামল। ঘড়িতে ক'টা বাজে? সাড়ে আটটা হবে হয়তো।
তিনতলার সামনে আসতেই হৃদকে দেখল দরজা লক করতে। সাঁঝ ওভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে হৃদকে পর্যবেক্ষণ করল। হোয়াইট শার্ট ইন করে পরা। কপালে ভেজা চুলগুলো লেপ্টে আছে। সাঁঝ বুকে হাত বেঁধে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ঠোঁট কামড়ে, বোঝার চেষ্টা করল, হৃদ গোসল করে এসেছে, প্রতিবার তো ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে বের হয়। আজ ভুলে গিয়েছে নাকি!

হঠাৎ সাঁঝের শয়তানি মস্তিষ্ক নেচে ওঠল। সাঁঝ দৌড়িয়ে হৃদের কাছাকাছি চলে এলো। হৃদ নিজের পাশে সাঁঝের উপস্থিতি লক্ষ করার পূর্বেই সাঁঝ নিজ হাতের বাহু দ্বারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ধাক্কা দিল।
হৃদ তাল সামলাতে না পেরে কয়েক কদম এগিয়ে গেল, পেছন থেকে সাঁঝ নিজের ঠোঁটের বাকা হাসি কমিয়ে, কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলে ওঠল, “হায় হায় রে! আমার তুলার মতো শরীর এই খাটাশ হৃৎপিণ্ডের ছোঁয়ায় ভ্যাঁচকাইয়া গেল রে!”

হৃদ কপাল কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ, এখন এটাই বাকি ছিল।”

“এ্যাহ, কী বাকি ছিল?”

“আপনার আগমনের।”

“কেন, আমার অপেক্ষায় ছিলেন নাকি?”

“হ্যাঁ তো, আমার শান্ত-শিষ্ট দিনটাকে শুভর সাথে 'অ' উপসর্গ যোগ করার জন্য নজরুলের কবরে তার মৃত্যুবাষিকীতে চড়ানো বাসি ফুল দিয়ে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।”
 
সাঁঝ হৃদের এক নিঃশ্বাসে বলা পুরো কথাটা না শুনলেও প্রথমের সামান্য ও শেষের 'শুভেচ্ছা' শুনে দাঁত কেলিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।”

তারপর আশেপাশে তাকিয়ে হৃদের কাছে এসে বলল, “আপনাকে হসপিটাল থেকে বের করে দিয়েছে, তাই না?”

হৃদ খানিকটা চেঁচিয়েই বলল, “মানে?”

“আরে আরে! আমাকে বলতে পারেন আপনার লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। আমি কাউকে বলব না।”

“আমি আপনাকে এসব আজে-বাজে বানোয়াট কথা বলতে যাব কেন?”

“কারণ আমি জানি।”
 
হৃদ কপাল কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করল, সাঁঝ কী ভাবছে আর এরকম সকাল সকাল মজাই বা নিচ্ছে কেন। আজ সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসগুলো অফ বলেই দেরি করে বেরিয়েছে। আর আজ সাঁঝও জলদি উঠেছে।

 হৃদ জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে এই মহান সত্যি বের করলেন, বলুন তো?”

সাঁঝ মিহি হেসে বলল, “এই যে! ঠিকমতো মেডিকেলে যান না। রাতেও প্রায় সময় আসেন না। ভার্চুয়ালেও এক্টিভ না। তার উপর...”

“তার উপর কী?

“মানুষকে সুস্থ করতে পারেন কি না জানা নেই, তবে অসুস্থ দারুণ ভাবেই করতে পারেন। সত্যি বলছি, নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।”

হৃদ খানিকটা কেশে উঠল। সাঁঝ একটু সরে দাঁড়িয়ে আবারও বলল, “সত্যিই কী তাই?”

“হ্যাঁ, আপনার মাথা। ”

“তা তো বুঝেছিই, আমি ভীষণ ইন্টিলিজেন্ট মেয়ে তো! বুঝতেই হবে।”

“হু, মাথা তো এসবেই চলে, অন্য ব্যাপার-স্যাপারে তো আবার আপনার মাথা গুলিয়ে যায়।”

“কোন ব্যাপার-স্যাপার?”

সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল। হৃদ উত্তর না দিয়ে উলটা প্রশ্ন করল, “ধাক্কা দিলেন যে! চোখ কি ছাদে আর ব্রেইন কি মাটির নিচে রেখে এসেছেন?”

“এ্যাই এ্যাই! কী বললেন আপনি?”

“এখন কি শ্রবণ ক্ষমতাও হারালেন?”

“আপনাকে তো আমি... ইচ্ছে করছে...”

সাঁঝ এদিক-ওদিক তাকাল। হৃদ তড়িঘড়ি করে হাতের ফোন পেছনে লুকোল। সাঁঝ চোরাচোখে তা দেখে বলল, “কী লুকোলেন ওটা?”

“কই? কিছু না তো।”

“এ্যাই! দেখান বলছি।”

“হ্যাঁ, দেখাই। এরপর আবারও আমার ফোন শহীদ হোক।”

“না দেখালে আপনাকে শহীদ করব।”

“বাকি রেখেছেন কি এখনও?”

“মানে?”

ঝগড়া করতে করতেই দু'জন সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। নিচ তলায় এসেও গিয়েছে। 

হৃদ বলল, “মানে এসে গিয়েছি, চলুন।”

সাঁঝ তাকিয়ে দেখল, তাদের ফ্ল্যাটের সামনেই চলে এসেছে। তেজী কন্ঠ মিইয়ে গেল। আস্তে-ধীরে বলল, “পরে কন্টিনিউ করব।”

মূহূর্তেই আবারও বলল, “ওয়ান সেকেন্ড!”

“কী?”

“কী বললেন?”

“কী বলেছি?”

“চলুন মানে?” 

“মানে, চলুন।”

“আপনার সাথে কই যাব? কেন যাব?”

হৃদ কিছু না বলে ফ্ল্যাটে ঢুকতে গেলেই সাঁঝ পেছন থেকে হৃদের পিঠের দিকের শার্টের অংশ টেনে ধরার কারণে হৃদ থেমে গেল।

পেছনে তাকিয়ে বলে, “আবার কী?”

“কী মানে? আপনি এখানে ঢুকছেন কেন?”

“কেন? এটা কি আপনার বাপের সম্পত্তি?”

“এ্যাই! দেখুন, বাপ তুলে কথা বলবেন না।”

“তো?”

“এটা আমার বাপের না হলেও তার বোনের তো? তার বোনের সব কিছুই তার এক মাত্র মেয়ের। মেয়ের সব কিছু আবার তার বি বা হি ত স্বামীর। এখন তার বিবাহিত স্বামী আবার আমার ভাই। আর ভাইয়ের সবকিছুতে দখল দেওয়া আমার সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট কাজ। সেই হিসেবে এই বাসা ইন্ডিরেক্টলি আমার।”

তারপর একটু থেমে সাঁঝ আবারও বলল, “আপনি কি জানেন, আপনাকে আমি এই বাসা থেকে বের করে দিতে পারি?”

হৃদ বাঁকা হেসে অস্ফুট স্বরে বলল, “ধুরন্ধর।”

তখনই সুমিতা বেগম দরজা খুলল। সাঁঝ ও হৃদের ঝগড়ার টেম্পরারি এন্ডিং হলো। 

সুমিতা বেগম জিজ্ঞেস করল, “তোমরা এখানে! একসাথে দাঁড়িয়ে!”

সাঁঝ বলল, “আমি ছাদ থেকে ঘুরে এলাম।”

 হৃদ বলল, “আপনি আসতে বলেছিলেন আন্টি।”

 সুমিতা বেগম মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আমি এখন তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম, বাবা। ভাবছিলাম, এখনও আসছ না কেন?”

হৃদ জবাবে বলল, “আপনি ডেকেছেন। না আসলে তো অভদ্রতা হয়ে যেত। আজকালকার বাচ্চা-কাচ্চা তো আবার বড়োদের সম্মানের ‘স’-ও করে না।”
 
শেষোক্ত কথাটা সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল। সাঁঝ দাঁত কিড়িমিড়ি করে তাকিয়ে আছে, যেন মা পাশে বলে কিছু বলতে পারছে না; না থাকলে খেয়ে ফেলত।

সুমিতা বেগম বলল, “বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন, বাবা? ভেতরে এসো।”

এরপর সাঁঝকে উদ্দেশ্যে করে বলল, “তোর হাবভাব ভালো ঠেকছে না, ভেতরে ঢোক। না হয় ঐ দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যা।”

সুমিতা বেগম বাসার ভেতরে চলে গেল। হৃদও সাঁঝের দিকে তাকিয়ে উপহাসমূলক হেসে চলে গেল । 
সাঁঝ বাইরের গেটের দিকে একবার তাকিয়ে ভাবল, “কোথাও একটুখানি সম্মান নেই আমার।”

_________________

সবাই একসাথে খেতে বসেছে। সাঁঝ ও উপমা পাশাপাশি, সাঁঝের বিপরিত, ঠিক সামনের আসনে হৃদ বসেছে। নুরুল ইসলাম অফিসে চলে গিয়েছেন। সুমিতা বেগম ও মনোয়ারা বেগম খাবার পরিবেশন করছে। সাঁঝ সেই যে মাথা নিচু করে ছিল, আর ওঠায়নি। সেভাবেই খেয়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় বাদে সাহস করে মাথা নিচু করে চোখ দুটো সামনে মেলে দেখল, হৃদ পানি খেতে গিয়ে মাত্রই তার দিকে তাকাল। চোখাচোখির এ-মুহূর্তটা বড়োই সর্বনাশা ছিল। সাঁঝ বিষম খেল। হৃদ দ্রুতই নিজের হাতের পানিটা সাঁঝকে এগিয়ে দিল। হাতে হাতে এই ছোঁয়ায় সাঁঝ জমে গেল। 

অনেকটা সময় লেগে যায় সাঁঝের নিজেকে শান্ত করতে। খানিকটা রেগেই মনে মনে বলল, “এটা কোন ধরনের খাওয়া? মানুষ এইভাবে খায়? খাওয়া হয়?”

মুখে বলতে পারল না। এরই মাঝে সুমিতা বেগম হৃদকে জিজ্ঞেস করল, “তা বাবা, বিয়ে করবে কবে?”

“জি আন্টি, মেয়ে পেলেই করব।” 

“কেমন মেয়ে পছন্দ বলো তো, খুঁজি আমরা।”

“এই ধরুন, সে শ্যামাঙ্গিনী হবে। এই গাত্র-রঙটা চমৎকার। অন্য কোন পুরুষের নজর সহজে পড়বে না। চুলগুলো কোমর অবধি হলেই হবে। একটু রাগী হবে। মেয়ে মানুষের রাগ আবার ছেলেদের জন্য ভিটামিনের মতো কাজ করে। জেদী হবে প্রচুর। আমার চেয়েও জেদী হতে হবে তাকে। যদি আমি খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো না করি, জেদ ধরে থাকি; সে যেন জোর করতে পারে। আর হবে প্রকৃতিবিলাসী। রোজ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য হলেও, সময় আমার হবে না। সকালে বাসার আশেপাশে হাঁটব, বিকেলে ঢাকায় সড়কে রিকশা নিয়ে ঘুরব, আর রাতে চাঁদ দেখব। তাকে এটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এই হলো আমার পছন্দ।”

সম্পূর্ণ কথা শেষে হৃদ সাঁঝের দিকে তাকাল। সাঁঝ বিমূঢ় হয়ে এক দৃষ্টিতে হৃদের দিকে তাকিয়ে আছে। 

এরই মধ্যে সুমিতা বেগম বলে উঠল, “বাহ্! তুমি তো দেখছি আমার মেয়েকেই পছন্দ করো।”

কথাটা শ্রবন ইন্দ্রিয় অবধি পৌঁছাতেই সাঁঝ পুনরায় বিষম খেল। কেশে উঠল হৃদও। 
.
.
.
চলবে....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন