প্রেমাসুখ - পর্ব ১২ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


হৃদ হাঁটু গেড়ে ছাদে বসে পড়ল। তার নিশ্চল চাহনি ছাদের মেঝেতে। নিজেকে শান্ত করতেই পারছে না। হৃদয়ের ছটফটানি বাড়ছে বৈ কমছে না। অনেকটা সময় এভাবে বৃষ্টিতে ভিজল। বৃষ্টির তেজ ধীরে ধীরে কমে এলো।

হৃদ ওভাবেই বসে থেকে বলে উঠল, “তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখেরও সন্ধানে যাও!—রবি ঠাকুরের গানের এই পঙক্তি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সুখ খুঁজতে গেলাম। অতঃপর প্রেয়সী রূপে জলজ্যান্ত এক অসুখ পেলাম।”

ঠোঁট এলিয়ে হালকা হাসল। এই হাসির মানে, “আমি যা অনুভব করেছি, সেই একই অনুভূতির স্বীকার অপর ব্যাক্তিটিও হয়েছে।“

________________

অনেকটা সময় ধরে শাওয়ারের নিচে বসে আছে সাঁঝ। পুরো শরীর বরফের মতো জমে গিয়েছে। কিন্তু কান দিয়ে এখনও ভাপ বেরোচ্ছে। অশান্ত এই অবুঝ মনটা বড্ড হাঁসফাস করছে। অনেকক্ষণ ধরে ভেবে চলেছে, এতো ছটফটানি কীসের জন্য? কার জন্য? বরাবরের মতো উওরের জায়গায় কোন শব্দ খুঁজে পেল না।  

তবে আজ হৃদের চাহনি তার কাছে অন্যরকম লেগেছে। বড্ড প্রশান্ত! শীতল! অনেক বেশি গভীর। সাঁঝ উঁকি দিয়ে দেখতে গিয়েছিল সে নয়নজোড়ার গভীরতা। কিন্তু ঘটে গেল অনর্থ। সে তো হারিয়েই গেল সেই রহস্যময় চোখ দু'টোতে। করে ফেলল না চাওয়া সত্ত্বেও সেই কাজ। বাঁধিয়ে ফেলল বিপত্তি। হৃদকে উদ্দেশ্য করে ওমন কথা বলে ফেলল।

ফট করে উঠে শাওয়ার অফ করে ফেলল। অস্থির কন্ঠে বলল,“উফ উফ উফ! এমন লাগছে কেন?”

চেঞ্জ করে রুমে চলে এলো। এখন তার একটাই উপায়, নিজেকে শান্ত করার। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোবে।

_______________

বারান্দায় রাখা ডিভানে বসে আছে হৃদ। হাতে তার কফির মগ, ধোঁয়া উড়ছে। একটু পর পর কফির মগে চুমুক দিচ্ছে।
বৃষ্টিতে ভিজার অভ্যেস তার নেই, এইজন্যই তো অল্পতেই সর্দি-কাশি বাঁধিয়ে ফেলে; যেমনটা এখন বাঁধিয়েছে। পায়ের কাছ দিয়ে ইভ দৌড়াচ্ছে। হৃদ উঠে ওর জন্য ক্যাটফুড এনে দিল। এরপর আবারও ডিভানে এসে বসল। আসার সময় তার ল্যাপটপও এনেছিল। নিজের ফেসবুকে ওপেন করে একজনের প্রোফাইলে প্রবেশ করল। এর আগে কখনও সেভাবে এই প্রফাইলে প্রবেশ করেনি। পুরো টাইমলাইন ঘুরতে লাগল। প্রতিটি স্ট্যাটাস মনযোগ সহকারে পড়ল।

খাওয়া শেষ করে ইভ এসে হৃদের কোলে শুয়ে পড়ল। হৃদ আয়েশ করে বসল। তার বাম হাতটা ইভের গায়ের উপর আর ডান হাত ল্যাপটপের কী-বোর্ডে। 

রাত গভীর হলো। টাইমলাইনের বছর দুয়েক আগের পোস্টগুলো দেখছে। তখনকার একটা পোস্টে এসে হৃদ থমকে গেল। ক্যাপশনে লেখা,“বাতাসে আজ প্রেম প্রেম ভাব। না জানি এই ভোরে কার হৃৎপিণ্ড চুরি করে এলাম!”

সেই তারিখের ছবিটা। হৃদ আলতো হাসল। 

শীতল চাহনি স্ক্রিনে স্থির রেখে শান্ত কন্ঠে বলল,“কেউ একজন বলেছিল, ‘তোমরা যার সন্ধানে মরিয়া হয়ে আছো, তা তোমাদের সন্নিকটেই অবস্থান করছে, খোঁজো’। কিন্তু আমি তো না খুঁজতেই পেয়ে গেলাম।”

________________

চরম বিরক্তি নিয়ে বসে আছে অর্ণব। তার পাশেই খোশমেজাজে শান্ত হয়ে বসে আছে অদিতি। ভোরের বাস। কেবল রোদ ছড়াচ্ছে চারিপাশে। স্থির ভঙ্গিতে যে কী করে বসে আছে অদিতি, তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। পাশেই তার তীব্র আকাঙ্ক্ষিত মানুষটি বসে আছে। লাজুক হাসল সে।

গম্ভীর মেজাজ নিয়ে বসে আছে অর্ণব। কোনক্রমেই অদিতির সাথে আসতে চাচ্ছিল না। কিন্তু, আসতে হলো। সাঁঝ জোর করেছে বিধায়ই আসতে হলো। ফুস করে একটা শ্বাস ছেড়ে সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

জানালা দিয়ে আসা সকালের মিষ্টি রোদ অর্ণবের মুখে লাগল।অদিতি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে মনে অনেক অনেক কিছু বলে ফেলেছে।

 কিন্তু এবার সে শব্দ করেই বলে ফেলল,“ইশ! আপনি কী সুন্দর!”

অর্ণব সাথে সাথে চোখ খুলে অদিতির দিকে তাকিয়ে কপাল, কুঁচকে ফেলল। বুঝতে না পারার ভান করে জিজ্ঞেস করল,“হোয়াট?”

অদিতি মেকি হেসে বলল,“নাহ! কিছু না।”

অর্ণব বিরক্তিতে কিছু একটা বিড়বিড় করে আবারও চোখ বন্ধ করল।

ঠোঁট চেপে হেসে মনে মনে বলল,“বাহ অর্ণব সাহেব! আপনার রাগী ফেইসটা একদম ক্রাশ ম্যাটিরিয়াল। আ'ম ক্রাশিত।”

___________________

অতিরিক্ত টেনশনে সাঁঝ আচারের বোয়াম কোলে তুলে খেয়ে যাচ্ছে। টেনশন কমছে না।

উপমা সাঁঝের কার্যকলাপ বেশ খানিকটা সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করে দু'বার ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করল, “কী রে?”

সাঁঝ আচার খাওয়া বন্ধ করে ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,“টেনশন হচ্ছে।”

“সে তো বুঝতেই পারছি, কিন্তু কেন হচ্ছে?”

“অদির জন্য।”

উপমা ভ্রু কুঁচকে বলল,“অদির জন্য!”

“হু।”

“অদি আবার কী করল?”

“ও কিছু করেনি। করেছি আমি।”

“কী করলি?”

“ওকে ভাইয়ার সাথে আসতে বলেছি। এখন ওরা একসাথেই আছে।”

“হ্যা, তো? এতে টেনশনের কী আছে?”

সাঁঝ বিরক্তিতে "চ" টাইপের শব্দ করে বলল,“ছাড়! তুই বুঝবি না।”

উপমা সাঁঝের পাশে এসে বসে বলল,“বুঝব, তুই বল।”

সাঁঝ কান্না কান্না ভাব করে বলল,“অদি, ভাইয়াকে পছন্দ করে।”

উপমা থম মেরে গেল। উপমা, অদিতি ও সাঁঝ ভিষণ ভালো বন্ধু। একে অপরের জন্য এরা নিজের জানও দিতে পারে। এতক্ষণে সে বুঝল অর্ণব কেন তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে সাঁঝকে বলতে না করেছে আর এর কারণটাও তাকে বলেনি। কারণ তো এটাই! উপমা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। দরদর করে ঘামছে। ডান হাত দিয়ে বাম হাত খামচাচ্ছে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় এগুলো তার অভ্যেস।

সাঁঝ নিজেকে আশ্বাস দিল,“আমার ভাই খুবই শান্ত মস্তিষ্কের, অদিতির পাগলামোগুলোতে কিছু করে-টরে বসবে না।”

অনেক কষ্টে উপমা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, যেখানে দু'জন দু'জনকে ভালবাসে সেখানে তৃতীয় ব্যাক্তি কিছুই না।
সে শান্ত হলো। বাম হাতে তাকিয়ে দেখল খানিকটা ছিলেও গিয়েছে। ওড়নার ভাঁজে ছেলা অংশটুকু লুকোল। 

সাঁঝকে উদ্দেশ্য করে বলল, “টেনশন নিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“হুম, তাই যেন হয়।”

উপমা প্রস্থান ঘটাল। সাঁঝের চিন্তা আরও বাড়িয়ে তুলতে তার ফোনে কিছুক্ষণ বাদে একটা ম্যাসেজ এলো। ফোনটা শুধুমাত্র অদিতি আর অর্ণবের আপডেট জানার জন্য জেনারেল মোডে রেখেছিল। আর এই সময় ম্যাসেজটা এলো। হাতে তুলে দেখল সেই পুরনো অপরিচিত নাম্বার, যেটা বিগত তিনদিন ধরে সাঁঝের নাওয়া-খাওয়া হারাম করে রেখেছে। নম্বরটি সেভ করেছিল ‘অসুখ’ নামে। এতো চিন্তায় এখন তার প্রচন্ড কান্না করতে ইচ্ছে করছে। 
মুখে কৃত্তিম কষ্টের ছাপ নিয়ে সে ম্যাসেজটি ওপেন করল।

“শ্যামবর্ণা নারীর মায়ার ফাঁদে যে পুরুষ একবার পড়েছে, সে নির্ঘাত মরেছে। এই মৃত্যুকে প্রাপ্তিতে পরিণত করতে কবুল করে নিলে আমায়। সন্ধ্যাবতী! ধন্য আমি।”

আহা সাঁঝ! এভাবে কেউ অস্থির হয় নাকি? একদম গলা-কাটা মুরগীর মত ছটফট করছে। মেয়ে জাতি বড়োই অদ্ভুত। কখনো কোন বিপদে পড়লে তারা অস্থির হয় না; অস্থির হয় তখন, যখন সেই বিপদের সুত্রপাত তাদের কাছে অজানা থাকে। 
তবে সাঁঝের অস্থিরতা আগের চেয়ে বেশ কিছুটা কমেছে। এটা তার জানা কথা, পরিচয় দেওয়ার ইচ্ছে হলে অনেক আগেই দিয়ে দিত । যেহেতু এখনও দেয়নি, তার মানে হয়ত সে নিজস্ব সঠিক সময়ের অপেক্ষায় আছে; সময় হলেই বলবে।

সাঁঝ কিছুক্ষণ বাদে রিপ্লাই দিল,“আমি কবে কবুল করলাম?”

ওপাশ থেকে জবাব এলো, “কেউ কি ইচ্ছে করে অসুখ বাঁধায়? কেউ কি ইচ্ছে করে কারো মায়ায় জড়ায়? কোনো অসুস্থ ব্যাক্তি কি সুস্থ হওয়ার জন্য বিষ পান করে? করে না তো। এগুলো হয় মনে মনে, গোপনে অভিসারে। যেমনটা তোমার মনের সাথে আমার মনের হয়েছে।”

সাঁঝ কী রিপ্লাই দিবে, বুঝাতেই হিমশীম খাচ্ছে। বেড সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে একেবারে পুরোটা শেষ করল। সময় অনেক বেশি দ্রুত চলছে। অনেকটা সময় পেরোনোর পর সাঁঝ বিছানা থেকে ফোন তুলে রিপ্লাই দিল,“আপনি কি চাচ্ছেন, আমি অস্থির হয়ে ছটফট করতে করতে পটল তুলি?”

রিপ্লাই এলো না আর। 
সাঁঝ ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। মনোয়ারা কেন সাঁঝকে ডাকতে ডাকতে রুমে প্রবেশ করল। সাঁঝ সেদিকে তাকাল। 

মনোয়ারা তাড়া দেখিয়ে বলে উঠল, “খেতে এসো আম্মু; অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে।”

সাঝ জোরপূর্বক হেসে বলল,“ভাইয়া আসুক একসাথে খাব।”

মনোয়ারা বেগম এগিয়ে এসে সাঁঝের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,“কী ভালোবাসা ভাইয়ের প্রতি! আমিও তোমার আব্বুর জন্য এমন করতাম”

আবারও ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল মনোয়ারা বেগম। কিছু একটা মনে পড়তেই পা দুটো থামিয়ে পিছু মুড়ল। সাঁঝ তার দিকে তাকাল।

“উপমা কোথায়?”

সাঁঝ ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,“জানি না ফুপি।”

মনোয়ারা বেগম কিছু না বলে প্রস্থান ঘটাল।

__________________

গেস্ট রুম ঠিক করে গোছাচ্ছিল উপমা। অর্ণবের ডাস্ট এ্যলার্জি আছে। তাই তার আাসার আগেই রুমটা পরিষ্কার করছিল। তিনদিন ধরে এই রুমে কারো প্রবেশ হয়নি। তার উপর জানালা সব খোলা ছিল। ঝড়-বৃষ্টির জন্য রুমটা পুরো ধুলোময় হয়ে আছে।

জানালার পর্দাগুলো খুলছিল। আজও দারুণ বাতাস। হঠাৎ কারো অস্তিত্বর আভাস পেল উপমা। জানালার দুই প্রান্তে নিজের হাত রেখে পিছু মুড়ল। শীতল এক বাতাস এসে উপমার হৃদয়ে তান্ডব শুরু করল। বাহ্যিক ভাবে বাতাসটা উপমার চুলগুলো চোখে মুখের সামনে ছড়িয়ে দিল। অর্ণব নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। উপমা চোখ পিটপিট করছে, চোখের সামনে চুল থাকার জন্য। অর্ণব ফুঁ দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিল। উপমা ঈষৎ কেঁপে উঠল, দু'চোখের পাতা বন্ধ তার।
মনে মনে বলল, “ইশ! এত সুখ কেন!”

অর্ণব নেশাক্ত কণ্ঠে বড়ো ধীর গতিতে বলে উঠল, “জান!”

উপমা থরথর করে কাঁপতে থাকল। অর্ণব-উপমা দু'জনেই কেমন ঘোরের মধ্যে আছে। 

হঠাৎ অর্ণবের এই ঘোর কাটল। এখনও সে সীমালঙ্ঘন করেনি। খানিকটা হেসে দু'কদম পিছিয়ে গেল।

মুখের উপর কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে না আর। উপমা ফট করে দু'চোখ খুলে ফেলল। অর্ণবকে নিজের থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে দেখে উপমা বুকে হাত রেখে শ্বাস ফেলে বলল, “জান বলে ডেকে একেবারে জানই নিয়ে নিয়েছিলে হাওলাদার সাহেব।”

অর্ণব হাসি কমিয়ে বলল, “দুনিয়া ছন্নছাড়া হয়ে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাক, দূর আকাশে নীলিমায় দাফন হোক এই প্রাণ। কলঙ্কের কালির স্পর্শ না লাগুক তার গায়ে, এমনই নিষ্পাপ-শুভ্রের ন্যায় পবিত্র থাকুক আমার জান।”

উপমা হা করে তাকিয়ে রইল। অর্ণব মুচকি হাসে বলল, “মেয়ে এভাবে আর পুড়িও না, এমনিই জ্বলে অঙ্গার হয়ে গিয়েছি!”

খানিকটা থেমে আবারও বলল,“জানোই তো আমি বড়ো অধৈর্য্য!”

জানালার দিকে হাত উদ্দেশ্য করে বলল, “এই যে এই জানালা! এই জানালা দিয়ে দু'জন মিলে পালাব অ্যান্ড আই প্রমিস, তিনজন হয়ে ফিরব।”

শেষোক্ত কথাটা বড্ড ধীরে-ফিসফিসিয়ে বলেছে।

উপমা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “ছিঃ!”

অর্ণব শব্দ করে হেসে ফেলল। বাম হাতের লাগেজটা রুমের এক কোণায় রেখে উপমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “খিদে পেয়েছে ভীষণ তোমার সাথে খাব বলে বাড়ি থেকে কিছু খেয়ে বের হইনি। এখন আসুন।”

উপমা দ্রুত বলে উঠল, “এমা! খেয়ে আসোনি কেন?”

অর্ণব মিহি কণ্ঠে বলল, “কারণ আমার অপেক্ষায় আপনি এখনও অভুক্ত আছেন।”

উপমা লাজুক হাসল। অর্ণব আরও বলল, “শুনেছি আগেকার দিনে বউয়েরা না কি তাদের বরের খাওয়ার অপেক্ষায় থাকত। বর খেত আর বউ পাশে বসে হাত-পাখা দিয়ে বাতাস কর....”

“খেতে চলো।”

“উঁহু, আগে কথাটি শেষ করতে দাও। বর খেত আর বউ পাশে বসে হাত-পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বলত,‘হ্যাঁগো, শুনেছ? আজ এটা-সেটা হয়েছে’। বলি তুমিও কি তাই করতে চাচ্ছ? বিয়ের আগে ওগো-হ্যাঁগো?”

“অর্ণব!”

“এসো,খেতে যাই।”

অর্ণব কেটে পড়ল। উপমা সেখানেই দাঁড়িয়ে হাসতে লাগল। কে বলবে ছেলেটা দু'বছর আগে কতটা গম্ভীর ছিল! আর সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় সেই উপমাই কিছুক্ষণ আগে অর্ণবকে বকা দিল, যেই উপমা ক'বছর আগে অর্ণবকে জমের মতো ভয় পেত। কারণ ছাড়াই ভয় পেত।

_________________

অদিতি আসেনি এখানে। বাসস্ট্যান্ড থেকেই তার চাচা এসে তাকে নিয়ে গিয়েছে।

সকালের নাশতা সেরে অর্ণব মনোয়ারা বেগমের পাশে বসে তার সুখ-দুঃখের কথা শুনছে। উপমা আর সাঁঝ পাশাপাশি বসে গল্প করছে। আজ তো উপমার মনে লাড্ডু ফুটেছে। বসার ঘরেই চারজন বসে আছে। কথা-বার্তার মাঝে উপমা আর অর্ণব আড়চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। যা সাঁঝের নজর এড়াচ্ছে না। খুব গম্ভীর হয়ে এদের দু'জনকে নিয়ে ভাবতে বসবে; ওমনিই সেই নম্বর থেকে এলো। কারো খেয়াল সাঁঝের দিকে নেই। তবুও সাঁঝ রিস্ক নিল না। এই অসুখের মেসেজ পড়লেই সে অসুস্থ হয়ে যাবে। 

বারান্দায় চলে এলো। রোদের ভয়াবহ তেজ! সকালেই প্রকৃতির অবস্থা এখনকার থেকে বিপরীত ছিল। সাঁঝ দোলনায় বসে মেসেজটা ওপেন করল। আজকের মেসেজটিতে একটা ছবি পাঠানো হয়েছে। সাঁঝ দেখল কোনো একটা প্রেসক্রিপশন এটা। সেখানে লাল কালি দিয়ে লেখা, “যদি হতে পারো প্রেয়সীর ছটফটানির মূল কারণ; তবে তোমার প্রেম সার্থক। আহা! আমি সার্থক।”

 সাঁঝ বড়ো একটা শ্বাস টেনে রিপ্লাই লিখল, “আমি আপনার কোন জনমের প্রেয়সী?”

কিন্তু সেন্ড করল না। এর আগের মেসেজে চোখ পড়ল। সেখানে লেখা ছিল, কেউ ইচ্ছে করে এসব করে না; এগুলো তো মনে মনে হয়।

তাই নিজের লেখা মেসেজ কেটে পুনরায় লিখল, “মাঝে মাঝে বিষ! কখনো মায়া! প্রায় সময় অসুখ! কোনটা ছড়াচ্ছি আমি? এদিক থেকে তো আপনি নিজেও ক্লিয়ার নন।”

অনেকটা সময় পরে ওপাশ থেকে আবার মেসেজ এলো,
“তুমি হলে শ্যাম মোহিনী,
নজর কারা এক রূপসী নন্দিনী,
যার সুদীর্ঘ পল্লববিশিষ্ট গভীর কালো অক্ষিদুটি মায়া দিয়ে ঘেরা। 
মুক্ত ঝরায় যে হাসি, নেশায় আমি পড়েছি, জানে কেবল ওষ্ঠেরা। 
বিষ তার নকশা করা সমগ্র অঙ্গের ভাঁজে। 
সে তো প্রেম, বিষরূপে ঘায়েল করতে পুরুষ মন খোঁজে। 
তার স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে কাঁপে আমার বুক, 
মূলত সে সুখ নয়, প্রেমাসুখ।”

সাঁঝের কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে! হাজারও অনুভূতির মাঝে কোনটা ব্যক্ত করবে তা যেন অনুভূতিহীন হৃদয়ের মতোই কাজ করছে। দোলনায় চোখদুটি বন্ধ করে দোল খাচ্ছে। এমন অনুভূতির স্বীকার সে আগে কখনো হয়নি। যে-কোনো সমস্যায় পড়লে সে অর্ণবকে বলত। অর্ণব তার জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত দিত। কিন্তু এবিষয়ে অর্ণবকেও বলা যাবে না। 

হঠাৎ এক দমকা হাওয়া এসে সাঁঝের গায়ে লাগল। এই ভ্যাপসা গরমের জন্য এটা খুবই প্রয়োজন ছিল। 

সাঁঝ রিপ্লাই দিল, মনের আসল কথাটা, “এটা খুবই সেনসিটিভ টপিক; যদি মজা নিয়ে থাকেন তো এখনই থেমে যান। আর যদি আপনি এ বিষয়ে সিরিয়াস হয়ে থাকেন, তবুও থেমে যান। ‘প্রেম’ ও ‘অসুখ’ দুটোতেই ফোবিয়া আছে আমার।”

আর মেসেজ এলো না; সাঁঝও আর অপেক্ষা করল না।

বিকেলের শেষভাগে মেসেজের রিপ্লাই এলো, “তুমি আমার পথ শেষের কোনো গন্তব্য নও, এজীবনের সমস্ত পথ চলতে থাকার এক ও একমাত্র রাস্তা। এটা বড্ড বিচিত্র একটা রাস্তা। একবার চলতে শুরু করলে পেছনের পথ ধীরে ধীরে ধ্বংস হতে থাকে, থেমে গেলে পথের সাথে সাথে নিজেরও ধ্বংস অনিবার্য। 

________________

সন্ধ্যায় কোচিং থেকে ফিরছে সাঁঝ, উপমা ও অদিতি। সময় সপ্তাহ পেরিয়েছে। 
কোচিং সেন্টার থেকে কিছুটা দূরে অদিতির চাচার বাসা, আর অনেকটা দূরে উপমাদের। কিছুটা পথ হেঁটে যাবে, এরপর সাঁঝ ও উপমা সিএনজি কিংবা বাস নেবে।
সন্ধ্যার জনমানবশূন্য রাস্তায় এই তিন কন্যার কথপোকথন খুবই জোরাল শোনা যাচ্ছে। তবে উপমা আগের মতো অত হাসি-মজা করছে না। কেমন যেন মনমরা! তবে তা কেবল অদিতির সাথেই। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে তেমন কথা বলেনি। 
ব্যাপারটা রাগ কিংবা হিংসার না, অদিতির হাসির পেছনে লুকোনো কষ্টটা সে দেখতে পারে, অনুভব করতে পারে। এসবের জন্য সে নিজেকেই দায়ী মনে করে আর গোপনে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। 

খোশমেজাজে গল্প করতে থাকা অদিতি হঠাৎ উপমার কার্যকলাপ লক্ষ করল। অন্যমনস্ক হওয়া উপমাকে প্রশ্ন করল,“কী রে? কী হয়েছে?”

উপমা হকচকিয়ে গেল। অদ্ভুত ভাবে সাঁঝ ও অদিতির দিকে তাকাল। জোরপূর্বক হেসে বলল,“কী? ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তোরা?”

অদিতি সজোরে হেসে উঠল। উপমা মুগ্ধ চোখে সেই হাসির দিকে চেয়ে রইল, সাথে বক্ষস্থলে অনুভব করল এক নিদারুণ নিষ্ঠুরতার যন্ত্রনা। সে বুঝতে পারল, ‘যদি এই মেয়েটা জানতে পারে, তার অধর কোণ থেকে মহামূল্যবান হাসিটা কেড়ে নিয়ে নয়ন-জোড়ায় দুঃখ-সাগর তৈরি আর কেউ না, তারই প্রিয় বান্ধবী করেছে; সে বাঁচবে তো?’

সাঁঝ হুট করেই বলে উঠল,“অদি, শুভ ভাইয়ার কী খবর?”

অদিতির মুখের হাসি নিভে গেল। সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল,“সে-খবর কি আমার রাখার কথা?”

“অবশ্যই। কারণ তোকে তো সে ইয়ে ইয়ে করে।”

অদিতি মন খারাপের ভান করে বলল,“তোর ভাই কি আমার খবর রেখেছে? না মানে, আমিও তো ওনাকে ইয়ে ইয়ে করি।”

উপমা এই প্রসঙ্গে আর কথা বলতে পারছে না, কথা শুনতেও চাচ্ছে না।
তাই বলল,“ওসব খবর-টবর ছাড়। এটা বল, তোর অসুখের কী খবর? এতগুলো দিন পেরোল। কিছু বলেছে?”

সাঁঝ বিরক্তি নিয়ে বলল,“তোকে না বলাই ভালো ছিল, কোন দুঃখে যে এই কাহিনি বলতে গেলাম!”

অদিতিকেও সেদিন সবটা বলেছে। অদিতি উপমার মতো করে জিজ্ঞেস করল,“বলেছে?”

সাঁঝের রাগ হুড়হুড় করে বেড়ে চলেছে। পাশে তাকিয়ে দেখল, অদিতির বাসার গলি এসে গিয়েছে। হাফ ছেড়ে শয়তানি হাসি হেসে বলল,“বিদেয় হ। যা যা।”

অদিতি কিছু না বলে চলে গেল। সাঁঝ এবার উপমার দিকে তাকিয়ে বলল,“অসুখ সংক্রান্ত একটা কথা বলবি তো!”

উপমা জিজ্ঞেস করল,“কী করবি?”

সাঁঝ কপাল কুঁচকে ভাবতে লাগল। কিন্তু করবেটা কী? 

অনেক্ষণ সময় নিয়ে বলল,”হ্যাঁ! তুই যে ভাইয়াকে ভাই মানিস না, এটা বলে দেব ফুপ্পিকে।”

উপমা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,“মা//র খাবি, সাঁঝ।”

উপমাকে এভাবে রিয়্যাক্ট করতে দেখে সাঁঝ ভ্রু-দ্বয় কিঞ্চিৎ উঁচু করে বলল,“কিছু আছে না কি?”

“না না, কী থাকবে?”
উপমা তৎক্ষনাৎ এটা বলল। সাঁঝও বলল,“হ্যাঁ, না থাকারই কথা। আমার যে ভাই! কপালে ভাবি জোটে কি না সন্দেহ।”

উপমা সাঁঝের কথার পরিপ্রেক্ষিতে মিহি হাসল।

_______________

বাসায় পৌঁছেই সাঁঝ ফ্রেশ হয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল, সাথে তার অতি প্রয়োজনীয় ফোন নিয়ে নিল।

তিনতলায় উঠতেই হৃদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা দেখল। কৌতূহল বশত দাঁড়িয়ে পড়ল, সেদিকেই তাকাল। মাত্র শাওয়ার নিয়ে আসা হৃদকে দেখে সাঁঝ লজ্জিত হয়ে পড়ল। একে তো এভাবেই অন্যের ফ্ল্যাটে উঁকি দিতে গিয়ে ধরা খেয়েছে, তার উপর আবার হৃদকে এমতাবস্থায় দেখেছে।

এভাবে সাঁঝকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,“কী চাই?”

সাঁঝ মেকি হাসি দিয়ে বলল,“আসলে একই বাসায় থাকি আমরা, একে অন্যের দরকার নেওয়া খোঁজ।”

হৃদ সাঁঝের কথা শুনে ঠোঁট চেপে হাসল। সাঁঝ যখনই বুঝতে পারল, সে কী বলেছে; সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বাতে কামড় দিয়ে বলল,“মিসটেক। খোঁজ নেওয়া দরকার। আসলে সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম তো! এজন্য এলোমেলো হয়ে গেছে।”

হৃদ হাসি থামিয়ে বলল,“বুঝলাম। তা কাকে চাই?”

সাঁঝ অকপটে জবাব দিল,“আপনাকে।”

হৃদ বা পাশের ভ্রু উঁচু করে বাঁকা হেসে বলল,“আচ্ছা। দিয়ে দিলাম আমার আমিটাকে। সযত্নে নিয়ে নিন।”

সাঁঝের অস্থির হয়ে ধুকপুক করতে থাকা হৃৎপিণ্ডটা হৃদের কথায় থেমে গেল।
.
.
.
চলবে..................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন