“আর ইউ ব্লাইন্ড?”
রেগে মেগে সাঁঝকে উদ্দেশ্য করে উপর্যুক্ত প্রশ্নটি ছুঁড়ল হৃদ। হসপিটাল থেকে তার ভার্চুয়াল বউয়ের সাথে চ্যাটিং করতে করতে ফিরছিল। গেট দিয়ে ঢোকার সময় ধাক্কা লাগাতে হৃদের শান্ত মস্তিষ্ক বিগড়ে যায়। তার উপর সাঁঝের ওমন ন্যাকা কান্না শুনতে পেয়ে হৃদ চুপ করে থাকতে পারল না। মেয়ে মানুষের এমন ঢংটাও তাদেরকে হৃদের অপছন্দের লিস্টে রাখার অন্যতম কারণ।
হৃদের কথা শুনে সাঁঝ আওয়াজ অনুসরণ করে সেদিকে তাকাল। হ্যাঁ, সেটা খাম্বা নয়; হৃদ ছিল। লম্বা ও সুঠাম দেহের অধিকারী হৃদ।
হলুদ রঙা পোশাক পরিহিতা এই শ্যামাবতীকে দেখে হৃদ কিছু সময়ের জন্য থমকে যায়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর নিচে পড়ে থাকা ফোনের দিকে তাকায়।
হৃদের ভাবনার মাঝেই সাঁঝ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠল,“এই যে এই মিস্টার! আপনি দেখে চলতে পারেন না? মেয়ে মানুষ দেখলেই গায়ে পড়তে ইচ্ছে করে?”
হৃদ কপাল কুঁচকে বলল,“হোয়াট?”
“বাংলা বোঝেন না? ইংরেজের বংশধর কোথাকার!”
“আপনি গায়ে পড়ে ঝগড়া করছেন কেন?”
“কিহঃ! আপনি আমাকে ঝগড়ুটে মেয়ে বললেন?”
“আমি কখন ঝগড়ুটে বললাম?”
“এই যে অস্বীকার করছেন! পাক্কা ভন্ড!”
“হ্যাঁহ?”
“এরকম উদ্ভট সাউন্ড করছেন কেন? মেয়েরা এসব ভংচং-এ ইমপ্রেস হয় না; এই সাঁঝ তো একদমই না।”
“সাঁঝ! আপনি? আর আমি কখন ইমপ্রেস করতে চাইলাম?”
“কথায় কথায় ইংরেজি ছুঁড়ে মারা, এটিটিউড নিয়ে ঘোরা; এসব তো মেয়েদের ইমপ্রেস করার ধান্দা!”
“আজীব তো আপনি! সেই কখন থেকে উলটা-পালটা বকে যাচ্ছেন। আমি কী করতে পারি সে সম্পর্কে আপনার কোনো আইডিয়া নেই।”
“এই! আমি পুলিশ ডাকব। বুঝি তো! প্রথমে পটানোর চেষ্টা, পরে না পটলে এসিড অ্যাটাক কিংবা কিডন্যাপ। আমার আগে নিজের সেফটি লাগবে। পুলিশ! পুলিশ!”
সাঁঝের চিল্লানো শুনে হৃদ ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বলল,“আমাকে দেখে ঐ টাইপের লাগছে? সিরিয়াসলি?”
“দেখে কী আসে যায়?”—এটুকু বলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলল, “এখন ইচ্ছে করছে কী জানেন? ইচ্ছে করছে...”
সাঁঝ এদিক সেদিক দৃষ্টি মেলল। হৃদ অবুঝ দৃষ্টিতে সাঁঝের পানে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। সাঁঝ হাতের কাছে কিছু না পেয়ে, নিজের রাগ দমন করতে হৃদের হাত থেকে ফোন নিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারল।
হৃদের ধ্যান ভাঙল। দ্রুত বলে উঠল,“এই এই! কী করছেনটা কী?”
কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার, হয়ে গিয়েছে। সাঁঝ তপ্ত করে একটা শ্বাস ফেলে বাঁকা হাসল। হৃদকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ইচ্ছেতো করছিল আপনাকে ছুঁড়ে মারতে! কিন্তু বস্তা তোলার শক্তি আমার নেই। সো, বেঁচে গেলেন!”
তখনই অর্ণব এলো। এখানকার ঘটনা সম্পর্কে অর্ণব পুরোপুরি অজ্ঞাত। দেরি হয়েছে এক কারণেই, তার প্রেয়সী মেসেজ দিচ্ছিল বারবার। এসেই সাঁঝকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কীরে! দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে যেতে বলেছিলাম না? আয়।”
সাঁঝ চলে গেল অর্ণবের সাথে। অর্ণব হৃদকে দেখেনি। সিঁড়ির সামনে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল হৃদ। মুখে রাও নেই। এই কিছুটা মুহূর্তে হৃদ অনেকগুলো ঘটনার সাক্ষাৎ একত্রে পেল। একেকটা ছিল উচ্চ শ্রেণীর ঝটকা। ঝটকাগুলো এমন ভাবে লেগেছে, যে হৃদ বুঝে উঠতে পারছে না। কিছু সময় বাদে নিজেকে খানিকটা ধাতস্ত করে ফুস করে একটা শ্বাস ফেলল।
মেয়ে মানুষ মানেই অদ্ভুত! এখন হৃদের হৃৎপিণ্ড একটা প্রশ্নের উত্তরের জন্য ছটফট করছে। প্রশ্নটা হলো,“দুনিয়াতে ঠিক কয় ক্যাটাগরির মেয়ে মানুষ আছে?”
_________
এই সন্ধ্যে বেলায় নিজের বাড়িতে ভাইয়ের ছেলে-মেয়ের আগমনে মনোয়ারা বেগম আপ্লুত!
ঠিক ক'বছর বাদে এসেছে তার ইয়াত্তা নেই। সাঁঝ অনেকবার এসেছে এখানে। উপমাও প্রায়শই গিয়ে তার মামাবাড়ি বেড়িয়ে আসে। বিগত কয়েক বছর ধরে উপমার এই যাওয়া-আসার পরিমাণটা বেড়েছে অনেকাংশে। আসল কারণটা এখনও কেউ উপলব্ধি করতে পারেনি।
সেই কখন থেকে এই দুই ভাই-বোনকে ডাইনিংয়ে বসিয়ে এটা সেটা খাওয়াচ্ছেন মনোয়ারা বেগম ও তার স্বামী নুরুল ইসলাম। সাঁঝ না করতেও পারছে না, এদিকে খেতেও পারছে না। অর্ণব অসহায় দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকাল। উপমা ঠোঁট চেপে হেসে যাচ্ছে।
মনোয়ারা বেগম বলে উঠল,“অর্ণব! খাচ্ছো না কেন? আরেকটু মাংস দিই?”
এরপর উপমার উদ্দেশ্যে বলল,“এই ওকে মাংস দে তো।”
এদিকে অর্ণবের অবস্থা এমন,ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। সাঁঝের অবস্থাও যে খুব একটা ভালো তা কিন্তু নয়! সে তো একটুও খেতে পারছে না। তার ওপর আজ সে ফোন হারানোর শোকে কাতর। এখানে হারিয়েছে বলতে ফোনের অর্ধমৃত অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। ডিসপ্লে তো সানন্দে চন্দ্রভ্রমণে গিয়েছে।
সাঁঝকে চুপচাপ খাবারের ওপর আঙুল নাড়তে দেখে মনোয়ারা বেগম বলে উঠল, “কী ব্যাপার আম্মু? খাচ্ছো না কেন?”
সাঁঝ চকিতে মনোয়ারা বেগমের পানে তাকাল। গভীর ভাবনায় মগ্ন কিংবা অধিক চিন্তায় চিন্তিত অবস্থায় এভাবে হুট করে কারো ডাক শুনলে, যে কেউ ছিটকে উঠবে। সাঁঝের বেলায়ও তাই হয়েছে।
হুট করে সাঁঝকে এভাবে ভীতগ্রস্থ দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে মনোয়ারা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকাল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সাঁঝ মেকি হেসে বলল,“গা গুলাচ্ছে ফুপ্পি। জার্নি করে এসেছি তো! আর খেতে পারব না।”
মনোয়ারা বেগম অস্থির চিত্তে সাঁঝের গালে-কাঁধে হাত রেখে বলল, “কী বলো! এভাবেই না খেয়ে খেয়ে শরীরের কী অবস্থা করেছ! এখন আবার এই অবস্থা!”এরপর উপমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “সাঁঝকে তোর রুমে নিয়ে যা। আমি কিছু ফল কেটে আনছি।”
সাঁঝ তড়িঘড়ি করে বলল,“এই না না ফুপ্পি! এসবের প্রয়োজন নেই। কিছু খাব না। প্লিজ!”
মনোয়ারা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,“আচ্ছা যাও তুমি। পরে খাবে।”
তখন অর্ণব বলে উঠল,“ফুপি! আমারও কেমন যেন লাগছে। পরে খাব। ওদের সাথে যাই?”
মনোয়ারা বেগম কঠোর গলায় বলল,“একদম না। এতদিন বাদে এলে! খাও চুপচাপ। ওসব বাহানা শুনছি না আমি।”
সাঁঝ উঠে উপমার সাথে চলে গেল। যাওয়ার আগে অর্ণবের অসহায় দৃষ্টি দেখতে ভোলেনি।
_________
রুমে প্রবেশ করতেই উপমা দরজা আটকে ফেলল। সাঁঝ গিয়ে বিছানায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসল। উপমাও এগিয়ে সাঁঝের সামনে বরাবর বসে শুধাল, “অদি আসলো না কেন?”
উপমার প্রায়শই মামাবাড়ি যাওয়ার দরুন সাঁঝের বান্ধবীর সাথেও, মানে অদিতির সাথেও খুব ভালোই সখ্যতা গড়ে ওঠে। একই সাথে ঢাবিতে পড়ার স্বপ্ন তাদের। সেজন্য ঠিক করেছে, কোচিংও একই সাথেই করবে।
সাঁঝ পেছন থেকে বালিশ তুলে কোলের ওপর রেখে বলল,“দুদিন বাদেই আসবে। ওর চাচীর বাসা ফার্মগেট। ওখান থেকেই পড়বে।”
“ওহ্! তাই বল। আমি আরও ভয় পেলাম, ও আসবে কি-না!” —কথাটা শেষ করেই উপমা বলে উঠল,“আচ্ছা আগে এটা বল, বাইরে হৃদ ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করছিলি কেন?”
সাঁঝ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,“হৃদ ভাইয়াটা আবার কে?”
“যার ফোন ভাঙলি!”
“ওহ্! তার মানে ঐ ব্রিটিশটার নাম হৃৎপিণ্ড?”
উপমা সাঁঝের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল, “হৃৎপিণ্ড!”
অতঃপর জোরে সোরে হেসে উঠল। হৃদ থেকে হৃৎপিণ্ড! কিছুক্ষণ বাদে উপমা বলে উঠল,“তুই যাকে হৃৎপিণ্ড সম্বোধন করলি, সে কিন্তু হৃৎপিণ্ডেরই ডাক্তার!”
সাঁঝ চোখ বড়ো বড়ো করে বলে উঠল,“সিরিয়াসলি?”
উপমা কোনোমতে “হ্যাঁ” বলেই উচ্চশব্দে হেসে উঠল। সাথে যোগ হলো সাঁঝ নামক মায়াবতীর হাসি। মুহূর্তেই সাঁঝের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা মলিন হতে দেখা গেল।
উপমা তা দেখে হাসি কমিয়ে প্রশ্ন করল, “কী?”
সাঁঝ ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, “ঐ ব্যাটা হৃৎপিণ্ড আজকে আমার কলিজাখানা টুকরা টুকরা করে ফেলেছে।”
উপমা বুঝতে পারল না। সাঁঝ গিয়ে ব্যাগ থেকে তার আধমরা ফোন বের করল। উপমার সামনে রেখে পুনরায় বিছানায় বসে ন্যাকা কান্না কাঁদতে কাঁদতে বলল,“এই অবস্থা করেছে।”
“সে কী? কীভাবে?”
“ধাক্কা লেগেছিল। তারপর...”—এটা বলে ফোনের দিকে তাকাল। উপমা বুঝল এতক্ষণে, সেই ঝগড়ার কারণটা কী ছিল। এটা বুঝতে পেরে আবারও অট্টহাসিতে মেতে উঠল।
কিছুক্ষণ বাদে সাঁঝ নিজেকে খানিকটা শান্ত করে উপমাকে বলল,“তোর ফোনটা দে তো!”
___________
রাতের খাবার খেয়ে ব্যালকনিতে বসে আছে হৃদ। বেশ কিছুক্ষণ ধরে একটা কথা তাকে ভাবাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে আনমনে হেসে ফেলল। তখন পায়ের কাছে ইভ দৌড়াচ্ছিল।
হৃদ কিছুক্ষণ ইভের দিকে তাকাল। এতে ইভ শান্ত ভঙ্গিতে হৃদের পায়ের কাছে বসল। হৃদ আলগোছে ইভকে কোলে তুলে নিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ইভ যেন হৃদের কোলের সাথে মিশে গেল। খানিকক্ষণ বাদে হৃদ ইভকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ইভ! মানে সন্ধ্যা। সে এক সন্ধ্যা, তুই আরেক সন্ধ্যা। দু'জনে কি প্ল্যান করে জ্বালাচ্ছিস না-কি আমায়?”
.
.
.
চলবে......................................