প্রেমাসুখ - পর্ব ০৪ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


সারারাত বৃষ্টি ছিল। হয়ত এজন্যই সকালটা এত সজীব দেখাচ্ছে। আড়ামোড়া দিয়ে উঠল সাঁঝ। বিছানায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, এখন বাজে সাতটা। এত সকালে সাধারণত তার ঘুম ভাঙে না। আজ ভাঙল। কাল বেশ কিছুটা সময় হৃদের সাথে কথা হয়েছে। 

সাঁঝ উঠে দাঁড়াল। পরনের প্লাজু আর টি-শার্টের উপরে একটা ওড়না পেঁচিয়ে নিল। চুলগুলো একটা ক্লিপ দিয়ে উঁচুতে বেঁধে সেলফোনটা হাতে নিয়ে নিল। এখন উদ্দেশ্য তার হাঁটতে বের হওয়া। 

রুম থেকে বেরোতেই ড্রইং রুমের সোফাতে আরিফ সাহেবকে দেখতে পেল। দৃষ্টি তার হাতের খবরের কাগজে নিবদ্ধ। পাতা উলটাতেই সাঁঝকে সামনে দেখল।
ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর নিজের চোখের চশমাটা খুলে, পুনরায় পরল। এবারও সাঁঝকে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরিফ সাহেব সুমিতা বেগমকে ডাকলেন,“কই গো সুমি! দেখে যাও! তোমার মেয়ের বোধ হয় শরীর খারাপ করছে।”

সুমিতা বেগম রান্না ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসেই সাঁঝের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সাঁঝের কপালে নিজের হাত নিয়ে এপিঠ ওপিঠ করে বলল, “কী ব্যাপার? অসুখ করছে তোর? ঠিক আছিস? এত সকালে এখানে কেন? কিছু লাগলে আমাকে ডাকতি!”

অতঃপর সাঁঝ এখানকার কাহিনি বুঝতে পেরেই কপালের চামড়া কুঁচকে ফেলল। বিরক্তি নিয়ে বলল,“একদিন সকালে উঠতে পারি না?”

“একদিনও না।”—কথাটি সাঁঝের মা ও বাবা উভয়েই একসাথে বলল। তারপর হেসে দিল। 

আজ অফ ডে। অর্ণব নিজের রুমে ঘুমাচ্ছে। ভীষণ দায়িত্বশীল আর সিরিয়াস স্বভাবের সে। এদিকে সাঁঝ একদম উল্টো। দুজনের মিল একজায়গাতেই। এই দুই ভাই বোন একসাথে থাকলে যেন এরা বাচ্চা হয়ে যায়। ছুটির দিনে অর্ণবের ঘুম ভাঙে বেলা পেরোবার পর।
আর সাঁঝ! একমাত্র বৃষ্টির দিন ছাড়া কেউ তাকে সকালে ওঠাতে পারেনি। ব্যাপারটা অদ্ভুত, তাই না? হ্যাঁ। সাঁঝ মেয়েটাই যে অদ্ভুত। সব বৃষ্টিবিলাসীদের জন্য এই নিয়ম করে রাখা; বৃষ্টি নামলে তাদের জন্য বৃষ্টি বিলাস ছাড়া সব কাজ নিষিদ্ধ। 
তবে আজ সকালে বৃষ্টিও নেই। হয়েছিল রাতে। সাঁঝ দ্রুত পায়ে বেরোলো বাড়ির বাইরে। ওদিকে সুমিতা বেগমও রান্নার কাজে লেগে গেল। আরিফ সাহেব পুনরায় খবরের কাগজে মুখ গুঁজলেন।

____________

টাঙ্গাইল শহরের একটা ছোট্ট এলাকায় সাঁঝ থাকে। শহর থেকে খানিকটা দূরে। একেবারে গ্রামাঞ্চলও বলা যায়না; কেননা শহুরে পরিবেশ এখানে বিদ্যমান। বাবা ও ভাইয়ের কর্মসংস্থান টাঙ্গাইল শহরে। তবুও তারা এখানটাতেই থাকেন। 
বাড়ির সামনের রাস্তাটা কাঁচা! কর্দমাক্ত! সারারাতের বৃষ্টির ফল এটা। সাঁঝ গুনগুনিয়ে হেঁটে চলছে। আশেপাশে তেমন মানুষ নেই। তখন সাঁঝের কী যেন মনে হলো, নিজের ফোনটা তুলে অদিতিকে কল দিল।

দু'বার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ করে অদিতি বলল, “কী হয়েছে সাঁঝ? এত সকালে কল দিলি কেন?”

“কিছু না। বাড়ি আছিস?”

“হ্যাঁ।”

“বের হ। আমি তোর বাড়ির সামনেই আছি।”—কথাটা বলেই কল কেটে দিল। হাঁটতে হাঁটতে অদিতিদের বাড়ির সামনেই চলে এসেছে সাঁঝ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর-ই অদিতি চলে এলো।

সকাল সকাল সাঁঝকে দেখে অদিতি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কী রে! কী হয়েছে?”

সাঁঝ অদিতিকে আসতে দেখেই সামনের রাস্তার দিকে ফিরল। এরপর এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “কী হবে? কিছুই না।”

অদিতিও সাঁঝের সাথে এগোল। দু'জনে হাঁটা ধরল। কিছুটা এগোতেই সাঁঝ অদিতিকে ডাকল, “অদি!”

অদিতি জবাবে ছোট্ট করে “হুম” বলল। 

দুজনেই সকালের মিষ্টি আবহাওয়া উপভোগ করছে। সাঁঝ বলে উঠল,“জানিস অদি! কিছুদিন ধরে একটা ছেলের সাথে কথা হচ্ছে।”

অদিতি খানিকটা চমকাল। সাঁঝের প্রথম ব্রেক-আপের পর থেকে তো ছেলেদের থেকে শত হাত দূরে থাকত। তবে?
সাঁঝ ঘাড় এলিয়ে অদিতির প্রশ্নবিদ্ধ বিস্মিত চাহনি দেখে হালকা হেসে পুরো ঘটনা বলল। 

পুরোটা শুনে অদিতি বলল,“দ্যাখ! হয়ত এই বেচারার আইডি দিয়ে অন্য কেউ মেসেজ দিচ্ছে!”

“কিন্তু কেন দেবে?”

“সে আমি কী জানি? এই! তোর কোনো আশিক নয় তো?”

“ধুর! কী বলিস? ওগুলো হবে কেন?”

“যেই হোক! কনভারসেশনটা ইন্টারেস্টিং ছিল। ভার্চুয়াল সংসার! আহা!”—কথাটা শেষ করেই অদিতি হেসে উঠল। 

সাঁঝ অদিতিকে হাসতে দেখে, ওর বাহুতে চাপড় মেরে বলল,“মজা নেওয়া হচ্ছে?”

“না না, একদম না। তোর সাথে মজা নেব? আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে রে?”

“হ্যাঁ, বুঝেছিস তবে। বেশি কথা বলবি না।”

তারপর নীরবে আবারও প্রকৃতি বিলাস করতে করতে কাটল কিছুটা সময়। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে এসে গিয়েছে এরা। গ্রামের ভেতরের দিকে। এদিকটা সম্পূর্ণ গ্রাম। সরু রাস্তা ও রাস্তার দু'পাশে গাছ লাগানো। মিষ্টি ও শীতল হাওয়া শরীরকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। কিছুটা দুরে যাওয়ার পর অদিতি থেমে গেল। অদিতিকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে সাঁঝও থামল এবং পিছু মুড়ল।অদিতিকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাঁঝ জিজ্ঞেস করল, “কী? পা ব্যাথা করছে?”

অদিতি মাথা নিচু করেই দু'পাশে নাড়ল। সাঁঝ পিছিয়ে অদিতির নিকট দাঁড়াল। কিছুক্ষণ বাদে অদিতি মাথা উঁচু করে হেসে দিল। 

এটা দেখে সাঁঝ অদিতিকে মারতে মারতে বলল,“ভয় পাইয়ে দিলি হারামী! এভাবে কেউ মজা নেয়?”

অদিতি হাসতে হাসতেই বলল,“তোকে ভয় পাওয়াতে দারুন লাগে ভাই! তুই তো সহজে ভয় পাস না! আহা!”

অদিতি উচ্চশব্দে হাসছে। তা দেখে সাঁঝ রাগ করে বাড়ির রাস্তায় হাঁটা ধরল। এদিকে অদিতির চোখ চিকচিক করছে, তা সাঁঝের চোখে পড়ল না। অদিতি আলগোছে অশ্রুকণা মুছে সাঁঝের পিছু পিছু গেল। 

পেছন থেকে অদিতি জোড়ে জোড়ে বলল,“দ্যাখ! যেই বয়সে একটা বর নিয়ে এভাবে সকাল সকাল হাঁটতে বেরোনোর কথা! সেই বয়সে বান্ধবী নিয়ে ঘুরছি। ব্যাপারটা কিন্তু খুবই ইমোশনাল।”

সাঁঝ অদিতির দিকে একটা কড়া চাহনি নিক্ষেপ করে পুনরায় সামনে তাকাল। অদিতি আবারও হেসে বলল, “কী কপাল আমার! কেউ বুঝল না। আজ যদি একটা বান্ধবী থাকত, যেভাবেই হোক জামাই এনে দিত!”

সাঁঝ থেমে গেল। কিছুটা পেছনে অদিতিকে দাঁড়িয়ে থেকে ঢং করতে দেখল। পা চালিয়ে অদিতির একদম কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,“দিতাম তো জামাই এনে! কিন্তু তোর তো আমার খবিশ ভাইটা ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কোনো ছেলেকেই ভাল্লাগে না!”

অদিতি একটু সিরিয়াস মুডে এলো। মুচকি হেসে বলল, “যাকে মনে ধরে যায়, তাকে ছাড়া এই দুনিয়ার আর কিছুই ভালো লাগে না রে! এটাই নিয়ম। কীসের নিয়ম জানিস?”

“কীসের?”

অদিতি ফিসফিসিয়ে বলল, “প্রেমাসুখ-এর।”

______________

হৃদ আজ ভীষন ব্যস্ত। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বেজে গিয়েছে। বাসার ভেতরে প্রবেশ করতেই বাড়ির মালকিনের সাথে দেখা হয়ে গেল। হৃদ সালাম দিল। 

মনোয়ারা বেগম সালামের জবাব দিয়ে বলল,“কেমন আছো বাবা?”

“ভালো আন্টি। আপনার শরীর কেমন আছে?”

“আগের চেয়ে ভালোই আছে। শুধু পায়ের জ্বালাপোড়া বেড়ে যায় মাঝে মাঝে।”

“মেডিসিন গুলো ঠিকঠাক নিচ্ছেন তো?”

“হ্যাঁ রে বাবা! আচ্ছা এটা বলো, তোমার বাবা-মা আসবেন কবে?”

“এইতো আন্টি, সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে-ই আসবেন।”

“তা বিয়ে-শাদী করবা না? বয়স তো কম হয় নাই।”

মনোয়ারা বেগমের এহেন প্রশ্নে হৃদ ইতস্তত বোধ করল। এসব প্রশ্ন কেউ সরাসরি করে! ভদ্রতার খাতিরে এখন এড়িয়েও যেতে পারবে না। তাই হৃদ বলল,“ভালো মেয়ে পেলেই করব।”

মনোয়ারা বেগম কিছু একটা ভেবে বলল,“ওহ্! আচ্ছা খেয়েছ রাতে?”

“না আন্টি। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাব।”

তখনই সেখানে মনোয়ারা বেগমের মেয়ে উপমা এসে তার মা-কে উদ্দেশ্য করে বলল,“এখানে এখনও দাঁড়িয়ে আছো কেন আম্মু? আমি আরও খুঁজছিলাম তোমাকে।”

মনোয়ারা বেগম বলল,“আরে! হৃদের সাথে দেখা হয়ে গেল। কথা বলছিলাম।”

উপমা কেবলই সেখানে হৃদকে দেখতে পেয়ে বলল,“আরে হৃদ ভাইয়া! কেমন আছো?”

“ভালো, তুমি?”

“ভীষণ ভালো ভাইয়া।”

“এক্সাম কেমন দিলে সব?”

“খুউব ভালো।”

“এখন এডমিশনের জন্য প্রিপারেশন নিতে হবে তো!”

“হ্যাঁ, ভাইয়া। কোচিং শুরু হবে সামনের মাস থেকেই। আমার মামাতো বোনও আসবে। একসাথে কোচিং শুরু করব।”

“আচ্ছা, ভালোভাবে প্রিপারেশন নিও।”

উপমা মুচকি হেসে “আচ্ছা” বলতেই মনোয়ারা বেগম হৃদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,“অনেক রাত হয়েছে; আমার বাসায় চলো, খাবে।”

“বুয়া রান্না করে গেছে আন্টি।”

“আচ্ছা, যেয়ে খেয়ে নিয়ো।”

“আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন। আল্লাহ্ হাফেজ!” কথাটি বলেই হৃদ সিঁড়ি দিয়ে ওঠতে লাগল। তিনতলা বাসা। নিচের পুরোটা জুড়ে মনোয়ারা বেগম পরিবার সহ থাকেন। আর বাকি সব ফ্লোর ভাড়া দেওয়া। লিফট নেই। হৃদ তিনতলায় একটা ফ্ল্যাটে একাই থাকে। 

বাসায় ঢুকেই হৃদ চোখের সামনে যা দেখল, তাতে তার কপাল কুঁচকে গেল। বুঝতে পারছে না এটা এখানে কী করে এলো!
.
.
.
চলবে.......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন